প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৯
সাইয়্যারা খান
আজ বুধবার। ১৪ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। তৌসিফ ডিজিটাল ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখে মুখটায় বিরক্ত হওয়া ভাব ফুটালো। এখনও খালি গায়ে বিছানায় উল্টে শুয়ে আছে সে। সময় এখন সকাল। দশটার আগে তাকে কেন্দ্রে থাকতে হবে। এতগুলো দিনের পরিশ্রম তার, বিফলে যেতে দেওয়া যাবে না। মস্তিষ্ক জটিল জটিল সমীকরণ সমাধানে সক্ষম তার। এবারের নির্বাচনে উমায়ের শিকদারের জয়ী হওয়া তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তুহিন যেই হারে ক্ষেপেছিল, তার উপর দিয়ে গিয়ে তৌসিফ উমায়ের’কে জেতাবে।
ঐ দিকে তাহমিনা আপা এ নিয়ে ভীষণ নারাজ তাও তৌসিফ জানে। চাচি আম্মার সাথে তৌসিফ একবার দেখা করবে ভাবলো। তাহমিনা আপা গরম মাথার মানুষ। আলস্য ঠেলে তৌসিফ উঠে বসলো। দুই হাতে চোখ কচলে টেবিলে ঢেকে রাখা চিয়া বীজ ভেজানো পানিটা পান করতে করতে বারান্দায় হেঁটে গেলো। এই পানিটা সকালে তার পান করতেই হয়। প্রচুর স্বাস্থ্য সচেতন কিনা তৌসিফ তালুকদার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কচুরিপানা দিয়ে সামনের পুকুর ভরে উঠেছে। তৌসিফ মোটেই এই দিকটায় সময় দিতে পারছে না। নির্বাচনের কাজ নিজে দেখে দেখে করাচ্ছে। প্রচার শেষ সময়ে বন্ধ আছে, এটাই নিয়ম নাহয় তৌসিফ আজ সকালেও মানুষ পাঠাতো। আপাতত তার নজর সীমাবদ্ধ ঘাটে। তার মায়ের খুব প্রিয় একটা জায়গা এই ঘাট পাড় তাই বোধহয় তৌসিফ অদ্ভুত এক টান অনুভব করে এটার প্রতি অথচ এই ঘাটের ক্ষুধাও আছে। জীবন্ত মানুষ গিলে ফেলার অসীম ক্ষমতা তার। তার এই ঘাট পাড়ে তৌসিফে’র প্রিয় একজন নারী একদিন পড়ে ছিলো। তাকে বাঁচানো যায় নি। তার সেই রহস্যময় মৃত্যু তৌসিফ আজও ভুলে নি। ভুলে নি তালুকদার বাড়ীর কেউ।
গোসল সেড়ে বুয়াকে বাস্তা দিতে বলে তৌসিফ ফোন করলো তুরাগ’কে। তিন ভাই একসাথে কেন্দ্রে যাবে। তৌসিফ একটু আগে যাচ্ছে। আদিত্য’কেও বলা আছে যাতে করে সে বাসায় থাকে। আজ ভার্সিটি যাওয়া তার নিষেধ। আদিত্য সায় দিয়েছে। খেতে খেতে তৌসিফ দেখলো মিনু এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। তৌসিফ ডাকলো,
“মিনু?”
“জি, মামা।”
ঝট করে এলো উত্তরটা। তৌসিফ কাছে ডেকে বললো,
“কিছু বলবি? খেয়েছিস?”
মিনু মাথা নাড়ে। তার খাওয়া হয় নি। একটু পর খাবে জানিয়ে বললো,
“মামা, আজ আব্বা আসবে।”
“কখন?”
“এই দুপুর দিকে।”
“আচ্ছা।”
মিনু সড়ে গেলো সেখান থেকে। তৌসিফ খাওয়া শেষ করে উঠে নিজের রুমে এলো। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবিটা একবার ধরেও রেখে দিলো। হালকা পিচ রঙের একটা টিশার্ট আর কালো রঙের টাউজার পরে চুলগুলো ব্রাশ করে নিজের মুখের যত্নে যথাসম্ভব খাটুনি খাটলো সে অতঃপর দশ হাজার টাকা মানি ব্যাগ থেকে বের করে মিনুকে ডেকে দিয়ে বললো,
“দুপুরে ভালো করে খায়িয়ে দিস।”
“জি, মামা।”
তৌসিফ বেরিয়ে এলো বাইরে। তুরাগ ততক্ষণে নিচে। দুই ভাই একসাথে রিক্সায় উঠলো। দশ মিনিটের দূরত্বে গাড়িটা আজ নিলো না। পেছনে দেখলো আদিত্য দৌড়ে আসছে। ওদের এখান থেকে অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ যাচ্ছে বিধায় সাড়ি বেঁধে রিক্সা চললো। তৌসিফ তুরাগকে জিজ্ঞেস করে,
“তুহিন বের হলো না?”
“ঘরে যেই *শ্যা পালে, সে বোধহয় আটকে রেখেছে।”
তৌসিফ কথা বাড়ালো না৷ পলক’কে তার খারাপ, ভালো কিছুই লাগে না। ভাইয়ের বউ সেই হিসেবে আদর বা সম্মান তাও আসে না। রিক্সাটা গেলো হক বাড়ীর সামনে দিয়ে। তৌসিফ সামান্য কপাল কুঁচকে তাকালো। এখানে একটু গ্যাঞ্জাম হয়েছে। ওর কানে সামান্য ‘তুহিন’ নামটা বাজলো। কিছুটা ভাবুক হয়েও তুরাগকে আপাতত কিছু বললো না। এখন এসবে মাথা না মা’রাই ভালো।
পলক সারা রুম জুড়ে এদিক ওদিক হাঁটছে। রাতের পোশাক পর্যন্ত খোলা হয় নি তার। চিন্তায় অস্থির লাগছে। কলি পালিয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তুহিন ওকে সেদিন ডাক্তার দেখালো, ঔষধ খাওয়ালো নিজ হাতে। খাবারটা পর্যন্ত বুয়া দিয়ে পলক ওর ঘরে পঠিয়েছে কিন্তু ও পালালো কিভাবে এটাই বুঝলো না পলক।
আজ রাত প্রায় দুইটা নাগাদ বাড়ী ফিরেছে তুহিন। সেই রোজকার কাহিনি তাদের যদিও আজ রাতে তুহিন পলক’কে তার মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে খোঁচা দেয় নি। পলক নিজেকে যথেষ্ট মেইনটেইন করে রাখে অথচ সামান্য মলিনতা দেখা দিলেও তুহিন সামান্য ভাবে তাকে খোঁচা দিবে যা পলক সহ্য করতে পারেনা। ওর কোন ভাবেই তুহিনের করা হেয় সহ্য হয় না। এই ভয়টা সবসময় পায় পলক৷ এখনও পাচ্ছে।
আজ রাতটা তাদের ভালোবাসা পূর্ণ ছিলো। তুহিন তাকে ভালোবাসার সাগরে ডুবিয়েছে। ডুবতে ডুবতে মৃতপ্রায় পলকে অতঃপর টেনে তুলেছে সেই সাগর থেকে। বুকে নিয়ে বেশ খানিকটা সময় আদর করে ঘুমিয়েছে। পলক তখন ঘুমায় নি। সে অনুভব করেছে সময়টাকে। তার প্রেমিক তুহিন আর স্বামী তুহিনের পার্থক্য অনেকটা। আকাশ পাতাল।
ভোরের আগ মূহুর্তে পলক ঘুমিয়েছে, সেই ঘুম ভেঙেছে তুহিনের চিৎকারে। বুয়া তাকে জানিয়েছে কলি নিজের রুমে নেই। তুহিন ওকে এদিক ওদিক খুঁজে যখন পায় নি তখনই সোজা রুমে এসেছে। পলক ওর ওমন রূপ দেখেই সিটকে গিয়েছিলো। তুহিন গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বেশ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেছিলো,
“আবার মে’রেছিলে?”
“আমার সাথে ওর দেখা হয় নি গত তিন দিন।”
“খায় নি?”
“বু..বুয়া.. ”
বাকিটা তুহিন শুনে নি তার আগেই বেরিয়েছে। সেই থেকে দম আটকে আছে পলক। প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন বিষাক্ত।
হক বাড়ীর পেছনে কলোনিতে থাকে কলির পরিবার। কলি পালিয়েছে ভোরের দিকে৷ দারোয়ান তখন ঝুমছিলো। সুযোগ সন্ধানী কলি সুযোগ পেতেই লুফে নিয়েছে। দাদীর বুকে পড়ে কেঁদে সব জানিয়েছে। দাদীও কাঁদছেন। এছাড়া করার মতো কিছু নেই তাদের হাতে। জেনেশুনে বুঝে সেখানে কলিকে দেওয়া হয়েছে। এত টাকা, পয়সা, ভালো খাবার কোথায় পাবে আর? তার থেকেও বড় কথা ভালো বাড়ী দেখে বিয়ে দিতে পারবে তারা।
কলি যখন বাবার সাথে দেখা করবে ঠিক তার আগ মূহুর্তে বাড়ীতে হাজির তুহিন। তার পেছনে দুটো লোক শুধু। এদের মধ্যে একজনকে চিনে কলি। তার নাম টনি। তুহিন অবশ্য ধমক দেয় নি, না শাসন করেছি। শুধু কোমড় থেকে পি’স্ত’ল বের করে কপালে ঠেকিয়েছে কলির। কলি কাঁদারও সুযোগ পায় নি। তুহিনের পেছনে বেরিয়ে এসেছে। কলোনির যারা যারা সরাসরি এই দৃশ্য দেখেছে সকলের চক্ষু কপালে তখন। তুহিনের সামনে চুপ থাকলেও ও যেতেই মুখে মুখে আরো একবার রটে গেলো তুহিনের কর্মকাণ্ড।
সকাল থেকে পৌষ আজ ভীষণ ব্যস্ত। এক গাদা রুটি বেলেছে। খামিরটাও নিজে বানিয়েছে। তাকে অবশ্য কেউ কাজ করতে বলে না৷ পৌষ আকার, ইঙ্গিতে বুঝে নেয়। এই যেমন আজ ভোর থেকে বড় চাচি ওর দরজার বাইরে কয়েকবার ঘ্যানঘ্যান করেছে। পৌষ বুঝেছে তাকে বের হতে বলা হচ্ছে। সেই থেকে গত দুই ঘন্টা ধরে ও এখানে। ছোট চাচি অবশ্য বাকি কাজ করছে। সেঝ চাচি বাইরে থেকেই বললেন,
“পৌষ, বাচ্চাদের জন্য ডিম পোর্চ করিস।”
গুনে গুনে সাতটা ডিম পোর্চ করলো পৌষ। আজ আর ভার্সিটি যাওয়া হবে বলে মনেও হলো না ওর। বড় চাচির হঠাৎ ই মনে হয়েছে ছেলের বিয়ের আগে বাড়ীঘর ঝাড়া-মুছা করতে হবে। তার জন্য পৌষ’কে বাড়ীতে থাকতেও বলেছে অথচ বিয়েতে পৌষ’র থাকা নিয়ে তার ভীষণ গড়িমসি। পৌষ বিরবির করে বললো,
“সব নাটক বাজ। নিজেদের ধান্দা হলেই মনে পরে পৌষ আছে।”
টেবিলে খাবার রাখার সময় ছোট বড় কিছু হাত ওকে সাহায্য করলো। হেমন্ত ওকে দেখে কড়া এক ধমক দিলো,
“থাপ্রে গাল ফাটাব! দুই দিন ধরে ঠিক হয়েছিস, এখনই টইটই শুরু।”
পৌষ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে যখন সুন্দর একটা হাসি দিলো হেমন্তের মুখটা নিমিষেই কালো হলো। ঐ নিষ্পাপ হাসিটার মলিককে এখানে মানায় না৷ তার ঐ চাঁদ মুখটাও এ বাড়ীতে মানায় না৷ হেমন্তের মাঝেমধ্যে মনেহয় পৌষ’র উচিত ছিলো হেমন্তের বাচ্চা হওয়া। চাচাতো ভাই-বোন সম্পর্কটা ভীষণ জটলা পাকানো ধরনের। এই যে চাইলেও বোন হিসেবে জড়িয়ে ধরা যায় না, একটু অতিরিক্ত ভালোবাসা যায় না, সামান্যতম আহ্লাদ করা যায় না। সমাজ সহ পরিবার বিধিনিষেধ জারি করেছে অনেক। বিশেষ করে তার আপন মা যার চোখে পৌষ’র সামান্য কিছুও বিরাট ব্যাপার।
খেতে বসে বড় চাচা বললেন,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৮ (২)
“হেমন্ত কেন্দ্রে যাচ্ছো না?”
“হ্যাঁ, এখনই৷ বের হব৷ কল দিলে মা-চাচিরা বের হবে।”
“আমি ভোট দিয়ে যাব তাহলে একেবারে। পৌষ’কে নিয়ে যেও।”
“ওর তো এখনো এনএইডি আসে নি।”
“কম্পিউটারের দোকান থেকে না তুললো কপি। ওটা নিয়েই যাও। যদি পারলো তাহলে দিবে নে। প্রথম ভোট বলে কথা।”
হেমন্ত মাথা নাড়ে। আজ পৌষ চুপচাপ ভীষণ। কিছু হলো না জিজ্ঞেস করা দরকার।