প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৭
ফিজা সিদ্দিকী
শহর জীবনে অভ্যস্ত মানুষজনের কাছে রাত শব্দটার গভীরতা অনেকটা ধোঁয়াশার মতো। দাম্ভিকতার প্রতীকী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু সাদা বাল্ব সমন্বিত ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় পুরো পথঘাট দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। রাস্তা দিয়ে শাঁ শাঁ শব্দে ধেয়ে চলা গরুর শব্দে নীরবতা বিলুপ্ত। ফুটপাত ধরে হেঁটে চলা অগণিত যাত্রীদের পদচারণে রাত শব্দটার মর্মার্থ সঠিকভাবে বোঝা দায়। রাত মানেই নিঝুম ঘন অন্ধকার, কোথাও দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাক, হঠাৎ করে ধেয়ে আসা গা ছমছমে এক ভাব, সেসব শহর জীবনে কই? এই যান্ত্রিক জীবনে মানুষগুলোও দিন দিন রোবটিক হয়ে যাচ্ছে। পাড়া পড়শী তো দূর, পাশাপাশি দরজায় অবস্থিত মানুষদের মধ্যেই সখ্যতা নেই। নেই কোনো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন শুধু যন্ত্রের মতো নিয়মমাফিক রুটিনে চলতেই থাকে।
পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করলো তুর্জয়। গাড়ির সামনের হলদেটে আলোর দুটো হেডলাইট নিভলো এতক্ষণে। নন্দিতা ঘুমে কাদা ততক্ষণে। ডাকবে না ডাকবে না করেও তুর্জয় আলতো হাতে বুক থেকে ডেকে তুললো তাকে। আজকাল একটুতেই ঘুম ভোর করে তার চোখ জুড়ে। ক্লান্ত লাগে শরীর। কিজানি আর কতদিন সে সবকিছু তুর্জয়ের থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে। একদিন না একদিন তো ধরা পড়তেই হবে। আর সেদিন তুর্জয় কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? খুব রেগে যাবে? নাকি শক্ত করে বুকের মাঝে তাকে চেপে ধরে বলবে, কোথাও যেতে দেব না তোমাকে। এতো বোকা কেন তুমি? আমার মৃত্যু নিজের নামে লিখে নিতে গিয়ে একবারও ভাবলে না আমার কথা? নন্দিতা কী তখন হাসবে? মুচকি হাসবে? নাকি তার হাসিতে থাকবে প্রশান্তির ঢেউ?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বের হলেই বাস্তবতাকে বড্ডো কঠোর লাগে তার। ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময়। নাজানি কোন মুহুর্তে তার সব সত্যি ফাঁস হয়ে যায়।
লাগেজগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে জানালার কাঁচে নক করে তুর্জয়। কখন যে সে গাড়ি থেকে বের হয়ে লাগেজও নামিয়ে ফেলেছে, টেরই পায়নি নন্দিতা। অতঃপর ফাঁপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুঁজে বেরিয়ে আসে সে। ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখে শীতল এক হাসি।
অনেকগুলো দিন বাদে নিজের পরিচিত বিছানা পেয়ে চোখে লেপ্টে থাকা ঘুমটা আরও জাঁকালোভাবে জাপটে ধরে তাকে। রুমে ঢুকেই ঝট করে শুয়ে পড়ে সে বেডে। তুর্জয় আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে লাগেজগুলো টেনে রাখে ঘরের এক কোণে। এরপর নন্দিতাকে চেঞ্জ হওয়ার তাড়া দিয়ে নিজে চলে যায় ওয়াশরুমে।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নন্দিতাকে আগের অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে তুর্জয়। আলতো হেসে নন্দিতাকে ঠিক করে শুইয়ে দেয় বিছানায়। অতঃপর রুমের লাইট অফ করে নিজেও এসে শুয়ে পড়ে নন্দিতার পাশে। দুইহাতে নন্দিতার কোমর জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিতেই শরীরে শীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে নড়েচড়ে ওঠে নন্দিতা। ঘুমের ঘোরে নিজেও আরও খানিকটা সরে যায় তুর্জয়ের দিকে। তুর্জয় তৎক্ষণাৎ মুখ ডোবায় নন্দিতার উন্মুক্ত গলার ভাঁজে। সেখানে নাক ঘষতে ঘষতে আলতো কণ্ঠে বলে ওঠে,
“দিন দিন বড্ডো চালাক হয়ে যাচ্ছ তুমি। শাস্তি পাওয়ার ভয়ে এমন আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়লে। নট ফেয়ার।”
তুর্জয়ের বাড়ন্ত খোঁচা খোঁচা দাড়ি নন্দিতার গালে, গলায় সুরসুড়ি দিচ্ছে রীতিমত। ঘুমের ঘোরে তুর্জয়কে সরিয়ে উল্টোপিঠ ফিরতে গেলে বাধ সাধে তুর্জয়। মুখ তুলে তাকায় নন্দিতার বিরক্তিমাখা ঘুমন্ত মুখের দিকে। এরপর আচমকাই ঠোঁট ডোবায় নন্দিতার ঠোঁটে। একটা, দুইটা, তিনটা চুমু খেতে খেতে আচমকা নিজের শক্ত সামর্থ্য প্রশস্ত পুরুষালি ঠোঁট চেপে ধরে নন্দিতার কোমল ঠোঁটে। অতঃপর সেভাবেই দুইহাতে আগলে তাকে তুলে আনে বুকের উপর।
গভীর ঘুমে নিমগ্ন নন্দিতা আচমকা নিঃশ্বাস নিতে না পেরে চোখ খুলে তাকায়। শুন্য মস্তিষ্কে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। অতঃপর ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতেই তুর্জয় আলতোভাবে ছেড়ে দেয় নন্দিতার ঠোঁট।
ছাড়া পেয়ে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে তুর্জয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালে ঠোঁট কামড়ে হাসে তুর্জয়। রাগে পুরো শরীর জুড়ে জ্বালাময়ী এক অনুভূতি টের পায় নন্দিতা। দাঁতে দাঁত চেপে সেই অনুভূতি হজম করে চুপচাপ শুয়ে পড়ে তুর্জয়ের দিকে পিঠ করে। তুর্জয় বোকার মতো হাঁকরে তাকিয়ে রইলো নন্দিতার দিকে। অতঃপর চটজলদি পিছন থেকে বামহাত রাখলো নন্দিতার কোমরে। সাথে সাথে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মুখ ডোবালো নন্দিতার ঘাড়ে। নন্দিতা সরে আসার চেষ্টা করলে আরও চেপে আঁকড়ে ধরলো তাকে। অতঃপর গলায় মুখ ডোবানো অবস্থায় মিনিমিনিয়ে বললো,
“সরি।”
নন্দিতা কোনো প্রত্যুত্তর না করলেও বন্ধ করে দিলো ছটফট। অভিমানের পাথর গলতে দেখে তুর্জয় বাঁকা হাসলো। নরম গলায় বলল,
“তোমার উচিৎ হয়নি একদম আমার জীবনে আসা। এভাবে আমার এতো কাছাকাছি এসে আমাকে দখল করে নেওয়া তো আরও উচিৎ হয়নি।”
“অন্য কারোর আসার কথা ছিল নাকি? আপনার ওই ফিমেল কলিগটার?”
নন্দিতার কণ্ঠে ভেসে ওঠা তীব্র ঝাঁঝ স্পষ্ট টের পায় তুর্জয়। তাইতো আরও খানিকটা রাগিয়ে দিতে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিটা বজায় রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ড্যাম হট কিন্তু মেয়েটা। পুরোই আগুন সুন্দরী। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, ব্ল্যাক গাউন পরে কনফিডেন্সের সাথে যখন আসামীর দিকে তাকায়। আসামী নির্দোষ হলেও দোষ মেনে নিতে বাধ্য। ডিফেন্স লয়ারও কেস হেরে যেতে বাধ্য। এমন একটা মেয়ে পাশে থাকলেই গরম লাগা দুই কাঠি বেড়ে যায়।”
নন্দিতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতঃপর সরাসরি উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। তুর্জয় বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু ওয়াশরুমের দরজার দিকে। ব্যপারটা কী ঘটলো সবটুকু যেন মাথার উপর দিয়ে গেল তার। নন্দিতার তো প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত ছিল। দুই চারটা কিল ঘুষি দিয়ে তার বারোটা বাজানোর কথা ছিলো। মেরে দ্বিতীয়বারের মতো মাথা ফাটিয়ে দিলেও খুব একটা অবাক হতো না সে। কিন্তু তার এভাবে নীরব থাকা অস্থির করে তুলছে তুর্জয়কে।
ওয়াশরুমের দরজার বাইরে পায়চারি করছে তুর্জয়। সেই কখন যে ভেতরে গেল নন্দিতা, বের হওয়ার নাম নেই। এদিকে অস্থিরতা বাড়তে থাকছে গফ ভেতরে। এ কেমন আচরণ? এমন শান্ত ভাবে সব কথা মেনে নেওয়ার কোনো মানে আছে নাকি? পরনারীর প্রশংসা করার সুবাদে দুই চারটা হাড্ডি ভেঙে দিত তার, নাহয় মাথাটা ধরে দেয়ালে ঠুকে দিতো। নয়তো গলাটা চেপে ধরে শাসন করতো। কিন্তু এমন চুপচাপ মেনে নেবে কেন? এটা কি অন্যায় নয়? অবিচার নয় তার প্রতি?
ওয়াশরুম থেকে বের হতে গিয়ে নন্দিতা আচমকা তুর্জয়কে আবিষ্কার করলো নিজের মুখোমুখি। খুব বেশি বিচলিত না হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলে খপ করে তার ডানহাত পাকড়াও করলো তুর্জয়। নিজের দিকে ঘুরিয়ে একদম কাছাকাছি টেনে আনলো তাকে।
অন্ধকার ঘরের হাট করে খোলা জানালা দিয়ে দূরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে ভেসে আসা আলোয় নন্দিতার গোলগাল মুখটা আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে যেন। তুর্জয় মোহনীয় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো নির্নিমেষ। ডানহাত উঠিয়ে উঁচু করলো নন্দিতার নীচু হয়ে থাকা ললাট। দৃষ্টি মেললো সরাসরি তার চোখের দিকে। অতঃপর কোমল কণ্ঠে বলে উঠলো,
“রাগ হয়েছে?”
নন্দিতা নিজেকে তুর্জয়ের বাহুবন্ধনী থেকে ছাড়িয়ে বড্ডো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“কেন হবে?”
“এইযে তোমার পাশে শুয়ে, তোমার গলায় মুখ ডুবিয়ে আমি অন্য এক নারির প্রশংসা করলাম।”
“যাকে এতো খুঁটিয়ে দেখতে পারেন, যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করেন, তার রূপের বর্ণনা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।”
তুর্জয় তার স্বভাবসুলভ বাঁকা হেসে নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। আলুথালু হয়ে পিঠে পড়ে থাকা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে থুতনি রাখলো তার কাঁধে। তুর্জয়ের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে নন্দিতার গালে, গলায়। শিহরণে নিঃশ্বাস দ্রুতগামী হচ্ছে তারও। অথচ তুর্জয় তার দুই হাত নন্দিতার হাতের উপর চেপে ধরে আছে কোমরের কাছে। সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। উপরন্তু বেপরোয়া তুর্জয় ইচ্ছেকৃত নিজের গরম নিঃশ্বাস জোরে জোরে ফেলছে তার কাঁধে। নন্দিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার কানের কাছে মুখ এগিয়ে আনে তুর্জয়। ফিসফিস করে বলে,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৬
“তোমার কোমরের ডানপাশে, বাঁকের ঠিক তিন আঙুল নীচে অবস্থিত লালচে রঙের তিলটা আমার বেশ পছন্দের। ক্যান আই কিস?”
অদ্ভুত দৃষ্টিতে নন্দিতাকে তাকাতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে তুর্জয়। আগের মত একই ভঙ্গিমায় বলে ওঠে,
“তোমার শরীরের প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা ছোট ছোট চিহ্ন আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি, এতটাই মুখস্ত।”