প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪০

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪০
ফিজা সিদ্দিকী

বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা কথাও ঠিকমতো বলেনি তুর্জয়। নন্দিতা ছটফট করছে কোর্টে কী হলো শোনার জন্য। অথচ পাথরের মতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে তুর্জয়। না একরত্তি পরিমাণ নড়ছে, না কিছু বলছে। মনে মনে ভয় হলেও তুর্জয়ের গা ঘেঁষে বসলো নন্দিতা। নরম সুরে বললো,
“এমন করছেন কেন?”

তুর্জয় নিশ্চুপ তখনও। মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু শোনা যাচ্ছে তার নিঃশ্বাসের তীব্র আনাগোনার শব্দ। নন্দিতা এগিয়ে গেল আরও খানিকটা। একহাতে তুর্জয়ের গাল ছুঁয়ে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“বেশি খারাপ খবর? এতো হোপলেস হয়ে পড়ছেন কেন? দেখবেন, ভালো কিছু হবে।”
এতক্ষণে তড়িৎ গতিতে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো তুর্জয়। দুজনের চোখাচোখি হতেই কেঁপে উঠলো নন্দিতা। তুর্জয়ের কঠোর দৃষ্টির সামনে তাকাতে পারছে না সে। তবুও সে চোখ সরালো না। কঠোর দৃষ্টির পানে নরম চোখে তাকিয়েই রইলো। তুর্জয় ঝট করে নন্দিতার হাত তার গাল থেকে সরিয়ে দিলো। বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে গেল দরজা দিয়ে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তুর্জয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা দৌড়ে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরলো নন্দিতা। পায়ে বেড়ি পড়ার মতো করে থমকে দাঁড়ালো তুর্জয়। পাথর হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো এক জায়গায়। নন্দিতা এবার ঘুরে তার সামনে গেল। দুই হাত উঁচু করে তুর্জয়ের দুইগালে রাখলো। কণ্ঠ তার অবরুদ্ধ। কান্নারা দলা পাকিয়ে চেপে রেখেছে তার কন্ঠনালি। সামান্য ঢোক তুর্জয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। ধীর কণ্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এমন করছেন কেন? কষ্ট হচ্ছে যে!”
তুর্জয়ের রাগ মাত্র ছাড়ালো। আচমকা নন্দিতার দুই বাহু শক্ত করে আঁকড়ে মুখোমুখি আনলো। হিসহিসিয়ে বললো,
“তুই যদি বলতিস ছুরিটা আমার বুকে চালাবি, নির্দ্বিধায় বুকটা পেতে দিতাম। কারণ চোখে চোখ রেখে দেওয়া আঘাতে ব্যথা হয়, কিন্তু পেছন থেকে মারা ছুরিতে আত্মসম্মানটাই মরে যায়, ধীরে… নিঃশব্দে… রক্তশূন্য হয়ে।”
নন্দিতার বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। সারা শরীরের রক্তপ্রবাহ চঞ্চল হলো। অস্থিরতায় হাসফাঁস করতে করতে ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,

“যে বুক আমার আশ্রয়স্থল, আমার নিরাপদ জমিন, সেখানে ছুরি চালানোর আগে আমার মরণ হোক।”
তুর্জয় ছাড়লো না তাকে। বরং আগের চেয়ে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে নিলো আরও। এক অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে এতটা দূরত্ব, একের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে অন্যের মুখেতে দূরত্বটুকু এমন। নন্দিতা ভয় পেল খানিকটা। আমতা আমতা করে বললো,
“আপনাকে অস্থির লাগছে বড্ডো। ফ্রেশ হয়ে এলে আমরা কথা বলবো।”
তুর্জয় ছাড়লো না। উপরন্তু হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে কণ্ঠ খাদে ফেলে প্রশ্ন করলো,
“শিকদারদের সাথে কী সম্পর্ক তোর?”
নন্দিতা শুকনো ঢোক গিললো। জবাবে দেওয়ার মতো কিছু নেই তার কাছে। তাই দৃষ্টি নত করে চুপ করে রইলো। তুর্জয় তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“আমি জানতে চাইছি কিছু।”

নন্দিতা স্তব্ধ। নিশ্চুপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। এতে তুর্জয়ের রাগের আগুনে ঘি পড়লো যেন। এক ধাক্কায় নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজের চুলগুলো দুইহাতে মুঠিতে ধরে অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কেন আমাকে এতটা আঘাত দিলি? কেন আমাকে এভাবে অপমান করলি? কেন আমার সবচেয়ে দূর্বল জায়গায় আঘাত করলি? আমাকে ধংস করার আর কী কোনো উপায় ছিল না?”
নন্দিতা দুই হাত মুখে চেপে কেঁদে উঠলো হু হু করে। জবাবে তার কাছে বলার মত কিছু নেই কেন? কেন সে এখনও পারছে না প্রকাশ করতে সবকিছু। কিসের এত ভয় তার?
নন্দিতাকে এখনো আগের মত নিশ্চুপ দেখে ফিকে হাসলো তুর্জয়। পিছনে না ফিরে মলিন কণ্ঠে বললো,
“আইনের পোশাক আমার সম্মান আর স্নিগ্ধতার প্রতীক। আদালত আমার কাছে পবিত্র, ঠিক যেমন পবিত্র মসজিদের দালান। অথচ আজ সেই পবিত্রতায় একদলা কালী লেপ্টে গেছে। আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তুমি আমাকে বেঈমান, কেনা বেচার পণ্য বানিয়ে দিলে আজ নন্দিতা। আমার আইন, আমার সততা আজ নিলামে উঠেছে, যে যার মতো দর তুলেছে তার।”

নন্দিতা ঠোঁট চেপে কাঁদছে। শব্দরা আজ তার সাথে বেইমানি করছে। একটা কথাও বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। তবুও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সে তুর্জয়ের কাছে। তার প্রশস্ত পিছে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। তৎক্ষণাৎ চোখ বুঁজে ফেললো তুর্জয়। মন চাইছে সব ভুলে বুকে জড়িয়ে নিতে নন্দিতাকে। কিন্তু বিবেক বাধা দিচ্ছে। এর চেয়ে তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেললেও কোনো অভিযোগ করত না সে।
“আমি, আমি আপনার ক্ষতি করতে চাইনি বিশ্বাস করুন।”
কোনক্রমে এটুকু শব্দ মুখ থেকে বের হলো নন্দিতার। কিন্তু তাতে তুর্জয়ের বুকে জ্বলছে থাকা জ্বলন্ত দাবানল নিভলো না। বরং সেই আগুনের লেলিহান শিখায় নন্দিতাকেও ভস্ম করতে বড্ডো কঠোর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কয়েকটা শব্দ। তুর্জয় পিছনে না ফিরেই একরোখা কণ্ঠে বলে উঠলো,

“আমি আপনার মুখটাও দেখতে চাইনা। দয়া করে চলে যান এখান থেকে।”
নন্দিতা থমকালো, চমকালো। ঘোলাটে দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে তাকাতেই আপনাআপনি হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো তার। তুর্জয় তার হৃদয়ে শিকল বাঁধলো। পিছু ফিরে বিধ্বস্ত নন্দিতাকে দেখার ক্ষমতা তার নেই। আবারও দূর্বল হয়ে পড়বে সে। পায়ে শব্দ তুলে তাই সেভাবেই ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে। ভুল করেও ফিরে চাইলো না একবার বিধ্বস্ত, বিষাদগ্রস্থ নন্দিতার দিকে।
বেশ অনেকটা সময় নিয়েই ওয়াশরুম থেকে বের হলো তুর্জয়। ইচ্ছেকৃত লেট করেছে সে। নিজের আবেগ অনুভূতির মতো নিজেকেও আবদ্ধ করে রেখেছিল। খিল টেনেছিল দরজায়। এলোমেলো ভঙ্গিতে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে চোখ বুঁজে অপেক্ষা করতে লাগলো সে নন্দিতার। অথচ সময় পেরোলো শুধু, নন্দিতা এলো না। চোখ মেলে ভ্রু কুঁচকে সে তাকালো আধো আধো খোলা দরজার দিকে। কারো চঞ্চল পায়ের গতি শোনা যাচ্ছে না। সবকিছু নীরব, নিস্তব্দ।
দরজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যপাশে তাকাতেই সাইড টেবিলের উপর একটা রংবেরঙের একটা কাগজ চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো তুর্জয়। কাগজের ভাঁজ খুলতেই চোখে পড়লো ঝরঝরে হাতে লেখা কয়েকটা লাইন।

“প্রিয়তম আমার,
যাকে আঘাত করার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনা, তাকে ধ্বংস করার অভিযোগে অভিযুক্ত আমি। খুনের আসামিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা হয়, অথচ আমার কপালে এলো বিচারকের কঠিন বিচার।
তুমি জানো না, তোমার প্রতিটা যন্ত্রণার পাহারাদার ছিলাম আমি। তুফান এলে নিজের বুক পেতে দিয়েছি, যাতে তুমি না ভাঙো, না কাঁপো, না দগ্ধ হও।

প্রিয়তম আমার, তোমার চিন্তাগ্রস্ত বিষন্নতা আমার কাছে ছিল যুদ্ধঘণ্টা। যে আমি প্রাণঘাতী যুদ্ধে নেমেছি শুধু তোমাকে রক্ষা করতে, আজ সেই আমাকেই তুমি অভিযুক্ত করছো তোমাকে ধ্বংস করার, সবকিছু শেষ করে দেওয়ার অভিযোগে। যার অস্তিত্বই ছিল তোমাকে আগলে রাখার জন্য, সে নাকি তোমার সবটুকু শেষ করে দিয়েছে।তোমার চোখে অশ্রুকে নিজের ব্যথা ভেবে বুকে চেপে দেওয়া সেই আমি এক তোমার চোখের বিষাদের কারণ।
আমার এই মুখ তোমাকে নাহয় আর নাইবা দেখালাম। যদি কখনো নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাই, সেই নাহয় আবার মুখোমুখি দাঁড়াবো আমরা। ততদিন নীরব এ দূরত্ব সঙ্গী হয়ে থাকুক আমাদের।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩৯

চিঠিটা শেষ করে তুর্জয় টের পেল তার গলা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে শূন্যতার হাহাকারে। চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়েছে সেই কখন, টেরই পায়নি। বুকের মাঝে দেবে থাকা নিঃশ্বাসটুকু মুক্ত করতে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। চারপাশের বাতাসে অক্সিজেনের কমতি, বুকে অশান্তি নিয়ে দৌড় দিলো সে ঘরের বাইরে। গোছানো পরিপাটি ডাইনিং টেবিলের উপর সাজানো খাবার। সদ্য গরম করা খাবারের গন্ধে মো মো করছে ডাইনিং এরিয়া। অথচ সেখানে বিরাজমান নীরবতা চপলতার সাথে জানান দিচ্ছে, সে নেই। সে চলে গেছে। তোমার চঞ্চলা বিদায় নিয়েছে। এ সংসার এখন তোমার একার। এ রাজ্যের সম্রাজ্ঞী অভিমান বুকে চেপে রাজ্যের দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিয়েছে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪১