প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৫
ফিজা সিদ্দিকী
বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত নন্দিতা মাকে কাছে পেয়েছে ষোলোআনা। বাবার প্রতি তার যতো না টান মায়ের প্রতি তার চেয়ে ঢের বেশি। মা বোধহয় বুঝতেন তার ছোট মনের দুরবস্থা। তাইতো সবকিছু পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় তৎপর থাকতেন সর্বদা। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান থেকে শুরু করে ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক, শপিং থেকে শুরু করে কুকিং সবটাই হাতে ধরে শিখিয়েছেন তাকে। নন্দিতা বরাবরই ঘুরকুনো ধাঁচের মেয়ে। বাহ্যিক চাকচিক্য, আধুনিকতার উড়ন্ত ছাপ তাকে টানে বিশেষ। ফ্রেন্ডরা যখন উইকেন্ডে আউটিংয়ে যেত, নন্দিতা মায়ের সাথে কিচেনে গিয়ে নতুন নতুন রান্না শিখতো। একটা বউ, ঘোমটা দেওয়া ঘরোয়া বধূ সাজার সাধ তার ছোটকাল থেকেই। তাইতো সময় পেলেই ঘরোয়া কাজ গুছিয়ে শিখতো বেশ।মায়ের সাথে যে তার জীবন সুতোর বন্ধন অল্পদিনের ছিল। বিধাতাও তাই বোধহয় বড্ডো তাড়াহুড়ো করে বড়ো করে দিয়েছিলেন তাকে।
নওরীন ছিলেন একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তার নারী। আবেগ, অনুভূতির প্রগাঢ় ঢেউ কখনো তরঙ্গায়িত করতে পারেনি তাকে। মন আর মস্তিষ্কের উপর ছিলো তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ। নস্যাৎ এ জীবনে আবগকে কখনো গুরুত্ব দেননি তিনি। তার কাছে জীবনটা ছিলো স্ক্রিপ্টেড কোনো সিনেমার মতো। হুট করে ঘটে যাওয়া আবেগঘন কোনো ঘটনাও তার ভাবমূর্তির বিশেষ পরিবর্তন করতে পারতো না। সামনে থেকে দেখলে কেউ মনে করবে, এ ঘটনা তার জানা। যেটা ঘটছে বা যা ঘটবে সবটুকুই তার নখদর্পণে। তাইতো কোনপ্রকার অনুভূতির খেলা দেখা যেত না তার ভাবমূর্তিতে। নিজের আবেগকে যথার্থ নিয়ন্ত্রণ করতে জানতেন তিনি। জীবদ্দশায় নন্দিতাকেও তিনি আবেগী হতে দেননি। আবেগ অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রন করার শিক্ষা তাকে দিয়ে গেছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নন্দিতার এমন রোবোটিক জীবন ভীষণ অপছন্দের। যে জীবনে প্রচুর হাসার কিছু হলে হাসতে পারবে না, বুক ভেঙ্গে কান্না এলে দাপিয়ে কাঁদতে পারবে না, এমন জীবন রোবোটিক নয় তো কী? মা বলতেন, কান্না মানেই দুর্বলতা। কারোর সামনে বোকার মতো কেঁদে ফেললে সমানের মানুষটা তোমার দূর্বলতা স্পষ্ট টের পেয়ে যাবে। কিন্তু নন্দিতা মানে না এসব। মানতে চায়না বরং। তার কাছে মনে হয় কান্নার চেয়ে বড়ো অস্ত্র আর কিছু নেই এ পৃথিবীতে। চোখ হতে নিঃসৃত দুই ফোঁটা জল নিমেষেই বশ করে ফেলতে পারে তোমার প্রিয়জনকে। কথায় যে কাজ পারে না, চোখের জল তা চোখের পলকেই করে ফেলে।
মায়ের আলমারিটা খুলে ভীষণ যত্নে তার শারিগুলোতে হাত বুলালো নন্দিতা। অতঃপর একটা সোনালী পাড়ের সাদা রঙের শাড়ি টেনে নিলো নিজের হাতে। চোখ বন্ধ করে নাক ডুবিয়ে বেশ জোরে জোরে টেনে নিলো বাতাস। এই শাড়িটা বাবার ভীষণ পছন্দের ছিল। যখনই বাবা আসতো, প্রায় দিনই এই সাদা শাড়িটা পড়ার আবদার করতো মাকে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে মা সবসময় তার চাওয়ার গুরুত্ব দিতেন না। তবে পরতেন মাঝে মাঝেই। শাড়িটাতে তাকে যে কী ভীষণ সুন্দর লাগতো! ফর্সা ত্বকের সাথে সাদা রংয়ের এই শাড়িটাতে তাকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগতো না। শাড়িটাতে এখনও মায়ের গন্ধ লেগে আছে। নাক ডুবালেই সেই গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে তার।
নন্দিতা কোনরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই সরাসরি কল করে তুর্জয়কে। ভূমিকা ছাড়াই নিরেট গলায় বলে ওঠে,
“আমার জন্য একটা ট্রলিব্যাগ কিনে আনতে পারবেন?”
“আমরা তো বেশি কিছু আনিনি। আমাদের ব্যাগেই তো হয়ে যাবে সব।”
“আমার কিছু জিনিস এক্সট্রা হচ্ছে। না না কিছু না, অনেকগুলো জিনিস। কোনটা ফেলে কোনটা যে নেব। আপনি আনবেন প্লিজ?”
তুর্জয় চট করে ব্যাপারখানা ধরে ফেলার মতো করে বললো,
“তুমি কী উপরের ঘরে গিয়েছ?”
নন্দিতা কণ্ঠ খাদে টেনে ছোট করে উত্তর দিলো, “জি”
তুর্জয় আর বাক্যব্যয় না করে ফোনটা কেটে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ বাদেই সিড়ির কাছ থেকে তুহিনের গলা শোনা গেল। নন্দিতা ঘর ছেড়ে বেরোতেই তার চোখে পড়লো দুইহাতে দুটো বড়ো সাইজের ট্রলিব্যাগ হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। নন্দিতাকে দেখামাত্র ব্যাগদুটো তার হাতে এগিয়ে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“ভাইয়ার আসতে সময় লাগবে। আপনাকে সময় নিয়ে গুছাতে বললো। তাড়াহুড়োর দরকার নেই।”
কথাটুকু শেষ করেই হনহন করে নীচে নেমে গেল তুহিন। কৃতজ্ঞতায় চোখ ভারী হয়ে এলো নন্দিতার। এমন একজন মানুষকে সে ঠকাচ্ছে। আদতে কি ঠকাচ্ছে সে? ঠকাচ্ছে তো। সত্য গোপন করা কী ঠকানো নয়? কিন্তু তার কাছে আর উপায় কই? আচ্ছা এই কেসটা জিততে না পারলে যে তার জীবন সংকটের কথা আজ সকালে তুর্জয় তাকে বললো, তা কী সত্যি? কিন্তু শুধুমাত্র তার জীবনের কথা ভেবেই তো এতো আয়োজন।
শুধু তার নয়, বরং তুর্জয়ের গোটা পরিবারকে বাঁচাতে গিয়েই তো এই ফাঁদে পা দিয়ে ফেললো সে। নন্দিতা আনমনে ভাবতে থাকে সেদিনের কথা…
একটুতেই ঠান্ডা লাগার ধাত নন্দিতার। এ কারনে এ বাড়িতে আইসক্রিম খুব একটা ওঠে না, তুর্জয়ের কড়া নিষেধ এ বিষয়ে। কিন্তু সেদিন দুপুরের মিষ্টি রোদে নন্দিতার মন আকুপাকু করছিলো একদলা আইসক্রিমের জন্য। তুর্জয়ও সেসময় বাড়িতে থাকে না। তাই সুযোগ বুঝে দরজাটা লক করে নেমে পড়ে নীচে। বড়ো রাস্তার ওপাশেই গ্রসারি শপ। দারোয়ান চাচাকে দিয়ে আনালে যদি কনবাহেব তার কানে চলে জয়তবে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে আজ। তাইতো নিজেই রাস্তা পেরিয়ে দোকানে গেল। দুইহাতে দুটো আইস্ক্রিম নিয়ে খোশমেজাজে রাস্তা হওয়ার সময় কোথা থেকে যেন আচমকা একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এলো তার কাছে। অতঃপর আইসক্রিম ধির হাতের ভাঁজে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিয়ে সাথে সাথেই দৌড়ে পালানো সেখান থেকে। ভারী ভারী চোখের পল্লব ফেলে নন্দিতা গোটা পথ সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর রুমে ঢুকে সেটাকে সাইডে রেখে আরাম করে আইস্ক্রিম দুটো খেয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফেরার সময় আচমকা মনে পড়ে গেল তার সেই কাগজের কথা।
টেবিলের উপর আলগোছে রাখা সেই কাগজের ভাঁজ খুলতেই দেখলো বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, “অ্যাডভোকেট তুর্জয় আহসান আর তার পরিবারকে বাঁচাতে যোগাযোগ করুন এই নম্বরে।”
ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হওয়া গলা নিয়ে সাথে সাথেই নন্দিতা কল করলো কাগজে দেওয়া সেই নম্বরে। কল তুলে কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়াই একজন পুরুষকণ্ঠ অত্যন্ত গাম্ভীর্য সুরে বলে উঠলো,
“সদ্য সদ্য বিয়ে করেছে, অ্যাডভোকেট তুর্জয়ের কিন্তু একদমই উচিত হচ্ছে না নিজের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলার। ভেরি ব্যাড।”
“কে বলছেন আপনি?”
