প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৬ (২)

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৬ (২)
সাইয়্যারা খান

রাতটা আজ ভীষণ ঠান্ডা। নভেম্বরের প্রথম বৃষ্টি সাক্ষাৎ করতে এসেছে। ভিজিয়ে দিয়েছে ধরণীতল। বাইরে হাত বাড়িয়ে দিতেই ঠান্ডা পানির ফোঁটা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিলো। গা রি রি উঠলো পৌষের। পৌষ মাসের শীত কি তবে আসছে? হেমন্তেই শীতের আবির্ভাব হলো কি না ভেবে পেলো না পৌষ। জানালা দিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেতেই পৌষের কোমড়টা পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে নিজের বুকে স্থান দিলো ওর পিঠটা। পৌষ হাতের পানি নিজের মুখে ছিটিয়ে আবারও বাইরে হাত দিলো অতঃপর হাতে থাকা পানি ছিটালো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তৌসিফকে। তৌসিফ মুখ কুঁচকে তাকালো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“ঠান্ডা লাগবে।”
“বালাই ষাট! ঠান্ডা কেন লাগবে?”
“প্রথম বৃষ্টি পৌষরাত। এত পানি নেড়ো না।”
“হেমন্তের বৃষ্টি। হেমন্তের বৃষ্টি পৌষের কষ্টের কারণ হতে পারবে না৷ হেমন্তের খুব প্রিয় পৌষ।”
“আর তৌসিফ? তৌসিফের প্রিয় না?”
“জানি না৷”
পৌষ আবারও দুই হাত বাইরে বাড়িয়ে দিলো। পানিতে হাত ভেজাতে ভেজাতে উচ্ছসিত হয়ে বললো,
“আপনার হাতও বাইরে আনুন।”
তৌসিফ হাত বাইরে আনবে তো দূর উল্টো পৌষের পেটটা ধরে রাখলো পেঁচিয়ে। পৌষ খুব সামান্য বিরক্ত হলো। বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বাইরে হাত দিয়েই দেখুন না৷ এক কাজ করি, ছাদে চলি? ভিজতে মন চাইছে।”
“খবরদার! এসব মুখে এনো না।”
“আশ্চর্য! মুখে না আনার কি আছে? চলুন ছাদে যাই। আজ গলা বড় করে হেমু ভাইকে বললাম আপনি আমাকে ভালো রাখবেন।”
“ভালো রাখব না বলছো?”
“সামান্য বৃষ্টিতে ভেজার আবদারই রাখছেন না জনাব। হায়, আমার তো ইচ্ছে ছিলো জামাই নিয়ে রোম্যান্টিক হব। বৃষ্টিতে ভিজব। মন খুলে আবদার জুড়ে দিব।”
“তো করো আবদার।”
তৌসিফ থুতনিটা পৌষের কাঁধে রেখে বললো। পৌষ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। বললো,
“আচ্ছা, সম্রাট তালুকদার কেমন ছিলো? উনি তো বিয়ে করেন নি অবশ্য কিন্তু গার্লফ্রেন্ডও কি ছিলো না? আমার মনে হয় তিনি বেশ রসিক ছিলেন।”

“তিনি রসিক ছিলেন, তোমাকে কে বললো?”
“মন বললো।”
“তোমার মন ভাইজানকে নিয়ে এত ভাবে? আমাকে নিয়ে ভাবে না?”
“ভাবার কারণ দিন আমাকে? চলুন বৃষ্টিতে ভিজি।”
কথার জালে বউ ফেলতে চাইছে বুঝতে পারলো তৌসিফ। হার না মেনে বললো,
“মোটেও ভিজতে দিচ্ছি না।”
পৌষ মুচড়ে সরে দাঁড়ায়। হাত দুটো তৌসিফের বুকের দিকে ধপ করে মুছে সরে যায় সেখান থেকে। তৌসিফ আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে বললো,
“তুমি কি এই সামান্য কারণে রেগে গেলে?”
“রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।”

বলেই পৌষ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তৌসিফ জানে বউ তার বাইতা ইদুর। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ির উপরই থাকে সে। জানালার থাই দ্রুত হাঁটে বন্ধ করে তৌসিফ ছুটলো বৌ খুঁজতে। কে জানে, আবার বেরিয়ে গেলো কি না? যেই অবাধ্য বউ তার। তৌসিফের নিজের উপর নিজেরই অবাক লাগে। সে কি না এভাবে ঘুরছে একটা মেয়ের পিছনে? এসব এখন মানায় তাকে? কেউ দেখতে মান ইজ্জত থাকবে কিছু? কোথায় গিয়ে যেন তৌসিফ সেই গম্ভীর্য ভাবখানা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। পৌষের সাথে শক্ত ব্যবহার করতে পারছে না। সারাক্ষণ মনটা আজ-কাল বিচলিত থাকছে। পৌষ থেকে এটেইনশন পেতে মন চাইছে৷ কে জানে কেমন একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় তার পেটে। সবসময় না কিন্তু পৌষের কাছাকাছি গেলে এটা হয়েই আসছে। ভালোবাসা না থেকেই যখন তৌসিফ পিছলে গেলো, না জানি ভালোবাসা প্রকাশে কোন আছাড়ই না খাবে ও।

তৌসিফ বাইরে এসে দেখলো হলরুম খালি। মেইন দরজা খোলা দেখেই যা বুঝার বুঝলো। দুষ্ট বউ তার। অবাধ্য মেয়ে। বড়ই উড়নচণ্ডী। তৌসিফ দেখলো এদিকে কেউ নেই। সবাই এই ঝুম বৃষ্টিতে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে আরাম করে। বর্ষার বৃষ্টি তো না বরং শীতের বৃষ্টি। তৌসিফ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। ছাদে কিছুতেই পৌষকে এখন যেতে দেওয়া যাবে না। কথাটা মনে পরতেই তৌসিফ যেন দৌড় দিলো। পৌষ এক ধাপ সিঁড়ি এগিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার আগেই তৌসিফ খপ করে ওর হাত ধরে ফেললো। পৌষ ছাড়াতে চাইলো। কণ্ঠে বিরক্তি এনেই বললো,

“দেখুন ভাই, জামাই লাগবে না আপাতত। আমি একাই ভিজব।”
“জামাই লাগবে না কেন?”
“কারণ আমার কপাল পুড়া।”
“তোমার কপাল পুড়া? একথা বলতে পারলে?”
“দেখুন ভাই, আপনার সাথে কথা কাটাকাটি করতে গেলে আমার দেড়ী হবে। আমাকে যেতে দিন। আধ ঘন্টা পরই ফিরে আসব।”

তৌসিফ ছাড়লো না কিছুতেই। জোর করে টেনেটুনে নিয়ে এলো। পৌষ সেই থেকে রাগে কাঁপছে। মুখ দিয়ে টু শব্দ করে নি। বাসায় আপা আছে। তার কানে গেলে নিশ্চিত পৌষকে বেয়াদব ভাববে যদিও পৌষ মানে ও বেয়াদব। অতশত আদব কায়দা শেখার ফুরসত নেই তার। তৌসিফ এদিক ওদিক কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। বউ রেগে আছে বিঁধায় তার সামনে যাওয়ার সাহস করছে না আপাতত। ভাবা যায়, এক সৎ মামাতো বোন যে কি না তৌসিফের একান্ত বউ তাকে তৌসিফ ভয় পাচ্ছে। লজ্জার বিষয়। তৌসিফের মাথায় বুদ্ধি এলো। বলা কওয়া ছাড়াই পৌষকে পাজা কোলে তুলে চলে গেলো রুমের বাইরে। পৌষ শুধু দাঁত চেপে বললো,

“রংঢং বাদ দিয়ে নামান আমাকে।”
তৌসিফ পিঠ আঁকড়ে ধরা হাতটা ছেড়ে দিলো। পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতেই পৌষ ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। তৌসিফ ওর চোয়াল সামান্য চেপে ধরে। মুখের কাছাকাছি মুখ এনে বলে,
“কত বলি দাঁত চেপে কথা বলবে না।”
পেছনের একটা ঘরে এনে তৌসিফ বাতি জ্বালালো। পৌষ দেখলো রুমটা বিরাট বড়। ততটা আসা হয় নি এখানে। তৌসিফ ওকে নিয়ে সোজা বারান্দায় গেলো। থাই খুলে দিতেই বৃষ্টির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিলো খুব সামান্য। পৌষ চোখ কুঁচকে তৌসিফের বুকে মুখ ঘঁষে বললো,

“বৃষ্টি তেছড়া ভাবে পড়ছে।”
“একদম তোমার মতো।”
পৌষ নড়াচড়া করতেই তৌসিফ নামিয়ে দিলো। এখান থেকে তেমন কিছু দেখা যায় না। শুধু বালির মাঠ আর ঘরবাড়ির দেখা মিলে। দুজন ভিজে গেলো খুব শিঘ্রই। তৌসিফের পরণে থাকা হালকা বাদামী রঙের টিশার্ট ভিজে বুকে পিঠে সিটিয়ে যেতেই ও নজর দিলো পৌষের দিকে। মেয়েটার কাপড়ও দেহের মাঝে লেপ্টে গিয়েছে। তৌসিফ ওর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিলো। হাতের ভাজে ভাজে হাত নিয়ে আঙুল গুলো গাঁথলো সুন্দর ভাবে। পৌষ আনমনা হয়েই বললো,

“এই দিকটায় আসা হয় নি ততটা।”
“হুঁ।”
তৌসিফ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে পৌষের ভেজা চুল নেড়ে দিলো। গলায় লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে বললো,
” কাঁপছো তুমি। ভেতরে চলবে?”
“আপনি কখনো সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছেন?”
ঘোলা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো পৌষ। তৌসিফ অবাক হয়েই উত্তরে প্রশ্ন করলো,
“সারারাত কেউ ভিজে?”
“ভিজে তো। আমি ভিজি।”
“অসুস্থ হতে না?”

“উঁহু। আমি সহজে অসুস্থ হই না। আপনি জানেন কি হয়েছিলো? হেমু ভাই বাসায় ছিলো না৷ আমি সারারাত বাইরে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।”
এলোমেলো খুব সামান্য বললো পৌষ। তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইতেই পৌষ হেসে বললো,
“কিছু না৷ ভিজতে মন চাইছিলো তাই ভিজেছিলাম।”
তৌসিফের মনে হলো পৌষ কিছু লুকিয়ে গেলো। মেয়েটা হয়তো আজও তাকে ভরসা করতে পারছে না। তৌসিফ আচমকা কিছু ভেবে নিলো। সে পৌষকে কিছু বলতে চাইলো। এক দুই দিন ধরে বলেও বলা হচ্ছে না। ভাবছে আজ বলে দিবে। এমন বৃষ্টি ভেজা মূহুর্তে কাঁপছে দু’জন। পৌষের ঠোঁট দুটো সাদা হচ্ছে ধীরে ধীরে। তৌসিফ খুব ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসলো পৌষের সামনে। পৌষ কিছু বুঝার আগেই তৌসিফ পৌষকেও টেনে বসালো ওর হাঁটুতে। হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে আচমকাই তৌসিফ বলে দিলো,

“আলাভইউ হানি। উইল ইউ লাভ মি ঠু?”
পৌষ আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তখনই খুব আশেপাশে বজ্রপাত হলো। কালোর মাঝে সাদা আলোয় দু’জন দেখে নিলো দু’জনে মুখ। তৌসিফ হাত নেড়ে পুণরায় তাড়া দিলো,
“বলো?”
“ভালোবাসা?”
“হুঁ।”
“এটা দিয়ে কি হবে? আমরা তো একসাথেই থাকি।”
“একসাথে থাকা আর ভালোবাসা কি এক কথা পৌষরাত?”
“আলাদা নাকি? সংসার তো করছিই আমরা।”
তৌসিফ খুব অবাক হলো। তাহলে কি এতমাসেও পৌষ ওকে ভালোবাসে নি? তৌসিফ তো বাসলো। ভালোবেসে ইজহারও করে দিলো তাহলে পৌষের কেন কিছু হলো না? তৌসিফ আচমকাই বলে বসলো,

“আমি তোমার সাথে বাচ্চাকাচ্চা সংসারের স্বপ্ন দেখি পৌষরাত।”
“মন্দ না দেখা। দেখতেই পারেন। আল্লাহ চাইলে হবে।”
“ভালোবাসা ছাড়া কেউ আসবে সেটা কিভাবে মেনে নিব আমি?”
“এখন কি জোর করে ভালোবাসতে হবে?”
“হবে হানি, প্লিজ ট্রাই। আমি তোমার বাচ্চার মা হতে চাই।”
পৌষ হঠাৎ করে এমন ঘনঘটা মূহুর্তে চারপাশ কাঁপিয়ে হেসে ফেললো। আঙুল দিয়ে গুতা দিলো তৌসিফের পেটে। তৌসিফ নিজের ভুল বুঝে শুধরানোর সুযোগ পাওয়ার আগেই পৌষ বললো,
“প্রযুক্তি খুব এগিয়ে তাই বলে এতটা?”

তৌসিফ কিছু বললো না। পৌষের থুতনিতে চুমু খেলো চুপচাপ। পৌষ আবদার বুঝে। খুব আদরের সহিত তৌসিফের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি কখনো আপনাকে ফিরিয়ে দেই নি। খুব বাজে তকমা গায়ে লাগিয়ে আপনার সংসারে এসেছি। সংসার করছি। সবটাই আপনার ইচ্ছেতে হচ্ছে। ভালোবাসাটা হবে কি না বুঝতে পারছি না।”

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৬

তৌসিফ ওকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো তাদের রুমের দিকে। আবেগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পৌষের দিকে। পৌষ হাসলো। তৌসিফ অভিভূত হয়। মেয়েটা এমন মূহুর্তে সবসময় হাসে। সেই হাসিতেই তৌসিফ মরে যায়। বারবার মরে যায়। আজও মরার পথে পা বাড়াচ্ছে তৌসিফ। খুব তোরজোড় করে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here