প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৪

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৪
সাইয়্যারা খান

তালুকদার বাড়ীর তৌসিফের ফ্ল্যাটটা আজ মেহমানে ভর্তি। তায়েফা এসেছে বিধায় তুরাগ সহ উপস্থিত এখানে। তাহিয়া আর তিশা এসেছে তাদের স্বামী নিয়ে। তিশার সন্তান থাকলেও তাহিয়ার তো নেই। সে অদিতি আর আদিত্যকে তাই আদরটা বেশি করে। এই ফুপিটা তাদেরও ভীষণ প্রিয়। ঠান্ডা, একা চোরা মানুষ। মীরাও এসেছে এখানে। পলক বাদে কেউ অনুপস্থিত নয় আর পলকের উপস্থিতিও এখানে কাম্য নয়। টেবিলে সন্ধ্যার নাস্তা রাখা। চা এখনো দেওয়া হয় নি। তৌসিফ বুয়াকে চা বানাতে বলে সকলের আড়ালে রুমে এলো।

রাগে তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এই পর্যন্ত কয়বার ডাকিয়েছে পৌষকে অথচ ওর খবর নেই। সেই দুপুরের পর থেকে কথাও হয় নি। একমনা হয়ে পড়ে ছিলো। তৌসিফ শুধু শাসিয়েছিলো যাতে তায়েফা আপার কান পর্যন্ত কথা না যায় কিন্তু তাই বলে এই মেয়ে এমন চুপ করে যাবে? এত মেহমান একটাবার সামনে পর্যন্ত আসছে না। রান্নাঘরে অন্তত চা করতে পারতো। ভাবনা তো যথার্থ না তৌসিফ জানে। দুই দিনে পাক্কা গৃহিণী তো আর হওয়া যায় না কিন্তু তৌসিফ কেন জানি এটাই চাইছিলো। হয়তো সব ঠিক থাকলে পৌষ নিজে আগ বাড়িয়ে আরো অনেক কিছুই করতো কিন্তু ঠিক আর রইলো কই? এতবার বলার পরও মেয়েটা মানছে না কিছুতেই। পলকের সাথে মিশলে তৌসিফের সংসার যে গড়ার আগে ধসে যাবে তা খুব ভালো করে জানা আছে। যার কারণে শুরু থেকে শেষ কোথাও পলককে রাখলো না, দিনশেষে সেই নামটাই যদি এমন ভাবে পীড়া দেয় তাহলে কার ভালো লাগে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুপুরে পৌষকে সামলানোটাও কষ্ট সাধ্য ছিলো তৌসিফের। মেয়ের সাহস কত, বলে কিনা সংসার করা সম্ভব না। দুই দিনে ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো? এত কঠিন পরিস্থিতি তৌসিফ সৃষ্টি করেছে ওর জন্য? উত্তর তো ঋণাত্মক আসছে বারবার। তৌসিফ তেমন কিছু করে নি। রাগে খাবার ফেলার ইচ্ছেটাও ছিলো না। নিতান্তই অনিচ্ছায় পড়েছে। এমন স্বাদের খাবার তৌসিফ ফেলতো না কখনোই অথচ পৌষের চোখেমুখে থাকা কষ্টের ছাপ এমন ছিলো যেন তৌসিফ তাকে খুব খারাপ কিছু বলেছে। কতটা কষ্ট পাওয়ার কারণ ও দেখছে না। দুই সাক্ষাৎ এ পলক তার এত প্রিয় হয়ে উঠলো? এদিকে তৌসিফ যে আদর যত্ন করার চেষ্টা করছে তার বেলায় কি? কিছুই না। শূন্য একদম। দুপুরে তখন ওকে শুধু ধমকে তৌসিফ বলেছিলো চুপ থাকতে। বাড়ীতে আপা আছে।

পৌষ হনহনিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তৌসিফ ওকে রুমে ডাকলেও আসে নি। তৌসিফও আর জোর করে নি। আজ দু’জনের মাঝে ভালোবাসা নামক অদৃশ্য অনুভূতিটা থাকলে তৌসিফ নিজে গিয়ে মানিয়ে আনতো। চাপা শ্বাস ফেলে দরজাটা খুলতেই অন্ধকার ঘর পেলো তৌসিফ। সুইচ চাপতেই বিছানার বাম পাশে ঘুমন্ত পৌষের দেখা মিললো। দরজা আটকে তৌসিফ এগিয়ে এলো ওর কাছে। বসলো হাতের কাছে। মাসুম একটা মুখ আর সরল দুটো চোখ। বিশেষ কিছুই নেই অথচ সে অপরূপা। তার মুখের আদল মায়াবী। নিজে শুকনো অথচ আপা বলায় কি রাগটাই না করলো। তৌসিফ হাসলো। হাত এগিয়ে পৌষের চুলে বিলি কেটে দিলো। আরাম পেয়ে ঘুম ভাঙার বদলে গাঢ় হচ্ছে যেন। তৌসিফের একটু হলেও মায়া বাড়লো। আচ্ছা, পুরুষ কি নারীর আগে প্রেমে পড়ে? উত্তর তৌসিফ জানে না। দুই দিনে তার মায়া জাগ্রত হচ্ছে কিন্তু ভালোবাসাটা হচ্ছে না। একটু বোধহয় সময় লাগবে কিন্তু তৌসিফ ঠিক ভালোবেসে নিবে। সংসার করার তার খুব ইচ্ছা অথচ বউ কিনা বলে সংসার হবে না? কি অনর্থক কথাবার্তা।
ওর গাঢ় ঘুম ভাঙাতে কষ্ট হলো তৌসিফের। বাইরে আত্মীয় স্বজনরা না থাকলে কখনোই ঘুমটা ভাঙতে দিতো না। আস্তে করে তৌসিফ একটু ঝুঁকে নরম স্বরে ডাকলো,

“হানি, ওয়েক আপ।”
পৌষ মুচড়ে উঠছে কিন্তু জাগ্রত হচ্ছে না। তৌসিফ এবার চুলে বিলি কাটা বন্ধ করে ওর গালে হাত দিলো। হালকা চাপড় দিয়ে ডাকলো,
“পৌষরাত? পৌষরাত? উঠো।”
“মরা মরলো কার আবার? যত্তসব ফাউল কারবার।”
তৌসিফের কপালে ভাজ দৃশ্যমান। ঘুমে তাকাতে পারছে না অথচ মুখে খই ফুটছে। তৌসিফ আবারও ডাকলো। এবারে ফট করে চোখ খুলে পৌষ। মুখটা বিতৃষ্ণায় একেবারে যা-তা অবস্থা করে রেখেছে। তৌসিফ একটু নরম স্বরেই বললো,

” মেহমান চলে এসেছে পৌষরাত। নাস্তা দেওয়া হয়েছে। রাতের খাবার রান্না হচ্ছে। একটু দেখতে। আর তাদের সাথেও তো দেখা করা দরকার।”
“কেন দেখব আর কি দরকার?”
ঘুম জড়ানো গলায় কথা বলায় একটু ভাঙা শোনালো। মেয়েদের ভাঙা এই ঘুমকণ্ঠটা সুন্দর। তৌসিফেরও ভালো লাগলো। হাত বাড়িয়ে পৌষের হাতটা ধরে বললো,
“তোমারই তো সব পৌষরাত।”
“ধুর মিয়া। কিসব আজগুবি কথাবার্তা। পৌষের কিছুই না। পৌষের কিছু দরকারও নেই। যতদিন রাখার রাখুন এরপর দেখা যাবে নে।”
হেয়ালি করে বলেই শোয়া থেকে উঠে বসলো পৌষ। তৌসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“যতদিন রাখব মানে?”
“মানে যতদিন এখানে থাকার, থাকব। আমি বললেই তো যাওয়া যাবে না।”
“তোমাকে প্রথম দিনই বলেছি। এইসব তোমার।”
“ওগুলো সবাই বলে।”
“হেয়ালি করছো পৌষরাত।”
“আমি জীবনেও সিরিয়াস হই না ভাই। মাফ চাই।”
পৌষ উঠে চলে যেতেই তৌসিফ খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেললো। এক টানে নিজের বরাবর বসিয়ে বললো,
” সিরিয়াস না হওয়ার মতো বিষয় না পৌষরাত। বিয়ে করেছি তোমাকে। ছেড়ে দিতে নয়।”

“আচ্ছা।”
“কি আচ্ছা?”
“যা আপনি বলবেন সবই আচ্ছা।”
তৌসিফ দিকবিদিকশুন্য হয়ে তাকলো। এই মেয়ের এই একটা দিক তৌসিফ বুঝে না৷ ও কি হেয়ালি করে নাকি সিরিয়াস থাকে তৌসিফ বুঝে না। আলগোছে পৌষের গালে হাত রেখে বললো,
“এমন করে না হানি। বলেছিনা এই সংসার তোমার।”
“ওসব মন ভুলানো কথা। আমিও ভুলভাল বুঝেছিলাম। পরে দেখলাম যাহ, শালা। সবই ভুগিজুগি।”
“ভুল কথা? আমার কথাগুলো তোমার মন ভুলানো মনে হয়েছে?”
“মিথ্যা বললাম কি?”
“অবশ্যই।”
“কি জানি। ছাড়ুন।”
“তুমি কি বলছো পৌষরাত?”
নিজের দু-হাত দিয়ে তৌসিফের থেকে গাল ছাড়ালো। আবেগহারা গলায় বললো,

” আমার সংসার না এটা। আপনার কথা সেদিন অবশ্যই মিথ্যা ছিলো। সত্য হলে, আমার সংসার থেকে কাউকে খাবার দিব তারও হিসেব কেন দিতে হলো? নিজের সংসারে সব করা যায় কিন্তু অন্যের সংসারে না। আমার আগেও যেমন ছিলো এখনও তেমনই। এটা আপনার সংসার। আপনার বোনেরা এসেছে। আপনি যা খুশি করুন। আমাকে টানবেন না। তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার হতো যদি সংসারটা আমার হতো। তবে হ্যাঁ, যদি তাদের সামনে যেতে বলেন আমি অবশ্যই যাব। হাজার হোক আপনি বিয়ে করে এনেছেন। কাঠের পুতুল তো, সবই করতে পারি। চাবি দিলেই হয়।”

তৌসিফ বাকহারা হলো। তবুও শুধু বললো,
“তুমি ঐ দুপুরের কথাটা ধরে রেখেছো পৌষরাত?”
পৌষ উঠবে কিন্তু তার আগেই ওকে কেউ বুকে জড়ালো। শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। বেশখানিকটা সময় ধরেই রাখলো। আজ একই দিনে দুইবার পৌষ একটু ভিন্ন অনুভূতি পেলো। জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটাই ভিন্ন। একটা কাঁধ পাওয়ার অনুভূতিটাই ভিন্ন। কাঁদার কাঁধ সবাই পায় না। পৌষও পায় নি। বুকে মুখ গুঁজে অভিযোগ করা তার স্বভাবে নেই। স্বাভাব গড়ে ওঠার সুযোগই পায় নি। ওভাবেই বুকে পড়ে রইলো বেশ কিছুটা সময়। তবে নিজ থেকে তৌসিফকে জড়িয়ে ধরলো না। অতশত আবেগ আবার তার কাজ করে না। চাইলেও জাগ্রত হয় না। তৌসিফ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে শুধালো,

” তুমি একদিনে সব জানতে পারবে না পৌষরাত। তবে শুধু মনে রেখো তুমি যেই কারণে আমার বোনদের খারাপ ভাবছো ঐ কারণটা খুব গভীর। হয়তো একদিন জানবে। আর পলক, ওর সাথে মিশলে খারাপ বৈ ভালো হবে না। তুহিন বাসায় আসবে রাতে। পলক জানে। তুমি এতো ভেবো না হানি। আমার উপর রেগে থেকো না। আমরা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। সংসার কি একাকী হয়? তুমি একপা এগিয়ে দেখো, আমি তৌসিফ চার পা এগিয়ে আসব।”
“মুখ ধুয়ে আসছি।”
তৌসিফ ওকে ছাড়লো। বিছানায় বসেই অপেক্ষা করলো পৌষের জন্য। পৌষ মুখটা মুছে খাট থেকে ওরনা নিয়ে মাথা ঢেকে নিলো। বেরিয়ে গেলো তৌসিফের সাথে।

“জামাই ছাড়া দেখি থাকতেই পারে না পৌষ। আমার মেঝ ভাইকে লাড্ডু বানিয়ে ঘুরাচ্ছো। কখন এসেছি। নাকি ননদ, ননাস ভালো লাগে না? না লাগলে বলে দাও ভাই, আসব না আর। ঘন্টা পেরিয়ে গেলো অথচ তুমি ঘর থেকে বের হও না। এসব লক্ষণ তো ভালো না। দুই দিনের বউ এখনই এত ঠাটবাট। আমার ভাই গিয়ে নিশ্চিত তেল দিয়ে নিয়ে এসেছে তোমাকে।”
“একটু বসুন আপা। আসছি আমি।”
তিশার এতগুলো কথার প্রেক্ষিতে শুধু একবাক্য বলে পৌষ সালাম বিনিময় করে চলে গেলো। তৌসিফ তুরাগের সাথে অন্য পাশে কথা বলছে। পৌষ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো চা তৈরী শুধু দুধ, চিনি মেশানো বাকি। বাকিটা কাজ ও নিজেই করলো। দুধ কমিয়ে দিতেই বুয়া আইঢাই করে বললো,

“ছোট মামী এখানে তো সবাই চায়ে দুধ বেশি খায়।”
“ওহ, দুধটা নাহয় আপনি দিন তো খালা। আন্দাজ পাচ্ছি না।”
বলেই দুইপা পিছিয়ে গেলো পৌষ। এত বছর দুধ চা শুধু তার নামেই ছিলো। দুধ কমিয়ে খেতে খেতে এখন দুধ হাতেই উঠতে চায় না। আজও পারলো না বেশি দুধ তুলতে। মনে হয় এই বুঝি বড় চাচি মা-বাবা তুলে গালি দিলো। হাত কম কম তুলতে তুলতে এখন বেশি তুলতেই ভয় পায়। চা ট্রে-তে সাজিয়ে পৌষ বললো,
“শুকনো বিস্কুট থাকলে সাথে দিন খালা।”
“নাস্তা দিয়েছিলাম।”
“তবুও, চা শুধু দিতে কেমন দেখায়।”

বুয়া মাথা নাড়লো। কয়েক পদের বিস্কুট সাজিয়ে দিলো। পৌষ ট্রে রাখলো সেন্টার টেবিলে। একে একে সবাইকে চা তুলে দিতে দিতে তিশার উদ্দেশ্যে বললো,
“বিকেলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আপা। আপনার মেঝ ভাই বাইরে গেলো। আপাও ছিলো না তাই ভাবলাম ঘুমিয়ে যাই। সজাগ পাই নি নাহয় উঠে এতাম। আর আপনার ভাই আমাকে কি তেল মারবে। আমি তো নিজেই তেলতেলে। দেখেন না, গা ভর্তি চর্বি শুধু দেখা যায় না।”

তায়েফা হাসলো ওর কথায় তবে মুখ ভেঙালো তিশা। পৌষ রান্নাঘরে যেতেই তায়েফা তিশাকে ধমকটা দিয়েছিলো। তাহিয়াকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে তাদের স্বামীদের সাথে খুব সংক্ষিপ্ত আলাপ করলো পৌষ। ওমন মূহুর্তে এলো আদিত্য। পৌষ মাড়ি শক্ত করে তাকালো। এটাকে আজ ঝালাই দিবে ও। একবার শুধু পাক।
আদিত্যকে চা দিতে গিয়ে ইচ্ছে করে পায়ে পা দিলো পৌষ। আদিত্য তাকাতেই চোখের ইশারায় বললো ‘কথা আছে’। আদিত্য মাথা নাড়ে। বিষয়টা সূক্ষ্ম ভাবে নজরে এলো তিশার। সাথে সাথেই মাথাটা বিগড়ালো। একেতো সমবয়সী তার উপর একই ভার্সিটিতে পড়ছে। তাহলে কি গোপন কোন সম্পর্ক আছে ওদের মাঝে? আজ-কাল তো দীনদুনিয়া ঠিক নেই। তিশা তারাতাড়ি তাহিয়াকে খোঁচা দিলো। তাহিয়া তখন তায়েফার সাথে কথা বলছিলো। ঠান্ডা স্বরেই বললো,

“কি হয়েছে?”
তায়েফাকে ভয় পায় বিধায় তিশা ওকে আড়ালে বললো,
“আমার মনে হয় আদি আর পৌষের মাঝে সম্পর্ক আছে আপা।”
“থাকবেই তো। চাচি হয় ওর।”
“তুমি বোকাই রয়ে গেলে আপা। ঐ সম্পর্ক না। অন্য সম্পর্ক। মাত্র দেখলাম ইশারায় কথা বললো। মেঝ ভাইকে জানানো দরকার। দেখলে না কেমন চটাং চটাং উত্তর দিলো।”
“তুই না খোঁচা দিলে তো ও উত্তর দিতো না।”
“ধুর। তুমি বুঝবে না। আমারই নজর রাখতে হবে। আমার ভাইয়ের সংসার করবে। এত সোজা।”
“বেশি বাড়াবাড়ি করিস না তিশা। আমাদের বিয়ে হয়েছে। ভাইদের সংসারে নাক না গলানোই ভালো।”
তিশা মানলো না। ও তাকে তাকে রইলো।

রাতের খাবারে বুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে যথাযথ রান্না পৌষ করেছে। তায়েফা না করলেও শুনে নি। তৌসিফ আর তুহিন কোথায় জানি বেরিয়ে গেলো। সেই ফাঁকে পৌষ আদিত্যকে ডাকলো ইশারায়। আদিত্য আসতেই রান্না ঘরের পাশের বারান্দায় গেলো দু’জন। ওকে পেয়েই পৌষ দাঁত চেপে ধমকালো চাপা স্বরে,
“আদির বাচ্চা,
চার কোনাইচ্চা।
দেখতে সুন্দর,
চিড়িয়াখানার বান্দর।”
আদিত্য মুখটা ভোতা করে বললো,
“আমার কি দোষ?”
“তোমাদের এই সন্ত্রাসী পরিবারে কেন যে আমার ভাগ্য জুটলো। আগে সত্যি করে বলো তো, পলক আপুর সাথে কি ঝামেলা? একমাত্র উনি বাদে কাউকে ভালো লাগে না এখানে অথচ তোমাদের চৌদ্দ গুষ্টি ওনাকেই দেখতে পারে না। ঘটনাটা কি? উত্তর না দিলে ঠাটিয়ে মারব একটা।”
“পুষি, শোন আমার কথা।”
“তোমার পুষিকে ভূসি বানিয়ে খাওয়াব আমি আদি। সরাসরি উত্তর দাও।”
আদিত্য কিছু বলার আগেই হঠাৎ বুয়া আসলো। জানতে চাইলো গোস্ত পাতিলে দিবে কি না। পৌষ আদিকে দাঁড়াতে বলে বেরিয়ে গেলো তবে ফিরে এসে আর পেলো না। রাতে যখন টেবিলে সবাই খেতে বসেছে তখনও পৌষ আদিতে ইশারায় থাকতে বলেছে। এই দৃশ্য এবারেও শুধু তিশার চোখেই আটকেছে।

তুহিন খাচ্ছে। পলক খুব যত্ন করে খাওয়াচ্ছে ওকে। মাঝেমধ্যে একটু ছুঁয়ে দেখছে। তুহিন ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। পলক অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো ওর পানে। পলক হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি দেখেন?”
“তোমাকে।”
“নতুন আমি?”
“বউ কি পুরাতন হয়?”
“মোটা হয়ে যাচ্ছি।”
“উঁহু।”
তুহিন খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠলো। পলক পিছু পিছু এলো। তুহিন হাত মুখে সোফায় বসতেই পলক ওর গা ঘেঁষে বললো। হালকা করে মাথা রাখলো কাঁধে। একহাতে তুহিন ওকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে হাত দিয়ে বললো,

“খুব শিঘ্রই আমার খুশি হব পলক।”
“হ্যাঁ।”
“তুমি চিন্তা করো না।”
“তুমি থেকে যাও।”
“তুমি রেখে দাও।”
“কোথায় রাখব তোমাকে? আমার বুকে থেকো যাও। আমাকে শূন্য করে যেও না, প্লিজ।”
“সুখের জন্য একটু দূরত্ব মেনে নাও পলক। সুখগুলোকে খুব মিস করি আমি। এবার নাহয় আমরা সুখী হই।”
“বাসায় থেকে হবে না?”
“উঁহু।”
“আই মিস ইউ।”
“মি ঠু, জান।”

তুহিন ওকে যতটুকু পারল জড়িয়ে রাখলো। চোখটা বুজে ভাবলো গতরাতের কথা। কেউ একজন ওকে আঘাত করে টেনে পুকুরে ফেলতে চাইছিলো কিন্তু পারে নি। তুহিনের ভারী শরীর তার ঐ ফিনফিনে শরীর বয়ে নিতে পারে নি। ঘাটে ফেলার পূর্বেই হালকা জ্ঞান আসে তুহিনের। তখন ও ছিলো সম্পূর্ণ নেশায়। বাড়ীর পেছনেও এসেছিলো নেশা করতে। নেশার টান উঠতে বাসায় থাকতে পারে না ও। তবে ঐ মূহুর্তে ওখানে তৌসিফ এসেছিলো। তুহিনের হালকা হালকা মনে পরে। ফোন, ঘড়ি পুকুর পাড়েই পড়ে ছিলো। ওকে কাঁধে তুলে গাড়িতে করে তৌসিফ নিয়ে গিয়েছিলো কোথাও। জ্ঞান পুরোপুরি ফিরেছিলো সকালে। তুরাগ সাথে ছিলো। তৌসিফ বেশ ধমকেছে ওকে।

এখন ওকে যেতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে৷ চিকিৎসা পুরোপুরি ভাবে করে তুহিন ফিরে আসবে। সেখানে আসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, ডিটক্সিফিকেশন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকে। তুহিন এতটাই আসক্ত যে চাইলেও একা একা ছাড়তে পারবে না। তৌসিফ ওর ভিসা জমা করেছে। জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হচ্ছে দেশের বাইরে। ইউএসএতে রিহ্যাবে ভর্তি করানো হচ্ছে। তুহিন না করার সাহস পায় নি কারণ তৌসিফ শুধু ওর কাঁধে বলেছিলো,
“আমার কারণেই তুই এই পথ ধরেছিস। আমি নিজেকে গুছিয়েছি। এবার তোর পালা।”
তুহিন আর টু শব্দ করে নি। ও নিজেও বেরিয়ে আসতে চায়। আর কত? আর কত এভাবে থাকবে? পলক ঘুমিয়েছে ওর বাহুডোরে। পাজা কোলে তুলে ওকে নিয়ে বিছানায় রেখে কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বেরিয়ে আসে তুহিন। ব্যাগ গোছানো। যাওয়ার আগে কলিকে ডেকে শক্ত কণ্ঠে বলে,

“আমি ফেরার আগ পর্যন্ত বাড়ীর বাইরে পা রাখবি না।”
“মামা.. ”
“চুপ! আস্তে। খবরদার যদি পালানোর চেষ্টা করেছিস তো।”
কলি মাথা নিচু করে রাখে। তুহিন আস্তে করে বলে,
“তোদের মতো ছোটলোকদের ভালো চাওয়াও ছোটলোকি বুঝলি কলি। নরক থেকে তুলে আনলাম আমি আর তুই কিনা ঐ নরকে যেতেই মরিয়া হয়ে আছিস? অবুঝ তো না তুই।”
“আমার মা…”
“সৎ মা তোর।”
“আমার আব্বা সৎ না।”
“তোকে তোর আব্বাই বিক্রি করেছিলো।”
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে কলি মুখ চেপে বললো,
“মিথ্যা।”
তুহিন এক পা এগিয়ে এলো। কলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“সত্যি। তোকে ঐ লোকের কাছে তোর আব্বাই বেঁচেছিলো। তোর মা সৎ না কলি। তোর আব্বাই সৎ। ছোট থেকে তোকে মিথ্যা বলে বড় করেছে তোর দাদি। বড়লোক দেখেই বিক্রি করেছিলো। তোকে প্রথম দিন সাত্তার হোসেনের বাড়ী দেখে মায়া লেগেছিলো তাই দ্বিগুণ টাকায় তোকে কিনে এনেছিলাম। তুই পলকের উপহার। পলকের সাথে থাকার জন্য তোকে এনেছিলাম আমি। তোর মুখে একটা মায়া আছে। মায়া ভেবেই তোকেই এনেছিলাম কিন্তু টাকা তো জলে গেলোই তুইও পালাতে চাস। না তুই উপহার হিসেবে ভালো না বোন হিসেবে। তোকে বোনের মতোই তো রাখলাম। সাত্তার হোসেনের মতো এখানে তো কেউ তোকে খারাপ চোখে দেখে না। ভাবিস না মিথ্যা বলবি। আমি জানি সাত্তার তোকে কাজের লোক হিসেবে না বরং অন্য লোক হিসেবে নিয়েছিলো। তোর মুখটায় মায়া বুঝলি নাহয় সাত্তার এত টাকা ঢালতো না৷ আর হ্যাঁ, আমি যেহেতু আজ তোকে সব সত্যি বলেছি তাই সিদ্ধান্ত তোর। হয় এখানে থাকবি নাহয় সাত্তারের কাছে ফেরত পাঠিয়ে টাকা তুলব আমি।”

কলি মিহিয়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানি পরছে টুপটাপ। এজন্যই বাবার সাথে তুহিন বা পলক দেখা করতে দিতো না। এজন্যই বাড়ী থেকে বের হতে দিতো না। পলক তো একবার মাইরও দিলো। অথচ কলি এতদিন ভাবতো কিভাবে পালাবে। সে অক্ষত না। সাত্তার হোসেন তাকে অক্ষত রাখে নি। আসলেই তো, তুহিন মামা ঠিক বলেছে। তার মতো ছোটলোক এই ভালোর যোগ্যই না।

নিচের অফিস কক্ষে তিন ভাই একসাথে বসা। তুহিন তৌসিফের কাঁধে মাথা দিয়ে আবদার করলো,
“আজ শেষবার খাই?”
“ড্রিংক বাদে কিছুই নেই এখানে।”
“তাতেই হবে।”
তুরাগ ছোট ভাইয়ের চুলে হাত বুলালো। তুহিন হঠাৎ বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। কেন কাঁদলো ও জানে না। শুধু মুখে ‘আম্মু আম্মু’ ডাকলো। তৌসিফ গা এলিয়ে শুয়ে পরলো ফ্লোরে। তিন ভাই সময় কাটালো আজ। কে জানে আবার কবে একত্রিত হবে তারা?

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৩

তুহিনকে গাড়িতে তোলার সময় তৌসিফকে জড়িয়ে কানে কানে শুধু বললো,
“আল্লাহর পর পলককে তোমার কাছে আমানত রেখে গেলাম মেঝ ভাই। আমি ফিরে এসে ওকে চাইব।”
তৌসিফ পিঠ চাপড়ে ভরসা দিলো। খুব গোপনে দেশ ত্যাগ করলো তুহিন। টের পেলো না কেউ।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here