প্রেমপিপাসা পর্ব ৯

প্রেমপিপাসা পর্ব ৯
সুমাইয়া সুলতানা

বাড়ির মেইন গেইটের সামনে বড়সড় একটা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভিং সিটে সায়র বসে আছে। সায়র একাধারে গাড়ির টিটটিট হর্ন বাজিয়ে চলেছে। এভাবে বিরতিহীন গাড়ির হর্ন বাজানোর ফলে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষজন সায়রের দিকে বিরক্তিকর চাউনী নিক্ষেপ করছে। যেতে যেতে বড়োলোক বাড়ির বিগড়ে যাওয়া ছেলে, ফাজিল কতশত উপাধি দিচ্ছে বিড়বিড় করে। সায়রের এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভেংচি কেটে তাদের কথা শুনেও না শোনার ভান করে, নিজের কাজে অঢেল রইল। লোকের কথা পাত্তা সে কোনো কালে দেয় না৷
সায়র হর্ন বাজানো বন্ধ করে হাঁক ছেড়ে ডাকল,

” ভাবী? ফাস্ট। আর কতক্ষণ ওয়েট করতে হবে?
ওদিক থেকে আশাপূর্ণ উত্তর পাওয়া গেল না৷ সায়র গাড়ির ছোট জানালা দিয়ে মাথা বের করে গেইটের দিকে উঁকি দিল। অরুর আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। অরু ভার্সিটিতে যাবে। হ্যাভেন, সায়র’কে বলেছে অরু’কে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে। কারণ, দুজনের ভার্সিটি পাশাপাশি। বাড়িতে সায়রের সাথে অরুর কথা হয়েছে। জানতে পারে সায়র অরুর সিনিয়র। এ কয়েকদিনে টুকটাক কথা বলার মাধ্যমে, দুজনের মধ্যে ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গিয়েছে।
অরুর দেরি দেখে সায়র দুর্বোধ্য হেসে আপনমনে আওড়ায়,
” আজ তো ক্লাসে ঢুকে স্যার’কে বলতেই হবে, আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি স্যার। দেরি হয়েছে কারণ আমার ভাবী আমাকে সময়মতো ছাড়ে নি।”
সায়রের ভাবনার মাঝে অরু চলে আসে। সায়রের চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। সায়রের সম্বিত ফিরল। গাড়ির দরজা খুলে গোমড়া মুখে জানতে চাইল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” লেট হয়েছে কেন? ”
অরু সিটে বসে পড়ল। সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে স্মিথ হেসে শুধাল,
” এত অধৈর্য হচ্ছিলেন কেন? ”
সায়র হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছু বলল না। অরু নিজেই পুনরায় বলল,
” আপনার অঙ্কিতা’কে দেখার খুব তাড়া বুঝি?”
সায়রের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অঙ্কিতার কথা অরু’কে বলেছে সে। লজ্জা পাওয়া ভান করে বলল,
” এভাবে বলোনা ভাবী। হৃদয়ের নিভে যাওয়া দহন জ্বলে ওঠে। ”
” আপনি মনের কথা অঙ্কিতা’কে জানিয়েছেন?”
” জানিয়েছি মানে? সেই নবীন বরণের দিন থেকে পিছে পড়ে আছি। মেয়েটার এ্যাটিটিউড অনেক। ঠিক মতো কথাই বলে না। ”
অরু তপ্ত শ্বাস ছেড়ে হতাশ কন্ঠে জানালো,
” কাউকে আপন করে পেতে চাইলে প্রচুর ধৈর্য্য শক্তির প্রয়োজন। নয়তো পছন্দের মানুষটার নাগাল পাওয়া সম্ভব না। ”
সায়র ঠোঁট উল্টে জবাব দিল,

” অন্যদের মতো আমার এত ধৈর্য্য নেই। ইচ্ছে করছে অঙ্কিতা’কে বিয়ে করে এক্ষুনি বাসর করে ফেলি। ”
অরু ভ্যাবলা কান্তের ন্যায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। অবাক লোচনে চেয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। থমথমে মুখে চুপ করে বসে রইল।
অরু উৎকন্ঠিত হয়ে মনে মনে ভাবে,
” যেমন বড়ো ভাই, তেমন তার ছোট ভাই। কারো থেকে কেউ কম না। এদের মস্তিষ্কে সারাক্ষণ এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘুরতে থাকে। ছ্যাহ! ”
অরুর অগোছালো ভাবনার মাঝে গাড়ি থামালো সায়র। গাড়ির ঝাঁকিতে অরু চমকে উঠল। সায়রের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। অরুর চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে সায়র হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলে,

