প্রেমপিপাসা পর্ব ৮
সুমাইয়া সুলতানা
হালকা শীতের সময় আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে। সকালের দিকে হালকা কুয়াশা চারপাশকে মোহময় করে তোলে, আর ঠান্ডা হাওয়া যেন শরীরকে সতেজ করে। রোদ ওঠার সাথে সাথে কুয়াশা কমে যায় এবং হালকা উষ্ণতার অনুভূতি তৈরি হয়। বিকেলের দিকে হিমেল হাওয়ার সাথে রোদ মাখা পরিবেশ মনকে প্রশান্ত করে।
রুমের জানালার দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে আছেন জামশেদ। চোখের চশমা আঙুল দিয়ে ঠেলে, হাতে থাকা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছেন। কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুবই মনোযোগ সহকারে কাগজ গুলো দেখছেন। ধোঁয়া উঠা গরম কাপ চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই ঘাড় বাঁকালেন। তিশা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার চায়ের কাপ। তিশা, অরুর ছোট চাচ্চুর বড়ো মেয়ে, আর ছোট মেয়ের নাম তুবা।
তিশাকে দেখে জামশেদ সন্তোষ হাসলেন। কাগজপত্র গুছিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলেন। কাপে এক চুমুক দিয়ে তৃপ্তি হেসে বললেন,
” বরাবরের মতোন ভালো বানিয়েছ। তুবা কি এখনো গাল ফুলিয়ে আছে? ”
তিশা ম্লান হেসে বলে,
” বসে নেই। শুয়ে আছে কম্বল দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে। বলেছে আজ স্কুলে যাবে না। কাউকে ডাকতে নিষেধ করেছে। ”
” এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না৷ ”
তিশা হতাশ কন্ঠে বলল,
” যেখানে অরু’কে ছাড়া আমাদের কারো ভালো লাগছে না। সেখানে তুবা তো ছোট।
তিশা আর অরু সমবয়সী। দুজন এক সাথে কত খুনসুটি করতো। তিন বোন মিলে দুষ্টুমি করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। বড়ো চাচার মেয়ে ওদের সাথে তেমন মিশতো না। মায়ের মতো অহংকারী। দু-একজন বাদে শেখ বাড়িতে অরু’কে সবাই ভালোবাসে। মেয়েটা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পর থেকে একটিবারও যোগাযোগ করেনি। শেখ বাড়ি থেকে কেউ ফোন করলে ফোন রিসিভ করতো না। বাড়ির লোকদের উপর চাপা অভিমান পোষণ করে আছে মেয়েটা, সবাই বুঝতে পারে। আজকে তুবা বায়না ধরেছে অরুর সাথে দেখা করতে যাবে। এভাবে হুট করে কারো বাড়িতে তো আর যাওয়া যায় না। সেজন্য ভেবেছে ফোন করে অরুর সাথে ছোট তুবার কথা বলিয়ে দিবে। কিন্তু সেটা হলো কোথায়? অরু তো ফোন তুলছে না। তাই ছোট তুবা রাগ করে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না।
চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে জামশেদ গভীর ভাবে বলে উঠলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” জানিস তিশা? অরু ঠিক তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। অরুর মা সবসময় নিজের মর্জিতে চলতে পছন্দ করতো। নিজের কথা কাজকর্ম কে সঠিক বলে ভাবতো। যতক্ষণ না বড়সড় একটা ধাক্কা খেতো, ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভূতি ফিরত না। আমি বোঝালেও কাজ হতো না। আমার মেয়েটা তার মায়ের মতো হয়েছে। জীবনে ধাক্কা না খেলে শোধরাবার মেয়ে সে নয়। তবে অরুর উড়ুচন্ডি দস্যিপনা অবুঝ বাচ্চামোকে প্রশ্রয় দিয়ে বাবা হিসেবে মেয়ের ক্ষতি করতে চাইনি বলেই, অরুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা দিয়েছি। হয়তে এখন আমার উপর রেগে আছে, কিন্তু ভবিষ্যতে অরু বুঝতে পারবে, বাবা-মা যা করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য করে। ”
” তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে চাচা। তুমি অরুর খারাপ কখনোই চাইবে না। শুধু ছেলে পূর্বে বিবাহিত, তারউপর এক বাচ্চার বাবা। তার সাথে অরুর বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না। জানি না অরু কিভাবে মানতে পারছে? এমনটা না করলে হতো না? দেশে কি ছেলের অভাব আছে? আমাদের অরুর জন্য কি ভালো ছেলের অভাব হতো? ”
জামশেদ প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে, চুপচাপ চা শেষ করলেন।
রাহাত বাজারের পথ ধরে হাঁটছে। একটা পার্সেল এসেছে জামশেদের নামে। সেটা নিয়ে আসার জন্য যাচ্ছে। জামশেদ নিজেই যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাহাত বলেছে সে এখন বাজারে যাচ্ছে। কোথায়, কার দোকানে পার্সেল এসেছে ঠিকানা বললে সে নিয়ে আসবে। জামশেদ ঠিকানা বলে দিয়েছেন। সেই পার্সেল আনার উদ্দেশ্যে এখন হাঁটছে সে।
কিছুদূর যেতে রাহাত দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে ফিরল। না, কেউ নেই। রাহাত আবার হাঁটা শুরু করল। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। রাহাত সাবধান হয়ে গেল। হেঁটে বাজারের পথ পরিবর্তন করে অন্য পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। মনে হচ্ছে কেউ তার অতি নিকটে পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটছে।
রাহাত উপলব্ধি করতে পারছে, কেউ তার ঘাড়ের দিকে হাত নিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে হাঁটার মাঝে এক সময় হঠাৎ করে পেছন ফিরে তাকায়। কে আছে না দেখেই অনুমানকৃত বাড়ন্ত হাত ধরে খোলা রাস্তার দেয়ালের সঙ্গে আগুন্তকঃকে শক্ত করে চেপে ধরল। আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে ঘুষি দিতে উদ্যত হলো। কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে আগুন্তকঃকের মুখশ্রী নজরে পড়তেই সহসা স্বীয় চোখমুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল।
একটা মেয়ে চোখমুখ খিঁচে নিঃশ্বাস আটকে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাহাত কপাল কুঁচকে ফেলল। কে এই মেয়ে? কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না।
রাহাত মেয়েটিকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেই গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কে তুমি? আমাকে ফলো করছিলে কেন? ”
মেয়েটি প্রথমে এক চোখ খুলল। রাহাতের সন্দেহী চক্ষু জোড়ায় নজর রেখে অপর চোখ টাও খুলল। ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে জানায়,
” আমি মিষ্টি। অরুর বান্ধবী। মাঝে মাঝে আপনাদের বাড়িতে মিষ্টির সাথে যেতাম। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? ”
মেয়েটার কথায় চটপট ভাব। বোঝাই যাচ্ছে খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। রাহাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎপরিমাণ। অরুর সাথে প্রায় তার এক বান্ধবী আসতো। তবে মেয়েটাকে সামনাসামনি ভালো করে দেখেনি। সেজন্য হয়তো চেহারা মনে নেই।
” অরুর বান্ধবী ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমাকে ফলো কেন করছো? মাসখানেক ধরে কেউ আমাকে ফলো করছিল। সেই মানুষটা তুমি নাকি? ”
মিষ্টি উৎফুল্ল চিত্তে সরল গলায় জবাব দিল,
” জি, আমি ছিলাম। আপনাকে আমার ভালো লাগে তাই ফলো করি। ইভেন ইন ফিউচারেও করবো। ”
রাহাত হতভম্ব হয়ে গেল। মিষ্টি’কে ছেড়ে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। ভ্রু উঁচিয়ে গমগমে গলায় বলে,
” কাউকে ফলো করা মারাত্মক অপরাধ। সেটা আমি হলে আরও ভয়ংকর! শোনো মেয়ে, বেশি বাড়াবাড়ি করবে না! আর কোনো দিন আমায় ফলো করতে যেন না দেখি। ”
মিষ্টি শুনল না৷ একটু এগিয়ে রাহাতের মুখোমুখি হয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
” অন্য কাউকে ফলো করতে যাবো কোন দুঃখে? আমি তো শুধু আপনাকে ফলো করবো। আপনি যেখানে যাবেন, সেখানেই আপনার পিছু নিবো। ”
” প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য গোপনীয় জায়গায় গেলে কি সেখানেও যাবে? ”
রাহাত ইচ্ছে করে মিষ্টি’কে লজ্জা দিতে এরকম একটা কথা বলল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। মিষ্টির মুখবিবর স্বাভাবিক। তার মুখশ্রীতে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। উল্টো তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কথাটা বলায় সে খুশি হয়েছে। রাহাত আশ্চর্য হয়ে বোকা বনে গেল।
রাহাত’কে অবাকের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে দিতে মিষ্টি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
” অবশ্যই যাবো৷ এটার থেকেও কোনো গোপনীয় স্থান থাকলে আমি যেতে রাজি আছি। শুধু আপনি সাথে থাকলেই হবে। ”
রাহাতের ইচ্ছে করছে মিষ্টি’কে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে! এই উড়ুচন্ডি বাঁচাল মেয়েটা কি জানে, সে কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে? কাকে কি বলছে? পরিচয় জানলে তৎক্ষনাৎ লেজ গুটিয়ে পালাবে। কড়া গলায় শাসিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
” তুমি তো দেখছি ভারী অসভ্য মেয়ে! বেয়াদবি আমি একদম বরদাস্ত করি না। আমার আশেপাশে তোমাকে যেন আর না দেখি। ”
মিষ্টির কোনো ভাবান্তর ঘটল না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
” ভবিষ্যতে আমাকে তো আপনার সহ্য করতেই হবে। সেজন্য এখন থেকে আস্তে ধীরে অভ্যাস করে নেওয়া ভালো। আর এভাবে আপনার আশেপাশে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি তো সোজা আপনার বেডরুমে থাকতে চাই।”
নিজ বক্তব্য শেষ করে মিষ্টি ভোঁ দৌড় দিয়ে রাহাতের সামনে থেকে চলে গেল। একেবারে রাহাতের দৃষ্টির সীমানার বাইরে গিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে।
এদিকে রাহাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, ভ্যাবলা কান্তের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পলক পড়ছে না। মস্তিষ্ক জুড়ে বারংবার বারি খাচ্ছে কথাগুলো। মিষ্টির কথা শুনে মাথা ঘোরাতে শুরু করেছে। এক্ষুনি কি সব বলে গেল মেয়েটা?
অরু রান্নাঘরে সায়রার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ডাকে নি। নিজে থেকে এসেছে৷ কতক্ষণ আর একা একা বদ্ধ কক্ষে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালো লাগে? অরু’কে দেখে সায়রা অধর প্রসারিত করে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলেন৷ অরুর অধরে হাসি নেই। চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছে।
সায়রা নরম কন্ঠে শুধালেন,
” তোমার কি মন খারাপ অরু? ”
অরু ম্লান চোখে তাকায়। নিস্প্রভ গলায় বলে,
” মন খারাপ তো ইদানীং সবসময় থাকে। এ আর নতুন কি? ”
সায়রা কিছু বললেন না। অরুর ইঙ্গিত তিনি বুঝতে পেরেছেন। রুবিনা’কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
” আটা রাখো। আগে আমাকে ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম এনে দেও। ”
রুবিনা আটা মাখাচ্ছিলেন। রুটি বানাবেন। তিনি উঠতে চাইলে অরু বাঁধা প্রদান করে। ধীম স্বরে বলে ওঠে,
” আপনাকে যেতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি। ”
রুবিনা মাথা নাড়ালেন। সায়রা খুশি হলেন। আস্তে আস্তে মেয়েটার জড়তা সংকোচ কমে যাচ্ছে। অরু ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে এনে দিল। পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ রান্না করা দেখতে থাকল।
ডাবল চকলেট বিস্কুটের মধ্যকার ক্রিম চাটতে চাটতে টুটুল রান্নাঘরে উঁকি দিল। এদিক ওদিক গোল গোল চোখে চেয়ে অরুর কাছে গেল। এক হাতে অরু পা জড়িয়ে ধরে। অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। টুটুল’কে দেখে এতক্ষণে গোমড়া মুখে একফালি রোদের ন্যায় হাসির ঝলক দেখা যায়। ছোট হাতটা মুঠো পুড়ে কোমর বাঁকিয়ে কিছুটা নিচু হয়। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কি ব্যাপার? ক্রিম দিয়ে তো পুরো মুখ মাখামাখি অবস্থা করে ফেলেছো। এভাবে কেউ বিস্কুট খায়?”
টুটুল ক্রিম লাগা দন্তপাটি বের করে চমৎকার হাসল। অরুর গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে বলল,
” সুন্দর আম্মু। আব্বু তোমাকে ডাকছে৷ ”
গুটিগুটি কদমে রুমে এসে হাজির হয় অরু। মুহুর্তে নাসারন্ধ্রে কড়া পারফিউম এর মিষ্টি ঘ্রাণ প্রবেশ করে। অরু চোখ বুঁজে টেনে নিলো সেই ঘ্রাণ। ঘ্রাণে কেমন সতেজতা মিশে আছে।
হ্যাভেন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মিস্টার পারফেক্ট বাবু হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে চুল সেট করছে৷ দর্পণে অরুর মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করে বাঁকা হাসল। গম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,
” কথা আছে। কাছে আসো। ”
অরু চমকে ওঠে। হকচকানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হ্যাভেন তাড়া দিল,
” কি বলেছি? শুনতে পাওনি? ”
অরু মুখ বাংলার প্যাঁচ বানিয়ে এগিয়ে আসে। হ্যাভেন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।
” বলুন৷ ”
হ্যাভেন ফোন এগিয়ে দেয়। আদেশের স্বরে বলে,
” তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। ফোন ধরোনি কেন? তুমি ফোন না ধরায় চিন্তিত হয়ে আমাকে কল করেছেন৷ অন্যদের সঙ্গে কথা না বলো। অ্যাট-লিস্ট তোমার বাবার সাথে কথা বলা উচিত। বয়স্ক মানুষ। তোমার আচরণে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন।”
অরু তেজি গলায় জানায়,
” বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি মেয়েদের সব। বাবার বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক থাকে না। ”
হ্যাভেন ধমকে বলল,
” বেয়াদবি বেশি হয়ে যাচ্ছে, অরু। মেজাজ খারাপ করবে না। আমার রাগ বাড়ালে তোমার ক্ষতি। যা বলছি শোনো। কথা বলো তোমার বাবার সাথে। ”
ধমকে অরু মৃদু কেঁপে ওঠে। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। এরকম জবরদস্তি ভালো লাগছে না। রাগ করলে রাগ দেখানো আর ভাঙানোর মানুষ নেই। ঠোঁট কামড়ে ধরে, পলক ঝাপটায়। এই বজ্জাত লোকের সামনে কিছুতেই নিজের চোখের পানি আসতে দিবে না। বাধ্য হয়ে ফোন নিলো৷ পা বাড়ায় বারান্দার উদ্দেশ্যে।
জামশেদ লাইনে ছিলেন। এতক্ষণ মেয়ে আর জামাইয়ের কথোপকথন শুনেছেন। অরুর কথা শুনে উপলব্ধি করতে পারছেন, মেয়েটা ভালো নেই। শারীরিক ভাবে ভালো থাকলেও, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। সাথে এটাও বুঝতে পারছেন, হ্যাভেন’কে এখনো অরু মেনে নিতে পারেনি। না মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক।
অরু ক্রন্দন মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো,
” হ্যালো। ”
জামশেদ লম্বা শ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। অমনি অল্প কুঁচকানো খসখস অমসৃণ গাল বেয়ে দু’ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। এক সপ্তাহ পরে তার মায়ের মিষ্টি কন্ঠ শুনতে পেলেন তিনি। কত মিস করেছেন তার অভিমানী চঞ্চল মায়ের সুরেলা ডাক! চশমা খুলে ঝটপট চোখের অশ্রু মুছ নিলেন। প্রফুল্ল সজীব হেসে শুধালেন,
” আমার মা কি খুব বেশিই অভিমান করে আছে, তার আব্বুর উপর? ”
অরু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। কান্নাগুলো গলায় দলা হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। কন্ঠনালী ভেদ করে বের হতে পারছে না। হয়তো অরু বের হতে দিতে চাচ্ছে না।
