প্রেমসুধা পর্ব ৬১
সাইয়্যারা খান
হঠাৎ ই বৈরী হাওয়া বইতে লাগলো অস্ট্রেলিয়ায়। বাইরে ঝড়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিউজ মিডিয়া সরাসরি সম্প্রচার করে যাচ্ছে আবহাওয়া। ঝড়ো হাওয়ার মাঝে উত্তাল পানি। মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় মানুষ জমে যাওয়ার উপক্রম। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট ততক্ষণে বন্ধ। যাতায়াত ব্যবস্থার বন্ধ করার অন্যতম কারণ হলো দূর্ঘটনা প্রতিরোধ। টিভির সাউন্ডটা আরেকটু কমিয়ে দিলো পৌষ। রিমোটটা পাশে রেখে এদিক ওদিক ফোন খুঁজলো। তার ফোনটা পাওয়া যাচ্ছে না। নাক আর মাথা জ্যাম হয়ে আছে। মুখ খুলে শ্বাস নিলো কিছুক্ষণ বড় বড় দম ফেলে। বুকের ভেতর অস্থির লাগছে তার। তৌসিফ এখানে নেই। বাইরে অবস্থা ভয়ংকর। শরীর ঠেলে বহু কষ্টে উঠে বসলো পৌষ। কোমড়ের দিকটা ব্যাথার দরুন চোখ মুখে খিঁচে নিলো। নিজেই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। চোখ দিয়ে টুপটাপ পানি পরলো কতক্ষণ। চাপা স্বরে কেঁদে বিরবির করলো,
— কোথায় গেলেন আপনি?
তৌসিফ বেরিয়েছে ঘন্টা তিন পার হলো। পৌষ এবার উঠে দাঁড়ালো। এক দুই পা করে এগিয়ে আলমারির কাছে এসে নিজের কাপড় নিলো। পরণে থাকা তৌসিফে’র বড় মোটা হুডিটা খুলে নিজের জামাটা গায়ে জড়ালো। তৌসিফ কোথায় সে জানে না৷ আবছা আলোয় ও ফোন পাচ্ছে না। এদিক ওদিক খুঁজেও যখন পেলো না তখন আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এলো কাউন্টারে। ম্যানেজার ওকে দেখা মাত্র এগিয়ে এলো। পৌষ জানালো তৌসিফ এখনো ফিরে নি। ম্যানেজার আসস্ত করে জানালো তৌসিফ ফিরছে। চিন্তার কিছু নেই।
পৌষ ভরসা পায় না৷ এক বিন্দুও ভরসা সে পায় না। বাইরে বাতাস তান্ডব চালালো। পৌষ সেদিকে তাকিয়ে এক দুই পা বাড়ালো বাইরের দিকে। ম্যানেজার ঘাবড়ে গিয়ে তার পিছু নিয়ে বারংবার নিষেধ করলো সেদিকে না যেতে কিন্তু পৌষ শুনলো না। এই শীতের দেশে তার উত্তপ্ততর হৃদয় কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এটা দেখা যায় না। ছোঁয়া যায়। শুধু অনুভব করা যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হোটেলে’র বাইর দিকে মেইন ফটকের ভেতর বসার জন্য সুন্দর বেঞ্চ করা। পৌষ এগিয়ে এসে সেখানে বসলো। তার পা দুটো চলছে না। এখান থেকে কোথায় যেতে হয় তাও পৌষ জানে না। গাড়ি কোথায় পাওয়া যায় তাও জানে না৷ সারি সারি গাড়ি লন সাইডে রাখা। রাস্তা-ঘাট তো বন্ধ। পৌষ কোথায় যাবে? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তৌসিফ তালুকদার’কে?
শুকনো মুখে পৌষ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঝড়ের বেগে আসা বাতাস গুলো তার মুখে ঝাপ্টা দিচ্ছে। নাকে ঠান্ডা বাতাস লাগাতে ব্যথা হচ্ছে। ঠোঁট গুলো খুব শিঘ্রই ফেঁটে ফেঁটে এলো। ফ্যাকাসে মুখে পৌষ পথ চেয়ে রইলো।
ম্যানেজার সহ এবার একজন মেয়ে স্টাফও এলো। তারা চেষ্টা করেও পৌষ’কে সরাতে পারলো না। অগত্যা মেয়ে স্টাফ একটা চাদর এনে ওর গায়ে দিয়ে সরে এলো। পৌষ তখনও ঠাই বসা। বিরবির করে বলতে লাগলো,
“কোথায় আপনি? কোথায় গেলেন? আমার কথা কি ভুলে গেলেন? আপনার এত এত ভুল সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে ভুলতে পারি না? এই ঠান্ডার প্রকোপে’র মাঝেও কেন আমার আমার ভেতর জ্বলছে? আপনি আমায় কোন প্রেমে মত্ত করে গেলেন? কেন একা ফেলে গেলেন? আমি কি ভুল ছিলাম? শাস্তি কেন আমার বেলায় এত কঠিন হয়? আপনি কি বুঝেন না? নাকি বুঝেন বলেই আমার শাস্তির সময় বৃদ্ধি করেন? ফিরে আসুন। ফিরে আসুন।”
চোখ দুটো সহসা লাল হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে রাত কাটিয়ে সকাল হলো। ঝড় কমেছে কিছুটা। মানুষ জন চলা ফেরা শুরু করলো। কেউ কেউ পৌষ’কে দেখলো। ম্যানেজার তার নাস্তা পাঠালেও পৌষ ঘুরে তাকালো না৷ তার দৃষ্টি নড়ে নি। সে দেখতে চায় কতক্ষণ তৌসিফ তাকে অপেক্ষা করায়। সময় গড়িয়ে তখন দুপুর। খুবই অল্প সূর্য উঁকি দিলো। এক ফালি রোদ সেকেন্ডের জন্য পৌষ’র উপর পরে পরক্ষণেই হারিয়ে গেলো। দুপুর হতেই লোক যাতায়ত বাড়ে। এত মানুষ আসে অথচ তৌসিফ আসে না।
কালো রঙের একটা গাড়ি লনে আসলো। পৌষ তখনও সোজা দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে। মোটা জ্যাকেট গায়ে গাড়ি থেকে নামলো তৌসিফ। সোজা হেঁটে ভেতরে ঢুকবে সে। খুবই তাড়ায় আছে যেন৷ সে তার হৃদয়ের এক টুকরো এখানে রেখে গিয়েছে। তারাহুরোয় সে আশেপাশে খেয়াল করে না। মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। হঠাৎ ই কপালে ভাজ পরলো। ছাই রঙা চদর গায়ে মুড়িয়ে কেউ একজন বসে আছে বেঞ্চে। তৌফিক তড়িৎ বেগে পিছু ফিরলো। তার হৃদপিণ্ড দাপিয়ে উঠলো ততক্ষণাৎ। সমস্ত শরীর যেন সেকেন্ডের জন্য প্রতিক্রিয়া জানাতে নারাজ হলো। শক্ত-পোক্ত মুখ চোখ হঠাৎই অসহায় হয়ে এলো। অতিরিক্ত চাপ অনুভব হলো তার। দুই একবার এদিক ওদিক তাকালো। সবই তো ঠিক আছে তাহলে কেন তৌসিফ নিজে ঠিক নেই? এই মেয়েটা। এই মেয়েটা পুতুলের মতো এখানে বসে আছে। কিন্তু কেন? এটা কি তার বসার জায়গা? তৌসিফ কি তাকে এখানে রাখতে বলেছে? কেউ কেন তার কলিজার যত্ন নেয় না? কেন তৌসিফ কারো ভরসায় রেখে গেলে বারবার হতাশ হয়? টাকা দিয়েও কেন কাজ হয় না? কেন হয় না? তৌসিফ কি বলে যায় নি ওর জানটার খেয়াল রাখতে? তৌসিফ কি টাকা দিয়ে যায় নি? তাহলে কেন পৌষ এখানে থাকবে? তৌসিফ বাদে কেন কেউ ওর তোতাপাখি’র খেয়াল রাখে না? তৌসিফে’র কান্না পেলো আজ। ভীষণ কান্না পেলো। তার মনে পরলো তার মায়ের কথা। মা বাদে কেউ তার খেয়াল রাখতে পারে নি৷ কখনোই পারে নি। তায়েফা আপা সংসার সামলে তৌসিফ’কে ততটা খেয়াল করতে পারে নি। সে ভালোবেসে গিয়েছে শুধু।
এতিম হওয়া বড় এক জ্বালার বিষয়৷ এদের অতি আপন বলতেও কেউ থাকে না৷ এই এক পৌষ এলো জীবনে অতঃপর খুব কম সময়ই তৌফিক নিজের খেয়াল রেখেছে। তার পায়ের নখটা সহ এই পৌষ কেটে দেয়। এত ভালোবাসা কেন ফিঁকে পরে যায় বারবার। উত্তর তৌসিফ জানে না।
দুই এক পা বাড়িয়ে এগিয়ে এলো বেঞ্চে’র কাছে। আস্তে ধীরে বসলো। একদম গা ঘেঁষে। পৌষ মাথা নিচু করে নিলো। তার দৃষ্টি গোটা এক রাত, এক সকাল পর সরলো এখন৷ তৌসিফ দুই হাতে ওকে টেনে নিজের বুকে নিলো। পৌষ উষ্ণতা পেলো। মুখটা বুকে রাখলো। তৌসিফ ওর মাথাটা চেপে ধরলো সেখানে। কেউ কোন কথা বললো না। খুব যত্নে ওকে কোলে তুললো তৌসিফ। ওরা এগিয়ে গেলো রুমের দিকে। বিছানায় পৌষ’কে রেখে তৌসিফ দরজা আটকালো। রুমে হিটার আছে তবে অফ করা। তৌসিফ তারাতাড়ি তা অন করলো। গতরাত থেকে তাপমাত্রা শুধু কমছে। এগিয়ে এসে গায়ের জ্যাকেট খুলে বিছানায় উঠে গেলো। এক টানে বুকে নিলো পৌষ’কে। আজব, আজ পৌষ কাঁদছে না৷ তৌসিফ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। বুকে নিয়ে মোটা কম্বলে ঢাকলো। পৌষ’র পুরো শরীর জমে আছে। তৌসিফ দেখলো ওর নামটা ঠান্ডা হয়ে আছে। ও জানে একটু ঠান্ডায়ই নাক ব্যথা করে পৌষ’র। তারাতাড়ি মাথা সহ ঢেকে নিলো৷ তৌসিফে’র শ্বাস-প্রশ্বাসে শিঘ্রই উষ্ণ হলো হাওয়া। পৌষ আরাম পেলো। তৌসিফ ওর কপালে সময় নিয়ে চুমু দিলো। ফাঁটা ঠোঁটজোড়ায় আঙুল বুলালো বেশ কিছুক্ষণ। পৌষ ফ্যাচফ্যাচ করে বললো,
— বাড়ী যাব না?
— যাব।
— ওওহ।
তৌসিফ ওদের মাথা বের করে। পৌষ’কে ধরে বসিয়ে ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে কল লাগায় খাবার দিয়ে যেতে। মিনিট পাঁচের মাঝেই হাজির হলো খাবার। পৌষ চুপচাপ খেলো। ওর ক্ষুধা লেগেছে। তৌসিফ নিজেও গোসল সেরে এসে পাশে বসে খেলো। নিজ হাতে পৌষ’র মুখটা মুছে দিয়ে বললো,
— এখন শুনবে?
— শুনব।
গতরাতে তৌসিফ ঠান্ডা মাথায় পৌষ’কে বলেছিলো সে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিবে পৌষ’কে। পিয়াসী এবং ওর গল্প যা আজও অজানা তা জানাবে তৌসিফ। তার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে। পৌষ মেনে নিয়েছে। সে ধৈর্য ধরেছে। গতরাতের আদরটুকুও স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়েছে। পৌষ’র মত মেয়েরা মানুষ চিনে। পৌষ এতটুকু তো জানে তৌসিফ তাকে অবহেলা করবে না। সে ভালোবাসা চিনে। ভালোবাসার ধরণও চিনে। যেই পৌষ’র জন্য আজ পর্যন্ত তেমন কেউ ব্যস্ত হয় নি সেই পৌষ’র জন্য তৌসিফ সবসময় দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। একদিনের আসা প্রশ্নের মুখে পৌষ এতদিনের ভালোবাসা ভুলবে না। তার দ্বারা সম্ভব না।
তৌসিফ পৌষ’র অল্প লাল হওয়া গালে হাত বুলালো। জিজ্ঞেস করলো,
— ব্যথা আছে?
— না।
— আচ্ছা, আমি বলছি তবে তার আগে ওয়াদা করো আমাকে আর ভুল বুঝবে না পৌষরাত। এই প্রথম কৈফিয়ত দিচ্ছি কাউকে আমি। এমন কাজের কৈফিয়ত যার প্রয়োজন আমার জীবনে নেই৷ না আছে গুরুত্ব।
— কৈফিয়ত দিয়ে যদি সবটা সুন্দর হয় তাহলে দিতে মন্দ কি?
— এত ভালোবাসা আজ পর্যন্ত কাউকে বসি নি নাহয় কৈফিয়তে’র প্রশ্নই উঠতো না।
তৌসিফ একটু থামলো৷ পৌষ’র হাত দুটো ধরে বলা শুরু করলো,
— আমার পিঠে কালো দাগ দেখে একদিন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ওটা কিসের দাগ। পায়েও দাগ দেখেছো।
— হ্যাঁ।
— পিয়ু’র সাথে ডিভোর্সে’র পর একরাতে ড্রিংক করে গাড়ি চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। ব্লাড রেয়ার হওয়ায় পাওয়া যায় নি। সেদিন আমাকে র’ক্ত দিয়েছিলো সোহা। ওর সাথে র’ক্তের কোন সম্পর্ক আমার নেই তবুও ও আমাকে সেদিন যেই উপকার করেছিলো তার বৈদলতে আজ আমি এখানে বসে আছি। পাঁচ মাস হাঁটতে পারি নি। বাসায় ছিলাম। সোহা আমাকে সাহায্য করেছে বিভিন্নভাবে…
কথা শেষ হওয়ার মাঝে পৌষ প্রশ্ন করে,
— কেমন সাহায্য?
— এই তো বউ বলে কথা।
— বলুন ঠিকঠাক।
— বিজনেসের কাজে সাহায্য করেছে। সেই সুবাদে দুই এক ঘন্টা রুমে থাকা হতো ওর। কাজের লোকরা ভাবীদের কানে এসব কথা দিলো। তারা তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়ালো সোহা’র সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক। কেউ কেউ বলতো আমি ওকে বিয়ে করে নিয়েছি। কেউ বলতো, “কাজের মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক”। ওপর ওয়ালার কসম কেটে বলছি, আমার সামনে আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা বলে নি। যদি বলতো হয়তো উত্তর আমি দিতাম ভিন্ন ভাবে। ঘরের শক্র বিভীষক। আমার দুই ভাবি ছড়িয়েছে এই কথা।
সোহা’র ঐ উপকারের বিনিময়ে আমি কখনোই ওকে তেমন কিছু বলতাম না৷ উল্টো আমার জন্য একটা মেয়ের চরিত্র খারাপ হয়েছে সকলের দৃষ্টিতে। শেষ সময়ে হয়তো ও খারাপ করতে চেয়েছে তাই সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে ওকে পাঠিয়েছি আমি। সেখানে ও বুঝবে জীবন কোথায় ছিলো ওর। তবে হ্যাঁ, মেহেদী ভালো ছেলে তার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। আমি ওর খারাপ করি নি। যেই লোভ ও করেছে সেই কিছু সম্পত্তি ও ওকে দিয়েছি।
দম আটকে পৌষ প্রশ্ন করে,
— পিয়াসী কেন বললো সোহা’র কথা?
— আমি কি জানি?
— মানে?
— এটা পিয়ু জানে। পিয়ু থাকাকালীন সোহা খুব কম আমাদের সাথে ছিলো। বেশির ভাগ গ্রামে ছিলো। আর ওর সাথে পিয়ু’র সম্পর্ক ভালো ছিলো। আমি আন্দাজে বলতে পারি, হয়তো তোমাকে নাড়া দিতেই ও সোহা’কে টেনেছে?
— কিভাবে জানলো?
তৌসিফ বিরক্ত হলো। বললো,
— হাউ ক্যান আই নো?
পরক্ষণেই বললো,
— বড় ভাবী বলতে পারে।
— উনি কেন বলবে?
— বড় ভাবীর সৎ বোন পিয়ু।
” কিহ”!
এক প্রকার চিৎকার করে উঠলো পৌষ। তৌসিফ হাসলো। বললো,
— জীবন রহস্যে ঘেরা পৌষরাত। যত গভীরে ঢুকবে তত অতলে হারাবে।
— ও কেন বললো ভিন্ন নারী সঙ্গী?
— ডিভোর্সের পর চিল ছিলাম৷ পিয়ু এক বিদেশি ছেলের সঙ্গে ভেগেছিলো। আমার মুখে কালি দিয়ে ও পালিয়েছিলো। ক্লবে যাতায়াত বেড়েছিলো। তবে আমার বুকে হাত রেখে বলছি পৌষরাত, দ্বিতীয় নারী আমার জীবনে তুমি। পিয়ু’র পর তুমি বাদে কাউকে গভীর ভাবে স্পর্শ করিনি।
— হালকা ভাবে করেছেন?
— হুঁ।
— কিভাবে?
— ঐ হাত ধরা পর্যন্ত।
— লুইচ্চামি তো ছাড়লেন না।
— ওহহো পৌষরাত। একবার ধরেছিলাম ভুলে। বন্ধুদের পাল্লায় পরে। তবে ঐ হাতই ধরেছিলাম। কিসিমিসি হয়নি।
পৌষ চুপ রইলো। ভেতরে খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। ও জানে তবুও কেন জানি তৌসিফ আগে কারো ছিলো তা আজ মানতে কষ্ট হচ্ছে। তৌসিফ পৌষ’র গালে চুমু দিয়ে বললো,
— এটার জন্য আমি খুব করে মাফ চাইছি।
— আচ্ছা, যেদিন আমরা এখানে আসব সেদিন হেডলাইনে দেখলাম আপনার উপর থেকে সকল মামলা তুলে নেয়া হয়েছে তাহলে কাল রাতে আপনি মামলার কথা বললেন ফোনে। কেন?
তৌসিফ মৃদু হাসলো। বললো,
— ঐ যে বলেছিলাম না, “কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না”। আমি ভেবেছিলাম রাজনৈতিক কোন কারণে আমার জাহাজে মাদকাদ্রব্য চালান করা হয়েছে কিন্তু না সেই কাজ করেছিলো পিয়ু’র বর্তমান জামাই। পিয়ু’র নামে আমি কিছু সম্পদ লিখে দিয়েছিলাম। যা ও ভেগে যেতেই সরিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে জাহাজেরও কিছু ছিলো। ও সেটা হাতিয়ে নিতেই ঐ চাল চেলেছিলো। দেশে এর বিচার সম্ভব না। তাই একই সাথে হানিমুন আর কোর্টের কাজ সামাল দিতে এখানে আসা। কাল থেকে আজ পর্যন্ত পিয়ু’র স্বামী’কে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে এলাম। এত দেড়ী হলো কারণ আবহাওয়ার কারণে রাস্তা বন্ধ ছিলো।
ও জানতো আমি এজন্যই এসেছি তাই শেষ সুযোগে সংসার ভাঙতে তোমাকে টার্গেট করেছিলো আর ও সফল হয়েছে পৌষরাত। দুই মিনিটে তুমি বিশ্বাস ভেঙে ফেললে।
পৌষ অবাক হয়ে বললো,
— গতরাত থেকে ভাবছিলাম আপনি আমাকে কুকুর বলেছেন।
তৌসিফ কপাল কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— মাথা গেছে তোমার? এইখানে শুধু আমি ছাড় দিয়েছিলাম বলে পিয়ু এত বাড় বাড়তে পেরেছে নাহয় এতদিন থালা হাতে ভিক্ষা করত। এখন কোর্টের চক্কর কাটবে কয়েকবছর। তোমার মাথা এতদিকে চলে এই দিকে চললো না?