” অঙ্কিতা। ”
অরু তাকায় সায়রের ইশারাকৃত জায়গায়। ফুটপাতে গাড়ির আসায় ব্যস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সায়েরর জানটুস। বারংবার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে। অঙ্কিতার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল অরু। মেয়েটা দেখতে ভালোই সুন্দরী।
সায়র গাড়ির জানালা খুলে মাথা বের করে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে চেঁচিয়ে বলল,
” জানটুস? আমার জন্য ওয়েট করছিলে বুঝি?
অঙ্কিতা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সায়রের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
” আপনি কোন ক্ষেতের মুলা, যে আপনার জন্য ওয়েট করতে যাবো? ”
অরু ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসল। অঙ্কিতার কথায় সায়র কিছুটা অপমানিতবোধ করল। পরমুহূর্তে দুষ্টু হাসল। আগের তুলনায় উচ্চস্বরে চিৎকার করে ওঠে,
” ওহো জানটুস! তোমাকে তো বাড়ি থেকে রিসিভ করার কথা ছিল। একদম ভুলে গিয়েছি সুইটি! রাগ করে না সোনা। ”

সায়রের বিদ্রুপ করে বলা কথায় অঙ্কিতার মেজাজ খারাপ হলো। আশেপাশের মানুষ ওর দিকে কিভাবে চেয়ে রয়েছে। অঙ্কিতা কন্ঠ খাদে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” চুপচাপ নিজ গন্তব্যে প্রস্থান করুন। পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে বদমাশ-গিরী করবেন না। আপনার কোনো অসুবিধা না হলেও, মেয়ে হিসেবে আমার অনেক সমস্যা হবে। প্লিজ চলে যান৷ ”
সায়রের কোনো হেলদোল নেই। মাথা চুলকে বলল,
” ঠিক আছে, আর কিছু বলবো না। চুপচাপ গাড়িতে ওঠো। ”
অঙ্কিতা চকিতে তাকাল। ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধায়,
” কারণ? ”
সায়র ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,

” একই ভার্সিটিতে যাচ্ছি। আমি তোমার সিনিয়র। জুনিয়রের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিবো। আমার কথা না শুনলে জোরে জোরে আরও উল্টোপাল্টা কথা বলবো। ”
অঙ্কিতা মুখ বিকৃতি করে সায়র’কে মনে মনে গালি দিল। দাঁত কিড়মিড় করে গাড়ির কাছে আসলো। সায়র নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে অসহায় মুখভঙ্গিতে অরুর পানে তাকায়। অরু সায়রের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। খোঁচা মেরে গাড়ি হতে নামতে নামতে শুধু বলল,
” ভালো হোন। ”
অরু নেমে গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ল। অঙ্কিতা’কে বসতে হলো সায়রের পাশে। মুখ ঘুরিয়ে সে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। অঙ্কিতা পাশে বসতেই সায়রের মন বাকবাকুম করতে লাগলো। গাড়ির স্পিড অনেক লো করে, পনেরো মিনিটের রাস্তা চল্লিশ মিনিটে পৌঁছেছে। অথচ, অরুর দেরি দেখে দুষ্টু সায়র হাহুতাশ করে মরেছে!

জহির চুপচাপ খাটে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। বিষাক্ত ধোঁয়া উড়াচ্ছেন অবলীলায়। তার মুখে গভীর ক্লান্তির ছাপ। চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছে একরাশ বিষন্নতা। একদিকে ব্যবসায় লস, ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে বাড়ির আর্থিক টানাপোড়ন। সব মিলিয়ে যেন তিনি এক দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আছেন। স্ত্রী শাহানা খাটের একপাশে বসে আছেন নিশ্চুপ হয়ে। স্বামীকে শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। তার মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তি। এই বিরক্তিকর গুমোট পরিস্থিতির সবটা জুড়ে রয়েছে অরু।
নিরবতা ভেঙে শাহানা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন,