অরুর নিশ্চুপ থাকা জামশেদের কষ্ট দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। আকুতি নিয়ে পুনরায় বললেন,
” অভিমান ভুলে একটি বার কি আব্বুর সাথে কথা বলা যায় না? কতদিন তোমার মুখে আব্বু ডাক শুনি না। মনে হচ্ছে হাজার যুগ ধরে তোমাকে দেখি না, তোমার কন্ঠ শুনতে পাই না। ”
অরু এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। অরু এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ও জানতো, বাবার মায়াভরা কন্ঠ একবার শুনলে শত অভিমান অভিযোগ থাকলেও অরু নিজেকে আটকাতে পারবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ভাঙা গলায় উচ্চারণ করলো,
” আব্বু! ”
জামশেদ উদ্বীগ্ন কন্ঠে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন,
” জি, মা। এই তো আমি। কাঁদে না মা। আব্বুর কষ্ট হচ্ছে তো। ”
” আমি তোমার কাছে যাবো। ”
” আচ্ছা, হ্যাভেন’কে বলো। সে তোমাকে নিয়ে আসবে। ”
” উনি যেতে দিবেন? ”
জামশেদ আস্বস্ত করে জানান,
” অবশ্যই। ”
” তোমাদের খুব মিস করেছি আব্বু। ”
” আমরাও। তুবা তো আজকে অনেক কেঁদেছে তোমার জন্য। ”
” তুবা কোথায়? ”
” ঘুমাচ্ছে। ”
দীর্ঘক্ষণ বাবা মেয়ের মান অভিমান, দুষ্টু মিষ্টি কথা চলল। কথা শেষ করে নাক টানতে টানতে রুমে আসে অরু। বেখেয়ালে হাঁটতে গিয়ে পুরুষালী প্রসস্থ শক্ত বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। অরু চমকে সহসা পিছিয়ে যায়। নজর অন্য দিকে রেখে হ্যাভেনের নিকট ফোন এগিয়ে দেয়। হ্যাভেন ফোন পকেটে রেখে দিল। বুকে হাত গুঁজে শিনা টানটান করে সটান হয়ে দাঁড়ায়।
” আগে বললে একটা বড়সড় ড্রামের ব্যবস্থা করে দিতাম। ”
অরু হতবিহ্বল অক্ষিপটে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। হ্যাভেনের আকস্মিক কথা তার বোধগম্য হচ্ছে না।
” কি বলতে চাইছেন, স্পষ্ট করে বলুন? ”
হ্যাভেন ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলে,
” যেভাবে কান্না করছিলে, নাকের জল চোখের মিলে আমার এই বিশাল বাড়িটা আরেকটু হলে ডুবে যেতো। আমি সর্বদা দায়িত্ববান আর সচেতন মানুষ। কান্না করার পূর্বে আমাকে ইনফর্ম করবে। জল জমা করার জন্য পাত্রের ব্যবস্থা করে রাখবো। ”
অরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিরক্ত কন্ঠে বলল,
” আবার শুরু করে দিয়েছেন, আপনারা আলতু ফালতু কথাবার্তা? ”
হ্যাভেন নিগূঢ় চাউনীতে ভরাট স্বরে বলে,
” মিথ্যা বলেছি? আমি বুঝতে পারি না, তোমার চোখে এত জল কোথা থেকে উদয় হয়? চোখে কি মহাসমুদ্র চাষ করো নাকি? ”
অরু দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দেয়,
” হ্যাঁ! শুনুন, আমি বাড়ি যেতে চাই। আব্বু বলেছে আপনাকে বলতে। ”
” কত দিনের জন্য? ”
অরু ভড়কে গেল। থমথমে মুখে বলল,
” থাকব না। দেখা করে চলে আসবো। ”
হ্যাভেন ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসল। অরুর কথাটা পছন্দ হয়েছে।
” তুমি থাকতে চাইলেও আমি দিতাম না। ”
হ্যাভেনের শান্ত জবাব। অরু চোখ ছোট ছোট করে শুধাল,
” কেন? ”
হ্যাভেন ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
” শীতের দিনে বিয়ে করেছি কি বউ ছাড়া থাকার জন্য? ”
অরু নাকমুখ বিকৃত করল। কি অসভ্য লোক! হ্যাভেন রুম ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। তক্ষুণি পেছন থেকে একরাশ দ্বিধা সমেত অরু ডেকে ওঠে,