পৌষ নিজের ভুল সরাসরি ঢাকতে চাইলো। হুরমুর করে বলে উঠলো,
— সব বুঝলাম কিন্তু এখনও ঐ ** কে পিয়ু পিয়ু করছেন কেন? লজ্জা করে না?
তৌসিফ বিরক্ত হলো। বললো,
— ও আমার ক্লাসমেট ছিল পৌষরাত। ওকে আমরা কেউই কখনো পিয়াসী ডাকি নি। সবাই পিয়া অথবা পিয়ু ডেকেছি।
পৌষ সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে চুপ হয়ে গেলো। তৌসিফ ওকে কাছে টানলো। নিজের কোলে বসিয়ে কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— গতরাতে বেশি কষ্ট পেয়েছিলে?
— হুঁ।
— এখন কমলো?
— হুঁ।
— আদরে ব্যথা বেশি ছিলো?
— একটু একটু।
— এখন ঠিক আছো?
— একটু একটু।
— আমি কাছে না থাকলে এমন দেবদাসী হয়ে যাও কেন পৌষরাত? আমাকে জ্বালাও কেন? তখন এভাবে কেন বসে ছিলো? তোমাকে দেখে আমার কেমন লেগেছে বলো তো?
— আমার তো ভেতর জ্বলে যাচ্ছিলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই।
— যদি কেউ হয়?
— কেন আপনি ছেড়ে দিবেন আমাকে?
— জানে মে’রে দিব তবুও ছাড়ব না।
— তাহলে?
— তাহলে বুঝাচ্ছি তোমাকে।
— একটুও না৷ দামড়া ব্যাটা। আমি ম’রে যাব। ছাড়ুন।
পৌষ’র কথায় তৌসিফ হেসে ফেললো। আলগোছে ওকে বুকে আগলে নিলো। ও জানে পৌষ ওকে ছাড়বে না। সেই রাস্তা তৌসিফ রাখে নি। তাদের বিবাহ নামায় এটা লিখা ছিলো। পৌষ স্বেচ্ছায় কোনদিনই তৌসিফ’কে তালাক দিতে পারবে না। হয়তো পৌষ জানে না কিন্তু তৌসিফ সহ বাকিরা জানে। তবুও কেন জানি তৌসিফ একটু উনিশ, বিশ হলেই হয় পায়। পৌষ’কে হারানোর ভয়।
পৌষ আস্তে করে বললো,
— দেশে কবে যাব?
— আর কিছুদিন থাকি?
— একদিনও থাকতে চাই না।
— কারণ?
— আমি ভয় পাই।
— কিসে?
— আপনাকে হারানোর ভয় হয় আমার। যদি এখানে হারিয়ে ফেলি?
তৌসিফ পৌষ’র গালটায় আদর দিলো। চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বললো,
প্রেমসুধা পর্ব ৫৯
— খুব সরি আমি।
— আমিও।
— তোমার আর প্রশ্ন আছে?
— আপাতত নেই।
বলেই পৌষ হাসলো। সে ভালোবাসে এই পুরুষটাকে। বয়সে বড় মানুষটাকে দেখলেই এখন প্রেম প্রেম লাগে। তৌসিফ নামটাই তার কাছে এখন আস্ত এক ভালোবাসা।