প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৮
সাইয়্যারা খান
প্রকৃতি আজ থমথমে ছিলো কিন্তু রাত বাড়তেই বদলে গেলো যেন। হুট করেই বৃষ্টি হচ্ছে। আগস্টের ত্রিশ তারিখ আজ। তৌসিফ তারিখটা আরেকবার মনে করলো। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা মাস হয়ে রইলো এই আগস্ট। কোনরূপ পূর্ব সংকেত ছাড়া আসা বৃষ্টিতে বাইরে ভিজে যাচ্ছে সব। ঘরে তখন মৃদু সোনালী এক আলোক ছটা রাজত্ব করছে। তৌসিফ অজান্তেই নিজের বাম পাশে তাকালো। বহু বছর যাবৎ খালি জায়াগাটা আজ পূর্ণ। পৌষ নামের মেয়েটা শুয়ে আছে এখানে। কপালে হাত ঠেকিয়ে সোজা হয়ে আছে। তৌসিফ বুঝলো না ও কি জাগ্রত নাকি ঘুম। দেখে আপাতদৃষ্টিতে ঘুমন্তই মনে হলো। সেটা মনে করেই হাত বাড়ালো পৌষর দিকে। হাতটা বোধহয় ছুঁয়েও দেখেনি মেয়েটাকে অথচ খ্যাঁকানি একটা এলো,
“বর্ডার পেরিয়ে কোথায় আসা হচ্ছে?”
“তুমি ঘুমাও নি?”
তৌসিফ অবাক হয়েই প্রশ্নটা করে। তাড়াক করে উঠে বসে পৌষ। মুখে বিরক্তিকর একটা ভাব এনে বলে,
“এই আলোয় মানুষ ঘুমায়? চোখের সামনে হলুদ বাত্তি ঝুলিয়ে রেখেছেন। ঘুম আসবে কিভাবে?”
“এটা তো খুব মৃদু আলো পৌষরাত। বন্ধ করে দিব?”
“খুব উপকার হতো।”
তৌসিফ উপকার করবে বলেও বিছানা ছাড়লো না। এটা দেখেই পৌষ এক ভ্রুঁ উঁচু করে। তৌসিফ হেলান দিয়ে বসা। সেভাবে থেকেই বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“চুলগুলো শুকিয়েছে না? বেঁধে ঘুমাও। নষ্ট হয়ে যাবে।”
পৌষ কানে শুনলো। মানলোও বটে৷ ডান হাতে চুলগুলো মুঠোয় ভরে চারটা প্যাঁচ দিয়ে খোঁপা করে ধ্রাম করে শুয়ে পরলো।এবারে একেবারে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে শুয়ে রইলো। ওর বিরবির তৌসিফের কানে এলো। লাইট বন্ধ না করায় ক্ষেপেছে। তৌসিফ পাশ থেকে রিমোট নিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শরীর লাগালো। চুলটা খোলাই ভালো ছিলো। এভাবে গিট দিয়ে রাখলে তো চুলগুলো নষ্ট হবে।
তাদের মাঝে বালিশ দিয়ে বর্ডার দেওয়া। খুব নিম্ন মানের একটা কাজ। তৌসিফ তালুকদার বুঝি বালিশের ধার ধারে? এক শর্ট দিয়ে বালিশ আউট করতে তার সেকেন্ড খানিকও সময় লাগবে না।
আজ চোখে ঘুম ধরা দিলো। তৌসিফ আরামে চোখ বুজে রইলো। যেভাবেই হোক বিয়ে তো হয়েছে। তৌসিফ হয়তো ভালোবাসে না কিন্তু সংসার তো চলবে। তৌসিফ নাহয় চালিয়ে নিবে। এই দস্যি মেয়ে নিয়ে একটু জ্বালা তো তাকে পোহাতেই হবে।
সকালের আলো ফুটেছে বেশ খানিকটা আগে। হক বাড়ীতে কেউই আজ সময় মতো উঠতে পারে নি। শনিবার বিধায় পিহা সহ জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র বেঁচেছে। নাহয় স্কুলটা বাদ যেতো। সকালটা আজ ভিন্ন হলো। একজনের অনুপস্থিতিতে বাকিরা কিছুটা হোটচ খেয়েছে। বাড়ীর বড়দের সাথে ছোটদের কথাবার্তায় সূক্ষ্ম এক চির দেখা যাচ্ছে। হেমন্তের ঘরেই কাল সবগুলো ছিলো। কেউ ডাক দেওয়ার সাহস পায় নি। বড় চাচা সহ চুপচাপ আছেন। ঘটনা যা বা যেটা হয়েছে তা ঠিক হয় নি তবে এটা হওয়ারই ছিলো। আজ নাহয় কাল পৌষ’কে বিয়ে দিতেই হতো। কিছুটা স্বার্থপরতা তিনি দেখিয়েছেন কিন্তু এতে পৌষর খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তৌসিফ তালুকদার এখন ক্ষমতায় নেই তাতেই তাদের যেই দাপট, ক্ষমতায় একদিন আসন্ন হলে সেই দাপট বাড়বে বৈ কমবে না।
বলা হয়, হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা। তৌসিফ তালুকদার সেই হাতি। পৌষ সেখানে ভালোই থাকবে। টাকাপয়সা সব দেখে বিয়েটা দিয়েছেন। সেজ চাচা টুকটাক কথা বললেও ছোট চাচা এসবে একদম চুপ। তার ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে। ছোট থেকে চোখের সামনে বড় হওয়া পৌষ, তাকে খুব করে চিনেন তিনি। তালুকদার বাড়ীটা একটু ভিন্ন। রহস্যময়। সেখানে কতটা টিকতে পারে পৌষ? আদৌ কি ও ভালো থাকবে? গতকাল ওর ঘরে গিয়ে কাজটা করা কতটা ঠিক হলো তাও যেন বুঝতে পারছেন না৷ বড় দুই ভাইয়ের কথা না করতে পারেন নি তিনি। আজ মেঝ ভাই থাকলে এই দশাটা হতো না৷ এভাবে বদনামও হতো না৷ পৃথিবীতে বাবা থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাও যদি না হয় অন্তত মা থাকাটা দরকার। মা-বাবা ছাড়া সন্তান থাকা উচিত না। সেই সন্তান গুলো কখনো পরিবার পায় না। না পাওয়ার হাহাকার তাদের হয় ভেঙে ফেলে নাহয় এক অ-ভঙ্গুর মানব মূর্তিতে পরিণত করে।
সিঁড়ি দিয়ে শ্রেয়া নেমে আসছে। বড় চাচি এগিয়ে এলেন তারাতাড়ি। শাশুড়ী হিসেবে তিনি কোনদিক থেকেই খারাপ নন অথচ তার চাচি সত্তাটা রুক্ষ, বেশ জটিল। শ্রেয়া এগিয়ে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন অস্থির কণ্ঠে,
“হে…হেমন্ত, ও ঠিক আছে? এখন কি অবস্থা?”
“ঘুম থেকে উঠেছেন আম্মু। ওনাদের জন্য নাস্তা বানাতে এলাম।”
“তুমি কেন বানাবে। ওরা আসবে না?”
“উপরেই খাবেন। ইনি, মিনির ক্ষুধা লেগেছে বেশ।”
ছোট চাচি একবার সাহস করে মেয়ে দুটো চাইতে চাইলেন কিন্তু সাহসটুকু তার জোগাড় হলো না। হেমন্ত থেকে তার সবচাইতে বড় সম্পদ গতকাল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন এই ভাই-বোন গুলোকে আলাদা করার ইচ্ছে তার নেই।
বড় চাচির হাতে হাতে ছোট চাচি খাবার গোছালেন। শ্রেয়া উপরে যেতেই বড় চাচা গম্ভীর কণ্ঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ওদের নিজেদের মতো থাকতে দাও। কেউ আগ বাড়িয়ে ঝামেলা করো না৷”
সেজ চাচি একটু চুপ রইলেন। কথাটা কি তাকেই বলা হলো? তাই তো মনে হচ্ছে।
হেমন্তর ঘরেই খাচ্ছে সবাই। পিহা আস্তে করে বললো,
“আমরা আপার কাছে যাই?”
খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন। তাদের আপা খুব তো দূরে না? পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। মসজিদের সামনে দিয়ে গেলে তিন চার মিনিট। হেমন্ত চুপ থাকাতে এবার ইনি, মিনি সহ জৈষ্ঠ্য, চৈত্রও বললো। চৈত্র একটু চুপ থেকেই আবার বললো,
“নাস্তা নিয়ে যাই হেমু ভাই? ভাবীর বাসা থেকেও তো এসেছিলো? আপাকে দেখেই চলে আসব।”
হেমন্ত চুপ রইলো। আচ্ছা, নাস্তা নিয়ে গেলে কেমন হয়? ছোট থেকে যেই বাড়ীতে মেয়েটা বড় হলো তাকে কাল জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। বাড়ীর কারোই কি একবার মনে হলো না তার পৌষটার শশুর বাড়ী নাস্তা পাঠাতে? ও কি এতটাই ফেলনা ছিলো? কই, হেমন্তের তো তা মনে হয় না। ও তো দেখতো পৌষ নামক ওর বাচ্চাটা বাড়ীতে টইটই করে কাজ করতো। বুয়া না এলে অতিরিক্ত কাজগুলোও করতো। হেমন্ত তো জানতো। অশান্তির জন্য ততটাও বলতো না। প্রতিবাদ করলেই নীরব এক যুদ্ধ হতো পৌষকে নিয়ে। শ্রেয়ার কথায় ধ্যান ভাঙে হেমন্তের।
“আপনার তো শরীর গরম হেমন্ত। জ্বর আসছে বোধহয়।”
ঘুম ভাঙতেই মাথার উপর সাদার মধ্যে আকাশি রঙের এক সিলিং নজর এলো। পৌষ বেশ এলোমেলো স্বভাবের। স্বভাব ফুটে ওঠে তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যেও। হাত-পা মেলে ঘুমাচ্ছিলো ও। ঘুম সুন্দর না তার। ঘাড় কাত করে একবার দেখেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। বাঁচা গেলো। তৌসিফ নেই এখানে। ব্যাটা গেলো কই? কথাটা ভাবতেই পৌষ উঠে। বিছানার চাদর ঠিক করে, কাঁথাটা ভাজ করে রাখে। বাথরুমের দরজা খুলে তখন তৌসিফ মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে। পৌষ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পেটানো দেহের এক পুরুষ। উঁহু, সুপুরুষ। বুকের লোমগুলো বেশ আকর্ষণীয় লাগলো ওর নিকট। হায় হায় পৌষ ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলো দুই মিনিট যা তৌসিফ তুরি বাজাতেই কেটে গেলো। পৌষ খুব সামান্য হকচকালো যা দেখে তৌসিফ মজার স্বরেই বললো,
“লজ্জা পেলে বুঝি?”
“সেটা আবার কি?”
“যেটা এখন তুমি পেলে।”
“লাজলজ্জা ভাই আমি পাই না। ওসব সাত বাজারে বিকিয়ে আনতে পারব। দেখলেন না, আপনার তিন বোন আর ভাবী কিভাবে পরখ করে আনলো। লজ্জা থাকলে বুঝি ওভাবে দেখতো?”
তৌসিফ গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো পৌষর পানে। সে জানে ক্ষতটা গভীর কিন্তু চাইলেও তৌসিফের করার মতো কিছুই ছিলো না। অতীত মানুষকে শিক্ষা দেয়। তালুকদাররা শিক্ষা ভুলে না। তাদের র’ক্তে ভুলে যাওয়া স্বভাবটাই নেই। তৌসিফ পৌষর দিকে এগিয়ে এসে গালে হাত রাখতে চাইলো কিন্তু সুযোগটা পৌষ দিলো না বরং দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
“ধরা পড়ে বিয়ে করেছেন আমাকে। দায়সারাভাবে পালিত এই বিয়ের দাম নেই বাজারে। চাইলেই আপনি আটকাতে পারতেন। তাহলে কেন নাটক করতে দিলেন?”
“তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”
“তাহলে বিয়ে করেছেন কেন? আমাকেই কেন? বিয়ে করবেন কিন্তু বউয়ের প্রশ্নের উত্তর দিবেন না। বাহ চান্দু বাহ।”
কথার ধরণে তৌসিফ একটু টললো। এবার হাত বাড়িয়ে পৌষর হাতটা ধরে ফেললো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শুধালো,
” বাজারে তোলার নাম নিও না পৌষরাত। সেই নামের তালিকায় শীর্ষে তোমার নামটাই রাখতো সকলে। কলঙ্ক শব্দটাই নারীর জন্য।”
“আমি দোষী নই।”
“বিশ্বাস করার লোক নেই পৌষরাত।”
“হাত ছাড়ুন আমার।”
“খুব ভুল ভাবছো তুমি। ছাড়ার জন্য ধরি নি। আমার হাতের মুঠ খুব শক্ত।”
“সেই শক্ত হাত নিয়ে দূরে যান। ছুঁ মন্তর ছুঁ, কালি কু’ত্তার *।”
“ছিহ্। এসব কি ভাষা পৌষরাত?”
“ভাষার খোটা দিবেন না খবরদার। আপনার তিন বোন… ”
তৌসিফ ওর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আটকালো। চোখ দুটো তার হাসলো যেন৷ পৌষর মাথা চাড়া দিলো ভিন্ন কিছু। এই চোখের মালিককে সে ভীষণ ভালোবাসে। তৌসিফ একটু ঝুঁকে বললো,
” বিছানা গোছানোর কাজ তোমার নয়। লোক আছে। তুমি আমার বউ পৌষরাত। তোমার কাজ আর দায়িত্ব ভিন্ন।”
পৌষ মুখ ভেঙালো। তৌসিফ থেকে মুচড়ে হাত ছাড়ালো। আলমারি খুলে তৌসিফ টিশার্ট পরতে পরতে বললো,
“খেতে এসো।”
পৌষ কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে। তৌসিফ একটু হকচকালো। ওহ, মেয়েটা তো এখনও ফ্রেশ হয় নি।
পৌষ বের হতেই দেখলো ছোটখাট দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। হাতে ঝাড়ু। পৌষর দিকে ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। পৌষ কপাল কুঁচকালো। মেয়ের দৃষ্টি দেখে বিছানা থেকে ওরনা নিয়ে গায়ে পেঁচালো। জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাই?”
“আমার নাম মিনু। আপনি ছোট মামি তাই না? আমি এখানেই থাকি। মামা পাঠাইলো। কইলো আপনাকে ডাকতে। খেতে আসুন ছোট মামি।”
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ১৭
শুদ্ধ, অশুদ্ধের মিশ্রণে কথা বলা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পৌষ বাইরে এলো। কোনদিকে যাবে ভাবতেই তৌসিফ ডাক দিলো,
“হানি, আ’ম হেয়ার৷ কাম ফাস্ট।”