” একটা কথা জানার ছিল। ”
সহসা গ্রীবা বাঁকায় হ্যাভেন। চোখের পলকে একদম অরুর কাছ ঘেঁষে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অরু চকিতে তাকাল। হ্যাভেন ঠিক করা শার্টের কলার পুনরায় ঠিক করে ব্যগ্র গলায় শুধায়,
” বলো। ”
অরু ছিটকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল। খিটখিটে মেজাজে জানতে চাইল,
” যতদূর মনে পড়ছে, আমি কালকে সোফায় বসে ছিলাম। খাটে গিয়েছিলাম কখন? ”
হ্যাভেন শয়তানি হেসে, দুঃখি মুখ করে জানায়,
” মাথার স্ক্রু কি ঢিলে হয়ে গিয়েছে? আমার এত সুন্দর গুড লুকিং ফেস দেখে তুমি রাতে দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলে। আমার সাথে ঢলাঢলি শুরু করে দিয়েছিলে। আমি এতবার বলার পড়োও আমার কথা আমলে নেওনি। কতবার বললাম, অরু এভাবে আমার ইজ্জত হরণ করো না। কিন্তু তুমি শুনলে না। সারারাত আমার সাথে চিপকাচিপকি করেছো। বেশি মাতাল ছিলে তাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে টের পাওনি। ভাগ্যিস ঘুমিয়ে ছিলে, নয়তো আজ বউয়ের হাতে ধর্ষণের শিকার হতাম। জনসম্মুখে মুখ দেখাতে পারতাম না। আমি ভীষণ দায়িত্বশীল মানুষ। মানবতার খাতিরে তোমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ক্ষান্ত হলো। নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে অরুর দিকে তাকায়। অরু হতভম্ব নেত্রদ্বয়ে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। অরু’কে জ্বালানো আর রাতে যে হ্যাভেন নিজে থেকে বউকে জড়িয়ে আরামে ঘুমিয়ে ছিল, সেটা গোপন রাখতে এসব বলেছে। নয়তো এই ধানিলংকা কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়বে।
অরু অবিশ্বাসের স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
” মিথ্যুক! আমি কি নেশা করেছিলাম, যে মাতাল হবো? আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি সেরকম টাইপের মেয়ে না। আপনি একজন বাহানাবাজ! যখন তখন সুযোগ খুঁজেন আমাকে টাচ্ করার। আমার আবছা আবছা মনে আছে। আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল। আপনি আমাকে খাটে শোয়ানোর পর, শক্তপোক্ত কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখতে পাই, আপনি আমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছেন। চাপা মারার জায়গা পান না? ”
হ্যাভেন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। গমগমে গলায় বলে,
” এই হলো মেয়ে মানুষ! যাই হয়ে যাক, নিজের দোষ স্বীকার করবে না। ওটা শক্ত কোলবালিশ না, ওটা আমি ছিলাম। আর আমি তো তোমাকে বাঁচিয়ে ছিলাম। আমার প্রতি তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। ”
অরু সরু চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
” আমার কি এমন হয়েছিল, যে আপনাকে বাঁচাতে হয়েছে? ”
” আরেকটু হলে শীতে মারা যেতে। আশি বছরের বুড়ির মতো ঠকঠক করে কাঁপছিলে। আমি না থাকলে তোমাকে উষ্ণতা দিতো কে? এরকম ঠান্ডা বডি দেখলে যেকেও মৃত বলে ঘোষনা করতো। ”
প্রেমপিপাসা পর্ব ৭
” কি করে বাঁচালেন? ”
” বলবো? লজ্জা পাবেনা তো?
অরু বিরক্ত দৃষ্টিতে তিরিক্ষি মেজাজে বলে,
” হেয়ালি না করে বলুন। ”
হ্যাভেন অরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আওড়াল,
” আমার সেই নিনজা টেকনিক, শরীর গরম করে।”