প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৯

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৯
ফিজা সিদ্দিকী

চেয়ার ছেড়ে চমকে উঠে দাঁড়ালো নন্দিতা। তুর্জয় এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। মুখে সাবলীল গাম্ভীর্য ভাব, অথচ পা দুইটা হাঁটার তালে কাঁপছে ক্ষীণ। নদীর দুকূল ছাপিয়ে ভাঙন ধরার মতো বন্যা নেমেছে তুর্জয়ের বুকে। দূরে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট টের পাচ্ছে নন্দিতা সেই ভাঙন কতটুকু তোলপাড় ঘটাচ্ছে তুর্জয়ের বুকে। তবুও আজ সে নির্লিপ্ত। মাথা নীচু করে দৃষ্টি নামালো মেঝেতে। তুর্জয় এগিয়ে এলো আরও কাছে। টেবিলের কাছে এসে দুই হাত ভরে দিয়ে দাঁড়ালো সেখানে। এতটুকু পিঠ আসতেই যেন কতটুকু হাঁপিয়ে গেছে সে। মনের উপর চলতে থাকা যুদ্ধ, শরীরেও প্রতিক্রিয়া দেখায় কিনা!

হুডি পরিহিতা লোকটা আগের জায়গায় বসেই হাসলো। তুর্জয় চোখ তুলে খুঁটিয়ে দেখলো ছেলেটাকে। বয়সে তার চেয়ে বেশ কমই হবে। ফর্সা মখমলি মুখে ক্লিন শেভটা বেশ মানিয়েছে। চেহারা জুড়ে কেমন যেন এক আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। চোখে মুখে নেই কোনো গাম্ভীর্য ভাব। বরং প্রথম দেখায় যে কেউ মুগ্ধ হওয়ার মতো তার লুক। মুখ জুড়ে কেমন যেন এক হাসি হাসি ভাব। তৎক্ষনাৎ ছেলেটার পাশে নিজেকে কল্পনা করলো সে। শ্যামলা যার গায়ের বরণ, খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি, চেহারা জুড়ে কাঠিন্য এক ভাব। দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করালে নিঃশেষে সকলের দৃষ্টি কাড়বে এই অল্পবয়সী ছেলেটা। আর এটুকু আত্মোপলব্ধি বুকের মাঝে তীব্র ভয়াবহ এক ঝড় তুললো তার। এজন্যই বোধহয় নন্দিতা তার আড়ালে এখানে। তার চেয়ে হাজার গুণে যোগ্য যে ছেলেটা।
নন্দিতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল তুর্জয়ের শীতল চাহনি দেখে। শুকনো ঢোক গিলে গলার রুক্ষতা ভাব খানিকটা ভিজিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি এখানে?”
“প্রশ্নটা বোধহয় আমার আপনাকে করা উচিত মিসেস আহসান।”
তুর্জয়ের কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ আর অধিকারবোধ। সামনে বসে থাকা ছেলেটাকে পরোক্ষভাবে বোধহয় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে নিজের অধিকার। বোঝাতে চাইছে তাদের সম্পর্ক, সম্পর্কের নাম। নন্দিতা নিজেকে খানিকটা ধাতস্ত করে নিলো। অতঃপর আগের মতোই স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“একটু কাজে এসেছিলাম। আপনি কি আমাদের সাথে বসতে চাইছেন?”
নন্দিতার কথার ভঙ্গিতে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে চরম বেহায়া বনে গেল তুর্জয়। স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,

“আমি বসলে কি আপনারা ডিস্টার্ব হবেন মিস্টার?”
নন্দিতা জোরপূর্বক হাসলো খানিকটা। লোকটাকে কিছু বলার না দিয়ে আগ বাড়িয়ে নিজেই বলল,
“একটু হবো। আসলে অনেকদিন পর দেখা তো, প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে না?”
তুর্জয় মারাত্মকভাবে আহত হলো নন্দিতার কথায়। সে কল্পনাও করেনি নন্দিতা সরাসরি এভাবে তাকে চলে যেতে বলবে। তাও কিনা অন্য এক পুরুষের সামনে। অহংবোধে চিড় ধরলো তার। রাগে নিঃশ্বাসের গতিবিধি হলো তীব্র। অতঃপর নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে রোষানলে দীপ্ত কণ্ঠে দুই পাটি দাঁতের মাঝে তীব্র ঘর্ষণ ঘটাতে ঘটাতে বললো,
“আপনি ভেবে চিন্তে বলছেন তো? মে আই লিভ?”
“ইউ শুড”

