প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৩+২৪
ফিজা সিদ্দিকী
দিনের উত্তাপ শেষে ফাগুনী রাত। বাতাসে বাতাসে নতুন উদ্যমে জেগে ওঠার ঘ্রাণ। ও পাশের বাহারী ফুলের গাছগুলোতে নতুন কলি, কচি কচি সবুজ পাতার আগমন জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। কানে কানে গুনগুনিয়ে গেয়ে যায় বসন্তের আগমনী গান। নন্দিতা উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে। বারান্দার অনুজ্জ্বল হলদেটে আলোতে স্পষ্ট তার কালো ব্লাউজ হতে উন্মুক্ত পিঠ। তুর্জয় চোখ ফেরালো কিছু একটা অবশিষ্ট হওয়ার আগেই। মেয়েটা আজকাল বড্ডো বেশি বউ বউ সেজে থাকে। অধিকার দেখায় সবকিছুতে। পাকা গৃহিণীর মতো কথায় কথায় ফুঁসে ওঠে তার উপর।
সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে বলে হয়তো খেয়াল করেনি সে। তবে নন্দিতার মধ্যে বেশ সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন এসেছে। গোলগাল হয়েছে আগের চেয়ে। চেহারায়ও কেমন যেন আদুরে এক ভাব। শারীরিক এই পরিবর্তনের পিছনে যে করণটাকে চিহ্নিত করছে সে, সেটা তো সম্ভব নয়। তারা একে অপরের মাঝে উন্মত্তের মতো ডুবেছিল বেশ মাস দুয়েক আগে। এরপর থেকেই নন্দিতা কেমন যেন দূরে দূরে থাকে। ঠিক দূরে নয়, তবে পাশে বসেও অজানা এক বলিরেখা টেনে দেয় দুজনের মাঝে। কেমন যেন সতর্ক সতর্ক ভাব তার মধ্যে। এই দেয়াল টপকে এগিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠে না তুর্জয়ের। তার উপর মনের মধ্যে চলতে থাকা নানান দোলাচলে এতদিন বড্ডো বাজেভাবে ফেঁসেছিলো সে। সঠিক একটা সিদ্ধান্তে আসতেও সময় লাগতো। সবটা মিলিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্বের পরিমাপ বেশ। এই দূরত্বের ডিঙ্গি টপকে তার ধারণা সঠিক হওয়া সম্ভব নয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্জয় বারান্দা ছেড়ে এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। আর দুই দিন পরেই ফিরতে হবে তাদের। তুলাকে ফেলে, একটা যৌথ পরিবার ফেলে নন্দিতার ও বাড়িতে যাওয়া বেশ কষ্টকর হবে নিশ্চয়ই। তার উপর গোটা দিন একা একাই সময় পার করে সে। ভাবনার মাঝেই নন্দিতার পাশে গিয়ে বসলো সে। কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আছড়ে পড়ছে চোখে মুখেও। আলতো হাতে চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে মুখটা খানিকটা নামিয়ে আনলো সে। ঘুমন্ত স্ত্রীর ললাটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অতঃপর ঠোঁটটুকু চেপে ধরে রাখলো সেখানে বেশ অনেকটা সময়। যেন তার ভাগ্যে লেখা সবটুকু ত্রুটি শুষে নিচ্ছে সে। ঘুমের মাঝেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠে অন্যপাশে ফিরলো সে। তুর্জয়ও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে আবারও গিয়ে বসলো নন্দিতার পাশে, মুখের সামনে। যেখান থেকে দুই চোখ ভরে দেখা যায় তাকে।
ডান হাত কানের নীচে দিয়ে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে নন্দিতা। নীচের ঠোঁট উল্টে ঘুমের ঘোরে কি যেন বিড়বিড় করছে সে। তুর্জয় খানিকটা নীচু হয়ে তার মুখের কাছে এগিয়ে নিলো কাল। কিন্তু স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। তবে বেশ আদুরে লাগছে তাকে। শাড়ির আঁচল সরে উম্মুক্ত কাঁধ, এলোমেলো কোমরের স্পষ্ট আকৃতি, বক্ষদেশের বিভাজিকা সবকিছু বড্ডো বাজেভাবে টানছে তাকে। কেমন যেন এক মোহাগ্রস্থের মতো নন্দিতার নিচের ঠোঁটটা আঁকড়ে ধরলো সে। অতঃপর ছোটো একটা কামড় দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“কী নামে ডেকে বলব তোমাকে, মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।”
