প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৮

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৮
ফিজা সিদ্দিকী

বিছানার উপর আধশোয়া ক্রমশ হাত পা ছোড়াছুড়ি করে চলেছে নন্দিতা। তুর্জয় বাম হাতে তার কোমর আঁকড়ে রেখেছে জোর করে। ডানহাতে তার টক দই দিয়ে মাখানো ভাত। প্লেটটা বিছানার একপাশে সরিয়ে রেখে নন্দিতাকে নিজের বুকের সাথে আরও খানিকটা ঠেসে ধরলো তুর্জয়। নন্দিতা ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে তাকালো তুর্জয়ের দিকে। ভাবখানা এমন, যেন তাকে জোর করে ভুলভাল কিছু খাওয়ানো হচ্ছে। নন্দিতার এমন আচরণ দেখে প্রথমে নিজেও খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল তুর্জয়। কিন্তু পরবর্তীতে আর মাথা ঘামায়নি। ডেস্কে তার প্রচুর কাজ পড়ে আছে। শিকদারের কেসটা কোর্টে উঠবে কাল। ফাইলগুলো রিড করতে হবে তাকে। আপাতত নন্দিতাকে কিছু খাইয়ে ঘুম পাড়ানো তার মূল উদ্দেশ্য।

জোর করে পুরো ভাতটা খাওয়ানো শেষে বিজয়ের হাসি দিলো তুর্জয়। নন্দিতা মুখ বেজার করে ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানার একপাশে। তুর্জয় শব্দহীন হাসলো। বিছানা থেকে নেমে যাওয়ার সময় আলতো করে কপালে চুমু দিলো তার। মনে মনে বেশ খুশি হলেও মুখটা অমন করেই চোখ বুঁজলো নন্দিতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এলোমেলো কিচেন গোছাতে বেশ সময় লেগে গেল তুর্জয়ের। সব কাজ সেরে রুমে এসে নন্দিতার পাশে বসতেই খেয়াল করলো সে ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। ফোঁশ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নন্দিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতেই আপনাআপনি ঠোঁটটা আলগা হয়ে উঠলো তার। আজ প্রথমবারের মতো তুর্জয় অনুভব করলো বাবা হিসেবে খুব একটা মন্দ হবে না সে। বউয়ের মতো বাচ্চাদের ধরে বেঁধে খাওয়াবেনা যদিও, সেই নরম টুকটুকে শরীরটাকে বড্ডো সাবধানে আগলে রেখে যত্ন নেবে। ভাবনার মাঝেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। বাবা হওয়ার অনুভূতি এমন কেন? তন মন জুড়ে কেমন যেন এক শিরশিরানি অনুভূতি খেলে গেল। হাত বাড়িয়ে নন্দিতার চুলের মাঝে বিলি কেটে দিতে দিতে করুণ কণ্ঠে তুর্জয় বলে উঠলো,

“বাচ্চার মা আর বাচ্চা দুটোকে একসাথে সামলানোর মতো হায়াত দিয়ে পাঠানো হয়েছে তো আমাকে?”
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো নন্দিতার। ঘুমের ঘোরেই বিছানার অপরপাশ হাতড়ালো সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। কিন্তু জায়গাটা আজ খালি। তুর্জয়ের ঘুম ভেঙে গেছে বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি চোখ মেললো নন্দিতা। ঘড়িতে তখন নয়টা পঁচিশ। এতো সকাল সকাল তুর্জয়ের বেরোনোর কথা তো নয়! আচমকা কিছু একটা মনে পড়তেই মোবাইল হাতে নিয়ে আজকের তারিখ দেখতেই চমকে উঠলো সে। আজ তো সেই দিন, যেদিনের জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে তুর্জয়। আজ শিকদারদের কেসটা কোর্টে উঠবে। আইনি মতে সওয়াল জবাব করা হবে। হবে তর্ক বিতর্ক, সত্য মিথ্যার লড়াই। চলবে কতো অরাজকতা নিজেদের পাপের বোঝা ঢাকতে। পাপের সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে চাওয়া প্রতিটা মানুষের প্রাণ নিয়েও টানাটানি হবে। দিনের শুরুটা কেমন যেন ভালো ঠেকলো না নন্দিতার। কেমন এক দমবন্ধকর অনুভূতি যেন চেপে ধরছে তার গলা। মনের মাঝে চলছে উথালপাথাল এক ঢেউ। চলছে ঝড়, ঝঞ্ঝা। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা টেবিলের রেখে দিতে গিয়ে খেয়াল করলো ধূসরের মিসড কল। সকাল থেকে দশবার কল দিয়েছে সে। লাস্ট কলটাও কিছুক্ষণ আগের।

ভয়, শঙ্কা যেন বেড়ে গেল আরও খানিকটা। কাঁপা কাঁপা হাতে ধূসরকে কল করলো সে। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো সাথে সাথেই। অথচ কোনো কথা বললো না। নন্দিতা ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কেন ফোন দিয়েছেন?”
“আপনার কণ্ঠ শুনতে। কোনো কাজের আগে মুখ মিষ্টি করে গেলে কাজটা নাকি ভালোভাবে হয়ে যায়। সেভাবে মুখ মিষ্টি করার তো অধিকার নেই, তাই ভাবলাম মিষ্টি কণ্ঠটাই শুনে ফেলি।”
“আপনি কী জানেন আপনি কত ফালতু একটা লোক?”
নন্দিতার রাগী কণ্ঠের বিপরীতে খানিকটা হেসে ধূসর বলে,
“জানি। মা বলতো, আমি নাকি পুরো বাবার মতো।”
“তার মানে আপনি স্বীকার করছেন আপনার বাবা খারাপ। তাহলে কেন তাকে সাহায্য করছেন? কেন অন্যায়ের সাথে আপস করছেন?”

ধূসর আবারও চমৎকার হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,
“আমি কই স্বীকার করলাম? বলেছি মা বলতো। মায়ের ধারণা স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই আমাদের উপর রাগ করেই বোধহয় তিনি ঘুমিয়ে গেলেন মাটির নীচে।”
নন্দিতা খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকলো। ওপাশ থেকেও কোনো কথা এলো না। এতটা সময়ে নিজেকে খানিকটা শান্ত করে নন্দিতা নরম কণ্ঠে বললো,
“আপনার মা বোধহয় কখনও চাননি আপনি আপনার বাবার মতো হন। আপনার বাবার প্রতি তার যে অসন্তোষ ছিলো, আপনার কথায় বেশ টের পেলাম। অথচ আপনি ঠিকই বাবার মতো হলেন। আপনার মায়ের ভয় ছিলো আপনাকে নিয়ে, আর আপনি সেই ভয়টাকে সত্য করে দিলেন।”
“আমি তো হতে চাইনি। মায়ের আঁচলে বাধা একটা শৃঙ্খল বাচ্চা ছিলাম। এতটা উশৃঙ্খল তো তার যাওয়ার পর হলাম। একা বড় হতে হতে কখন যে দুনিয়ার চাকচিক্যতা গায়ে মেখে নিলাম, টেরই পেলাম না। এরপর আর কখনো বেরিয়ে আসতে পারলাম না।”

ধূসরের কন্ঠটা করুণ শোনালো। নন্দিতা তাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আপনার জীবনের পুরো ঘটনা আমার জানা নেই, তবে কারোর চলে যাওয়া আপনাকে বদলায়নি বরং আপনি চেয়েছেন বলে বদলেছেন। এই দোষটুকু পুরোটাই আপনার।”
“আপনাকে আমার কেন এত ভাললাগে জানেন? আপনার কাছে এলে আমি মা মা গন্ধটা পাই। মায়ের শাসন, বাঁধন সবটুকু কিভাবে যেন মিলে যায় আপনার সাথে। তুর্জয় আহসানের আগে আমি কেন পেলাম না বলুন তো আপনাকে?”
নন্দিতার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো এবার। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা কেটে দিতে গেলে সাথে সাথেই হুশিয়ারি দিয়ে ধূসর বলে ওঠে,
“কাটবেন না একদম। কথা আছে।”