নন্দিতার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি। তুর্জয় রাগী দৃষ্টিতে চোখ মেলে তার দিকে তাকাতেই নন্দিতা তাকে সরাসরি অগ্রাহ্য করে আগের মত গিয়ে বসলো চেয়ারে। সাথে সাথে কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে খানিকটা উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনাকে কষ্ট করে বাইরে অপেক্ষা করতে হবে না। ধূসর আমাকে ড্রপ করে দেবে।”
“আমি আপনার ড্রাইভার নই। এই পর্যন্ত যেভাবে এসেছেন, যেতেও পারবেন, আম শিওর।”
কথাটুকু শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না তুর্জয়। জোরে জোরে পা ফেলে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে। কাঁচের স্লাইড থেকে নন্দিতা তাকিয়ে রইলো তুর্জয়ের দিকে। যতক্ষণ না গাড়িটা তার চোখের আড়াল হলো, তাকিয়েই রইলো সে।

“এসবের মাঝে আমাকে কেন জড়ালেন?”
সামনে বসে থাকা ছেলেটার কন্ঠ শুনে ফিচেল হাসলো নন্দিতা। অতঃপর দুইহাত টেবিলের উপর ঠেকিয়ে তার উপর থুতনি রেখে সরাসরি তাকালো ছেলেটার দিকে। এরপর একই ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“এসবের মাঝে আমাকে জড়ালেন কেন?”
“আপনি না চাইলেও এসবের সাথে কানেক্টেড।”
“আপনারা চাইলেই আমাকে রেহাই দিতে পারতেন। অন্তত মনুষত্বের খাতিরে হলেও আমাকে না জড়াতে পারতেন। আমার জানামতে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে আপনাদের অজানা নয়। তারপরও নিঃস্ব একজন মানুষকে আপনাদের এই নোংরা খেলার হাতিয়ার বানিয়ে তারই কাছের মানুষের ক্ষতি করছেন। আপনারা চাইলেই এসব আটকাতে পারতেন।”

লোকটা প্রমোদ হাসলো। হাসতে হাসতেই বললো,
“হিউম্যানিটি দেখানো ওসব ভালো মানুষের কাজ। আমরা ভালো নই মিস।”
“মিসেস। ওয়াইফ অফ তুর্জয় আহসান।”
নন্দিতার কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ। দুই হাত টেবিলের উপর রেখে জোরালো কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে কথাটা। তা দেখে ধূসর বেশ মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“আপনি বোধহয় আর খুব বেশিদিন মিসেস থাকবেন না। আজকে যে কাজটা করলেন, এডভোকেট তুর্জয় আহসান আপনাকে এরপরও টলারেট করবে ভাবছেন?”
নন্দিতা দমে গেল ধূসরের এই প্রশ্নে। সত্যিই কোনো জবাব নেই তার কাছে এই প্রশ্নের। কেনই বা মেনে নেবে তুর্জয় তার এই ঔদ্ধত্যতা? কী বা দায় পড়েছে তার?
নন্দিতাকে চুপ থাকতে দেখে ধূসর তাড়া দেওয়া ভঙ্গিতে আবারও বলে উঠলো,

