প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৮
সাইয়্যারা খান
“কোথায় ছিলেন আপনি সারারাত?”
তুহিন উত্তর করে না। টলমলে পায়ে ভেতরে ঢুকে। পলক আগায় না। দরজাটা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে নিজেকে অতিরিক্ত একটা জঞ্জাল মনে হয় তার। এই যে তুহিন ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলে গেলো, কেন গেলো? তার দৃষ্টিতে পলকের অবস্থানটা ঠিক কোথায় পলক বুঝে না। ধপাস করে শব্দ হতেই চমকালো পলক। বুঝলো তুহিন পড়ে গিয়েছে। দরজা আটকে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ঘরে। ঘর অন্ধকার। তুহিন হয়তো বাতি জ্বালাতে পারে নি। সুইচ চাপ দিতেই হলদেটে আলোয় ঝকঝকে দেখালো ঘরটাকে। পলক তারাতাড়ি বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেলো। উবুড় হয়ে বেসিনে মুখ দিয়ে পড়ে আছে তুহিন। গোটা মুখটা ওর বেসিনে। নিশ্চিত বমি করতে করতে এখানেই ঘুমিয়েছে। পলক পলকহীন চোখ তাকিয়ে রয়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন তার বিষ ছড়ায়। চারপাশে বিষাক্ততায় ঘিরে যায়। নিজে ঢুকে তুহিন’কে সামলাতে সামলাতে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। এই শক্ত দেহ টানার শক্তি তার ততটা নেই। পানি ছেড়ে তুহিনের মুখ ধোয়াতেই কিছুটা নড়েচড়ে উঠে ও। পলক আস্তে করে শুধু বলে,
“শান্ত থাকুন।”
“তোর বোন একটা *শ্যা।”
নিজের আপন বড় বোনকে নিয়ে শোনা এতটা বাজে মন্তব্যে পলক সামান্যও রাগ দেখালো না৷ না ছাড়লো তুহিনকে। উত্তরে ছোট করে বললো,
“আপনার ভাইও। এর পুরুষবাচক আর বললাম না।”
“তুমি বাইরে যাও। আমি একাই পারব।”
পলক কোন কথা বলে ছেড়ে দিলো। বেরিয়ে এলো বাইরে। একেবারে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রান্না ঘরে আসতেই দেখলো কিছু ময়লা হাঁড়ি পাতিল রাখা। চট করে মাথাটা ধরে গেলো ওর। মাড়ি শক্ত করে দ্রুত কদম ফেলে গেলো কাজের মেয়ের ঘরে৷ ওখানে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে শ্যামলা দেখতে মেয়েটা। ঘুমন্ত মেয়েটার চুলে থাবা বসালো পলক। ঘুম থাকায় প্রাথমিক ভাবে না বুঝলেও পরক্ষণেই মেয়েটা গুমরে উঠে। কেঁদে ফেলে শব্দ করে। হিসহিসিয়ে তেড়ে উঠে পলক,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“অ্যই চুপ! একদম চুপ।”
“মামী.. মা..মী ব্যথা পাইতাসি। ছেড়ে দেন।”
” ভাষা ঠিক কর।”
বলেই চুলটা আরেকটু টেনে ধরে পলক। মেয়েটা ছটফটিয়ে উঠে। ব্যথায় তার সদ্য জাগ্রত মস্তিষ্ক টনটন করছে। কোনমতে তুতলে বললো,
“ব্যথা পাচ্ছি মামী। ছেড়ে দিন দয়া করে।”
“আমি ছেড়ে দেই আর তুই পরে পরে ঘুমা তাই না? রান্নাঘরে নোংরা কেন? রাতে তুই পরিষ্কার করলি না কেন?”
“ওগুলো তো বুয়া… ”
পলক ওকে বলতে দিলো না। টেনে হিঁচড়ে নিলো রান্নাঘরে। ফিনফিনে দেহটা ঠকঠক কাঁপছে তখন। এক প্রকার ওকে ছুঁড়ে ফেলে পলক। আঙুল দিয়ে পাতিল দেখিয়ে বলে,
“এখনই পরিষ্কার কর।”
মেয়েটার সম্পূর্ণ কায়া কম্পমান৷ কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে যেতেই ওর গায়ে ধাক্কা খেয়ে একটা কাপ পড়লো নিচে। “অভাগী যেখানে যায় সেখানে সমুদ্রও শুকিয়ে যায়” কথাটা যেন পই পই করে ফলে গেলো। মেয়েটা থম মে’রে দাঁড়িয়ে যাওয়া মাত্রই পলক যেন চিতার বেগে হামলে পড়ে। গালে দুটো চটকানা খেতেই গ্রাম্য ভাষায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে কিশোরী। নিজের মৃত মা আর বাবা’কে ডেকে উঠে করুণ স্বরে। মাঝেমধ্যে দাদীকে ডাকে। পলক হাতের কাছে বেলন পেতেই ওটা দিয়ে প্রহার করলো ওর পিঠে। নিজের সবটুকু রাগ উগলে দিলো ছোট জানটার উপর। পলকের এইরূপ কেউ দেখে নি৷ কখনোই না। বরাবরই এক শান্ত, ঠান্ডা, মিষ্টি দেখতে মেয়ে পলক। অত্যাচারী, অমানুষিক রূপটা তার মাঝে জাগ্রত হয় মাঝেমধ্যে। ক্ষেত বিশেষে।
হঠাৎ পলকের হাতটা ধরে কেউ আটকালো। নিমিষেই খানখান হলো পলকের সেই দৈত্য রূপ। শান্ত, কোমল এক নারীতে পরিণত হলো সে। মুখের সেই কঠিন ভাবখানা উড়ে গিয়ে ঠাই নিলো নমনীয়তা, স্নেহ, মায়া। তুহিন দেখলো ফ্লোরে শুয়ে থাকা কাজের মেয়েটাকে। পলক’কে কিছু জিজ্ঞেস করলো না বরং পলকই জিজ্ঞেস করে,
“খাবেন এখন?”
“হুঁ।”
পলক শান্ত পায়ে গিয়ে ফ্রীজ খুলে। ঠান্ডা খাবার ওভেনে দিয়ে গরম করে। তুহিন দুই পায়ের তালুতে ভর দিয়ে বসে। তার সামনে কলি কাঁদছে। ময়লা গায়ের রং অথচ মুখটায় ছিটেফোঁটা মায়া আছে। গড়ন সুন্দর মুখটার। মা মা’রা গিয়েছে ছোট বেলায়। একটা বোন আছে ওর ছোট। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সেখানেও মেয়ে। দাদী ভিক্ষা করে। রনিকে কাজের মেয়ে খুঁজতে বলায় ও খুঁজে এনেছে ওকে। বাজার ছাড়িয়ে মসজিদের পাশেই হক বাড়ীর ভাড়াটে কোলানীতে থাকে।
তুহিন গম্ভীর কণ্ঠে ডাকে,
“কলি?”
মেয়েটা এতক্ষণ কাঁদছিলো তাই বুঝে নি তুহিন এসেছে। ওকে সামনে দেখেই শব্দ করে কেঁদে উঠে। তুহিন একই ভঙ্গিতে বলে,
“উঠে ঘরে যা। সকাল হোক, ডাক্তার আসবে।”
“মামা, মামী মে’রেছে। আমি বাড়ী যাব মামা। আমাকে বাড়ী যেতে দিন।”
কলি উঠে বসেছে। তুহিনের শান্ত মুখটা অশান্ত হলো। দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলো,
“অ্যই কু’ত্তার বাচ্চা, যা ঘরে যা।”
কলির দেহটা কাঁপছে। তাকে এখানে যেকোনো দিন মে’রে ফেলবে পলক। উঠে দাঁড়ালো পলক। পেছন ফিরে দেখলো টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে পলক, ঠিক একজন দায়িত্বশীল, প্রেমময় স্ত্রী’র ন্যায়। মনটা ভালো হলো তুহিনের। ও যেতে নিলেই পেছন থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে কলি পুণরায় বলে,
“মামা আব্বাকে আসতে বলেন না। বাড়ী যাব আমি।”
সবে মাত্র মনটা ঠিক হয়েছিলো যা বিগড়ে গেলো ততক্ষণাৎ। পেছনে ঘুরে ক্যাবিনেটের নিচের ড্রয়ার খুলে একটা চা’পাটি বের করে তড়িৎ বেগে ধরে কলি’র ঘাড়ে। দাঁত খিঁচিয়ে বলে,
“আরেকবার বাড়ী যেতে চাইলে কল্লা ফেলে দিব জা’নোয়ারের বাচ্চা। সোজা ঘুমাতে যা।”
ঘাড় থেকে তুহিন চাপাটি সরাতে না সরাতেই দৌড়ে ঘরে ঢুকে কলি। তুহিন খেতে বসার আগেই কাউকে ফোন দিলো।
পলকের চোখে মুখে কোন ভাবাবেগ নেই। খেতে খেতে তুহিন বললো,
“তুমি খেয়োছো?”
“আমি ডায়েটে আছি।”
“লাভ কি জান? সেই মোটাই দেখাচ্ছে তোমাকে।”
পলক আঁতকে উঠে। কম্পমান গলায় বলে,
“কিন্তু আমি তো চার্টের বাইরে খাবার খাই না।”
ও কথা বলার সময় মুখ খুলতেই মুখে এক লোকমা খাবার ঢুকিয়ে দিলো তুহিন।
বাড়ীতে বিয়ের রমরমা পরিবেশ। পৌষ’র পায়ে সামান্য ব্যথা আছে এখন। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় না কিন্তু একেবারে আগের মতো দৌড়াদৌড়িও ততটা করতে পারছে না। ড্রয়িং রুমে সভা বসেছে। হেমন্তের বিয়ের আলোচনা হচ্ছে। এই মাসেই শুভ কাজটা সেরে ফেলার যথাযথ চেষ্টা করছে সকলে। শ্রেয়া’র বাড়ী থেকেও সমস্যা নেই। মেয়েকে তারা সুপাত্রের হাতে তুলে দিয়ে ওমরায় যাবেন। হেমন্ত বাপ-চাচাদের সাথে কথাবার্তা বলছে। ওর দুই দিকে ইনি, মিনি বসা পায়ের উপর হাত দিয়ে। তার দুই পায়ে চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য। পিহা চৈত্র’র ঘাড়ের পেছনে উঁকি দিয়ে আলোচনা শুনছে। পৌষ বসা একদম মুখের সামনে। আধ ভাঙা পা দোলাচ্ছে ও। মুখে একটু পর পর চানাচুর পুরছে। সকলে গভীর মনোযোগী হয়ে শুনছে সব। মেয়েকে দেনমোহর কত দিবে, গয়নাগাটি সহ হাবিজাবি কিনতে হবে৷ মা-চাচিদের উদ্দেশ্যে হেমন্ত বললো,
“শাড়ি গয়না শ্রেয়ার পছন্দেই কেনা হবে। বিয়ে তো একটাই, নিজের পছন্দে সব করুক।”
কথাটা বোধ-হয় মা-চাচিরা পছন্দ করলো না। সেঝ চাচি বলে উঠলেন,
“মেয়ের আবার পছন্দ কিসের? জামাই বাড়ী থেকে যা দিবে তাতেই খুশি থাকবে।”
” বিয়ে মেয়ের, পছন্দ তো তারই হবে সেঝ চাচি। বউ আনছি আমি, তাকে যথাযথ সম্মান করার দায়িত্ব আমার।”
একটু থেমে বাবা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
“গয়না মা-চাচিরা কিনে ফেলুক। শাড়ি সহ বাকি সব পৌষ’কে সাথে নিয়ে শ্রেয়াকে কিনে দেই।”
বড় চাচি ফট করে বললেন,
“পৌষ যেয়ে কি করবে? ও বুঝে কিছু?”
“বিয়ের আগে তো শ্রেয়াকে একা নিয়ে বের হওয়া মানায় না আম্মু।”
“অন্য কাউকে নিয়ে যাও।”
“ইনি-মিনিকে নিয়ে যাই তাহলে?”
ইনি, মিনি লাফিয়ে উঠলো খুশিতে, বাকিরা হকচকালো। দুই বোন আদুরে আহ্লাদী হয়ে হেমন্তের গালে গাল ঘোষছে। হেমন্ত দুই বোনকে কোলে নিয়ে বসে। ছোট ছোট দুটো পুতুল যেন এরা৷ দেখলেই আদর আদর লাগে। এক সাথে যখন কথা বলে তখন আদুরে ভাবখানা টগবগিয়ে বাড়ে।
ছোট চাচি সকলের জন্য চা আনলেন। চা পান করতে করতে বড় চাচা বললেন,
” তাই করো। মেয়ে মানুষের কত কিছুই তো লাগে এখন। তোমার মা-চাচিরা ততটা বুঝবেও না এখন আর না বুঝবে তুমি নিজে। পৌষ গেলে শ্রেয়াও কিছুটা স্বস্তি পাবে কেনাকাটা করতে।”
বাবা’র কথা পছন্দ হলো হেমন্তের। ছোট চাচা জানালেন,
“কার্ড কাল নিয়ে আসব। সেঝ ভাই ডেকোরেটরের সব কাজ দেখছে। আর জৈষ্ঠ্য, চৈত্র সাথে আছে, কেটারিং এ ঝামেলা হবে না।”
বাড়ীতে অনেক বছর পর বিয়ে হচ্ছে। শেষ ছোট চাচার বিয়ে হলো। সকলেই অতি উৎসাহী বিয়েটা নিয়ে। পৌষ’র আর ভালো লাগলো না এই আলোচনা৷ চা হাতে নিয়েই উঠে নিজের ঘরে ঢুকলো। বিছানায় বসে আলমারির কাপড়ের ভাজ থেকে বের করলো একটা ভাজ করা কাগজ। দরজাটা সামান্য চাপিয়ে খাটে বাবু সেজে বসে এক চুমুক চা খেলো। মুখে জোরপূর্বক কিছুমিছু লজ্জা ভাব এনে চার ভাজ করা কাগজটা খুললো। চোখের মনিতে তখন ভেসে উঠে এক পুরুষের অবয়ব। প্রায়সময় পৌষ একা থাকাকালীন সময় দেয় এই কাগজের টুকরোটাকে। এই জোয়ানের নামে যতই শুনে ততই মুগ্ধ হয় পৌষ। এর কীর্তিকালাপ সব গুছিয়ে মনে রাখে পৌষ। চোখটা বন্ধ করতেই এক লাল রঙা গাড়ি ভেসে উঠে পৌষ’র মানসপটে।
করোল্লা ই ত্রিশ এর ড্রাইভিং সিটে বসা এক তাগড়া পুরুষ যার হাতের শিরা গুলো স্টেরিং ঘোরানোর সাথে সাথে ফুলেফেঁপে উঠছে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে পৌষ, ‘কে এই সম্রাট চেয়ারম্যান?’ উত্তরটা তার মন তাকে দিলো স্বেচ্ছায়, এক বিস্তর কল্পনায়।
সম্রাট? বাঁশ রঙা এক শার্টে লম্বাটে এক দেহ। সম্রাট? ঝাকড়া চুলে ক্লিন শেভ করা এক তাগড়া যুবক। যার লাল রঙা গাড়িটা নিয়ে সে দাপিয়ে বেড়াতো সারা শহর। নায়ক মান্নার মতো মুখের সেই আদল যাতে কতশত যুবতী ডুবে যেতো। কত চোখে কাজল আঁকা হলো। কত ঠোঁট রঙিন হতো। দাপুটে সম্রাট তালুকদার শুধু নিজের দাপট নয় বরং উজাড় করে দিয়েছে স্বয়ং নিজেকে। যার পেছনে থাকতো কত কত যুবক। কোমড়ে গুঁজে থাকা লাইসেন্স করা সেই পি’স্তল হোক বা হোক বাম হাতে থাকা সোনার ঘড়ি সবটাই যেন তার রাজকীয়তার বহিঃপ্রকাশ। উদাম গায়ে তখন লুঙ্গি পরে বাড়ির পুকুরে ডুব দেয়া হয় তখন আড়াল থেকে উঁকি দেয় একদল যুবতী।
সম্রাট? সে না মেদ পূর্ণ আর নাই ফিনফিনে দেহের। সে হলো এক স্বপ্ন পুরুষ। যার চোখে তাকিয়ে কেউ কথা বলে না। যার কাছে কেউ হিসেব নিকেশ চায় না। নাম নয় বরং আগা থেকে গোড়া পুরোটাই সে সম্রাট। এক অনবদ্য ভূমিকার সাক্ষী। এক অলিখিত অধ্যায়। এক জলজ্যান্ত পুরুষ যে এক শ্রেণীর মানুষের একমাত্র আশার প্রদীপ। কারো চোখের অশ্রু ঝরানোর একমাত্র শব্দই তো সম্রাট। উপন্যাসের চিত্ররূপই তো সম্রাট। শুধু বুঝি নাম, এই জলজ্যান্ত পুরুষটার সবটুকু জুড়ে শুধু আভিজাত্য। যখন ঝাঁজালো সেই সুগন্ধি মেখে রাস্তা দিয়ে যায় তখন কত নারী যে লুকিয়ে যে ঘ্রাণ নেয় তার ইয়াত্তা নেই। এই প্রেম নগরের রাজপুত্র সে। ষোড়শী থেকে যুবতী সবার চোখের প্রেম সে। অষ্টাদশীর কাজল লেপ্টে যাওয়ার দোষে দোষী সে। দাপুটে তালুকদার সে। সমশের তালুকদারের যোগ্য পুত্র সম্রাট চেয়ারম্যান সে।
পৌষ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গুনগুন করে গান গায়,
‘আমার প্রাণে বায়ে বায়ে বাজে রে বাঁশির সুর,
সে যে কাহারে চায় — কাহারে ডাকে — কাহার তরে জাগে তার মধুর গুঞ্জর।
চিরদিন তার আশে-পাশে রহি, চেয়ে চেয়ে দেখি, ভাবি মনে মনে…
সে কি জানে না জানে?’
গানটা গাইতে গাইতে পৌষ হায়হুতাশ করে আবার গেয়ে উঠলো,
“আমি রূপ নগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি,
ইরান-তুরান পাড় হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি..
কিন্তু তুমি নাই…
ও বন্ধু তুমি কই কই রে,
এই প্রানও বুঝি যায় রে…”
বড় চাচি হুরমুর করে ভেতরে ঢুকতেই কপাল কুঁচকে তাকালো পৌষ। মেজাজই খারাপ হলো এক প্রকার। না চাইতেও জিজ্ঞেস করে,
“কিছু বলবে?”
“হেমন্তকে বলবি তুই যাবি না তোর পায়ে ব্যথা।”
“কে বললো? পা আমার ফিটফাট আছে। ফুটবলে দুটো লাথি দিয়ে দেখাব?”
“ফাইজলামি করবি না পৌষ। আমার ছেলের বিয়েটা ভাঙবি তুই।”
পৌষ ঠান্ডা চায়েই চুমুক দিলো। বললো,
“কেন? ভাঙলে কি তুমি কষ্ট পাবে?”
বলেই হেসে ফেললো। বড় চাচি বেজায় রেগে গেলেন। বলে উঠলেন,
“বেয়াদবি করবি না পৌষ। তোর সাথে হেমন্ত বাইরে গেলে বউ রেখে তোকেই হাজার জিনিস কিনে নিবে। নতুন বউ এসব দেখে মানবে? ওর সাথে যাবি না তুই, খবরদার।”
পৌষ এমন একটা মুখ করলো যেন খুব কষ্ট পেলো। বড় চাচি তো এটাই ভাবলেন কিন্তু তার ভাবনা চুরমার করে পৌষ বললো,
“বিনিময়ে একটা কাজ করতে হবে।”
“কি কাজ?”
বড় চাচি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে। পৌষ চা শেষ করে বললো,
“তোমার ছেলের বিয়েতে আমি কোন ভাবেই উপস্থিত হব না। বিয়ে তো দূর কোন অনুষ্ঠানেও না।”
“পা’গল তুই? হেমন্ত মানবে না। ও বিয়েই করবে না।”
“সেটা তো আমি জানি না।”
বড় চাচি রেগে গেলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“বুঝি তো আমি, বুঝি না। আমার ছেলেটাকে চিপড়ে খাবি তুই। তোর মা ছিলো…. ”
“হেমু ভাই! হেমু ভাই!”
আচমকা পৌষ এভাবে ডাকায় বড় চাচি চমকালেন। পৌষকে কিছু বলার আগেই দৌড়ে হেমন্ত সহ পাঁচ ভাই-বোনও ঢুকলো। পৌষ হাতেনাতে চাচিকে ধরালো। বললো,
“বড় চাচি বললেন যাতে তোমার বউয়ের আশেপাশে না থাকি। মনজুর করা হলো এই দাবি।”
হেমন্ত কপাল কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত হয়ে মা’কে বলে উঠলো,
“তোমার মূল সমস্যাটা কোথায় আম্মু?”
বড় চাচি ইহকালেও ভাবেন নি পৌষ এমন করে উঠবে। এই মেয়ে একটা ইতর। এত কটুকথা, এত অপমান-অপদস্থ করেন তবুও এই মেয়ে ভাঙে না। কিসের গড়া এই মেয়ে? কোন ধাতুর? এর গায়ে কি কোন কথাই লাগে না? মানুষ এতটা শক্ত ধাঁচের কিভাবে হয়?
পিহা কি একটা মনে করে দৌড়ে গিয়ে বাবা’র কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
“আম্মু আপা’কে বিয়েতে থাকতে না বলেছে। হেমু ভাই রেগে গিয়েছে।”
বড় চাচা টগবগিয়ে উঠলেন। স্ত্রী’র প্রতি বিরক্ত ভাব তার চোখে মুখে। এই মহিলা একটা ত্যড়া।
পৌষ’র ঘর থেকেই গুজব রটে গেলো, ‘হেমন্ত বিয়ে করবে না।’
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৭
বিষয়টা অবশ্য গুজব না। হেমন্তে’র মুখ দিয়েই কথাটা বেরিয়েছে। পৌষ পাত্তা দিলো না কিছুতেই। ও বরং ভাই-বোন নিয়ে ছাদে উঠেছে পাশের বাড়ীর চালতা চুরি করতে। ছোট ছোট মাত্র ধরেছে। জৈষ্ঠ্য’কে দিয়ে একটা বাঁশ আনিয়ে তাতে পলিথিন বেঁধে রেলিঙের উপর দাঁড়ালো পৌষ। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য দুই দিক থেকে তাদের আপাকে ধরে আছে। পিহা বোল-বাটি নিয়ে এলো। ছোট ছোট হাতে পানিতে চাতটা ধু্চ্ছে ইনি-মিনি।
ছাদের মেঝেতে বসে ভর্তা মেখে যখন আঙুল চেটেপুটে খাচ্ছে সকলে তখনই ছাদে আসে হেমন্ত। নিজেও যোগদান করে ভাই-বোনদের সাথে।