প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪
ফিজা সিদ্দিকী

“এসবের মধ্যে পুলিশ এলো কেন? আমার ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে কাটাছেঁড়া করার সাহস পুলিশ কিভাবে পেল?”
কেবিনে উপস্থিত নার্স মৃদু কেঁপে উঠলো তুর্জয়ের কণ্ঠে। বেডে শুয়ে থাকা নন্দিতার পায়ে সবেমাত্র ব্যান্ডেজ শেষ করেছে সে। এমন সময় কেবিনের দরজা খুলে সেখানে উপস্থিত হয় আনসার। তাকে উদ্দেশ্য করে বলা কথার অর্থ বুঝে মাথা নত করে ফেললো সে। মৃদু কন্ঠে বললো,
“আজ উনি আপনাকে আঘাত করেছেন, কাল যদি এরচেয়ে বড়ো কিছু করে দেন, এই ভয়েই…”
“আমার ওয়াইফকে উনি বলার অধিকার আমি তোমাকে দিইনি। আর আমার বউ আমাকে কিভাবে ট্রিট করবে, সেটার জন্য তোমার থেকে পারমিশন নিতে হবে তাকে?”

“স্যার, আপনি যে বললেন বউ মেরেছে!”
আনসারের কথা শুনে রাগী চোখে তার চোখে তাকাতেই আচমকা ঘর কাঁপিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে নন্দিতা। নন্দিতার হাসির রেশ ধরে তার সাথে তাল মিলিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ওঠে কেবিনে উপস্থিত নার্সও। তুর্জয় রাগী চোখে একপলক নন্দিতার দিকে তাকালে কোনক্রমে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে সে। কিন্তু পরক্ষণেই ব্যর্থ হয়ে আরও জোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে,
“দা গ্রেট এডভোকেট মিস্টার তুর্জয় আহসান, যাকে কোনো কেসে হারানো যায়না, শেষে কিনা নিজের বউয়ের হাতে মার খেয়ে হেরে গেল!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কোনক্রমে কথাটুকু শেষ করে আবারও আগের ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করলো নন্দিতা। তুর্জয় ফিরে তাকালো না সেদিকে। ব্যথায় টনটন করা মাথাটায় অতিরিক্ত রাগের কারণে আরও বেশি যন্ত্রণা শুরু হলো তার। অতঃপর ঝট করে কেবিনের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
তুর্জয়কে রাগাতে পেরে যেন বেশ মজাই পেল নন্দিতা। আনসারের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে বললো,
“বোম ব্লাস্ট হওয়ার আগে আপনার স্যারের মাথায় পানি ঢালুন, আনসার সাহেব। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানিতে যদি একটু ঠাণ্ডা হন।”

কেস নম্বর 209 এর ফাইলটা হাতে নিয়ে তার উপরে পড়ে থাকা ধূলোগুলো আলতো হতে পরিষ্কার করলো আলোক। অতঃপর এক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। মনে মনে আওড়ালো,
“শেষ থেকে শুরুর গল্পটা এবার আমি লিখবো। আর পুতুল খেলার মতো করে রশি ধরে নাচাবো তোমাকে। সেবার আমার গেছিলো, এবার তোমার যাবে। সব যাবে, সবটুকু।”

সকালের সোনালী রোদের প্রথম ছটা আড়াআড়িভাবে এসে পড়েছে তুর্জয়ের মুখের উপর। ব্যথার কারণে উপুড় হয়েই শুয়ে থাকতে হয়েছে তাকে গোটা রাত। ওষুধের কারণে অবশ্য ঘুমাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। কিন্তু শেষরাতের দিক থেকে ওষুধের প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করেছে, আর পুরো শরীর জুড়ে অসহ্য রকমের এক ব্যথা টের পাচ্ছে সে। তবুও ঘুমের রেশ কাটেনি পুরোপুরিভাবে।

নন্দিতা আলগোছে নিজের পিঠ দিয়ে আড়াল করলো তুর্জয়ের মুখে পড়া আলোটুকু। অতঃপর আলতো হেসে তাকালো তার দিকে, যার ঘুমন্ত অবয়বটুকুর প্রেমে পড়ে সে রোজ। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো, গাল ভর্তি চাপ দাড়ির ফাঁকে বামপাশে ছোট একটা কাটা দাগ। মুখের এই দাগটাকে দেখলে মনে হয় যেন এ যেন অনেকটা গাল ভর্তি টোলের মতো। যার উপস্থিতি সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে আরও কয়েকগুণ। কোনো দাগও যে কারোর সৌন্দর্য্যের প্রতীক হতে পারে, তা এই মানুষটাকে এত কাছ থেকে না দেখলে জানতে পারত না নন্দিতা। টিকালো নাকের একদম নিচে অবস্থিত কালচে ঠোঁটদুটো কিছুক্ষন পর পরই একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে কিছু বিড়বিড় করছে মৃদু শব্দে। নন্দিতার চোখ আটকে গেল এই দৃশ্যে।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা ত্রিশ। নন্দিতা মৃদু হেসে জানালার পর্দা লাগিয়ে দিল। এরপর আলতো পায়ে এগিয়ে গেল তুর্জয়ের কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে খানিকটা উচ্চকন্ঠে বলে উঠলো,
“ঘুমালে আদর পায় আর জেগে থাকলে কাপড়ের মতো তুলে আছাড় দিতে ইচ্ছে করে, রাক্ষস একটা।”
“একদম রাগাবেন না আমাকে। আমার রাগ সহ্য করতে পারবেন না আপনি নন্দিতা। বাচ্চা একটা মেয়ে, এতো কষ্ট নেবেন কিভাবে? পারবেন না, পারবেন না।”

ঘুমের ঘোরে তুর্জয়ের এমন আবোলতাবোল কথা শুনে সন্ধিহান চোখে তার দিকে তাকায় নন্দিতা। অতঃপর ডানহাত কপালে ঠেকাতেই টের পায় জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তুর্জয়ের। এতক্ষণ এই ব্যাপারটা খেয়াল করেনি বলে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো সে। দেরী না করে দৌড়ে রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে করে পানি নিয়ে এলো। বাটিটা টেবিলে রেখে তুর্জয়ের পাশে বসতেই স্পষ্ট টের পেল তার শরীর কাঁপছে। তড়িঘড়ি আলমারী থেকে ভারী একটা কম্বল বের করে চাপিয়ে দিলো তার গায়ে। অতঃপর একটুকরো কাপড় পানিতে ভিজিয়ে আলতো করে তা চেপে ধরলো তুর্জয়ের মাথায়।

টিকটিক শব্দে চলতে থাকা ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর বোলাতে গিয়ে নন্দিতা খেয়াল করলো ত্রিশ মিনিট পেরিয়েছে। তুর্জয়ের শরীরের কাঁপুনিটাও এখন আর নেই। কপালে হাত ঠেকিয়ে পরখ করলো জ্বর আছে নাকি! নাহ জ্বরটাও নিয়ন্ত্রণে। অস্থির হয়ে পড়া মুখটা এবার যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।

নিজেকে সান্ত্বনা দিতে নন্দিতা আরও একবার তার হাত রাখলো গম্ভীর, কাঠখোট্টা, তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষের কপালে। অতঃপর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল নামিয়ে আনলো পুরুষালী ঠোঁটের কাছে। সিগারেটের তাপে পোড়া কালচে ঠোঁটটা জ্বরতপ্ত হয়ে আরও খানিকটা আদুরে হয়েছে কি? নাহলে তার কাছে এতো লোভাতুর লাগছে কেন? একটু বেশীই টানছে আজ। আচমকা বড্ডো দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসলো সে। ডানহাতে তুর্জয়ের চোখ ঢেকে আস্তে করে এগিয়ে গেল তার দিকে। অতঃপর চোখ বুঁদে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ওই পুরুষালী জ্বরতপ্ত ঠোঁটে। ঘুমের ঘোরেই আপনাআপনি নিজের ঠোঁট আলগা করে ফেললো তুর্জয়। যা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো নন্দিতা। অতঃপর তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩

“জীবনের প্রথম টাটকা চুমুটা আমি এই নিষ্পাপ, আদুরে মানুষটাকে উৎসর্গ করলাম। আপনি বাসি চুমু পাবেন, ডিয়ার হাসবেন্ড। এটা আপনার শাস্তি। বিয়ে করা বউকে সবসময় নিজের থেকে দূরে দূরে রাখার শাস্তি। আমার প্রথম ভালোবাসা, প্রথম চুমুতে আপনার কোনো অধিকার রইলো না আর। সব হারালেন।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