“কে বলছি এটার চেয়ে বড়ো জরুরী হলো কী বলছি। আপনার হাজবেন্ডকে বোঝান শিকদারের কেসটা যেন ছেড়ে দেয়। নাহলে যে অল্প বয়সেই বিধবা হতে হবে আপনাকে। বাবা মা গেছে, শ্বশুর শাশুড়িও একদম জায়গামতো টপকে যাবে। একা একা থাকেন বয়স্ক দুজন মানুষ। আহা, এই কষ্ট সহ্য করা যায় নাকি? তার চেয়ে ওপারে শান্তি থাকলে ভালো হয়না?”
নন্দিতার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো তাৎক্ষণিক। তার একটা দুনিয়া উজাড় হয়েছে এইতো কয়েকমাস আগেই। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে এই কয়টা মানুষকে আঁকড়ে ধরে। এখন যদি তারাও তাকে ছেড়ে চলে যায়, কী নিয়ে বাঁচবে সে? কেন বাঁচবে? নাহ, আর মাথা কাজ করে না তার। ত্বরান্বিত কণ্ঠে সাথে সাথেই বলে ওঠে,
“আমি চেষ্টা করবো। প্লিজ আপনি আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবেন না।”
লোকটা কুটিল হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,
“আপনি যতদিন আমার কথামতো চলবেন আমিও আপনার কথা রাখবো। আপনি হেরফের করলে আমিও..”
নন্দিতা কিছু বলার আগেই নিঃশব্দ হয়ে যায় ওপাশ থেকে। সে পুনরায় কল করতে গিয়ে দেখে নম্বরটা সুইচ অফ। এরপর আর কখনো এই নম্বর ওপেন হয়নি। প্রতিবারই তারা নতুন নতুন নম্বর থেকে ম্যাসেজ দেয়।
নন্দিতার ভাবনার সুতো ছেঁড়ে আসরের আজানের শব্দ শুনে। ফোঁশ করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ট্রলিদুটো হাতে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকে সে। অতঃপর আলমারি থেকে একে একে সবগুলো শাড়ি ভাঁজ করে ঢোকায় ব্যাগের মধ্যে।
“জলিল”
“জি ম্যাডাম”
“তোমার আগের কাজটা ঠিকমতো হয়েছিল তো? কোনো হেরফের হলে কিন্তু মেয়েটার আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
জলিল নওরীনের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বলে,
“আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। প্রতিটা রক্তের শিশি আমি নিজের হাতে বদলে দিয়েছি।”
“এরপর তাদের প্ল্যান কী?”
“দুইদিনের মধ্যেই আবার রক্ত নিতে লোক পাঠাবে ওই বাড়িতে। কিসব পরীক্ষা হবে।”
“তোমাকে কী করতে হবে মনে আছে তো?”
“হ ম্যাডাম। টেকা দিয়ে ওইটা বদলাতে হবে আবার।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৩+২৪
কথাটুকু শুনে রহস্যময় হাসি হাসলো নওরীন। নন্দিতার বাড়ীতে যাওয়া প্রতিটা ব্লাড স্যাম্পল সে এই বন্ধ ঘরের লোহার চেয়ারে বসে বসেই চেঞ্জ করে ফেলেছে। দুইদিন পর স্যাম্পল কালেক্ট করে যে রিপোর্ট আসবে সেসবের ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। শিকদার ভাবছে ওরা তাকে আটকে রেখেছে, কিন্তু সে যে স্বেচ্ছায় এখানে পড়ে আছে, একথা তাদের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে।