প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৩

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৩
সাইয়্যারা খান

সারি সারি রাজহাঁস দল বেঁধে পুকুর ঘাটে নামছে। এগুলোর মালিক তুহিন। সখের বশে রাজহাঁস পালে সে। এখানে প্রায় পঞ্চাশটার অথবা তার অধিক হাঁস আছে। এগুলো দেখে রাখে আবার দু’জন লোক। ভোর হতেই এদের ঘর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন এক গুচ্ছ সাদা মেঘের ন্যায় তারা দৌড়ে যায় ঘাট পাড়ে। রাজহাঁস গুলো পানিতে নামে না ততটা। ঘাটের চারপাশে বসে থাকে। তুহিন প্রায়শই ভোরে দেখতে বের হয়। মাঝেমাঝে নিজেই পানিতে ভুসি গুলিয়ে একেকটার মুখের সামনে গামলা নিয়ে খাওয়ায়।

মানুষের নানান সখ, তুহিনের এটা হঠাৎ জেগে ওঠা এক সখ। সখটার সূত্রপাত সুন্দরবনের এক ভ্রমণ। ভ্রমণের সূত্রপাত রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ থেকে পালানো। এভাবে বলাটা অবশ্য ভুলই হচ্ছে। পালাতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিলো। যেভাবেই হোক একরাতের মধ্যে শহর ছাড়তে হবে। পরিচিত একজনকে সাথে নিয়ে সুন্দরবন গিয়েছিলো তুহিন। সেখানেও কড়া নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা মেহমান হয়েছিলো এক দরিদ্র দম্পতির ঘরে। ফরেস্ট অফিসার আবার তাদের দলের। তাতেই সুবিধা হলো। সেবার তুহিন প্রকৃতির মায়ায় জড়ালো। বাকহারা রাজহাঁসের মায়ায় জড়ালো। নিজেই ফেরার পথে দুটো কিনে এনেছিলো। পরে বিরাট পরিসরে পালন শুরু করলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজও তুহিন বেরিয়ে এসেছে সকাল সকাল। গতরাতের নেশাটা হুট করেই আধ রাতেই ছুটে গেলো। তুহিন এতে বিরক্ত হয়। তার পাশেই পলক তখন ঘুমাচ্ছিলো। তুহিনের হঠাৎই কিছুটা মায়া জাগে পলকের জন্য। কিছুটা সময় ঘুমন্ত পলকের মুখ, হাত হাতড়ে দেখে। আগে যেমন পলকটাকে জড়িয়ে ধরলেই শান্তি পাওয়া যেতো এখন তা পাওয়া যায় না। নেশা যাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে প্রেমের সুধা চেনানো বড়ই কঠিন। তুহিন নিজেই নিজের প্রেমের ধ্বংস ডাকছে। প্রতিনিয়ত ডেকেই যাচ্ছে।
বাড়ীর গেটের বাইরে পুকুর। সেখানেই চেয়ার নিয়ে বসেছে তুহিন। পরণে কালো টিশার্ট আর সাদা লুঙ্গি। পায়ের উপর পা তুলে সে দেখছে রাজহাঁস গুলোকে।ঘরের নাম্বারে ডায়াল করে কলিকে বলে,
“নিচে কফি পাঠা তো।”
“জি, মামা।”

রনি, টনি সহ কয়েকজন এদিকটায় চলে এলো। রনি আর টনি মূলত তৌসিফের কাজ করে। সকাল থেকে রাত তৌসিফের পেছনেই ছুটে। আজ তারা বাড়ী ফিরে নি। রাতে নিচতলার অফিসেই ছিলো যেন মুখে নয় সত্যি অর্থেই তারা তৌসিফ’কে বড় ভাই মানে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় এই ভোরে তুহিনকে দেখে এগিয়ে আসে। আশেপাশে যারা হাঁটতে বেরিয়েছিলো মেইন রোড দিয়ে যাতায়াত কালে তারাও তুহিনকে দেখে এগিয়ে আসে। একটু সুযোগ পেলে সবাই যেন কথা বলতে চায় অথচ এই তুহিন এক আতঙ্ক বৈ কিছুই না৷ এর নামে রটে আছে সারা এলাকায় নানান বদনাম। এই খবর তুহিনও জানে তাইতো মুচকি হাসে। যেই মানুষ গুলো তার নামে তারই বদনাম জপ করে তারাই আবার একটু সুযোগ পেলে মুখ চেনাতে এগিয়ে আসে। দুনিয়াটা তেলবাজির কারখানা৷ ক্ষমতাবানেরা শুধু তেল চায়, গোলামী তাদের পছন্দ। যতটা বশ্যতা স্বীকার করবে ততটাই শিখড়ে পৌছাবে। একবার যদি মুখ ফস্কে সত্যি বেরিয়ে আসে তখন শুধু আয়ুর সংখ্যা উল্টো গুনবে। এটাই যেন এক অলিখিত নিয়ম।

ফজরের নামাজ পড়ে চপ্পল পায়ে সারা বাড়ী হাঁটে তাহমিনা। ছোট্ট কালের অভ্যাস। গাছপালা দেখাশোনা সহ নানান কাজ। আজকের কাজটা যেন একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। চড়ুই পাখিগুলো বাড়ীর পেছনের জঙ্গল থেকে আজ প্রচুর শব্দ করছে। মাঝেমধ্যেই আতঙ্কিত হয়ে উড়াল দিচ্ছে। তাহমিনার ঠোঁটে তখন জিকির। ডান হাতটায় বাদামী রঙের এক চকচকে তসবিহ। পেছন থেকে ডাক আসে,
“আপা।”
তাহমিনা জিকির শেষ করে। এগিয়ে আসে উঠানে। একজন বুয়া জানালো,
“ল্যাদা এসছে আপা।”
“বাড়ীর বাইরে বসা।”
বুয়া চলে যেতেই তাহমিনা ঘুরে দাঁড়ালো। তুহিনকে দেখে বিরবির করে কিছু বললো। তখনও জঙ্গল থেকে টগবগ করার শব্দ আসছে। তাহমিনা তাতে বিরক্ত। এত সময় কেন লাগছে?

হক বাড়ীতে বিয়ের আয়োজন চলছে। আজ চলন যাবে। দুই দিন বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান এ বাড়ীতে। পৌষ সহ বাকিরাও হাতে হাতে কাজ করছে। আজ বড় চাচি যথেষ্ট শান্ত। পৌষ’কে এরিয়ে যাচ্ছেন। দেখা যাবে নুন থেকে চুন খসলেই তার ছেলে বরযাত্রী নিয়েই যাবে না। ছোট চাচি ডালা গুলো সব টেবিলে রেখে ডাকলেন সবাইকে,
“অ্যই তোরা খেতে আয়।”

কেউ শুনলো না বোধহয়। গিয়ে বাচ্চাদের টেবিলে ডাকলেন। একে একে সবাই বসলো। বড়রা খেয়ে উঠেছে আগেই। দুপুরের খাবার আজ সন্ধ্যায় খাচ্ছে এরা। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়েছে দুইটায়। এরপর হেমন্তকে হলুদ গোসল করানো হলো। সব শেষ করতে বিকেল। চাচি ভাত চটকে মুরগী দিয়ে নিতেই ইনি, মিনি মুখ ঘুরালো। ওরা খাবে না। ছোট চাচি বারংবার বলেও যখন খাওয়াতে পারলো না তখন রাগে দুটো ধমক দিলো, এতেই যেন সর্বনাশ ঘটলো। পুরো বাড়ী মাথায় তুলে কান্না জুড়েছে দুই বোন। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য এগিয়ে এসে কোলে তুললো ওদের। ছোট চাচি গিয়ে ডাকলেন পৌষ’কে। পৌষ তখন ভাই-বোনদের কাপড় গোছাচ্ছে। এদিকে বাসরঘর সাজাতে মানুষ এসেছে। বাড়ীর এদিক ওদিক সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ার উপক্রম। আত্মীয় স্বজন দিয়ে গিজগিজ করছে যেন। ছোট চাচি অনুরোধের স্বরে বললেন,

“পৌষ, বিচ্ছু দুটোকে একটু খায়িয়ে দে না।”
“কাজ করছি।”
“একটু আয়। দুপুরের পর খায় নি।”
“তাতে আমার কি? আমিও না খাওয়া।”
“তুই আর ওরা এক হলি বল? আয় না সোনা, একটু খায়িয়ে দে। আমাকে বড় ভাবী ডেকেছে।”
পৌষ ছেলে দুটোকে কাজ বুঝিয়ে যেতে যেতে কাঠখোট্টা গলায় বললো,
” স্বার্থপরের দল। নিজের বাচ্চা না খেলে আমার কাছে আসে।”
ছোট চাচি শুনলেন তবে কথা বাড়ালেন না। তিনি সহ এই বাড়ীর কত মানুষই তো স্বার্থপর যারা পৌষ নামক মেয়েটাকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যাবহার করে।

হাতির উপর হেমন্ত। নিচে তার ভাই-বোন গুলো। ইনি, মিনিকে কোলে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু ওরা ভয়েই উঠবে না। বরযাত্রী বেশ আতশবাজি ফুটিয়ে যাচ্ছে বউ আনতে। পৌষ’র হাতে পাতাবো’ম। একটু পরপর এদিক ওদিক ছুঁড়ে দিচ্ছে ও। চৈত্র চরকি বো’মটা মাঝে ছাড়লো। হেমন্ত আগেই শাসিয়েছে, হাতির সামনে এসব করা যাবে না। হাতি উত্তেজিত হলে সমস্যা। পৌষ’কে দেখে বুঝার উপায় নেই খানিক সময় আগে বাসায় কি হয়েছে। হেমন্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো।
আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই বাসায়। তাদের মধ্যে থেকেই একজন চাচি বলেছিলো পৌষ’কে নিয়ে। কিছুটা তাচ্ছিল্য করেই বলেছিলেন,