” আমি আগেই বলেছিলাম, ওই মেয়ের উপর ভরসা করো না! কালনাগিনী মেয়ে একটা। স্বার্থপরের মতো নিজের কথা ভাবলো আর চাচা-চাচির কথা একটু ভাবলো না। এতদিন পেলেপুষে কালসাপ লালন-পালন করছিলাম! আমাদের কোনো লাভ হলো না। উল্টো অপয়া মেয়েটা বড়োলোক বাড়ির বউ হয়ে রাজরানী হয়ে গেল! বলি তোমার বুদ্ধি কি হাঁটুতে থাকে? বিয়ে দিয়েছো ভালো কথা। হ্যাভেন তালুকদার এর মতো ভদ্রলোক, সুদর্শন পুরুষ, এত ক্ষমতাশালী মানুষ দেখে বিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল? কোনো মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে যার টাকা পয়সা আছে, অরুর কথায় আমাদের টাকা দিতে অস্বীকার করতো না, এমন একজনের সাথে অলক্ষী মেয়ের বিয়ে দিতে!”
শাহানার ঝাঁঝালো কথায় স্পষ্ট বিদ্রুপের ছাপ। হিংসাত্মক চোখে রাগের বহিঃপ্রকাশ। জহির সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নাকমুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়লেন। ধীর কণ্ঠে হতাশ গলায় বললেন,

” বুঝতে পারিনি মেয়েটা তার মায়ের মতোন এক নাম্বার পাল্টি-বাজ হবে! তোমার কি মনে হয়, আমি ইচ্ছে করে এমন কিছু করেছি? মধ্যবয়স্ক পাত্র হলে জামশেদ রাজি হতো না। তাছাড়া, হ্যাভেনের সাথে অরুর বিয়ে জামশেদ ঠিক করেছিল। আমি শুধু সম্পর্কের দোহাই দিয়ে টাকা উশুল করতে চেয়েছিলাম। হ্যাভেনের টাকা আসলে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। অরু যে এতটা ধুরন্দর পণ্ডিত হয়ে ধরা দিবে, কোনো কালে আন্দাজ করতে পারিনি। ”
শাহানা নাক ছিটকান। কটাক্ষ করে বলেন,

” ধূর্ত মেয়ে নয়, হারে হারে বজ্জাত! তুমি কি এখনো বুঝতে পারছো না, সে কতটা চালাক আর লোভী? সবসময় নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। এই মেয়ে টাকা চিনে, টাকা। সে জানত কীভাবে টাকা হাতছাড়া করতে হবে। সেজন্য হ্যাভেন’কে বলে টাকাগুলো নিজের করে নিয়েছে। ”
” এটা ঠিক পরিস্থিতিটা আমাদের পক্ষে যায়নি। জামশেদের সঙ্গে আরেকবার কথা বলা দরকার। দেখি কোনো সুরাহা মিলে কিনা। ”

শাহানা তাচ্ছিল্য হাসলেন।
” তোমার এই অন্ধ বিশ্বাস একদিন আমাদের পুরোপুরি ডুবিয়ে দিবে। তোমার ভাইও স্বার্থ লোভী মানুষ। মেয়েকে বড়োলোক ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে, নিজের চিকিৎসা থেকে শুরু করে ভরনপোষণ সবকিছুর জন্য টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মেয়ের জামাইর থেকে। আমরা কতদিন ধরে লোনের চাপ সামলে চলেছি? জামশেদ কি পারতো না, হ্যাভেন’কে বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে? হ্যাভেনের কাছ থেকে এই টাকাগুলো আমাদের শেষ আশা ছিল। কিন্তু এখন? কিছুই করার থাকল না! ”
জহির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চোখে অপরাধবোধের ছায়া। স্ত্রীর কথায় মাঝে মাঝে পথভ্রষ্ট হয়ে যান৷ নয়তো তিনি অরু, জামশেদ’কে হিংসা করেন না। ভালোবাসেন।
” শান্ত হও। পেছনের কথা ভেবে আর কি লাভ? প্রাপ্তবয়স্ক অরু’কে এক বাচ্চার বাবার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটার পক্ষে কি এসব মেনে নেওয়া সহজ হচ্ছে? আমাদের শানায়া’কে কি পারতে এক বাচ্চার বাবার সাথে বিয়ে দিতে? ”

শাহানা এবার সত্যিই রেগে গেলেন। ঝাঁঝ নিয়ে চওড়া গলায় বললেন,
” আমার মেয়ের সাথে ওই অরুর তুলনা করছো তুমি? আমাদের মেয়ে আর তোমার ভাইয়ের মেয়ে কি এক হলো? ”
জহির কোনো জবাব দিলেন না। ঘরে চলছে নিস্তব্ধতা। শাহানা চেয়েছিলেন একটা হিংসাত্মক শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া, কিন্তু জহির থেকে আশাজনক উত্তর পেলেন না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। অফিসে প্রচুর কাজের চাপ, ক্লায়েন্টদের কাজ সম্পর্কে অবগত করানো, সব মিলিয়ে মাথার ভেতর যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তারউপর এরকম একটা খবর! হ্যাভেন অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রেখে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ছুটে এসেছে। তার মুখমন্ডল জুড়ে অস্থিরতার ছাপ। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুতগতিতে উদ্বিগ্ন সমেত হাঁটা শুরু করল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে বক্ষস্থল ধরাস ধরাস করছে। কলিং বেল টিপতেই রুবিনা দরজা খুলে দিলেন। ঝড়ের বেগে বেডরুমের দিকে ছুটল। দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে অরুর মৃদু আর্তনাদ ভেসে এলো। হ্যাভেন বুক ধক করে ওঠে। চোখে তৎক্ষণাৎ শঙ্কা আর উত্তেজনা ভর করল। জোরে জোরে শ্বাস টানছে। বলিষ্ঠ শরীরটা ঘেমে জুবুথুবু অবস্থা। গলার টাই খুলতে খুলতে রুমে প্রবেশ করল। ভেতরে গিয়ে দেখল, অরু বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে রয়েছে। পাশে ফ্যামিলি ডাক্তার বসে আছেন। সায়রা অরুর মাথার কাছে বসা। হ্যাভেন’কে দেখে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন।

হ্যাভেন গায়ের কোর্ট খুলে ডিভানে ছুড়ে মারলো। ব্যস্ত কদমে অরুর পাশে দপ করে বসে পড়ল। নিগূঢ় চাউনীতে অরুর পা হতে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে চলেছে হ্যাভেনের আহত নেত্রদ্বয়। অরুর এক হাতের কনুই ছিঁলে গিয়েছে। পায়ের গোড়ালি আঁচড়ের ন্যায় দাগকাটা। কপালে ছোট একটা ব্যান্ডেজ। আপেলের মতো থুতনিতে নরম চামড়া কিঞ্চিৎ উঠে থেঁতলে গিয়েছে। সেখানে ব্যথানাশক মলম লাগানো। অরুর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” অরু পাখি? কিভাবে হয়েছে এসব? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? কতটা লেগেছে? ”

অরু চোখ খুলে, ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে। হ্যাভেনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সকালের পরিপাটি করা চুল এলোমেলো হয়ে, অল্পসংখ্যক চুল কপালে ঘামের সাথে লেপ্টে রয়েছে। মুখমন্ডল জুড়ে অস্থিরতা। ফর্সা মুখশ্রী কেমন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। ঘনঘন শ্বাস টানছে। সেই তপ্ত নিঃশ্বাস অরুর চোখেমুখে উপচে পড়ছে। গোছানো হ্যাভেন অল্প সময়ে অগোছালো হয়ে মুখের এ কি বেহাল দশা করেছে? এই চিন্তা, উদ্বেগ সবেতে মিশে রয়েছে অরু! অরু ক্লান্তিমাখা নয়নে চেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অপছন্দের অসহ্যকর লোকটার মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করল।

ক্লাস শেষে অরু ভার্সিটির গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির আসায়। সায়র বলেছে গেইটের কাছে অপেক্ষা করতে। সে রাস্তায় আছে। অরু স্বাভাবিক ভাবে একটু হেঁটে মেইন রোডে দাঁড়ায়। তক্ষুণি একটা রিকশা গাড়ি এসে অরু’কে ধাক্কা মারে। রিকশা চালক ইচ্ছে করে মারেনি। বয়স্ক মানুষ সূর্যের রশ্মি চোখে লাগায় খেয়াল করেনি। ধাক্কা খেয়ে অরু ছিটকে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে যায়। মুহূর্তে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে সে। পা ধরে সেখানে বসে পড়ে, মৃদু আওয়াজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। বোধ হয় মচকে গিয়েছে। কপালের চামড়া কেটেছে অল্প একটু। হাতে, শরীরে বিভিন্ন জায়গায় টুকটাক ব্যথা পেয়েছে। রিকশা চালক ক্ষমা চেয়েছেন অরুর থেকে। সায়র এসে অরু’কে নিয়ে বাড়ি চলে আসে। যেহেতু সিরিয়াস কোনো ক্ষতি হয়নি। সেজন্য আসার সময় পারিবারিক ডাক্তার’কে কল করেছে। এ খবর হ্যাভেন’কে ফোন করে সায়র জানিয়েছে। তখন মিটিংয়ে ছিল হ্যাভেন। সায়রের নাম্বার দেখলে কখনো রিসিভ করতো না। ফোন করা হয়েছে অরুর নাম্বার থেকে। অরুর কল দেখে ঝটপট কল রিসিভ করে জানতে পারে হৃদয়ে আঘাত পাওয়ার মতো খবর। কিসের মিটিং? কিসের কি? তৎক্ষনাৎ দিন-দুনিয়া ভুলে বাড়ির পথে রওনা হয়।
হ্যাভেন ব্যাকুল হয়ে অরুর ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত ছোঁয়ায়। অরু সহসা ব্যথাতুর শব্দ তুলল। হ্যাভেন ঘাবড়ে হাত সরিয়ে নিলো। সায়েরর দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে চিৎকার করে বলল,

” শঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুধু একজন ডক্টর ডেকেছিস কোন আক্কেলে? একজন ডক্টর দিয়ে কি হবে? আরও ডক্টর ডাক। ওকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করতে হবে। জলদি জলদি সুস্থ না হলে রাতে শরীর গরম করবো কি করে? এমনিতেই আমার নিউমোনিয়ার প্রবলেম রয়েছে।”
ডাক্তার সহ রুমে উপস্থিত প্রত্যেক সদস্য চোখ বড়ো বড়ো করে হ্যাভেনের দিকে চেয়ে আছে। সকলে তব্দা খেয়ে হা করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাভেনের থেকে এরকম লাগামহীন বেলেল্লাপনা কথাবার্তা মোটেই কাম্য নয়। সর্বদা স্ট্রংলি কথা বলে। যার কর্কশ কন্ঠের দাপটে প্রভাবশালী মানুষদের শরীরে কাঁপন ধরায়। এই প্রথম সেই দাম্ভিক হ্যাভেন থেকে এসমস্ত কথা শুনছে। হোঁচট খাবে না?
সায়র ভোঁতা মুখে শান্ত গলায় জবাব দিল,

” ভাই আর ডক্টর ডাকার প্রয়োজন নেই। বডিতে টুকটাক চোট পেয়েছে। গুরুতর আহত হয়নি। সো রিলাক্স। ”
হ্যাভেন তেতে উঠল। তিরিক্ষি মেজাজ সহিত পুনরায় চেঁচিয়ে বলে,
” জাস্ট শাট আপ, ব্লাডি ফুল! আমাকে সস্তা নলেজ দিচ্ছিস? যা বললাম, সেটা কর। ”
সায়র শুনলো না। গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে রুম হতে চলে গেল। হ্যাভেন আহাম্মক বনে গেল! তার ছোট ভাই তার কথা অগ্রাহ্য করে ভাব দেখাচ্ছে? দেখাক। এক মাঘে শীত যায় না। হ্যাভেনও সময় বুঝে এর শোধ নিবে।
সায়রা লজ্জায় নুইয়ে পড়লেন হ্যাভেনের কথার জালে। আস্তে করে অরুর থেকে টুটুল’কে ছাড়িয়ে কোলে তুলে কক্ষ ত্যাগ করলেন। অরু’কে ব্যথায় কাতরাতে দেখে ছোট্ট টুটুলের মনে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে। তার সুন্দর আম্মু কেন ব্যথা পাবে? শিশুসুলভ মনোভাব ক্ষুদ্র সত্তা কষ্টে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। অরু আদুরে সহিত কাছে টেনে স্নেহময় কথা বললেও কাজ হয়নি। অতঃপর কেঁদে কেটে অরুর কোমর জড়িয়ে, পেটে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ডাক্তার চিকিৎসার জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরে, হ্যাভেনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বোঝানোর স্বরে বললেন,

