প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩১

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩১
সাইয়্যারা খান

শরৎ বিদায় নিয়ে হেমন্ত এলো এলো ভাব। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিড়িয়ে অক্টোবর মাসের প্রলেপ। রাতগুলো ঠান্ডা শীতলতায় ভরে আছে। গায়ে ওরনাটা ভালো মতো টেনে পৌষ গুটিয়ে যেতেই তৌসিফ বললো,
“বেশি ঠান্ডা লাগছে?”
“উহুঁ..আআ হাচ্চুহ।”
তৌসিফ এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিলো। রাত বাজে দুইটা বাইশ। পৌষের ক্ষুধা লাগায় দু’জনই বেরিয়ে এসেছে। রান্না করা স্যান্ডউইচটা গরম করতে দিয়েছে তৌসিফ। পৌষ পা তুলে বসেছে এখানেই। তৌসিফের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

“আচ্ছা, আমাকে বাগান বাড়ী নিয়ে যাবেন কাল?”
কপালে সহসা ভাজ পড়লো। তৌসিফ মুখের ভঙ্গি না বদলেই বললো,
“ওখানে দেখার মতো কিছু নেই।”
“আমি যাব। ওখানে নাকি আগের মতো সব কিছু আছে? আচ্ছা, ওটা কেমন? পুরাতন দিনের বাড়ির মতো? আপনি গিয়েছিলেন?”
বেশ কৌতুহল নিয়ে পৌষ জিজ্ঞেস করছে। তৌসিফ চোয়াল শক্ত করে বললো,
“এক বলাতে দেখিয়ে আনলাম এরমানে এই না সব আবদার পূরণ হবে।”
“কেন হবে না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তৌসিফ মনে মনে অবাক হয়। আচ্ছা, তার বউ কি তাকে ভয় পায় না? সে কি জানে না সে কার বউ? তৌসিফ সম্পর্কে তার ধারণা ঠিক কতটুকু? বিপ বিপ শব্দ হতেই তৌসিফ ওভেন খুলে স্যান্ডউইচ বের করে। তার উপর সস দিয়ে বউকে এনে দেয়। পৌষ এক কামড় খেয়ে একটু এগিয়ে দেয় তৌসিফের মুখের সামনে। তৌসিফ এক কামড় দিলো। খেয়ে বললো,
“আমার অভ্যাস খারাপ হচ্ছে পৌষরাত। বউ হিসেবে তোমার খেয়াল রাখা উচিত আমার প্রতি।”
“খেয়ালই তো রাখছি। একটু পেট বের হলে কিচ্ছু হবে না। শুনুন, আমি কিন্তু কাল ভার্সিটিতে যাব। যাব না?”
তৌসিফ বলেছিলো বাড়ী ফিরলেই এ বিষয়ে কথা বলবে। একটু ভেবে বললো,

“যাবে কিন্তু এদিক ওদিক চলে যেও না পৌষরাত।”
“আদিকে বলে…”
বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো পৌষ। মাত্রই আদির বাইকে করে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সেদিনের ঘটনা মনে পড়ায় চুপ করে গেলো। তৌসিফ বোধহয় বুঝলো। পানির গ্লাস এনে ওকে দিয়ে বললো,
“চলো। ঘুমাবে।”
পৌষ কথা বললো না আর। তার কাছে আজকের দিনটা ভীষণ খুশির। সম্রাটকে দেখার যেই অদম্য ইচ্ছে তা পূরণ হয়েছে। তৌসিফের পেছন পেছন ঘরে ঢুকে পৌষ জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা, আপনার কাছে ওনার আর ছবি নেই? প্রতি বছর ঐ এক ছবিই দেখি। সেই বাঁশ রঙের শার্ট।”
পৌষের কণ্ঠে উদাস ভাব দেখে তৌসিফ ভীষণ বিরক্ত হলো। এই মেয়ে এখনো পড়ে আছে সম্রাট ভাইকে নিয়ে। মুখে ক্রিম লাগাতে লাগাতে তৌসিফ বললো,

“ভাসুর হয় তোমার।”
“চাচাতো ভাসুর।”
“চাচাতো ভাসুর নিয়ে এত ভাবতে নেই৷ এত দেখতেও নেই। চোখে পাপ লাগবে।”
“আরো কোথাও পাপ লাগবে।”
তৌসিফ পিছন ফিরে তাকাতেই পৌষ হেসে দিয়ে বললো,
“ঐ পোস্টার হাত দিয়ে ছুঁয়েছি, মন দিয়ে ভেবেছি। আপনি কি জানেন তাকে আমি স্বপ্নেও দেখেছি।”
“এত ভাবো যে স্বপ্নেও দেখলে?”
“হুঁ। কি দেখেছি জানেন?”
বলে ভীষণ লজ্জা আনলো মুখে। তৌসিফ অবাক, হতবাক হয়ে গেলো। এই মেয়ে সম্রাটের কথা বলতে গিয়েই কেন এত লজ্জা পায়? এখন তৌসিফের হিংসে হচ্ছে। ভীষণ হিংসে। তাকে রেখে কেন তারই মৃত চাচাতো ভাইকে পৌষ এতটা চায়? গালে ক্রিম লাগাতে লাগাতে তৌসিফ বললো,

“তালুকদার বাড়ীর বউ তো হলেই। এখন শান্ত থাকো।”
পৌষ গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো,
“আমি চাইলাম যারে
ভবে পাইলাম না তারে
সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে
সে এখন বাস করে অন্যের ঘরে”
তৌসিফ চাপা স্বরে ধমক দিলো,
“অন্যের ঘরে কোথায় পেলে তাকে পৌষরাত?”
“তাহলে আপনিই বলুন তার শোকে কোন গান গাইব?”
তৌসিফ লাইট বন্ধ করলো। পৌষ বালিশে মুখ দিয়ে খিটমিট করে হাসছে। তৌসিফের মুখটা দারুণ লাগছে তার কাছে। ব্যাটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

ইনি, মিনিকে কোলে নিয়ে ভোর সকালে হেমন্ত বের হচ্ছে। দুই বোন একটু ঘুরবে। ভোরে উঠেছে। ছোট চাচি ওদের সামলাতে গিয়ে কাঁদছেন শুধু। ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়েছিলো বাড়ীর সকলে। ফিরে এসেই চাচির কান্না কানে গেলো ওর। দরজা টোকা দিয়ে অনুমতি নেয়,
“চাচি আসব?”
চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলেন,
“হেমন্ত? এসো আব্বু।”
হেমন্ত ঢুকেই ছোট চাচাকে বললো,
“ওদের নিয়ে একটু হাঁটতে বের হলেই হয়। আগে তো এত সকালে উঠতো না৷”

বলেই দু’টোকে কোলে তুলে হেমন্ত। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রাখে। হেমন্ত একটু দেখে হাতড়ে। সামান্য গরম শরীর। এই যে পৌষের সারা জীবনের কষ্ট ছিলো তাকে নাকি কেউ ভালোবাসে না, কেউ আপন ভাবে না, সেই পৌষ কি জানে না তার শোকে শোকে দুটো জোনাকির আলো নিভু নিভু। পিহা তখন ঘুম। হেমন্ত চৈত্র আর জৈষ্ঠ্যকে ঘুমাতে দিলো না আর। এই দুটোকে রোজ তুলে নামাজে নিতে হয়। পৌষ ওদের তুলে নানান কৌশলে। কত সময় শীতের সকালে পানি দিলো মুখে। কাঁথার ধরে ঝাড়া দিতো। দুই ভাই আর যাই হোক তাদের আপাকে টু শব্দ বলার সাহস পেতো না। একা একাই হাসলো হেমন্ত। চৈত্র টুপি রেখে ঢুলতে ঢুলতে এসে বললো,

“কই যাব হেমু ভাই?”
“গুত্তে।”
উত্তর দিলো ইনি, মিনি। জৈষ্ঠ্য এসেছে বেশ ফ্রেশ মাইন্ডে। পাঁচজন বের হতেই বড় চাচা ওদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“এত সকালে কোথায় যাচ্ছো?”
হেমন্ত বরাবরই এড়িয়ে গেলো। জৈষ্ঠ্য আস্তে করে উত্তরে বললো,
“ভাই একটু হাঁটতে নিয়ে যাবে।”

বড় চাচা গেট বন্ধ করে এলেন। ছেলেমেয়েদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন৷ নিজের বড় ছেলের চোখে সে এতটাই পড়ে গিয়েছে যে ছেলে তাকে দেখেও দেখে না। তার ভেতর পুড়লেও এই বাড়ী বাটোয়ারা হতে দিবেন না তিনি। হেমন্ত এই পাগলামি কেন থামাচ্ছে না তাই বুঝতে পারছেন না। রাগ নিজের স্ত্রীর উপরও কম না তার। কি হতো পৌষটাকে সুন্দর মতো পাললে? এমন না তার ভাতিজিকে তিনি দেখতে পারেন না৷ সংসারে অশান্তি হবে ভেবে তিন ভাই দেখেও যেন দেখতো না৷ ছোটটা অবশ্য পৌষকে যতটুকু সম্ভব আদর করতো তবে সেই আদরটাও সেঝ ভাবি নষ্ট করে দিয়েছিলো বহু আগে। ছোট্ট পৌষ আপবাদ নিয়ে নিয়েই বেঁচে আছে। সেদিন ভাইয়ের বউকে ধমক দিয়ে তিনি থামাতে পারেন নি শুধু গম্ভীর হয়ে ছিলেন৷ ওর পর থেকে তার ছোট ভাই ভাতিজি থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব রাখতো। চাচা ভাতিজির সম্পর্কটাকেও ছাড় দেয় নি কেউ অথচ পিহাকে এখনও সেঝ চাচা, মেঝ চাচা দু’জনই আদর করেন৷ সেঝ চাচি এটা নিয়ে টু শব্দ করেন না। সকল নিয়ম নীতিমালা প্রযোজ্য ছিলো শুধু মাত্র পৌষের জন্য।
মসজিদের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হেমন্ত ওদের নিয়ে পেছন দিয়ে বাজার দিয়ে বের হলো। জৈষ্ঠ্য হাঁটতে হাঁটতেই বললো,

“হেমু ভাই, যদি আপা আমাদের দেখে?”
“আপা কই? আপা চলো হেমু বাই।”
দুই বোন জোর করতেই হেমন্ত চোখ গরম করে তাকালো জৈষ্ঠ্যর দিকে। জৈষ্ঠ্য মাথা চুলকে বললো,
“আমি তো প্রেডিকশন করলাম শুধু।”
“রাখ তোর প্রেডিকশন। দারোয়ানকে বলি আপাকে ডেকে দিতে।”
চৈত্র কথাটা বলতেই ইনি,মিনিও মাথা তুললো। হেমন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো ডাগর চোখে। হেমন্তের মন চাইলো দুই ভাইকে দুটো চড় দিতে৷ ইনি, মিনি হেমন্তের গাল ধরে আবদার জুড়ে দিলো,
“আপাকে দাকো না হেমু বাই।”

বেকায়দায় পড়লো হেমন্ত। কোথা থেকে ডাকবে এখন পৌষকে? ওদের ঘাট পাড় পর্যন্ত এনে ঘুরিয়ে নিলো হেমন্ত। তুহিনের সাদা রাজহাঁস গুলো কাজের লোকেরা ছেড়ে দিয়েছে। একসাথে এত রাজহাঁস দেখে দুই বোন উচ্ছাসিত হয়। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে থাকে। ওরা যখন পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিলো তখনই বারান্দা থেকে দেখলো পৌষ। ওখান থেকেই জোরে ডাকতে লাগলো,
“চৈত্র, জৈষ্ঠ্য? হেমু ভাই? দাঁড়াও একটু।”
কেউ শুনলো না৷ পৌষ দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নেয়ার আগেই তৌসিফ এসেছে তারাতাড়ি। পৌষের চিৎকার শুনেই এসেছে মূলত। হাত ধরতেই পৌষ বলে উঠলো,
“ওরা এসেছিলো। ওখানে ছিলো রাস্তায়। আমি আমি মাত্র দেখলাম। ডাকলাম৷ শুনলো না৷”
বলেই যেতে নিবে কিন্তু হাতটা আটকে রাখা তৌসিফের কাছে। পৌষ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। আস্তে করে বললো,
“দেখতাম একটু।”
“আমি জগিং এ যাচ্ছি। তুমি রেডি হও৷ ভার্সিটি পৌঁছে দিব আমি।”
কথা দিয়ে তৌসিফ বুঝালো এখন বের হওয়া যাবে না৷ পৌষের মুখভঙ্গি বদলালো না৷ তীব্র আকাঙ্খা লুকিয়ে ছিলো সারামুখে। একটু দেখা করার লোভ তাকে আঁকড়ে ধরেছিলো।

কফি হাতে রুমে ঢুকেছে হেমন্ত। শ্রেয়ার মাথার কাছে বসে হাত বুলাতেই মেয়েটা চোখ খুললো। হেমন্ত ওর কপালে ঝুঁকে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বললো,
“গুড মর্নিং শ্রেয়ু্।”
“গুড মর্নিং।”
ভাঙাচোরা নারী কণ্ঠে হেমন্তের বুকটা কেঁপে উঠলো। ঘুমঘুম কণ্ঠটা সত্যিই যেন ভীষণ ভিন্ন শুনালো। হেমন্ত ওকে ধরে উঠালো। চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
“কফি এনেছি। মুখে পানি দিয়ে এসো।”
মুচকি হাসে শ্রেয়া। চুলটা খোঁপা করে উঠে যায়। হেমন্ত বিছানা গুছিয়ে নিলো ততক্ষণে। শ্রেয়াকে নিয়ে বসলো বারান্দায়। কফি হাতে তুলে দিয়ে ঠান্ডায় দু’জন বেশ জমজমাট ভাবে লেগে বসে রইলো। হেমন্ত নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার শরীর খারাপ লাগছে এখনও?”
“এখন ভালো লাগছে।”
“ডাক্তার দেখাতে চলি আজকে?”
“আরে সামান্য মাথা ব্যাথা নিয়ে কি ডাক্তার দেখাব?”
“বাসায় কোন কাজে হাত দিবে না শ্রেয়ু। কেউ কিছু বলবে না তোমাকে।”
“কেউ কিছু বলে না হেমন্ত। আপনি খামখা ভাবছেন।”
হেমন্তের কাঁধে মাথা রাখতেই ও বললো,
“বাসার কথা মনে পরছে শ্রেয়ু? যাবে?”
“নিয়ে যাবেন?”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩০

“অবশ্যই। আজ কোর্টে যাব দুপুরে। ফিরে এসে নিয়ে যাব।”
“এই ঝামেলা আপনি আর কতদিন.. ”
“হুঁশ! ঝামেলা বলো না আর কোন দিন। আমার ছোট বাচ্চার হক এটা শ্রেয়ু। প্রয়োজনে আমি বাড়ী ছাড়ব তোমাকে নিয়ে তবুও আমার পৌষের হক ছাড়ব না৷”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here