“আপনার এমন অবান্তর কথা শোনার সময় কিংবা রুচি কোনোটাই আমার নেই।”
“অবান্তর নয় কিছুই। এটা আমার আক্ষেপ, আমার অনুশোচনা। এসব আপনি বুঝবেন না।”
“বুঝতে চাইও না। আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে ছাড়া আর কাউকে বোঝার প্রয়োজন বোধ করিনা।”
“আর আমার ভালোবাসা? আমি যাকে ভালোবাসি তাকে বোঝা তো আমারও প্রয়োজন তাইনা?”
“ভালোবাসার মতো সুন্দর জিনিস আপনাদের মত পাপিষ্ঠদের মুখে মানায় না। এতে ভালোবাসা পবিত্রতা হারায়।”
“এতো ঘৃণা করেন আমাদের?”

ধূসর করুণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলে নন্দিতা কণ্ঠে খানিকটা জোর ধরে বলল,
“আপনার ধারণার চেয়েও বেশি। আমার স্বামীর ক্ষতি করতে চাওয়া প্রতিটা মানুষকে আমি চরমভাবে ঘৃণা করি।”
ধূসর হাসলো আবারও। বললো,
“ইশ! এমন চাঁদ কপাল নিয়ে জন্মটা আমার হলো না কেন? কপাল কেটে আপনাকে নিয়ে নেওয়া যায় না?”
“অবান্তর কথা শেষ হলে রাখছি। এইসব অন্য মেয়েদের উপর ট্রাই করুন। ন্যূনতম রুচিবোধ বেঁচে থাকলে একজন বিবাহিত মেয়েকে এসব বলবেন না আর।”
ধূসর ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। অতঃপর কন্ঠটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
“আপনার স্বামীকে একটু সাবধানে থাকতে বলবেন। গাড়ি ছাড়া যেন না বের হয় কোথাও। তার কিছু হলে তো আপনি আবার ভালো থাকবেন না। আর আপনি ভালো না থাকলে আরও একজন….”

ফোন কেটে দেয় নন্দিতা। এসব কথা ভালো লাগছে না তার। তবে ধূসর যে তাদের সাবধান করার জন্য কল দিয়েছিলো বুঝেছে সে। নিশ্চয়ই বেশ বড়সড়ো কিছু প্ল্যানিং চলছে তাদের। কিন্তু কী?
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে সাইড টেবিলের পাশে একটা চিরকুট পেল নন্দিতা। চিরকুটটা যে তুর্জয়েরই লেখা এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। কোনো কারণবশত আগে বের হতে হলে, এমনই চিরকিট রেখে যায় সে তার জন্য। নন্দিতার বেশ ভালো লাগে এই ব্যাপারটা। কেমন যেন প্রেম, আবেগ ঠিকরে পড়ে তার লেখা প্রতিটা শব্দে।
“আজকে থেকে আরও কয়েকটা দিন আমার জন্য ভীষণ আতঙ্কের, ভয়ের। ভয় আমি নিজেকে নিয়ে পাইনা, যেটুকু ভয় সবটুকু তুমি। তোমাকে কাছে পাওয়ার লোভে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ভয় পাই এখন। নিজের যত্ন নিও, আমি আসছি। ফিরতে লেট হবে কিন্তু! চিন্তা কোরো না”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৭

ওযু করে এসে নামাজে বসলো নন্দিতা। কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল সে। বুক উজাড় করা কান্নার ঢল নেমে এলো তার সৃষ্টিকর্তার নিকট। কাঁদলো, চাইলো, অভিযোগ করলো। সবশেষে সবটুকু ভয়, আশঙ্কা সৃষ্টিকর্তার কাছে উজাড় করে দিয়ে নিরাপত্তা চাইলো। চাইলো আরও কতকিছু। যা চাওয়া যায়না মানুষের কাছে, সে সবটা তার কাছে চাইলো। অবশেষে হিঁচকি তুলতে গিয়ে তীব্র ব্যথা টের পেল পেটে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৯