প্রেমঘন আবেগী মুহুর্তের মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতে সশব্দে বাড়ি খেলো দরজা। তুর্জয় কপাল কুঁচকে তাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো টিকটিক শব্দে চলতে থাকা ঘড়ির দিকে। রাত এগারোটা ত্রিশ। এতরাতে কেউ তাদের দরজায় আসার মত উপযুক্ত কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে প্রথমটুকু মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিলো সে। কিন্তু পর পর বেশ কয়েকবার একইভাবে দরজায় হওয়া শব্দে খানিকটা ভয় পেল হলো সে।
দরজার ছোটো ছিদ্র দিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখতে পেল তুর্জয়। তৎক্ষণাৎ দরজার নব ঘুরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে লোকটার দিকে তাকাতেই আশেপাশে চোখ বোলালো লোকটা। যেন সতর্ক দৃষ্টিতে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছে। অতঃপর চটজলদি পকেট থেকে একটা খাম বের করে তুর্জয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা ম্যাডামের জন্য।”
তুর্জয় হতভম্ব দৃষ্টিতে একবার লোকটার দিকে তো একবার হাতে তাহ্জা জিনিসটার দিকে তাকাচ্ছে। এই মাঝরাতে তার সাথে ঠিক কী ধরনের মশকরা করা হচ্ছে এটাই বোঝার চেষ্টা করছে যেন। তন্মধ্যে হনহন করে চলে গেল লোকটা। চোখের আড়াল হওয়ার আগে তুর্জয়ের দিকে ফিরে কেমন যেন এক হুশিয়ারি কণ্ঠে বললো,
“রক্ষাকবচের নামে শত্রুর প্রবেশ চারিদিকে। আপনার চেয়ে আপনার স্ত্রীর বিপদ বেশি আশেপাশে।”
জলিল আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। পরণের চাদরটা দিয়ে মুখ ঢেকে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে হনহন করে। পিছু ফিরল না আর একবারও। অথচ তুর্জয় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সেই একই জায়গায়। বরফের মতো জমে গেছে যেন তার পা দুটো। নড়াচড়া করার ন্যূনতম শক্তিটুকু পাচ্ছে না। নানান প্রশ্ন, জালের মতো ঘুরে ধরেছে তার মস্তিষ্ক। অতঃপর কুণ্ডলী পাকিয়ে জট লেগে যাচ্ছে একের সাথে অন্যের। কিন্তু উত্তর অজানা।
সকালটা শুরু ভ্যাপসা গরম দিয়ে। ঘুম থেকে উঠে নন্দিতা সবার আগে গোসল সেরে নেয়। গরমে শরীরটা বড্ডো চ্যপচ্যাপে লাগছিল। এখনও বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। তুহিন আর লারা বেশ দেরী করেই ওঠে ঘুম থেকে। কড়া পাওয়ারের ওষুধ খান বলে তুহিনা বেগমও বেশ বেলা করে ওঠেন ঘুম থেকে। কাজ কাম থেকে বিরতি বলে তুর্জয়ও সকাল সকাল ওঠার তাড়া দেখায় না আর। বালিশ আঁকড়ে শুয়ে থাকে বেলা বারোটা পর্যন্ত। আপাতত গোটা ঘরে সে একাই জেগে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলগুলো পরিপাটি করতে করতে সকালের নাস্তা কী বানাবে সে নিয়েই মনে মনে চিন্তা ভাবনা করছিলো সে। এমন সময় মনে হলো ফ্রিজে দুধ আছে বেশি করে। পায়েশ বানালে মন্দ হয়না। তুর্জয়ের বেশ পছন্দের। ভাবনাটুকু মনে আসতেই শরীর গুলিয়ে আসলো নন্দিতার। দুধের কথা চিন্তা করেই পেটের ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো সবকিছু। হাতের টাওয়েলটা মেঝেতে ছুঁড়ে তাড়াহুড়ো করে ঢুকে পড়ে সে ওয়াশরুমে। বেশ কয়েকবার বমি বমি ভাব হলেও বমি হলো না একটুও। গোটা সময়টা পেটের ভেতরটা মুষড়ে ওয়াক ওয়াক করে গেল সে।
ওয়াশরুমের খোলা দরজা থেকে ভেসে আসা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তুর্জয়ের। বিছানা ছেড়ে চটজলদি এগিয়ে এলো সে নন্দিতার কাছে। শরীর ততক্ষণে দূর্বল হয়ে ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম তার। মাথাটাও ঘুরছে বেশ। নন্দিতাকে এক হাতে আগলে আলতো করে বুকের সাথে চেপে ধরলো তুর্জয়। অতঃপর অন্যহাতে তার মাথায়, পিঠে, পেটে আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“ঠিক আছো তুমি? শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে? ডাকলে না কেন আমাকে? ইশ! চোখ মুখের কী অবস্থা।”