” বি স্ট্রোং ম্যান। শী ইজ পারফেক্টলি ফাইন। মেডিসিন দিয়েছি। কিছুদিন রেস্ট নিলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। নাউ এভ্রিথিং ইজ অলরাইট। ডোন্ট বি এক্সাইটেড। টেক কেয়ার। ”
হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে ভরাট স্বরে প্রশ্ন করলো,
” আপনি আমাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করছেন আঙ্কেল? কেন হবো না? বউ আমার। উত্তেজিত আমি না, তো কি আপনি হবেন? ”
ডাক্তার থমথমে খেয়ে গেলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিমেষে চুপসে গেল। নিজেকে সামলে উত্তর দিলেন,
” আমি সেরকম কিছু বোঝাতে চাইনি। নরমাল ভাবে বলেছি। ”
হ্যাভেন অরুর গালে হাত রাখল। একটা আঙুল থুতনিতে লাগায়, কাঁচা আঘাতে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব হলো। অস্ফুট স্বরে মৃদু ব্যথাতুর আওয়াজ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। হ্যাভেন তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয়।
ডাক্তার পুনরায় বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে বললেন,

” আমি এখন আসি। বেশি জোরে কথা বলো না। আর তোমার ওয়াইফের শরীরে জখম। তাই কয়েকটা দিন দূরে থাকো। রুগীর ডিস্টার্ব হবে। আমি যেই মেডিসিন দিয়েছি তাতেই হবে। অন্য ডক্টরের প্রয়োজন নেই। ”
ক্ষেপে উঠল হ্যাভেন। দাঁতে দাঁত চেপে সিরিয়াস হয়ে বলল,
” দূরে থাকব মানে? অন্য ডক্টর লাগবে না মানে? আপনি একজন বিবাহিত মানুষ হয়ে এরকম অন্যায় কথাবার্তা কিভাবে বলতে পারেন? ফটাফট বউ সুস্থ না হলে, রাতে বউকে জড়িয়ে ধরে শরীর গরম করতে পারবো না! জানেনই তো আমার ঠান্ডায় নিউমোনিয়া শুরু হয়। বউকে নরমাল ভাবে ছুঁতে গেলেও ‘উ’ ‘আ’ শব্দ বের করবে মুখ দিয়ে। লোকে শুনলে ভাববে আমি বউয়ের সাথে কি না কি করেছি। অথচ, বাস্তবে দেখা গেল বউয়ের হাতটা পর্যন্ত স্পর্শ করিনি! এত বড়ো দায়ভার কে নিবে? এটা ভাবতেই আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।”
ডাক্তার অসহায় মুখভঙ্গিতে চেয়ে বললেন,

” বাবা আমাকে যেতে হবে। ”
লজ্জায় অরুর কান গরম হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে পারছে না। হা করে কথা বলতে চাইলে থুতনির চামড়ায় টান পড়ছে। অতি কষ্টে ক্ষীণ স্বরে আওড়াল,
” আঙ্কেল আপনি এখন চলে যেতে পারেন। ”
বলতে দেরি, কিন্তু ডাক্তারের রুম ত্যাগ করতে দেরি হলো না। ব্যাগটা বগলদাবা করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলেন।
হ্যাভেনের দিকে চেয়ে অরু মৃদু বিষণ্ণতা নিয়ে ছোট করে জানায়,

” আ’ম ফাইন। ”
হ্যাভেন মেনে নিলো। কিন্তু শান্ত হতে পারলো না। অরুর কথা বলার ধরনই বলে দিচ্ছে, সে মোটেও ঠিক নেই। চোখমুখে মলিনতার রেশ।
হ্যাভেন শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আবার অরুর কাছে চলে আসে। অরু চোখ বন্ধ করে ছিল। পুরুষালী মাতাল সুঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতেই বুঁজে রাখা চোখ মেলল। হ্যাভেন তার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। অরুর বিরক্ত লাগছে। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল।
” কতবার বলেছি সাবধানে চলবে। হাঁটার সময় চোখ কি কপালে তুলে হাঁটো? ”
হ্যাভেনের নিরব ধমকে শাসনের গমগমে স্বর। অরু ভাবলেশহীন ভাবে নিশ্চুপ থাকল। অরুর থেকে জবাব না পেয়ে হ্যাভেনের রাগ বেড়ে গেল। আলতো করে অরুর চোয়াল চেপে ধরে, মুখ নিজের দিকে ফেরালো। গভীর দৃষ্টিতে অরুর ভাসা ভাসা চোখে নজর রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,

