প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৮
ফিজা সিদ্দিকী
বিগত কয়েকদিন ধরেই ভীষণ রকম ব্যস্ততায় দিন পার করছে তুর্জয়। ঘুম থেকে উঠেই কোনরকম রেডি হয়ে ল ফার্মের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া আর লেট নাইট করে বাড়ি ফিরে কোনক্রমে খাওয়া শেষ করে ঘুম, এটুকুর মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তার জীবন। নন্দিতা মাঝে মাঝে আড়চোখে খেয়াল করে তুর্জয়কে। বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন যেন অন্যরকম এক সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে তুর্জয়ের মধ্যে। মাঝে মাঝে তো ঠিকমতো চোখের দেখাটুকুও মেলে না তার। নন্দিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ে সে। অসুস্থতার কারণে আজকাল নন্দিতারও ঘুম হয় বেশি। অনেক সময় রাতেও দেখা মেলে না তার। দূরত্বটা দুজনের মাঝে এতটুকু আঁটোসাঁটো হয়ে বসেছে যে অভিমান বাড়তে বাড়তে পাহাড় সমান। নন্দিতা অপেক্ষা করতে করতে জেগে থাকতে পারে না আর। অগত্যা ঘুমে ঢুলে পড়ে। অপরদিকে তুর্জয় গোটা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে নন্দিতাকে নিজের মতো ঘুমে কাদা দেখে অভিমানে বুক ফুলে ফেঁপে ওঠে।
কেউ অপেক্ষা করুক। মাঝে মাঝে না খেয়ে বসে থাকুক। অপেক্ষা করতে করতে রেগে ফুঁসে উঠে শুনিয়ে দিক কয়েকটা কড়া কথা। শাসন করে বলুক, “এতো অপেক্ষা করায় কেউ? কাল থেকে তাড়াতাড়ি না ফিরলে দরকার বাইরে থাকবে সারারাত।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পুরুষ মানুষের চাহিদা বোধহয় এটুকুই। স্ত্রীর রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সবটুকু উপর আধিপত্য থাকুক শুধু তার। তাইতো নন্দিতাকে রোজ এভাবে নির্লিপ্ত দেখে বুকে ভাঙ্গন ধরে তার। মনে হয়, এই বুঝি হারিয়ে ফেললো সবকিছু। অথচ কিছুমাস আগেও তার কোনো ভয় ছিলো না। ছিল না কোনো পিছুটান। জীবনটাকে লম্বা একটা রেস আর নিজেকে প্রতিযোগী হিসেবে একের পর এক জটিল কেস নিয়ে দুই হাতে খেলেছে সে। অথচ আজ ভয় হচ্ছে তার। সামান্য একটা কেসের ডেট যত এগিয়ে আসছে ততোই অজানা এক ভয় চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে যেন তাকে। দুজনের মাঝে তৈরি হওয়া দূরত্বটাই বোধহয় অনেকাংশে দায়ী এক্ষেত্রে। কিন্তু আজীবন নারী সঙ্গ থেকে দূরে থাকা তুর্জয়ের পক্ষে এই দূরত্ব ঘোঁচানোর কাজটা মোটেও সহজ নয়।
যেন বিশাল এক সমুদ্রের মাঝে কেউ চার হাত পা বেঁধে ফেলে দিয়েছে তাকে। হাজার চাইলেও সাঁতরাতে পারছে না। পারছে না উতরাতে এই পরিস্থিতি থেকে।
সকাল থেকেই কাজে বেশ অমনোযোগী তুর্জয়। আনসার সাহেব কাজের ফাঁকে ফাঁকে তুর্জয়কে পরখ করছেন। কেমন যেন অস্থির, চিন্তাগ্রস্থ, অসংলগ্ন লাগছে তাকে। অস্থিরতায় কাগজপত্র এলোমেলো করে বসে আছে এই মুহূর্তে তার অপরপাশে। বাম হাত মাথায় ঠেক দিয়ে চোখ বন্ধ করে বেশ নিমগ্ন হয়ে চিন্তা করছে কিছু। আনসার সাহেব নিজেও খানিকটা বিচলিত হলেন তুর্জয়কে এমন অবস্থায় দেখে। টেবিলের উপরে রাখা পানির গ্লাসটা আস্তে করে তুর্জয়ের দিকে এগিয়ে খানিকটা গলা কাশলেন। অতঃপর চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“স্যার, আপনি কী শিকদারের কেসটা নিয়ে ভাবছেন? এই কেসটা নিয়ে আপনি প্রচুর স্টাডি করেছেন, এটা আপনিই জিতবেন।”
“কেসের গোটা ফাইলটা উধাও আনসার।”
আনসার চমকে তাকায় তুর্জয়ের দিকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“কী বলছেন স্যার এগুলো?”
“তুমি ঠিকই শুনেছ। ফাইলটা আমি বড্ডো সাবধানে রাখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অসাবধান কাজটা করে ফেলেছি।”
“এক্সট্রা কোনো ফটোকপি নেই?”
তুর্জয় না সূচক মাথা নাড়াতেই খানিকটা করুণ সুরে আনসার বলে,
“এখন কী হবে স্যার? অপনেন্ট দল তো ফাইট না করেই জিতে গেল। আপনার সাথে এমন শত্রুতা কে করলো?”
রাগে তুর্জয়ের শরীর জ্বলছে। শরীরের প্রতিটা রোমকূপ পর্যন্ত জ্বলে উঠছে বিশ্রীভাবে। দপ দপ করে জ্বালাময়ী এক রক্তক্ষরণ ধরেছে মাথার প্রতিটা নিউরনে। আনসারের চোখে চোখ রেখে তুর্জয় শীতল কণ্ঠে বলে,
“আমি জানি এই কাজটা কার।”
তৎক্ষণাৎ আনসারের মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। কপালে জমতে শুরু করে বিন্দু বিন্দু আকারে ঘাম। পকেট হাতড়িয়ে রুমাল খুজতে গিয়ে ব্যর্থ আনসার আড়চোখে একবার তুর্জয়ের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টির রাগের গভীরতা মাপতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললো তৎক্ষণাৎ।
“নন্দিতা আমার সাথে এমন বেইমানি কেন করলো বলো তো আনসার? কী এমন উদ্দেশ্য থাকতে পারে এর পিছনে?”
আনসার চমকপ্রদ হাসলো। কণ্ঠে একরাশ অসহায়ত্ব ঢেলে মলিনভাবে বললো,
“মেয়েটাকে আপনি অতিরিক্ত বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন স্যার। হয়তো সে অপনার শত্রুপক্ষের লোক। আপনাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলো। এই মেয়ের…”
আনসার আরও কিছু বলতে যাবে। তার আগে তার দিকে শান্ত চোখে তাকালো তুর্জয়। কণ্ঠে যথার্ট গম্ভীর্যতা টেনে শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমার স্ত্রীকে এই মেয়ে বলার অধিকার আমি কাউকে দিইনি। সম্মানের সাথে নেবে তার নাম।”
আনসার চোখ নামিয়ে ফেলে। অপরাধী কণ্ঠে বলে,
“সরি স্যার। কিন্তু যে মানুষটা আপনাকে এতো বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিলো, আপনি এখনও তাকে প্রোটেক্ট করছেন।”
তুর্জয় হাসলো। ঠোঁট বাঁকানো সেই হাসি খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা উপায় নেই। আনসার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। তুর্জয় টেবিলের একপাশে পড়ে থাকা গাড়ির ছবিটা হাতের মুঠোয় ভরলো। অতঃপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে কন্ঠ খাদে ফেলে বলল,
“নিজের বিশুদ্ধতম অনুভূতিটুকু উৎসর্গ করা মানুষটাকে অশুদ্ধ হতে দিই কীভাবে? এ যে আমার অনুভূতিতে কলঙ্ক লেপ্টে যাওয়ার মতো।”
শহরের পিচঢালা রাস্তা ধরে তুর্জয়ের গাড়ি ছুটে চলেছে দূরন্ত গতিতে। নির্দিষ্ট সময়ের থেকে বেশ অনেকটা সময় আগেই বেরিয়েছে আজ সে। মনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানো অস্থিরতা যেন এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছে না তাকে। গাড়ি একসাইডে পার্ক করে তুর্জয় সবেমাত্র মাথা এলিয়ে দিয়েছে সিটে। এমন সময় আনসারের কল পেয়ে এলোমেলো হাতে রিসিভ করে। বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে,
“এই মুহূর্তে আমাকে আর কল দিও না। একা থাকতে চাই আমি খানিকটা সময়।”
খানিকটা সময় নিরবতা পালন করে অস্থির কণ্ঠে আনসার বলল,
“ব্লু টোকাই কফি রোস্টার্স এ এই মুহূর্তে আপনার জন্য সবচেয়ে চমকপ্রদ জিনিস অপেক্ষা করছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”
ঘড়িতে তখন সবেমাত্র সাতটা ত্রিশ। সময়টুকু সে নন্দিতাকে দিতে চেয়েছিলো। বিগত কয়েকদিনের জমতে থাকা অভিমান, তার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চেয়েছিল। কেন যেন তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না এমন একটা কাজ নন্দিতার দ্বারা সম্ভব। কিন্তু এই ফাইলের ব্যাপারে নন্দিতা, আনসার আর সে ছাড়া আর কারোর জানার কথা নয়। চুরি হওয়ার ভয়েই তো ফাইলটা ফার্ম থেকে সরিয়ে নিজের ঘরে এনে রেখেছিল। তাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে রাখা জিনিস এদিক সেদিক হলে সেই দায় তো এসে পড়ে একমাত্র নন্দিতার দিকে। কিন্তু মস্তিষ্ক যতই যুক্তি তর্ক দাঁড় করাক না কেন, তার মন বলছে নন্দিতা এমন একটা কাজ করতে পারে না।
আর যাইহোক, তার পিঠপিছে তারই ক্ষতি সাধন করতে তার শত্রুপক্ষের সাথে হাত মেলানোর মত জঘন্য কাজ নন্দিতার দ্বারা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যায় ঝকমকে নিয়ন আলোর মাঝে দাম্ভিকতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ‘ব্লু টোকাই কফি রোস্টার্স’ নামে কফিশপটা। ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের জন্য বেশ কয়েকবার আসা হয়েছে তার এখানে। শহরের রাস্তায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো এই কফিশপের চারপাশে সব গাছগাছালির সমাহার এটাকে একটা রয়াল, এলিগ্যান্ট ভাইব এনে দেয়। কাঁচের স্বচ্ছ আবরণীতে ঘেরা কফিশপের কৃত্রিম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মহলের মধ্যে থেকে বাইরের শীতল, সবুজাভ পরিবেশের সাথে গরম কফির কাপে চুমুক, সন্ধ্যাকে আরও খানিকটা জমকালো করে তোলে। এ কারণেই এই কফিশপটা বিশেষভাবে পছন্দ তুর্জয়ের।
আনসারকে বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে যায় তুর্জয়। তাড়া দেওয়া কণ্ঠে বলে,
“এই অসময়ে এখানে কেন ডেকেছ? আমার আজ বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল।”
“যার জন্য আপনি বাড়ি ফিরতে তাড়া দেখাচ্ছেন, তিনি তো কফিশপের ভেতর অন্য কারোর সঙ্গে হাতে হাত রেখে..”
তুর্জয়ের রাগী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বাকিটুকু বলার আর সাহস পেল না আনসার। নিভে আসা কণ্ঠে সামনের দিকে ইশারা করে বললো,
“ভেতরেই আছে।”
তুর্জয় আর ক্ষণকাল অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল কফিশপের ভেতর। এসির শীতল বাতাসে আজ যেন শরীর হিম হয়ে আসছে তার। কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে শরীরের প্রতিটা অঙ্গে প্রত্যঙ্গে। পা দুইটা বরফ সম ভারী হয়ে আঁকড়ে ধরছে ভূমি। এগোনোর সহজ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মনে প্রাণে চাইছে আনসারের কথাগুলো মিথ্যা হোক। মিথ্যা হোক তার সব সন্দেহ। ধ্বংস হয়ে যাক সে। ধূলোয় মিশে যাক সবকিছু, তবুও মৃত্যুর পরও মানুষটা শুধু তার থাকুক। যে মাথা তার বুকে আশ্রয় খুঁজেছে সে অন্য কোথাও শান্তি খুঁজে না পাক এক মুহূর্তের জন্য।
চলতে থাকা কদম থেমে গেল তুর্জয়ের। থেমে গেল ফ্লোরের সাথে ঘর্ষণরত বুটের শব্দ। তার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে কোণার একটা টেবিলে তার মুখোমুখী বসে আছে নন্দিতা।
অপরপাশের মানুষটার মুখ দেখা না গেলেও সেটা যে একজন পুরুষমানুষ, এটুকু স্পষ্ট। ব্ল্যাক হুডি পরা, মাথা পর্যন্ত ঢাকা সেই মানুষটা নিজের হাতে ধরে রেখেছে নন্দিতার হাত। নন্দিতা মাথা নিচু করে ব্যস্ত তার সাথে কথা বলতে। এটুকু দৃশ্য দেখেই তুর্জয়ের বুক খামচি দিয়ে উঠলো। তীব্র বুকে ব্যথা নিয়ে দুই হাতে চেপে ধরলো তার বুক। এই বুঝি তার হার্ট এ্যাটাক হবে। এই দৃশ্যটুকু এতো ভয়ংকর কেন? ভেতরের সব শিরা উপশিরায় তীব্র যন্ত্রণা টের পেল সে। হৃদয়ের অস্বাভাবিক গতিবিধিতে আচমকা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সে।
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৭
বুকে চেপে রাখা দুইহাত আরও জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে বুকের সাথে। গাল হা করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আরও একবার তাকায় সে সামনে। নন্দিতা সহ আরও বেশ কিছু মানুষের চোখ তখন তার দিকে। ভয়ে নন্দিতার মুখ রক্তশূন্য। নন্দিতাকে এমন অবস্থায় দেখে বেশ হাসি পেল তুর্জয়ের। সাথে সাহস পেল মনে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট টেবিলের সামনে।