প্রেমসুধা পর্ব ৫৫

প্রেমসুধা পর্ব ৫৫
সাইয়্যারা খান

চোখ, মুখ উল্টে ত্যাড়া হয়ে শুয়ে আছে পৌষ। তার মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা কাজ করছে। যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তখন তৌসিফ চমকাবে। ভাববে অচেনা জায়গায় পৌষ কোথায় ই বা গেলো। তখন সে ভাঙা হারিকেন দিয়ে বউ খুঁজবে। পৌষ আবার চালাক। চতুরতা তার হাড্ডি-গুড্ডিতে ভরপুর। পৌষ লুকাবে বিশাল বড় এই আলমারির পিছনে। তৌসিফ যখন বউ খুঁজতে খুঁজতে পা’গল তখন পৌষ ফ্রীজে থাকা দামি দামি ফলগুলো খাবে আর টিভি ছেড়ে মনমতো একটা জাপানিজ কার্টুন দেখবে। বিষয়টা মন্দ না। করাই যায়। এতটুকু শাস্তি তো তৌসিফে’র হক। হক মা’রা পৌষ পছন্দ করে না। সে খুব করে চায় যার যার হক সে সে পাক।

এই শাস্তিটা তৌসিফ পাবে সদ্য অপরাধের জন্য। এই ভয়ংকর ঠান্ডায় সে পৌষ’কে গোসল করতে বাধ্য করেছে। পৌষ নাকি ময়লা হয়ে গিয়েছে। এই পুরুষটা প্রচুর খুঁতখুঁত করে। তার খাবারে খুঁতখুঁত। মানুষে খুঁতখুঁত। এমনকি তার পরিবেশের উপরও এক খুঁতখুঁত স্বভাব আছে। এই যেমন যেখানে সেখানে সে থাকতে পারে না। পৌষ’র মনে হয় এটা একটা রোগ। এই রোগের নাম খুঁতখুঁতানি রোগ। এই রোগের কোন ঔষধ নেই। আছে শুধু ঝাড়ফুঁক। পৌষ ভাবলো এই দফায় একদিন দেশে ফিরে তৌসিফ’কে ঝাড়াবে। ঝাড়ুর দুই বারি খেলেই সে ঠিক হয়ে যাবে। তারকাঁটার মতো সোজা হয়ে যাবে। এই ঠান্ডার মধ্যে কেউ বউ গোসল করায়। আরে ভাই, প্লেনে করে এসে কে ই বা ময়লা হয়? আশ্চর্য!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পৌষ যখন আকাশ-পাতাল উদ্ধার করে চিন্তা করতে করতে ডুবে যাচ্ছিলো তখন তার পথভ্রষ্ট করতে তৌসিফ হাজির হলো। পৌষ’কে গোসল করিয়ে এখন নিজেও গোসল করে এসেছে। এসেছে তো এসেছে খালি গায়েই রুম জুড়ে পায়চারি করে যাচ্ছে। এতে অবশ্য পৌষ’র সমস্যা হচ্ছে। তার মনোযোগ ঠিক থাকছে না। রাগ গুলো ধরে রাখা যাচ্ছে না। পৌষ বিরক্ত হয় নিজের উপর। রাগ কেন ধরে রাখা যাবে না। রাগকে ধরে রাখতেই হবে। তৌসিফ তালুকদারকে বশে আনতেই হবে। তার বুঝতে হবে শীতের দেশে গোসল করা বাধ্যতামূলক না। গোসলে পানি নষ্ট হয়। দেশে পানির বড়ই আকাল। না জানি কবে পানি ফুরিয়ে যায়? পৌষ বড়ই চিন্তিত। ওর চিন্তার ফাঁকে হঠাৎ গায়ে কিছু পরতেই কম্বলের নীচ থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে পৌষ। ভেবেছিলো গায়ের উপর পোকামাকড় কিছু বুঝি পরলো কিন্তু না তেমন কিছু না। তৌসিফ লোশন ছুঁড়ে দিয়েছে। পৌষ হাতে নিয়ে তা তৌসিফে’র দিকে ফিঁকে মা’রে। ক্যাচ ধরে সগর্বে হাসে তৌসিফ। কোমড়ের টাউজারটা টেনে কাছে এগিয়ে এসে পৌষ’র সম্মুখে দাঁড়িয়ে আদেশ ছুঁড়ে,

— লোশন লাগিয়ে দাও।
পৌষ সাদা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি তো পারি না।
— আসো শিখিয়ে দেই।
— শিখতেও চাই না।
— মানুষ শীতের দিনে শরীরে কিছু তো লাগায় নাকি? দেখেছো নিজেকে তুমি। শরীরের কি অবস্থা হানি।
বিষন্ন গলায় পৌষ বললো,
— হুঁ।
ব্যাস এতটুকুই। হাঁটু ভাজ করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে শরীরে কম্বল টানতেই তৌসিফ কেড়ে নিলো তা। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?
পৌষ উত্তর করে,
— কই কিছুই না।
— আশ্চর্য! তুমি কোথায় তাকিয়ে আছো পৌষরাত?
— কোথায় তাকালাম আবার? আপনার দিকেই তো তাকিয়ে আছি।
— পৌষরাত!
— বলুন।
— তুমি কি দেখছো?
— আপনাকে দেখছি। খালি গায়ে আছেন। পরণে কালো টাউজার। গলায় টাওয়াল।
— দেখেতো হাতে কি।
— খালি।
তৌসিফ চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। পৌষ’র মাথাটা ধরে নিজের মুখের সামনে এনে বলে,
— এখন?
— বড় আলমারিটা দেখা যাচ্ছে। এই যে।

আঙুল দিয়ে উল্টো দেখালো তৌসিফ’কে। তৌসিফে’র মাথাটা তখন ঝিমঝিম করতে লাগলো। পৌষ’র চোখে যে সমস্যা হচ্ছে তা বুঝে গেলো যেন কিন্তু হঠাৎ করে কিভাবে সম্ভব? পৌষ দেখলো তৌসিফ চিন্তায় মুখটা পাংশুটে করে তাকিয়ে আছে। ফোনটা হাতে তুলে ঝটপট কল লাগালো কাউকে।
মনে মনে ভীষণ মজা পেলো পৌষ। তৌসিফ’কে বোকা বানাতে পেরে তার বুকের ভিতর এক অজানা সুখ হচ্ছে। এই লোক মহা চালাক। ঠান্ডায় গোসল করানোর শাস্তি এটাই। কাল সকালে গিয়ে পৌষ ঠিক হবে।
পৌষ উঠে আলমারিতে গিয়ে ব্যাগ নিলো। তাকিয়ে রইলো তৌসিফে’র দিকে। চিন্তিত মুখে সে তখনও কল করছে। পৌষ প্লেন থেকে আনা চকলেট বের করে একটা নিজের মুখে দিলো। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গিয়ে বসলো তৌসিফে’র পাশে। একটা চকলেট খুলে তৌসিফে’র মুখে দিতেই কাঙ্ক্ষিত কলটা রিসিভ হলো। তৌসিফ চকলেট চুষতে চুষতেই ডিনার দিতে বলে রেখে দিলো। পৌষ হা করে শ্বাস টানলো। এটা কি হলো? পৌষ তো ভাবলো তৌসিফ হয়তো ডাক্তারকে কল দিচ্ছে। ডাক্তার এলেও পৌষ কিছুক্ষণ তিড়িং বিড়িং করতো কিন্তু কোথায় ডাক্তার?
তৌসিফ ফোনটা রেখে লোশন এগিয়ে দিয়ে বললো,

— তারাতাড়ি লোশন দাও হানি।
পৌষ’র এত রাগ লাগলো যা বলার বাইরে। তার মন চাইলো এই লোকটাকে খামচে দিতে। ওরই দোষ। মনে রাখা উচিত ছিলো এটা তৌসিফ তালুকদার। দ্যা মোস্ট চালাক ব্যাটা। পৌষ মনে মনে গালি দিলো, “খাটাস ব্যাটা”।
— কি বিরবির করছো?
পৌষ মুখ লটকে তৌসিফ’কে লোশন লাগালো। এই লোক একটা অলস। এইসব কাজ সে নিজে করবে না। পৌষ’কে দিয়েই করাবে। পায়ে লোশন লাগিয়ে নখে আবার আলাদা জেল লাগায়। পৌষ মুখ কুঁচকেই রাখলো। কোন পুরুষ এতটা ঢং কিভাবে করতে পারে?
এমনিতেই এত সুন্দর তার উপর এসব ডলাডলি তার লাগবেই।
খাবার আসতেই তৌসিফ তা নিয়ে নিজেই সার্ভ করে। পৌষ’কে ডাকতেই গমগমে স্বরে শোনা গেলো,

— খাব না।
— উঠে এসো।
— ক্ষুধা নেই।
— আছে।
— বলেছি তো খাব না।
— হানিই আ’ম ঠু হাঙ্গরী।
পৌষ’র বুকে একটু একটু মায়া লাগে। উঠে বসে মাথা সহ কম্বলের নীচেই রেখে বলে,
— এখানে দিন।
— এখানে এসো।
— মোটেই না।

তৌসিফ বউ’কে আর খোঁচালো না। উঠে প্লেট নিয়ে বসে পৌষ’র হাতে দিলো। প্লেট নিয়ে অন্য দিকে মুখ করে খাচ্ছে ও। তৌসিফ শ্বাস টানলো। শুধু মাত্র গোসল করালো বলে এত রাগ। ভাবা যায়? হানিমুনে এসে যদি বউই রেগে থাকে তাহলে হানি যায় একদিকে মুন যায় আরেকদিকে। এ এক বিরাট মুশকিল। তৌসিফ অসহায় অসহায়বোধ করে। বউ নিয়ে বড় জ্বালায় আছে সে।

এই ফিলোসফির কোন ব্যাখা নেই। কেউ দিতে পারবেও না। যেই তৌসিফ তালুকদারের ধারে কাছে কেউ ঘেঁষার সাহস পায় না সেই তৌসিফ তালুকদার এখন বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আদর-সোহাগ পাওয়ার জন্য ভেতর ছটফট করে তার। মন চায় এই আদর আদরটার সাথেই থাকতে। সারাক্ষণ চোখ ভরে একেই দেখতে।
বেল বাজতেই তৌসিফ উঠে দরজা খুলে। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরে ফর্মাল লুকে একজন লোক এসে ওয়াইনের একটা বোতল এবং কিছু আইস কিউব সাইডে সাজিয়ে রেখে গেলো। ইংরেজিতে কোনরূপ জড়তা ছাড়াই হাসিমুখে তাদের স্বাগতম জানিয়ে কিছু সুন্দর বাক্য আওড়িয়ে গেলো। তার কথা ছিলো এই যেমন,

“আপনাদের রাত মিষ্টি মধুর হোক”
এছাড়াও হাংকি পাংকি আরো অনেককিছুই বলেছে সে। পৌষ উত্তরে চমৎকার এক মুখ ভ্যাংচি দিয়েছে। লোকটা থতমত খেলেও মুখ হাসি-হাসি রেখেছে। বলা যায় এটা তাদের দক্ষতা। কাজের ক্ষেত্রে এরা যথার্থ পটু। লোকটা যেতেই চোখ সিকায় তুলে পৌষ প্রশ্ন করলো,

— হানিমুনে এসেছে এসব গিলতে?
— কিসব বলো তুমি হানি? বউ থাকতে আমি এসব ধরব?
— না থাকলে ধরেন?
— টুকটাক।
— বাহ্। ভালো তো। আসুন খাই।
অবাক কণ্ঠে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,
— কি খেতে চাও?
— মাগনা সবই খাব আমি।
তৌসিফ গরম পানির কেতলিটা চালু করে পর্দা টানতে টানতে বললো,
— এখানে কিছুই মাগনা না।
— তাহলে আপনি টাকা দিয়ে কিনে ছাইপাঁশ খাচ্ছেন? বাহ্। খুবই ভালো। এসব খেতেই এখানে এসেছেন? এখনই দেশে যাব আমি। আপনি থাকুন এখানে।
কেতলিতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। তৌসিফ গিয়ে দুটো কাপে কফির স্লেশে ঢেলে গরম পানি দিলো। পৌঢ উত্তর না পেয়ে গমগমে স্বরে বললো,

— কথা বলেন না কেন হ্যাঁ?
তৌসিফ কাপ নিয়ে একটা পৌষ’র হাতে দিয়ে বললো,
— তুমি এত কথা কিভাবে বলো? আমার কি যে ভালো লাগে। মন চায় সারাটাক্ষন তোমাকে শুনি।
— আপনি কি আমাকে রেডিও বলে অপমান করছেন?
তৌসিফ বিছানায় পা তুলে বসে হাসলো। পৌষ’র গা ঘেঁষে বসে বললো,
— অনেক ঠান্ডা।
— তাহলে মরুভূমিতে যেতেন। গরম লাগতো।
— মরুভূমিতে হানিমুন। নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া।
— যাবেন নাকি?
— কেন নয়?
— কবে যাবেন?
— নেক্সট হানিমুনে।
— এতই সোজা?
— বউ তো আমারই। সোজা না কঠিন তা আমি দেখে নিব।
— কফিটা মজা লাগছে।
— ল্যাটের টেস্ট ভালো।
— বিস্কুট নেই এখানে?
— ক্ষুধা লেগেছে?
— না কিন্তু এটার সাথে বিস্কুট ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।
তৌসিফ ফোন হাতে তোলা মাত্রই পৌষ কেড়ে নিলো। তার মুখটা হাসি হাসি। তৌসিফ এক ভ্রুঁ উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,

— কি হলো?
— পিঠ থাপ্রে দিন আমাকে।
— কিহ!
— আরে দিন না।
তৌসিফ ঠাই বসে রইলো। পৌষ নিজের পিঠে নিজেই থাপ্পর দিয়ে বাহবা দিলো। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে দুটো বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বললো,
— এটা প্লেন থেকে চুরি করে এনেছি। বাথরুমে যাওয়ার সময় সাইডে দেখেই দুটো তুলে নিয়েছিলাম। দেখলেন কিভাবে চলতে হয়? আমার জামাই….
— তোমার জামাই এর কষ্টের টাকা। জানি তো আমি। এসো এখানে। কফি ঠান্ডা হচ্ছে।
পৌষ মহা আনন্দ নিয়ে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেলো। তৌসিফ বউয়ের কপালে হঠাৎ নিজ থেকে চুমু দিতেই পৌষ চাইলো মুখ তুলে। তৌসিফ ওর গালে হাত রেখে বললো,

— সবসময় এমন থেকো পৌষরাত। কখনো বদলে যেও না। আমাকে ফেলে যেও না।
— কেন যাব?
— যেতেই দিব না।
তৌসিফে’র গালে হাত রাখে পৌষ। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— আপনি যে দেখতে অনেক সুন্দর তা কি জানেন?
— জানি।
— কে বললো?
— মা বলতো।
— শাশুড়ীর সাথে আমি একমত। আমি শুধু সুন্দর না বরং অতি সুন্দর। পুরুষদের এত সুন্দর হতে নেই।
তৌসিফ ওকে টেনে বুকে ফেলে। গলায় হাত দিতেই ঝটকা মে’রে উঠে বসে পৌষ। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

— ভুলে যাই নি কিন্তু। এখন নয় ছয় কিছুই মানব না। একটু আগে গোসল করেছি।
— কাম অন হানি……
— উঁহু।
— প্লিজ।
— কু’ত্তায় কামড়ালেও না।
— আজব কুকুর কেন কামড়াবে?
— ঘুমান সাহেব। আজ ডাল গলবে না কিছুতেই।
— রাগ পরে দেখিও তোতাপাখি।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৪

তৌসিফ নানান কথা বললো। পৌষ অনড়ভাবে বসে রইলো। আচমকা টানে ওকে নিজের কাছে নিলো তৌসিফ। পৌষ গাঢ় চাহনি দিলো ওকে। তৌসিফ চোখে হাসে। অদ্ভুত ভাবে পৌষ’র রাগ পরে গেলো। যেন বরফের দেশে দ্বিপ্রহরের সূর্য উঁকি দিলো। টলমল করছে সমুদ্র। পৌষ বিগলিত হলো। নিজে আগ বাড়িয়ে তৌসিফে’র কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— সুন্দর পুরুষ।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৬