প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩২
ফিজা সিদ্দিকী
আয়েশ করে মায়া মাখিয়ে রান্না করার মতো কোনো ব্যক্তি ধূসর নয়। তাই বেশ ভেবে চিন্তেই চটজলদি পায়েস বানানোর সিদ্ধান্ত নিলো নন্দিতা। ফ্রিজ থেকে দুধের প্যাকেট আর পায়েসের চাল বের করে দ্রুত হাতে লেগে পড়লো নিজের কাজে।
এতো সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ধূসরের নেই। তার রাত হয় ভোরের আলো ফোটার পর আর দিন হয় বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে। কিন্তু নন্দিতার ফোন পেয়ে আজ বেশ সকাল সকালই উঠে পড়েছে সে। ফ্রেশ না হয়ে বাবার রুম, চাচার রুম মিলিয়ে অবশেষে তাদের সিক্রেট রুমে গিয়ে মিলেছে নির্দিষ্ট ফাইলটা। সকাল সকাল সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব তল্লাশি চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে খুব একটা কঠিন হয়নি কাজটা। কারন এ সময় বাবা আর চাচা বের হয়ে যান অফিসের উদ্দেশ্যে। আর বাড়ির বাকিরা সব যে যার মতো কাজে ব্যস্ত। সকাল সকাল তাদের বাড়িতে এতো হৈ চৈ দেখা যায়না। সবাই যে যার মতো রেডি হয়ে বের হলেই কাজের লোকরা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। তাই যে যার মতো ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ে কাজের উদ্দেশ্যে। ধূসরের বড় ভাই তৈমুর শিকদার, প্রফেশনলি একজন পুলিশ অফিসার হলেও তার প্রধান কাজ বাপ, চাচাদের বেআইনি কাজের সহায়তা করা। পুলিশের ভেসে থেকে বেকায়দায় আইনি ভাবে সহায়তা যাকে বলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৈমুরকে কথায় দেখা যায়নি আজ। হয়তো নিজে ঘরেই রয়েছে, নয়তো কোনো কাজে বেরিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। নিজের ঘরেই ডাকাতি করতে ধূসরের বিবেক বাধা দিয়েছিলো খানিকটা। কিন্তু পরক্ষণেই নন্দিতার কথা ভেবে কেন যেন সব বিবেক জলাঞ্জলি দিয়ে ফেললো সে। মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা তাকে টানছে অনবরত। নাহ, ওই ক্লাব, পার্টিতে গায়ে ঢলে পড়া মেয়েগুলোর মতো না। এই চাহিদা ভিন্ন। মূলত সে নন্দিতাকে চাহিতে শুরু করেছে। যেটা একরাতের জন্য না, বরং প্রতিটা রাতের জন্য। আফিমের নেশাও যে একটা নারীর নেশাকে বিট করে ফেলতে পারে, সেটা সে গতরাত থেকে বেশ টের পাচ্ছে।
নন্দিতার সাথে দেখা করার পর ব্লাড স্যাম্পলটা ল্যাবে হ্যান্ডওভার করে নিত্যদিনের মতো ধূসর চলে যায় নাইট ক্লাবে। অ্যালকোহন আর মেয়েলি নেশা দুটোই যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। খুব কম এমন দিন যায়, যখন ধূসর কোনো মেয়েকে নিয়ে রুমে ঢোকে না। ক্লাবের নির্দিষ্ট একটা রুম সবসময়ই বুক করা থাকে তার জন্য। যখন যে মেয়ের দিকে নজর যায় ধূসরের তাকে নিয়ে সোজা চলে যায় রুমের বিছানায়। রাত শেষে নির্দিষ্ট একটা অ্যামাউন্ট ভরা খাম টেবিলের উপর রেখে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। পরে সেখান থেকে সোজা বাড়িতে এসে শাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম। এরপর অবশ্য মেয়েটার আর কোনো খোঁজ রাখে না সে। মেয়েদেরকে যে জোর করো বিছানায় আনে ধূসর, এমনটাও নয়। কিছু মেয়েরা পকেটে টাকা দেখে তো কিছু তার ড্যাশিং লুকস্, এরপর নিজে থেকেই সারা দেয় তার ডাকে। নেশায় বুঁদ হয়ে গোটা রাতের ফুর্তির সঙ্গী হতে।
গত রাতে একের পর এক ওয়াইনের গ্লাস শেষ করেছে ধূসর। অথচ অবাক করার বিষয় হলো নেশা চড়েনি তার। নেশায় বুঁদ হয়ে কোনো মেয়েকে নিয়ে রুমেও যায়নি। শরীর অসুস্থ না হলে এমন ঘটনা কোনো মিরেকলের চেয়ে কম নয়। অথচ ধূসর ছিল একদম সুস্থ স্বাভাবিক। আরও অবাক করার বিষয় হলো, এতো হাই ভলিউম, গান বাজনার পরিবেশ তার ভালো লাগছে না। কেমন যেন অস্থির লাগছে ভেতরটা। মন চাইছে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে স্থিত কিছু নিঃশ্বাস টেনে নিতে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে ওয়াইনের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে সে বেরিয়ে আসে নাইট ক্লাব থেকে। এরপর ড্রাইভ করে সোজা বাড়িতে।
চেঞ্জ না করেই ধূসর সোজা চলে যায় ছাদে। তাদের ভিলা বাড়ির ছাদ থেকে নীচে তাকালেই ঝকঝকে নীল রঙের পানির সুইমিং পুল চোখে পড়ে সবার আগে। বাড়ীর ব্যাকসাইডে বেশ কিছু গাছ মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় তাদের আভিজাত্যের অহমিকার। কোনো কিছু চিন্তা না করেই ধূসর সটান শুয়ে পড়ে ছাদের মেঝেতে। অতঃপর চোখ বুঁজতেই ভেসে ওঠে নন্দিতার নিটোল গোলগাল মুখটা। উচ্চমানের প্রসাধনীর আস্তরণহীন মুখটায় বড্ডো মায়া। মেয়েটাকে সুন্দরী বলা যায়না। খানিকটা চাবি ফেস, কিন্তু নজরকাড়া। একবার তাকালে আবারও ফিরে তাকানোর মতো। সাদামাটা একটা কালো সালোয়ার সুট পরে থাকা এই মেয়েটার মাঝে কী যে পেল ধূসর জানে না। তবে কোনো এক সম্মোহনী টানে সে সেই ডাকে সাড়া দিলো নিজে অজান্তেই। চোখ বন্ধ করেই ভাবতে লাগলো পরস্ত্রীকে নিয়ে। আর এই ভাবনা তাকে প্রশান্তি দিলো। কারন হলো তার ঠোঁটের কোণের হাসির।
রাতে যখন যে সেভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল ছিল না ধূসরের। সকালের আলো ফুটতেই ঘুম ভাঙ্গলো তার, আর নিজেকে আবিষ্কার করলো খোলা ছাদের নীচে। ঠাণ্ডায় শরীরটাও বেশ ব্যথা করছে, তাই ভোরের আলোর সাথে সাথেই নেমে এসে শুয়েছিল নিজের ঘরে।
কলিংবেলের শব্দে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে নন্দিতার। চুলার আঁচ কমিয়ে গেট খুলতেই একজন ডেলিভারি বয় তার হাতে ধরিয়ে দেয় একটা প্যাকেট। দরজা লক করে নন্দিতা বেশ সাবধানে প্যাকেটটা রাখলো ডাইনিং টেবিলের উপর। অতঃপর দৌড়ে চলে গেল চুলার কাছে।
এক বাটিতে বেশ খানিকটা পায়েস সাজিয়ে সেটা ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতেই ঘড়ির দিকে খেয়াল হলো নন্দিতার। প্রায় বারোটা বাজে। অথচ দুপুরে খাওয়ার কোনো আয়োজনই করা হয়নি তার। সকাল থেকেই কিছু খাওয়া হয়নি তার। তুর্জয়কে এভাবে না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে নন্দিতারও আর ইচ্ছে করেনি কিছু খেতে। কিছুক্ষণ পরই লাঞ্চের টাইম, কিজানি তুর্জয় আজ খাবে কিনা! বলে তো গেল বাইরে খাবে, কিন্তু আদৌ খাবে তো?
শাওয়ার শেষ করে বেছে বেছে বেশ পুরোনো একটা কাপড় পরলো নন্দিতা। সাদা রঙের সালোয়ার সুটটা বিয়ের আগে বেশ অনেকবার পরেছে নন্দিতা। বেশ ঢিলেঢালা ছিল বলেই গরমের দিনে আরাম পাওয়া যেত এই জামাটা পরে। কিন্তু এখন মোটা হওয়ার জন্য একেবারে ফিট হয়েছে কাপড়টা। নিজেকে আয়নায় দেখে অসুস্থতা, তুর্জয়ের অভিমান, একে একে সব মনে পড়তে শুরু করলো তার। মনের মাঝে উঁকি দিলো একটা ভাবনা,
“কী এমন ক্ষতি হতো, শেষ কয়টা দিন তার সাথে কাটানোর সুযোগ করে দিলো? আমার প্রতি তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন হলে খোদা?”
প্যাকেট থেকে আসল জিনিসটা বের করলো নন্দিতা। প্যাকেট খুলতেই গাঢ় নীল রঙের লম্বাটে একটা কাঁচের বোতল বেরিয়ে আসে। যেখানে বড় বড়ো করে লেখা “Sette”
Fratelli Sette একটি প্রিমিয়াম ভারতীয় রেড ওয়াইন যা ক্যাবারনেট সাভিগন এবং সাঙ্গিওভেস নামক আঙ্গুরের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়। যার স্বাদ জটিল এবং সমৃদ্ধ। কালো চেরি, ওক এবং অন্যান্য ফলের সুবাসও থাকে এতে। এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে 14-14.5%
কিচেনের সাথে লাগোয়া বড়ো হলঘরের একপাশে রাখা ছোটো একটা টি টেবিল আর সোফা সেট। শেলফ থেকে একটা ওয়াইনের গ্লাস বের করে ওয়াইনের সাথে সেটা সাজিয়ে রাখলো টি টেবিলে। অতঃপর ডাইনিং টেবিলে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলো ধূসরের।
দ্বিতীয় দফায় কলিং বেল বাজতেই ভেতরটা ধক্ করে উঠলো নন্দিতার। ভয়ে রীতিমত হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। ফাঁকা বাড়িতে একা একটা ছেলেকে ডাকার ফল তাকে কিভাবে যে পোহাতে হবে সে জানে না। শুধু জানে তুর্জয়ের জন্য এই ফাইলটা জরুরী। ভীষণ রকম জরুরী।
নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিলো নন্দিতা। এরপর এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলো দরজা। একহাতে কালো রংয়ের একটা ফাইল ধরে অন্যহাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে ঠেলে ধূসর আলতো হেসে প্রবেশ করলো ঘরের মধ্যে। নন্দিতা দরজা লক করলো না। আলতো করে ভেজিয়ে দিয়ে দুরুদুরু বুকে এসে দাঁড়ালো ধূসরের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে। ধূসর চোখে তুলে একবার নন্দিতার দিকে তাকালো অতঃপর সামনে টি টেবিলের উপর রাখা ওয়াইনের বোতলের দিকে। বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো সে। চোখ ঘুরিয়ে নন্দিতার দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াইনের বোতলের দিকে তাকালো। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বললো,
“বলো তো কে বেশী নেশাময়, তুমি নাকি সে?”
শেষটুকু বলতে গিয়ে ধূসর তাকালো নন্দিতার দিকে। অস্বস্তিতে কাদা হয়ে নন্দিতা জায়গা ছাড়লো তাড়াতাড়ি।
ডাইনিং টেবিলের উপর চাপ দিয়ে রাখা পায়েসের বাটিটা ধূসরের সামনে রেখে কণ্ঠে খানিকটা রাগ টেনে নন্দিতা বললো,
“খেয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় হন।”
ধূসর চমৎকার হাসলো। হাসতে হাসতেই বললো,
“বাড়িতে মেহমান আসলে এভাবেই তাড়িয়ে দেন বুঝি?”
“আপনার আমার মেহমান নন। আর শত্রুদের পাত বেড়ে খাওয়াই না আমি। নেহাৎ আমাকে সাহায্য করছেন আপনি, নাহলে এই বাড়িতে পা রাখার সাহসও দেখাতে পারতেন না।”
ধূসর রাগলো না। বরং আগের মতোই হেসে বললো,
“শত্রুর জন্য মিষ্টি পায়েস যখন বানালেন, সম্পর্কে এত তিক্ততা টেনে আর কী লাভ? একটু ভালো মুখে কথাই নাহয় বলুন।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩১
“কথা আর টাকা দুটোই জায়গা বুঝে খরচ করতে হয়। যেখানে সেখানে খরচ করলে সেটাকে ওয়েস্ট বলে। আর কোনকিছু ওয়েস্ট করা আমার একদমই পছন্দ নয়।”