তুর্জয়কে এভাবে অস্থির হতে দেখে দূর্বল শরীর নিয়েই হেসে দিল নন্দিতা। কেমন যেন এক দূর্বল, বিষাদগ্রস্থ কণ্ঠে বললো,
“এটুকুতেই এভাবে অস্থির হচ্ছ, আমি না থাকলে কী করবে তখন? ধরো কোনো একদিন তুমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি একেবারে জন্য ঘুমিয়ে পড়লাম।”
নন্দিতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তীব্র এক ধমক দেয় তুর্জয়। অতঃপর তাকে বুকের সাথে আরো খানিকটা লেপ্টে ধরে বেসিন থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয় নন্দিতার। ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে হাত ভিজিয়ে ঠাণ্ডা পানি ছিটা দেয় সেখানেও। অতঃপর কোলে তুলে তাকে নিয়ে আসে ঘরের মধ্যে। বিছানার উপর বসিয়ে আলমারি থেকে একটা শুকনো তোয়ালে এনে চোখ, মুখ, ঘাড় মুছিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“এই ধরনের উল্টো পাল্টা কথা যেন আমি দ্বিতীয়বার না শুনি আর তোমার মুখে। নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
“আপনার চেয়ে খারাপ আর কাউকে এখনও দেখিনি আমি।”
নন্দিতার সোজাসাপ্টা জবাবে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো তুর্জয়। অতঃপর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে বললো,
“আপনি কী আমার বেড পারফরমেন্সের কথা বলছেন? অন্ধকার ঘরে, আপনাকে কাছে পেয়ে কতোটা ব্যাডলি আদর করি, ইস দ্যাট?”
বুক কাঁপছে নন্দিতার। হাত পা কেঁপে উঠছে থরথর করে। পুরো শরীর জুড়ে ভর করেছে অভাবনীয় এক অস্থিরতা। তুর্জয়কে কী জবাব দেবে সে? সেই সকাল থেকেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে যাওয়ার জন্য ধরপাকড় করছে সে। অথচ সে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে আছে পাশের ঘরে। দরজাটা পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে। গোঁ ধরে বসে আছে ভেতরে। ডাক্তারের কাছে যাবে না কোনমতে।
নন্দিতার এমন অযাচিত পাগলামির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তুর্জয়। রীতিমত বিরক্ত হয়ে সে শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি দিয়ে নন্দিতাকে বলে ওঠে,
“এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে হয় ডাক্তারের কাছে যাবে আর নাহয় আর এক মুহুর্ত এই বাড়ীতে থাকবো না আমি। একাই ফিরে যাব।”
আচমকাই নন্দিতার কান্না পেল ভীষণ। এই প্রথমবারের মতো তুর্জয় বেশ রুঢ় আচরণ করলো তার সাথে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও এতখানি রুঢ় সে আজ পর্যন্ত হয়নি। তবে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলোও বটে। সে যে চায় এই সম্পর্কের মাঝে ফাঁক আসুক। ফাঁক ফোকর দিয়ে অশান্তির বীজ বপন হোক। এরপর শুস্ক পানিতে পানি, খাবার খেয়ে সেই বীজ চারাগাছ থেকে এক পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে রূপ নিক। মুছে যাক সে তুর্জয়ের মন মস্তিষ্ক থেকে। অথচ নারী মন তার অন্য কারোর সাথে সহ্য করতে পারে না স্বামীকে। এ ভাগ যেন তার হৃদয়ের ভাগ। যার কোনো ভাগাভাগি নেই, নেই কোনো বাটোয়ারা। এর সবটুকু অধিকার, সবটুকু সত্তা শুধুই তার। বাঙ্গালী নারী বলে কথা।
সবাইকে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বলে বুঝে দিতে চাইলেও নন্দিতা বেশ টের পাচ্ছে এ কিসের সংকেত! রোগ তার শরীরের ছড়িয়ে পড়েছে রীতিমত। তাইতো এবার ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার লক্ষণ। শরীর জুড়ে লক্ষণীয় অস্বাভাবিক পরিবর্তন তাকে আরও বেশি করে টের পাইয়ে দেয় তুর্জয় এখন তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চাইলেই আর কখনও তুর্জয়কে কাছে পাবে না সে। ওই মানুষটার বেপরোয়া ভালোবাসায় ডুব দিতে পারবে না। তার নির্লিপ্ত কথার মতো লাগামহীন উন্মত্ত বিচরণে শিহরিত হওয়া হবে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুর্জয়, এই পরিবার, এই গোটা দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে তার। আচ্ছা এরপর কী মানুষটা আবার নতুন করে সংসার করবে? তাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে নতুন কোনো নারীকে আলিঙ্গল করে বুকে জড়িয়ে নেবে? তার পেশিযুক্ত দুই বাহুর মাঝে আবদ্ধ করবে নতুন কাউকে? ওই একই ঘরে, একই বিছানায় তারা……
নাহ এরপরেরটুকু আর ভাবতে পারলো না সে। শরীর জুড়ে তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে কন্ঠনালী অবরুদ্ধ হলো। দুইহাতে মুখ ঢেকে আচমকাই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। এসব ভাবনা তাকে পীড়া দিচ্ছে। বড্ডো বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে তার মানব হৃদয়ে। অসহনীয় চিনচিন ব্যথারা ঢাক ঢোল পেটানোর মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার শরীর জুড়ে। এই মানুষটার অস্তিত্ব জুড়ে সে নয়, অন্য কোনো নারী থাকবে, এই ভাবনটুকুই পাগল করে দিচ্ছে তাকে।
দরজার বাইরে থেকে হাউমাউ করে কান্নার স্বর ভেসে আসছে নন্দিতার। এতগুলো মাসে নন্দিতাকে এভাবে কখনও কাঁদতে দেখনি তুর্জয়। শুধু এভাবেই নয়, তাকে কখনও কাঁদতেই দেখেনি সে। সর্বদা ভুবনভোলানি হাসিতে লেপ্টে থাকা ঠোঁটের দুইপাশে হালকা গর্ত সৃষ্টি হওয়া মুখেই যেন অভ্যস্ত সে। তাই আজ তার এই উথালপাথাল করা কান্নারা বুকের মাংসপেশী খামচে ধরছে তার। অস্থিরতায় মস্তিষ্ক শূণ্য শূন্য ঠেকছে। শুধু দুইহাতে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে অনুরোধের সুরে বলে ওঠে,
“আচ্ছা রেখে যাব না তোমাকে। এমন বাচ্চাদের মতো করছো কেন? দরজাটা খোলো অন্তত। ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাব না, শুধু আমাকে তোমার কাছে আসতে দাও। কান্না থামাও।”
তুহিনা বেগম সহ বাকিরা বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে দিলেন। সকাল সকাল একপ্রকার হইহুল্লোড়ের মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে তাদের। ঘটনার বিষয়বস্তু না বুঝলেও তুর্জয়ের মনের শক্ত খোলস ভেদ করে নন্দিতা যে সেখানে পাকাপোক্ত বাসা বেঁধেছে, এ বেশ তের পেলেন সালমা বেগম। ঠোঁটে তাই তার ক্ষীণ হাসি লেপ্টে।
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই ভেতর থেকে দরজার লক খুলে দিলো নন্দিতা। ফোলা ফোলা চোখ মুখ কান্নার ফলে লাল হয়ে আসে। কান্না এখনও থামেনি পুরোপুরি। তিরতির করে কাঁপছে নাকের ডগা। ঠোঁট দুই একের সাথে অন্যটা আবদ্ধ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ফুঁপিয়ে কান্না করেছে কিছুক্ষণ আগে। ধীরে ধীরে নাক টানছে এখনও।
দরজা খুলতেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় তুর্জয়। দুই হাতে আজলায় নন্দিতার মুখখানি ধরে কোমল কণ্ঠে বলে,
“আমাকে এমনিতেও ফিরতে হতো আজ। কেসের ডেট এগিয়ে আসছে। এই কেসটা কতটুকু জটিল আর কনফিডেনশিয়াল সেটা একটু হলেও জানো তুমি। আগাম প্রস্তুতির জন্য আমার কয়েকটা দিন লাগবে। এখানে হেরে গেলে যে আমাকেও হারাবে হবে তোমায়। এটা শুধু একটা জটিল কেস না, আমার জীবন মরণেরও খেলা। আমি হেরে গেলে দুনিয়াও হারাতে হবে আমাকে। তুমি চাইলে থেকে যেতে পারো। আমি পরে এসে নিয়ে যাব?”
শেষোক্ত কথাটা ইচ্ছেকৃতভাবেই প্রশ্ন করার ভঙ্গিমায় বললো তুর্জয়। কারন সে মনে প্রাণে চায় নন্দিতা তার সাথে ফিরে যাক। শূন্য চারদেয়ালের ঘরে প্রাণ ঢেলে দেওয়া মানুষটাই যদি না থাকে, তবে যে এ শূন্যতা আরও বাড়বে খানিকটা। শূন্যতায় পুড়বে তার বুকও। এতখানি শূন্যতা নিয়ে সে লড়বে কিভাবে? যদি তার মতামত হিসেবে কথাটা বললে নন্দিতা চুপচাপ মেনে নেয়, তাইতো কৌশলে প্রশ্ন হিসেবে ছুঁড়ে দিলো তাকে।
নন্দিতা কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো তার নীচের পুরু ঠোঁট। অতঃপর মাথা নেড়ে নাসূচক ভঙ্গিমায় বলল,
“যাব”
বাইরে আজ আজকে রোদের উত্তাপ খানিকটা কম। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে নন্দিতা। সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা দেবে তারা। ঘণ্টা দেড়েকের পথ, তাই রাত হওয়ার আগেই পৌঁছে যাবে ঠিকমতো। খাওয়া দাওয়া শেষে তুর্জয় বেরিয়েছে কোনো এক কাজে। এই ফাঁকে সালমা বেগমের কাছ থেকে উপরতলার চাবিটা নিয়ে সেখানে যাওয়ার কথা ভাবে নন্দিতা। নন্দিতার বাবা মার মৃত্যুর পর উপরতলাটা আর ভাড়া দেয়নি তারা। বোধহয় তাদের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলার সাহস পায়নি নন্দিতাকে, তাইতো না কখনও তারা আর উপরতলায় গেছে আর না সেই জিনিসপত্র সরিয়ে অন্য কাউকে ভাড়া দিয়েছে। এই পরিবারকে দেখলেই কৃতজ্ঞতায় নুজ হয়ে আসে সে। এই দুটো বয়স্ক মানুষকে এতো ভালো কে হতে বলেছিলো? তার মতো সদ্য অনাথ হওয়া মেয়েটাকে কী নির্দ্বিধায় নিজের ঘরে তুলে নিলো। বেঁধে দিল পাকাপাকিভাবে নিজের পরিবারের সাথে। অথচ তাদের পরিচয় ছিল অল্পদিনের। এই অল্পদিনের পরিচয়েই কতটুকু মায়া, ভালোবাসা জন্মালে তবেই ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করা যায় এমন একটা মেয়েকে, যার কিনা কেউ নেই দুনিয়াতে। তারা আগলে না নিলে আজ বোধহয় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না তার।
অনেকগুলো মাসের অব্যবহৃত তালায় মরিচা পড়েছে। খুলতে গিয়ে বেশ পেতে হয় নন্দিতাকে। অবশেষে দরজা খুঁজে ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গরমে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে তার। তাড়াহুড়ো করে ঘরের দরজা, জানালাগুলো খুলে ঘরের লাইট ফ্যানগুলো চালিয়ে দেয়।
তিন কামরার ঘরের দুটো বেডরুম আর একটা কিচেন, ডাইনিং রুম একসাথে। নীচতলার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে এটুকু, আর বাকিটুকু খোলা ছাদ। এই ছাদে আসার সিড়ি উঠে এসেছে নীচতলা দিয়েই।
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২১+২২
বাবামায়ের ঘরে ঢুকে বেশ খানিকটা সময় থম মেরে বসে থাকলো নন্দিতা। একে একে মনে পড়ে গেল বাবা মায়ের সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা। বাবার সাথে তার স্মৃতি বড্ডো কম। গম্ভীর গোছের মানুষ, চেহারায় সর্বক্ষণ কেমন এক রাগী রাগী ভাব স্পষ্ট। নন্দিতার সাথেও খুব বেশি কথা তিনি বলতেন না। বাড়িতেও আসা যাওয়া ছিলো তার কম। পুলিশের কর্মকর্তারা বরাবরই বোধহয় এমন গম্ভীর গোছের মানুষ হয়। মায়ের কাছে শুনেছিলো তার চাকরিটা আগে এমন ছিল না। নন্দিতা যখন বছর দশেকের, কোনো এক জটিল কেসে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। এর কয়েক বছর পর থেকেই এক বছরের বেশি কোনো জায়গায় স্থায়ী হননি। ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেতেন অন্য জায়গায়। এর কারণ অবশ্য মা তাকে কখনও বলেনি। কোনো এক নির্দিষ্ট কারণে আর পাঁচটা বাবার মতো লোকসমাজে তাকে কখনও নিজের মেয়ের পরিচয় দেননি তিনি। সবকিছুকে কেমন যেন এড়িয়ে চলতেন।