“বললেন না তো কেন করলেন?”
“আপনাকে জানিয়ে আমার লাভ?”
“লাভ! ওকে কী লাভ চাইছেন আপনি বলুন।”
“আমার সাথে এই মিথ্যা অভিনয়টা চালিয়ে যেতে হবে আপনাকে।”
“আর আমি আপনার কথা কেন শুনবো?”
“কারন আমি আপনাদের প্রত্যেকটা কথা শুনেছি। আপনাদের কথামত সব কাজ করেছি। এমনকি নিজের হাজবেন্ডকে ওই জঘন্য রোগের দিকে থেকে দিয়েছি শুধুমাত্র আপনাদের কথায়। এতকিছুর পরিবর্তে কি আপনাদের আমাকে ফিরতি কিছু দেওয়া উচিত নয়?”
ধূসর নিশ্চুপ থেকে ভাবলো খানিকটা সময়। অতঃপর লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো,
“আচ্ছা বেশ। বলুন কী করতে হবে আমাকে।”

“এমন কিছু যাতে তুর্জয় আমাকে ঘৃণা করে। তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে তার আড়ালে আপনার আর আমার মধ্যে কিছু চলছে।”
ধূসর ভ্রু কুঁচকে তাকালো নন্দিতার দিকে। সন্ধিহান কণ্ঠে বলল,
“কিন্তু তাতে আপনার কী লাভ? ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃণা দেখার মত কলিজা এখনও আপনার হয়নি। তাই এসব চিন্তা বাদ দিন।”
“আমার এতটুকু কলিজা আছে যে এখানে বসে বসেই আপনার কলিজা টেনে ছিঁড়ে নিতে পারি ধূসর সাহেব।”
নন্দিতার চোখ দুইটা থেকে নির্গত তীব্র রাগ ধূসরকে বিমোহিত করলো খানিকটা। অতঃপর মশকরা করার ভঙ্গিতে সে বললো,
“ধূসর সাহেব, ইশ! ডাকটা শুনে মন তো চাইছে কলিজাটা বের করে রেখে দিই আপনার সামনে।”
“শিকদারের বংশধররা এক একটা জানোয়ার জানতাম। কিন্তু তাদের পোষা কুকুরগুলোও যে বিশ্রী রকম জানোয়ার জানা ছিল না।”

ধূসর শব্দ করে হাসলো এবার। কোনক্রমে হাসি থামিয়ে চোখে টুকে তাকালো নন্দিতার চোখে দিকে। যে চোখে একরাশ ঘৃণা আর অবজ্ঞা। এই মুহূর্তে ধূসরের নিজেকে ডাস্টবিন মনে হচ্ছে। নন্দিতা যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, তেমনটাই লাগার কথা।
“কুকুররা কিন্তু অনেক বিশ্বস্ত আর মনিব ভক্ত হয়। আপনি চাইলে আপনার ভক্ত হতেও রাজি কিন্তু।”

শেষের কথাটুকু চোখ টিপে খানিকটা নীচু কন্ঠে বললো ধূসর। নন্দিতা শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। শব্দ শুনে আশেপাশের মানুষজন তাকালো তাদের দিকে। নন্দিতা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। নন্দিতার এনে দেওয়া ব্লাড স্যাম্পেলের শিশিটা হাতে নিয়ে ধূসরও বের হলো তার পিছু পিছু। আজ মূলত এই কাজের জন্যই এসেছিলো সে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২৮

যে লোকটা এতদিন নন্দিতার বাড়ির দরজায় এসে ব্লাড স্যাম্পল দিয়ে গেছিলো কয়েকদিন আগে থেকেই অসুস্থ সে। অগত্যা শেষ সময়ে এই কাজের দায়ভার এসে পড়ে শিকদার বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ছেলে ধূসর শিকদারের উপর। বাবা আর চাচার তৈরী মাস্টারপ্ল্যান সফল হতে দেখার জন্য সেও নিজে থেকেই এসেছিল আজ নন্দিতার সাথে দেখা করতে। আর তুর্জয়ের শরীর থেকে নেওয়া ব্লাড স্যাম্পল নন্দিতার কাছ থেকে নিতে। এখন শুধু এই স্যাম্পল ল্যাবে পাঠিয়ে এডভোকেট তুর্জয় আহসানকে এইডস নামক জটিল রোগের শিকার হতে দেখার পালা।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩০