প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১২
ফিজা সিদ্দিকী
বেলা ঠিক বারোটার সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। নন্দিতা তখন আলুথালু হয়ে রান্নায় ব্যস্ত। আজ প্রথমবারের মতো তুর্জয়ের জন্য ঝাল ঝাল করে কয়েক পদের ভর্তা বানাচ্ছে সে। সাথে একদম পাতলা ডাল। তুহিনা বেগমের কাছে শুনেছে ছোটবেলায় এই খাবারের প্রতি ছিলো তার দুর্বলতা। একবার পাশের বাড়ির এক মহিলা ঝাল ঝাল ঢেঁড়সের ভর্তা খাওয়াবার লোভ দেখিয়ে পাঁচ তলা অবদি ভারী ভারী জিনিসপত্র বইয়ে নিয়েছিল তাকে দিয়ে। ওইটুকু বয়সে বেশ ওজনের জিনিস নিয়ে টানা এক ঘন্টা ওঠানামা করায় পা ফুলে পরেরদিন জ্বর অবদি এসে গিয়েছিল। তুর্জয়ের এসব ছেলেমানুষী নানান গল্প সে শুনেছে তুহিন বেগমের কাছ থেকে। গল্প শুনতে শুনতে মাঝে মাঝেই অবাক হওয়া কণ্ঠে নন্দিতা বলে ওঠে,
“আম্মা, তোমার ছেলে ছোটবেলায় বদলে যায়নি তো? হয়তো কেউ একই রকম দেখতে ছেলেকে তোমার ছেলের জায়গায় রেখে চলে গেছে, আর তুমি বুঝতেই পারনি।”
তুহিনা বেগমকে উচ্চস্বরে হাসতে দেখে নন্দিতা আবারও আগ্রহ নিয়ে বলে,
“আমি মুভিতে দেখেছি আম্মা। একই রকম দেখতে সাতজন থাকে দুনিয়ায়। ওরকমই কেউ মনে হয় তোমার ছেলের সাথে বদল হয়ে গেছে ছোটবেলায়। নাহলে তোমার ছেলে এমন চোর চোর হলো কেন?”
“চোর?” তুহিনা বেগম অবাক হওয়া কণ্ঠে বলে ওঠে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যাঁ চোরের মতোই তো। কেমন চোখ ছোটো ছোটো করে আড়চোখে তাকায়। ঠিক যেমনটা চোররা তাকায় চুরি করার ধান্দায়। নিজের ঘর থেকে আবার কী চুরি করতে চায় কে জানে?”
“যা ওর নিজের হয়েও আলাদা, তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে চুরি করতে চায়। সামনে থেকে তাকাতে লজ্জা পায় কিনা!”
কথাটুকু শেষ করে হো হো শব্দে হেসে ওঠেন তুহিনা বেগম। নন্দিতা আগামাথা না বুঝে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকে শুধু।
একের পর এক কলিং বেলের শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় তার। চুলার আঁচ কমিয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় নন্দিতা। যাওয়ার আগে বসার ঘরে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে নন্দিতার। এই সময়, এই কাজ, এই অনুভূতি সবটুকুই তার চেনা, তবুও কেন যেন প্রতিবারই হাসফাঁস করার মতো অবস্থা হয় তার। পা চলে না। মন চায় মাটি ফাঁক হয়ে যাক, আর সে এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাক। এ দোলাচল, এ অস্বস্তি, এ অবিচার আর কত? সৃষ্টিকর্তা কি একবারও মুখ তুলে চাইবে না তার দিকে? এতো পরীক্ষা কেন নেয় তার?
কলিং বেলের শব্দ ফুরিয়ে এবার দরজায় করাঘাতের শব্দ। প্রচণ্ড শব্দে কেউ যেন অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে দরজা। এমন চলতে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে তা ভেঙে পড়তে সময় নেবে না। অবশেষে মাটিও ফাঁক হলো না, আর তারও সবকিছু থেকে পালিয়ে যাওয়া হলো না। উপায়ান্তর না পেয়ে তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দরজার নব ঘোরালো সে।
কালো পোশাকে শরীর ঢাকা। মুখের প্রায় অধিকাংশই দাড়ির কবলে। উপরের যেটুকু অংশ ফাঁকা তাতেও লম্বা একটা ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। লোকটা যেন খুব কৌশলে নিজেকে আড়াল করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। আচমকা কেউ দেখলে ভাববে কোনো কুরিয়ার বয়, কিন্তু আদতে সে শিকদারের ভৃত্য। নাহ ঠিক ভৃত্য নয়, তাদের টুকরোতে পোষা কুত্তা। যাদের না আছে মন, না আছে মায়া আর না আছে মানবতা। যেটুকু আছে সবটুকুই সর্বনাশা।
লাল লাল চোখে একপলক নন্দিতার দিকে দৃষ্টি ফেলে হাতে থাকা বক্সটা এগিয়ে দিলো সে। রোজকার মত নন্দিতা সেই বক্সটা গ্রহণ করলে লোকটা পিছু ফিরে চলে গেল, ঠিক যেভাবে এসেছিলো। কোনো বাক্য বিনিময় নয়, কোনো সৌহার্দ্যতা নয়। যেন একটা রোবট এসে তার মালিকের দেওয়া অনুমতির পালন করে গেল অক্ষরে অক্ষরে।
বিগত কয়েকদিন ধরেই ঠিক এই সময়ে এমন এক পার্সেল আসে তার কাছে। প্রতিবারের মতো পার্সেল ওপেন করে সেই একই জিনিস পেল ভেতরে। একটা টেস্ট টিউবে খানিকটা ব্লাড স্যাম্পেল, একটা সিল্ড ইনজেকশন আর কিছু মেডিসিন। এগুলো উঠিয়ে নিয়ে বক্সটা ফেলে দিলো সে। যেন এসব বিষয়ে কোনোভাবেই কিছু আঁচ না করতে পারে তুর্জয়।
আলমারির একদম কোণার দিকে অব্যবহৃত জায়গা দেখে গোপনে রেখে দিলো জিনিসগুলো। অতঃপর হতাশ মুখে ফিরে আসতে গিয়ে কী মনে করে যেন আবারও তাকালো সেদিকে। বিগত দিনের সবগুলো ব্লাড স্যাম্পেল, সিরিঞ্জ রাখা সেখানেই, এক দুই মার্ক করে। আচমকা তার খেয়াল হলো আজই তার এক সপ্তাহ পূরণের শেষ দিন। ব্যপারটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই কোটি কোটি রক্তকোষগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। বুকের ভেতরে জমাট বাঁধা রক্ত স্রোত চলকে উঠলো যেন। চিৎকার করে বলল, নাহ। এই অকাজ তুই করতে পারিস না নন্দিতা। কী নিয়ে বাঁচবি তাহলে? ভালোবাসা ব্যতীত জীবন আর কোমায় শুয়ে থাকা পেশেন্ট দুটোই এক।
কতকিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা, বোঝাতে চেয়েও বোঝানো হয়না। এই মানুষটাকে তুই ভালোবাসিস, সবটুকু দিয়ে ভালোবাসিস। যার শরীরে মশার কামড় পড়তে দিবি না বলে লোডশেডিংয়ের রাতে গোটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিস, সেই মানুষটার সাথে এমন একটা নির্মম কাজ করতে গিয়ে বুক কাঁপবে না তোর? কলিজা ছিঁড়ে যাবে না? গলা ভেঙে কান্না পাবে না? শরীর অবশ হয়ে আসবে না? যদি তাই হয়, তবে ছেড়ে দে। ছেড়ে দে এ শহর, প্রয়োজনে এ দেশ। পালিয়ে বেড়ালেও একসাথে বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা নিয়ে পালা। প্রিয় মানুষটার চোখে ঘৃণা দেখার চেয়ে যে মরণ ভালো! পারবি না ওই অবিশ্বাস করা চেহারা মেনে নিতে? পারবি তো সুস্থ মানুষটার ওই পরিণতি করে নিজেকে মাফ করতেন? কী এমন হবে? মৃত্যু? এই দুর্বিষহ জীবনের চেয়ে মৃত্যু কী শ্রেয় নয়?
নন্দিতা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। কাঁপতে থাকা দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর শব্দ করে পাগলের মতো কেঁদে উঠলো। শেষবার এমন কান্না সে বাবা মাকে খাটিয়ায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন কেঁদেছিল। এরপর অনেকগুলো মাস হলো, কান্না আসলেও কাঁদেনি কখনও। মন খারাপ হলেও হেসেছে, কষ্ট পেলেও হেসেছে, অভিমান হলেও হেসেছে, রাগ হলেও হাসি দিয়ে ভুলেছে। কারন মা বলেছিলো, হাসির মাঝেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান। আচমকা এলোমেলো পায়ে নন্দিতা এগিয়ে গেল আয়নার সামনে।
চোখে জল, দৃষ্টি ন্যুজ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সারা মুখ জুড়ে আতঙ্ক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুইহাতের তালু দিয়ে নিজের ভেজা চোখ মুছলো সে হম্ভিদম্ভী করে। অতঃপর আয়নার দিকে তাকিয়ে আচানক হি হি করে হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতেই চোখ ছাপিয়ে জল গড়াচ্ছে তার। তবুও হাসি না থামিয়ে বারবার বাচ্চাদের মত চোখ মুছছে সে। আর বিড়বিড়িয়ে বলেছে,
“আমি তো হাসছি। দেখো মা, আমি অনেক হাসছি। তুমি তো বলেছিলে হাসলে সব সমস্যার সমাধান জয় যায়। সব সমস্যার সমাধান নাকি এই মুখের হাসি। এটা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়, জীবনে জীতে যাওয়া যায়। এই দেখো আমি হাসছি তো, খুব করে হাসছি। তাও কেন আমি আমার জীবনের এই সমস্যার সমাধান পাচ্ছি না? কেন আমি পারছি না এই চক্রান্ত থেকে নিজের মানুষটাকে বাঁচাতে। কেন পারছিনা আমি সুন্দর একটা পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে। তুমি মিথ্যুক। কিছু জানো না তুমি। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ, মা। হাসি দিয়ে কিচ্ছু করা যায়না। আমি হাসবো না আর। কখনও হাসবো না।”
নন্দিতার আহাজারি বন্ধ চার দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো শুধু। কেউ জানলো না, কেউ শুনলো না হাসতে জানা মেয়েটা কতটুকু কষ্ট বুক পেতে নিয়েছে। কতটুকু ওজন তার বুকে চেপে বসেছে শেকড় গেঁথে। কেউ বুঝল না, দুঃখ লুকাতে হাসতে জানা মেয়েটা আজ আর দুঃখ লুকাতে পারল না।
নন্দিতা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপে মত্ত, ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠলো সে সময়। আতঙ্ক নামে সেভ করা এক নম্বর থেকে গোটা গোটা অক্ষরে ভেসে উঠলো এক বার্তা,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১১
“সময় ফুরালে জীবনও ফুরাবে। আজ রাত ঠিক বারোটা পর্যন্ত সময়। মেডিসিনের প্যাকেট থেকে প্রথম মেডিসিনটা খাওয়ালে ঘুমে ঢলে পড়বে। এরপরই ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্লাড প্রবেশ করাতে হবে শরীরে। ব্যথা যাতে না করে তাই ঘুমের মধ্যেই দ্বিতীয় ওষুধটা খাওয়াতে হবে। ঠিক এক সপ্তাহ পরে এডভোকেট তুর্জয় আহসানের শরীর থেকে ব্লাড কালেক্ট করার জন্য লোক পাঠানো হবে। রিপোর্টে যদি এইচ আই ভি পজেটিভ না আসে, তাহলে……বাকিটা আপনি ভালো জানেন। সময় মনে আছে তো? ঠিক রাত বারোটা।”