প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৯

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৯
সাইয়্যারা খান

শ্রেয়া জৈষ্ঠ্যকে দিয়ে কিছু আনাতে বাইরে পাঠিয়েছে। সেই থেকে জৈষ্ঠ্য ফিরে নি। কেউ অবশ্য এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করে নি কিন্তু শ্রেয়া ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। কোথায় গেলো ছেলেটা? চৈত্র একবার খুঁজলো। না পেয়েও কিছু বলে নি৷ ওরা তো জানে না শ্রেয়া পাঠিয়েছে ওকে। হাতের কাজও যেন আগাতে চাইছে না এই মুহূর্তে। হেমন্ত বাসায় নেই। যদি ফিরে প্রশ্ন করে তখন কি বলবে শ্রেয়া? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। ওরনা দিয়ে মুছে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে দিলো ও। এই বাচ্চাগুলো হেমন্তের অনুপস্থিতিতে কিছুটা শ্রেয়া দেখে রাখে। ওদের সাথে কথা বলে।

নিজের মতো ভালোবাসতে চায়। কে জানতো জয়েন ফ্যামিলি অপছন্দ করা শ্রেয়া এতটা মায়ায় আটকে যাবে। শ্রেয়া পরক্ষণেই ভাবে এটা পৌষের মায়া যা শ্রেয়া সামাল দিতে চেষ্টা করছে। ইনি, মিনির শরীর ভালো না। দুই বোন একসাথে অসুস্থ। কারণ অবশ্য কারো জিজ্ঞেস করা লাগে নি। ছোট চাচি মেয়েদের শোকে হাউমাউ করে কাঁদেন। গতরাতেও কাঁদতে কাঁদতে তার মুখে কিছু সত্যি কথা বেরিয়েছে। পৌষের অভাবেই এই জ্বর এসেছে বলে বারংবার বলেছে। তার মেয়ে দুটো খাওয়া দাওয়া করছে না ঠিকমতো। রাতে শুধু হেমন্ত খাওয়ায়৷ দুধ তো ওদের পৌষ খাওয়াতো নানা ছলেবলে। ওটাও বন্ধ আজ কয়েকদিন। সব মিলিয়ে মাসুম দুটো জানের উপর দিয়ে ভীষণ চাপ যাচ্ছে। বড় চাচি কাল ছোট চাচীর কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কাঁদতে পারেন নি। তারও দুটো সন্তান তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি চোখে দেখেন অথচ সন্তান দুটো তাকে দেখেন না৷ হেমন্ত কথা বলে না। পিহাও নিজের মতো ঘরকোনা হয়ে থাকছে। সেই হিসেবে সন্তান তিনিও হারিয়েছেন। সেঝ চাচি অবশ্য চুপ থাকে নি। ছোট চাচির কথায় ত্যাছড়া ভাবে বলেছিলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“শুরু থেকে রংতামাশা না করে বাচ্চা পাললে তো আজ এই অবস্থা হয় না৷ জামাই নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরে মেয়ে দিয়েছো আরেকজনের হাতে, এখন মেয়ে তোমাকে চিনেই না বোধহয়। মা থাকতে সন্তান আবার না খেয়ে অসুস্থ হয়?”
ছোট চাচি উত্তর করেন নি। তিনি শুধু কেঁদেছেন। পৌষকে ফোন দিয়েও কেউ পান নি৷ মেয়েটা ফোন ধরে নি। শ্রেয়া সেঝ চাচিকে দেখতে অবাই হয়। তার নিজের দুই ছেলেও তো তার সাথে অতি প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলে না। তার চোখে কিসের এত রাগ পৌষের প্রতি শ্রেয়া তা বুঝে উঠতে পারছে না।
“ভাবী?”
পিহার ডাকে চমকে তাকালো শ্রেয়া৷ তখনই দরজায় বেল বাজলো। শ্রেয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো জৈষ্ঠ্য এসেছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো শ্রেয়া। জৈষ্ঠ্যের হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,

“গিয়েছিলে?”
উত্তর দেওয়ার আগেই ওকে টেনে ভেতরে আনে শ্রেয়া। জৈষ্ঠ্য মাথা নাড়ে। নিচু স্বরে বলে,
“আপা বাসায় ছিলো না।”
“কিহ! কোথায় গিয়েছে?”
“জানি না। দারোয়ান খবর পাঠাতেই ফ্ল্যাটে থাকা বুয়া বললো আপা নেই। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি।”
শ্রেয়া বসলো। আজ পৌষকে দরকার ছিলো। মেয়েটা ফোন ধরলেই কিছুটা শান্তি পাওয়া যেতো। জৈষ্ঠ্য আরো বললো,
“মনে হচ্ছে তৌসিফ তালুকদার মানে দুলাভাই বাসায় নেই।”
“কে বললো?”
“দারোয়ান।”
শ্রেয়া আর কিছু বললো না। আজও হেমন্তের দেড়ী হবে। ও আসলেই ইনি, মিনিকে খাওয়ানো যাবে একটু।

ভীষণ চিন্তায় পৌষ নখ কামড়াচ্ছে। সোহা নামক আপদ কোথা থেকে জুটলো তার কপালে? পলক তাকে আগেই সচেতন করেছিলো। এই ফ্ল্যাটে সোহার আনাগোনা আগে থেকেই। পলক অবশ্য তেমন কিছু বলে নি কিন্তু যতটুকু বলেছে তাতে পৌষ অনেকাংশেই এতটুকু বুঝেছে সোহা এখানে আসে, যায়। মিনুকে সোহাই এখানে রেখেছে। তার মাধ্যমেই নাকি এ ঘরের খবর সোহার কাছে পৌঁছায়। একটা জোয়ানজাহান মেয়ে একা থাকা এক পুরুষের বাড়ীতে কোন কাজে আসে? কোন সন্দেহের সুরে পলক বলে নি তবে বলেছে তো। সেই থেকেই সোহার প্রতি কিছুটা বিদ্বেষ পৌষের মনে। এখানে আবার আরেক ঝামেলা। পৌষের মন টিকছে না৷ কিছুতেই না। সম্রাটের বাগান বাড়ী। ভাবা যায়, যাকে নিয়ে কতগুলো বছর পৌষ কতশত কল্পনা করলো তার করা বাগান বাড়ী। ভেতর দেখার অদম্য এক আগ্রহ পৌষের ভেতর। কাল ওখানে পৌষ যাবেই যাবে। সম্রাটের বাড়ীটা ঘুরে দেখে আসবে।
দরজায় ঠকঠক শব্দ করে মিনু৷ পৌষ আসতে বলে ওকে। হাত বাড়িয়ে ফোন দিয়ে বলে,

“মামা।”
পৌষ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
“একটু কথা আছে। তুমি এসো তো আবার।”
মিনু ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো। মাথা নেড়ে চলে গেলো। ফোন কানে লাগিয়ে সালাম দিতেই তৌসিফ ওপাশ থেকে উত্তর নিলো। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললো,
“ফোন কোথায় তোমার পৌষরাত? ফোন দিচ্ছে সবাই৷ আমিও দিলাম৷ পাচ্ছি না।”
পৌষ এদিক ওদিক তাকালো। না পেয়ে বললো,
“আছে কোথাও।”
“এটা কেমন উত্তর পৌষরাত? মানুষের প্রয়োজন হয় না? তুমি জানো ইনি, মিনি অসুস্থ? ওদের….”
আর কিছু শুনার আগেই পৌষ চোয়াল শক্ত করে ফেললো। দাঁত চেপে বললো,

“কি হয়েছে?”
“তুমি রেগে আছো?”
“না।”
“ফোন খুঁজে, বাসায় ফোন দাও হানি৷ বাচ্চা দুটো অসুস্থ। আমি থাকলে…”
তৌসিফকে শেষ করতে দিলো না পৌষ। বললো,
“ওদের নিয়ে ভাববার মানুষ আছে। তারা সব জেনেই সব করেছ। অত ভাবার কিছু নেই।”
“হেমন্ত বললো খাচ্ছে না ঠিকমতো।”
“এটা আমাকে অপবাদ দেওয়ার আগে হেমু ভাইয়ের মা আর চাচির ভাবা উচিত ছিলো।”
তৌসিফ ভড়কালো একটু। ও ভেবেছিলো পৌষ ওবাড়ী যেতে চাইবে, কাঁদবে কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণে ভালো চমকালো। মেয়েটা কেমন জানি। অদ্ভুত। কথা ঘুরালো তৌসিফ। বললো,
“আমি ফিরে আসব শিঘ্রই।”
“আচ্ছা।”

ফোন কাটতেই পৌষের এলোমেলো লাগলো। তারাতাড়ি নিজের ফোন খুঁজলো। কোথায় রেখেছিলো তাও মনে নেই। ড্রেসিং টেবিলের উপর পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনের উপর। ভেতরে কি চলছে পৌষ বুঝতে পারছে না। শুধু একবার ওদের কণ্ঠ শুনতে মন চাইছে। শ্রেয়ার ফোন থেকে অসংখ্য কল দেখে ওকেই ব্যাক করে পৌষ। রিসিভ হয় খট করে। পৌষ খুব শান্ত ভাবে বলে,
“আমার পাক বাহিনীর খেয়াল রাখতে পারলো না তোমার স্বামী?”
“পৌষ, কথা বলবে একটু ওদের সাথে। তোমার ভাই আসে নি এখনও। ওরা খাচ্ছে না।”
“না খেলে আমি কি করব ভাবী বলো? যার যার বাচ্চা তার তার। তুমি এক কাজ করো তো। ঐ বিচ্ছু দুটোর সামনে ফোন নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, অন্য কেউ যাতে না থাকে।”
শ্রেয়া ছলছল চোখে হেসে ফেললো। হোক অল্প কিছু দিন শ্রেয়া চিনেছে পৌষকে। মেয়েটা সরাসরি প্রকাশ করতে পারে না৷ দৌড়ে ছোট চাচির ঘরে আসে শ্রেয়া। ওর পেছনে চৈত্র, জৈষ্ঠ্য আর পিহা। ঘরে ওরা বাদে কেউ নেই আর। স্পিকারে থাকা ফোনে হঠাৎ কাটখোট্টা গলা শোনা গেলো,

“কিরে পাকবাহিনীর দল, তোদের কত কাজ দিয়ে এলাম। আর দুই বিচ্ছু তোদের বলি নি আমার খাটের নিচ পরিষ্কার করতে? দুটো বিছানায় কি করছিস? পিহা, তুই আমার ঘর তালা দিবি। কেউ যাতে না ঢুকে ওখানে…”
এতটুকু শুনেই কাঁদছে ইনি, মিনি। জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। সেই কান্নার মাঝখানে আবার মুখ দিয়ে ‘আপা’ শব্দটাও বের হচ্ছে। পিহা নাক টানছে। ওপাশ থেকে এবার কথা থামিয়ে ধমক এলো,
“এক থাপ্পড় মারব। বেয়াদব গুলো, তোদের যে বললাম আমার বাথরুম ধুয়ে রাখতে, রেখেছিস?”
“আমি দুয়ে দিব আপা।”
একসাথে দুটো জরাজীর্ণ কণ্ঠ এলো। পৌষ নরম হলো না। বললো,
“না খেয়ে শক্তি পাবি বিচ্ছুর বাচ্চা? এখনই খা। সকালে বাথরুম ধুয়ে রাখবি। ঘর মুছে রাখবি।”

“আপা তুমি আথবে না?”
“খাবি কি না বল?”
“থাব।”
“এখনই খা। উঠ, ঝটপট।”
“তুমি থাবে না আপা?”
“পরে খাব।”
“তুমি থায়িয়ে দিবে না?”
“আজ না। আজ আপার হাতে ব্যথা। তারাতাড়ি খা।”
“তুমি কই আপা?”
“শশুরবাড়ী। এখন চুপচাপ খা। আপা ফেলে দিব আবার।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৮

“আপা, ভিডিও কল দেই?”
কথাটা বললো পিহা। পৌষ না করলো। শুধু বললো,
“আজ না।”
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট চাচি এবারেও কাঁদলেন। পৌষটাকে তিনি অপছন্দ করতেন না কিন্তু কখনো ওভাবে আদরও করা হয় নি। আজ মনে হলো আদর করা উচিত ছিলো। একটু আদর মেয়েটার পাওনা ছিলো।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৯ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here