” তুমি বুঝতে পারছো, কতটা টেনশন নিয়ে আর ভয় পেয়ে এখানে এসেছি? ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছিল আজ। কোনরকম কাকু’কে হ্যান্ডেল করতে বলে পাগলের মতো ছুটে এসেছি। আমার চিন্তা দেখে তুমি মজা নিচ্ছো?
অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। ও আবার মজা নিলো কখন?
” রেস্ট করবো। বিরক্ত করবেন না তো। ”
হ্যাভেন ক্ষিপ্ত মেজাজে বলে,
” রাখো তেমার রেস্ট! আমার বিশ্রাম হারাম করার ধান্দা করে, নিজে দিব্যি বিশ্রাম করবে? সেটা চলবে না। ”
অরু ফোঁস করে লম্বা শ্বাস টানল। মাথায় চিনচিন সুক্ষ্ম ব্যথা করছে। নিস্প্রভ গলায় জবাব দেয়,
” আমার সত্যি খারাপ লাগছে। ”
হ্যাভেন দমে গেল। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে, জোড়ালো আওয়াজে বলল,
” ব্যথা যখন পেয়েছো তোমাকে সুস্থ করার দায়িত্ব আমার। জানোই তো আমি রেস্পন্সিবল মানুষ। শুধু ডক্টরের ঔষধে কিছু হবে না। স্পেশাল নিনজা টোটকা লাগবে৷ সেই টোটকা আমি তোমাকে দিবো।”

” কিসের টোটকা? ”
হ্যাভেন সাবলীলভাবে জানায়,
” তোমার আঘাত পাওয়া স্থানে আমার কড়া ডোজার চুমু পড়লে, দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। ভেবোনা তোমাকে স্পর্শ করার জন্য ধান্দা খুঁজছি। তোমাকে চুমু খাওয়া তো দূরে থাক, টাচ্ করবো ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। ভাগ্যিস আমি জেন্টলম্যান। তাই মানবতার খাতিরে তোমাকে সুস্থ করার ক্ষুদ্র প্রয়াস করছি মাত্র। ”
অরু চকিতে তাকাল। স্তব্ধ হয় গেল বদনখানি। হ্যাভেনের সুগভীর চোখে চেয়ে লজ্জা, ভয়, আক্রোশে ফেটে পড়ল। কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলো,

” আপনি এমন কিছু করবেন না। ”
হ্যাভেন শুনল না। নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে, অগ্রসর হয় আপন কাজে। অরুর সজাগ থাকা অবস্থায় প্রথম বারের ন্যায়, অতি যত্নে চুমু এঁটে দিল বধূয়ার আঘাত পাওয়া ললাটে। অরু মুহূর্তে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। আড়ষ্টতায় আইঢাই করে উঠল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে করতাল! হাতে ব্যথা, নয়তো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো। থুতনিতে চুমু খাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে ওঠে হ্যাভেন,
” আমার সবচেয়ে অপছন্দের সুস্বাদু আপেল! ”
অরু উত্তেজনায় স্বীয় ঠোঁট কামড়ে ধরে। সবশেষে হ্যাভেন পায়ের গোড়ালিতে চুমু খেতে উদ্যত হয়। অরু তৎক্ষনাৎ বাঁধা প্রদান করে। ক্ষীণ স্বরে আওড়াল,

প্রেমপিপাসা পর্ব ৮

” না, প্লিজ। ”
হ্যাভেন এবারেও অরুর কথা অগ্রাহ্য করে সেখানেও চুমু খেল। অরু দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” শালার জামাই! একবার সুস্থ হতে দে। তোর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ব। ব্যাটা বজ্জাত! ”

প্রেমপিপাসা পর্ব ১০