“ওকে আগে বিদায় করে নিতে।”
কথাটা বলেছিলো বড় চাচিকে। বড় চাচির আপন বোন৷ তিনি দেখেন নি পৌষ এখানে ছিলো। তাই তো বলে ফেলেছিলেন,
“আপদ কি সহজে বিদায় হয়? আমাদের ঘাড়ে রেখে মা-বাপ খাল্লাস। এদিকে জ্বালায় ম’রছি আমরা।”
তার ভাইয়ের বউ তখন বলে উঠেছিলো,
“আপা, দুই দিন পর সম্পত্তি নিয়ে টান দিবে। বিয়ে দিতে ও কি কম খরচ?”
“খরচটা নিশ্চিত আপনার জামাই দিবে না কাকি।”
পৌষ’র কণ্ঠ কানে যেতেই আত্মা ছলকে ওঠে বড় চাচির। এদিকে পৌষ যেন আজ প্রচুর মুডে আছে। ঝগড়া করার জন্য গলা চুলকায় তার ঠিক যেমন কচু খেলে হয়। দুই আঙুলে গলা চুলকাতে চুলকাতে পৌষ এগিয়ে এলো। বড় চাচি কথা কাটাতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে ঘটনা ঘটেছে। খবর পৌঁছেছ হেমন্তের কানে। ও প্রায় সময় অবাক হয়। একজনের মা-বাবা না থাকলে তারই বাবার বাড়ীতে মানুষের ঠিক কতটা সাহস হলে এসব কথা বলে? পৌষটাকে মানুষ কেন দেখতে পারে না। ও কারই বা ক্ষতি করলো?

পালকিতে করে বউ নিয়ে রাত দুইটা নাগাদ বাড়ী ফিরেছে হেমন্ত। ভীষণ হইচই গেলো কিছুক্ষণ। দরজা আটকে রাখা থেকে শুরু করে টাকা আদায় সবই ঘটলো। সবাইকে বিদায় দিয়ে হেমন্ত কঠিন স্বরে বলেছে,
“সোজা ঘুমাতে যাবি।”
কেউ বুঝি শুনলো? রাত তিনটায় সবাই ভারী পোশাক বদলে দল বেঁধে এলো পৌষ’র ছোট্ট কুঠুড়িতে। টাকা পয়সা ভাগ হচ্ছে তখন। জৈষ্ঠ্য উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ভাজা মুরগী ওভেনে দিয়ে গরম করে নিয়ে এলো। আপার রাতে ক্ষুধা লাগে এটা তো সবাই জানে।
পাশের রুমে হেমন্ত শ্রেয়ার হাত ধরে বারান্দার দাঁড়িয়ে। পৌষ’র প্রতি হেমন্ত যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। শ্রেয়ার খারাপ লাগছিলো হেমন্ত বুঝে নি। পৌষ নাকি শ্রেয়াকে পোশাক বদলানো থেকে শুরু করে লেবুর শরবত সবটুকু করে গিয়েছে অথচ কাউকে একটা বার বলে নি। মেয়েটা এমনই। কাউকে বলে না। ধন্যবাদ গ্রহণ করা আর কারো চোখে বড় হওয়া কোনটাই যেন তার স্বাভাবে নেই। যখন যা মন চাইবে তাই করবে। হেমন্ত শ্রেয়ার হাত ধরে নরম স্বরে বললো,

“তোমাকে বিয়ের আগে একটা কথা বলেছিলাম শ্রেয়া, মনে আছে?”
শ্রেয়া চোখে হাসে যেন উত্তর করে হ্যাঁ, তার মনে আছে। হেমন্ত অল্প হেসে বলে,
” ওদের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য অনেক বুঝলে। বড় ভাই হই ওদের। নিজের বাচ্চাদের মতো পেলেছি। পৌষটা সবচাইতে ভিন্ন। ওকে দেখতে কঠিন মনে হলেও বুঝে নিবে ও নারকেল। বাইরে শক্ত ভেতর নরম।”
“খুব ভালোবাসেন?”
“খুউব।”
কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেমন্ত শুধু বললো,
“আমাকে ভালোবাসার উপায় শিখাই শ্রেয়া?”
“শিখে নিয়েছি আমি।”
“তাই?”
“হুঁ। আপনার বিচ্ছু বাহিনী আগেই শিখিয়েছে।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১২ (২)

হেমন্ত হেসে ফেললো। চোখের দিকে চাইলো গভীর দৃষ্টি ফেলে। কিছুটা হাসফাস করে বললো,
“আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারব শ্রেয়া? অনুমতি হবে?”
শ্রেয়া লজ্জায় পড়লো। নিজ থেকেই হেমন্তের বুকে মাথা রাখে। মাথার ঘোমটা সরতেই ভেজা চুলের ঘ্রাণ যেন মাতোয়ারা করে হেমন্তকে। হেমন্ত শক্ত করে বুকে জড়িয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে রাখে।
আকাশের চাঁদ তখন আলো বাড়ালো, তারা স্বভাবতই লুকিয়ে দেখলো। বিস্তর আকাশের নিচে এই প্রথম দু’জন মানব-মানবী বিপরীত কাউকে ছুঁয়েছে, এতটা কাছ থেকে।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৪