প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪১
ফিজা সিদ্দিকী
নিদ্রাহীন একটা রাতের শেষে ক্লান্ত সকালে নিজেকে খুঁজতে বেশ পেতে হচ্ছে তুর্জয়কে। গোটা রাত তাকে পাহাড় সমান বোঝা অনুভব করিতে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছে। অথচ সে ছিল নির্ঘুম।
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসা লাগেজ দুটো নিয়ে এক কাপড়েই বাড়ি ছেড়েছিল নন্দিতা। অভিমানে বদ্ধ মন সাথে নিয়ে আসতে চায়নি তুর্জয়ের একটাও স্মৃতি। এ বাড়িতে যা কিছু আছে, সব তো তারই আমানত। নিজস্ব বলতে এই মায়ের ঘর থেকে নিয়ে আসা বোঝাই করা দুটো লাগেজ। যার মধ্যে থাকা কোনো জিনিসই খুলে দেখা হয়নি এখনও। ভীষণ যত্নে পাশের রুমে রেখেছিল এগুলো, সময় সুযোগ বুঝে খুলে দেখবে বলে। অথচ সুযোগ হওয়ার আগেই সময় ফুরালো। এ জীবনে তার হাহাকারের শেষ নেই। না পাওয়ার খাতার পৃষ্ঠা ফুরায় না? কলমের কালিও কী আমৃত্যু সঙ্গ দেবে? আর পাওনার খাতায় ধুলো জমেছে, জমে গেছে সেই কালী। লেখা হয়না যে বহুদিন কিছু!
হোটেলে ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে লাগেজ খুলে মায়ের একটা শাড়ি পড়েছিল নন্দিতা। শারিগুলোতে আজও কেমন মা মা গন্ধ আছে। কয়েকটা শাড়ি একসাথে করে নাক ডোবালো সে তাতে। আর তখনই সবটুকু বাঁধ ভেঙ্গে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে। দুনিয়াটা এতো কঠিন, মা থাকতে কখনও টের পায়নি সে। টের পেতে দেননি কখনও তিনি তাকে। অথচ গোটা দুনিয়ায় আজ সবচেয়ে অসহায়, সবচেয়ে দুঃখী বোধহয় সে। যার শরীরে একটু একটু করে বাসা বাঁধছে এইডস নামক মারাত্মক ভয়ংকর রোগ, কোনো নিরাময় নেই যার। হারিয়েছে মমতাময়ী মা, মাথার উপর দাম্ভিকতার ছায়া দেওয়া বাবা, ভালোবাসার প্রাণপ্রিয় স্বামী। এইযে একমাত্র জীবন, এটুকুও হারানোর পথে। আর কিছু কী আছে তার হারানোর?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনেকক্ষণ ভাবার পর নন্দিতার মনে হলো হারানোর মত তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবনটাতে জুয়া খেলার মতো সবটুকু বাজি রেখেছিল সে। আর শেষবেলায় সবকিছু হেরে গিয়েই এখন সর্বশান্ত।
শাড়ির ভাঁজে রাখা ডায়রিটা আচমকা টুপ করে নন্দিতার কোলে পড়লো। মনে পড়ে গেল তার সেদিনের কথা। মায়ের ডায়রিটা পড়তে চেয়েও পড়া হয়নি তার। রেখে দিয়েছিল যত্ন করে। কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে মায়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে এই ডায়রির পাতা উল্টাবে বলে মনস্থির করেছিলো। সেই সময়টা আজ হলে মন্দ হয়না তবে।
গায়ে জড়ানো মায়ের শাড়ি, ক্লান্ত তার হৃদয়। দুপুরের পরিবর্তে এখন শুধু গভীর রাত। রাতটুকু যে তার নির্ঘুম কাটবে, এটুকু বেশ টের পাচ্ছে। ঘন বিষন্ন রাতের মতো তার জীবনটাও হয়তো ফুরিয়ে আসছে। কিজানি আর কখনও সময় পাবে কিনা! তাই সময় অপচয় না করে ডায়রি হাতে নিয়ে বসে পড়লো মেঝেতে। বিছানায় হেলান দিয়ে ভীষণ যত্নে একবার হাত বুলালো ডায়রির উপরিভাগে। অতঃপর কাঁপা হাতে উল্টালো মলাট।
প্রথম কয়েকটা পাতা জুড়ে বাবাকে নিয়ে মায়ের অভিযোগে ভরা কথাগুলো দেখে বেশ অবাক হলো নন্দিতা। মাকে সে কখনও বাবার সাথে মনোমানিন্য করতে দেখেনি। অথচ তার কত অভিযোগ ছিল বাবাকে নিয়ে। মায়ের শক্ত আবরণের ভেতরের কোমল প্রেমিকাসত্তা একটু একটু করে উন্মুক্ত হচ্ছে তার চোখের সামনে। নন্দিতা ঠোঁট এলিয়ে হাসছে সেসব অভিমানী অভিযোগ দেখে।
হঠাৎ করে একটা পাতায় এসে থমকে গেল নন্দিতা। দিনটা ছিল তার আঠারোতম জন্মদিনের দিন। আজও মনে আছে তার, এইদিন মায়ের কাছে কেঁদেকেটে বাবাকে চেয়েছিল সে। তার প্রথম স্কুল জীবন থেকে শুরু করে জন্মদিন, কোনো বিশেষ দিনেই বাবাকে কাছে পায়নি নন্দিতা। অথচ সেদিন এক অদম্য জেদ চেপে বসেছিল তার মাথায়। বাড়িতে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সবটা বাবার দায়িত্বেই হলেও, দূর থেকে নয়, সেদিন বাবাকে পাশে চেয়েছিল নন্দিতা। বাবা না আসা পর্যন্ত কেক কাটবে না বলে ঘরের দোজা বন্ধ করে শুয়ে ছিল। এরপর বাবা এসেছিলেন। তার হাসিমাখা মুখে স্পষ্ট খুশির ঝিলিক থাকলেও বাবার মুখে কেন যেন বিষন্নতার ছাপ পেয়েছিল। অথচ তিনি ভীষণ সুন্দরভাবে সেটাকে আড়াল করে হেসেছিলেন নন্দিতার সাথে।
১৬ই অক্টোবর,
মেয়ে তোমার কাছে উপহার চেয়েছিল। বাবা উপহার। বাবার আদর, সান্নিধ্য দিতে না পারে এমন পেশায় কে বলেছিল তোমাকে জড়াতে? আমরা কী সাধারণে সুখী ছিলাম না? অসাধারণ হতে গিয়ে আজ তুমি তোমার মেয়েকে উপহার দিলে ঠিকই। তবে তার চাওয়া বাবার সাথে দিলে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত উপহার। কেন তুমি এমন হয়ে গেলে নিহান? একবারও কী আমাদের মেয়ের কথা ভাবলে না? আমি জানি তুমি একজন দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার। কিন্তু সে দায়িত্ব তোমার পরিবারকে নিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতে ঠেলে দেয়, এমন দায়িত্ব আমি চাইনা। ও আমার একার মেয়ে কেন হলো না? তাহলে তো ওকে বুকে আগলে নিয়ে অনেকদূরে চলে যেতে পারতাম।
১৯শে অক্টোবর,
আবারও তুমি ওই ভয়ংকর লোকটার সাথে জড়ালে? তারা মানুষ নয়, তারা হায়না। তুমি সহ তোমার পরিবারের সবাইকে শেষ করে দেবে। তাদের সাথে প্রতারণার শাস্তি কী হতে পারে জানো? তোমার এই ন্যায়পরায়ণতা তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
২৫শে অক্টোবর,
এ সংসার আমি আর করব না নিহান। তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করে বড্ডো সয়েছি। কথা নেই বার্তা নেই ছোট কয়েক লাইনের একটা চিরকুট মাথার কাছে রেখে দিয়ে তুমি পালালে? হ্যাঁ পালালে। তুমি একটা পলাতক। বউ বাচ্চা রেখে শুধুমাত্র নিজের ডিউটি পূরণ করতে তুমি পালিয়েছ। তোমার কাছে তোমার মিশন বড়ো, আর আমরা? কী লিখেছ চিরকুটে? শিকদারদের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ জোগাড় করে এরপর ফিরবে? আর নাহলে ফিরবে না? এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি? এতে যে তোমার প্রাণ যেতে পারে, জানো না? এই একরত্তি বাচ্চাটাকে আমি একা সামলেছি ছোটো থেকে। সামনেও একাই সামলাবো। আমি করবো না তোমার সাথে আর সংসার। তুমি ফিরে এলেই এর একটা বিচার হবে। তার আগে এই ডায়েরি ছুঁয়েও দেখবো না আমি।
এটুকু পড়েই বুকের মাঝে ধক করে উঠল নন্দিতার। শিকদার! এই শিকদারের সাথে যোগসূত্র তবে তুর্জয়ের একার নয়? এই সূত্র তার সাথেও জড়িয়ে। তবে কী শিকদারদের আসল টার্গেট তুর্জয় নয়? তুর্জয় কী জানে এ ব্যাপারে? অজস্র প্রশ্নরা ডানা ঝাপটে বেড়াচ্ছে তার আশেপাশে, অথচ একটারও জবাব জানা নেই তার। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নন্দিতা পৃষ্ঠা বদলালো। এরপরের অনেকগুলো পৃষ্ঠা ফাঁকা। পাতা উল্টাতে উল্টাতে বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা পর আবারো চোখে পড়লো একটা লেখা। সময়টা প্রায় এক বছর পরের।
৫ম সেপ্টেম্বর,
একটা বছর পর তোমার দেখা পেলাম আজ। বিশ্বাস করো নিহান, তোমাকে দেখার আগে কতশত অভিযোগ জমা ছিল আমার। মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম আর কখনও কথা বলব না তোমার সাথে। কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়ালে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে, পাহাড়ে ধ্বস নামার মতো আমার অভিমান ধ্বসে গেল। ডুকরে কেঁদে মুখ লুকালাম তোমারই বুকে। আমার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থলকে আবার নতুন করে খুঁজে পাব, আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। গোটা একটা বছর সময় লেগে গেল তোমার ফিরতে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম তুমি বোধহয় আর নেই। নইলে কিভাবে একটুও যোগাযোগ না করে থাকতে?
আমাদের এতদিনের সংগ্রাম শেষ হয়েছে নিহান। সকল তথ্য প্রমাণ সহ তুমি সুস্থভাবে ফিরে এসেছে। ইশ! তোমার শরীরে কতো কালশিটে দাগ। কী নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে তারা তোমার উপর। তুমি পালিয়ে তো এসেছ, কিন্তু ওরা যদি আবার খোঁজ পায় তোমার? আর হারাতে পারবো না তোমাকে। এজন্য এই শহর ছেড়ে চলে যাব আমরা। আমি আমার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চাই। আর পারবো না এই হারানোর ব্যথা সইতে।
এরপরের কয়েকপাতা পড়ে নন্দিতা যা বুঝল, এখান থেকেই তাদের পলাতক জীবনের সূচনা। বাবা কিছুদিন পর পরই কেন বদলি করতেন, কেন তারা স্থায়ীভাবে একজায়গায় থাকতে পারতো না এখন সবটা স্পষ্ট তার কাছে। ডিপার্টমেন্টের নির্দেশমতো পুলিশের পেশা ছেড়ে একটা সিক্রেট এজেন্সির এজেন্সির চাকরিতে জয়েন করেছিলেন এরপর তিনি। বদলে ফেলেছিলেন নিজের নাম ধাম পরিচয় সবটুকু। অথচ শিকদাররা ধরা পড়েনি। রাতারাতি আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের পুলিশ স্টেশনে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। রাতারাতি লোপাট হয়ে গেছিল সব প্রমাণ। এরপর থেকেই হতাশ হয়ে পড়েন নিহান। চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেকদিন চুপচাপ জীবন কাটাতেন। ততদিনে নন্দিতার এইচ এসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট এসেছে। বেশ ভালো নম্বর পেয়েছে সে। বাবাকে খুশি হতে না দেখে নন্দিতা চিন্তায় পড়ে যায়। একদিন ক্লান্ত বিকালে গুটিগুটি পায়ে বাবার ঘরে যায়। নিহান তখন জানালার ধারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। মেয়েকে ঘরে আসতে দেখে কাছে ডাকেন তিনি। নন্দিতা বাবার কাছে এসে নরম কণ্ঠে বলে,
“আমার রেজাল্টে তুমি খুশি হওনি, বাবা?”
“ভালো নম্বর পেয়েছ তুমি। খুশি হব না কেন? এরপর কী করবে ভেবেছ?”
“তুমি কী চাও?”
“ছোটো থেকে তোমার সবকিছু নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তোমার মা, এবারও এই অধিকার শুধুমাত্র তার। আমি সবসময় দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে এখন হঠাৎ করে নিজের অধিকার দেখাতে পারিনা।”
“আমি জানতে চাই বাবা।”
সেদিন নন্দিতা জেনেছিলো বাবা তাকে ল নিয়ে পড়াশোনা করাতে চান। একজন ন্যায়পরায়ন উকিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান তাকে। নন্দিতাও দ্বিমত করেনি।
সকালের তেজি আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে মেঝেতে এসে পড়ছে। আলোর তেজ জানান দিচ্ছে বেশ বেলা হয়েছে। পুরো ডায়রিটা পড়ে নন্দিতার বুক ভারী হয়ে এলো। তার এতদিনের সুস্থ জীবনের পিছনে বাবা মায়ের অবদান কতটুকু আজ টের পেল। বাবাকে সবসময় কাছে পায়নি বলে তার মনে যে অভিযোগ জমা ছিল, আজ ছাইয়ের মতো উড়ে গেল সব। বিছানার মাথা এলিয়ে ডায়রির শেষ পাতাটা উল্টালো নন্দিতা।
আমার মেয়ে,
এই লেখাটুকু শুধু তোর জন্য। ডায়রিটা যদি কখনও হাতে পাস আমাদের জীবনের সবটুকু জানতে পারবি। এটাও জানবি, ছোটো থেকে কেন নরমে আদরে মানুষ না করে শক্ত হতে শিখিয়েছি তোকে। কান্না গিলে ফেলে হাসতে শিখিয়েছি। আমি আমার জীবনে অনেক কেঁদেছি। আমার মেয়েটার কান্না যে আমার সহ্য হবে না। পুরুষ মানুষ মানেই একরোখা, জেদি। সেই জেদের সামনে তার সখের নারীও ধোপে টেকে না। তাই আমি ভীষণভাবে ঘৃণা করি এই পুরুষজাতিকে। তোর বাবার এই জেদ আমাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় নামিয়েছে। ক্ষমতার সাথে সত্যের লড়াই হয়না, ক্ষমতা জিতে যায় সবসময়। এই কথাটা তোর বাবা কখনও বুঝতে চায়নি। তবে একটা সময় পর থেকে আমিও বোঝানো ছেড়ে দিয়েছি। মানুষটাকে তার মতো থাকতে দিয়েছি। আমাদের সংসারে ভালোবাসার কমতি নেই, যেটুকু কমতি যেটুকু নিরাপত্তার আর একে অন্যকে বোঝার। উনি কখনও বুঝতেই চাননি আমার কথা।
আমাদের যদি কিছু হয়ে যায় উত্তরাধিকার সূত্রে এই ডায়রি হয়তো তোর হাতে আসবে, আর নাহয় পুলিশের। নাহলে হয়তো আগুনে ঝলসে যাবে, শিকদারদের প্রমাণ লোপাটের এ এক অনন্য পদ্ধতি। তবে যদি তুই হাতে পেয়ে যাস, এই আশায় কয়েকটা লাইন লিখে গেলাম তোর জন্য। তোর বাবা আমাকে লুকিয়ে আবারও চেষ্টা করে গেছিল শিকদারদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করার। শিকদাররা এখন কুত্তার মতো খুঁজছে তাকে। আমাদের বাড়িওয়ালা দুই বৃদ্ধা বেশ ভালো মানুষ। আমার কেন যেন মনে হয় আমরা না থাকলে তারা তোকে দেখে শুনে রাখবেন। আমাদের হায়াতের কোনো ঠিক নেই।
তাই আরও কিছু লিখে যাই শোন, আমি একটা বড়ো মতো আংটি পরি দেখেছিস? ওই আংটিটা তোর বাবা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আংটিটার বিশেষত্ব হলো এর মধ্যে ছোটো খাটো কিছু লুকিয়ে রাখা যায়, মানুষ টেরই পাবে না। যদি কখনো আমার লাশ খুঁজে পাস, সবার আগে আংটিটা খুলে নিস, এটা তোর বাবার সারা জীবনের সম্বল। এটার জন্যই মানুষটা মৃত্যুর মুখে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন। মা বাবা তোকে সবকিছু থেকে আড়ালে রেখেছিল বলে রাগ করিস না। আমাদের দুজনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তোর ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করা। আমরা তা পেরেছি বোধহয়। এরপর জীবনের সব লড়াই তোর একার। আমি জানি আমার মেয়ে ভীষণ স্ট্রং, একদম তার মায়ের মতো। সে পারবে।
ডায়রিটা বুকে চেপে নন্দিতা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হাত পা ছড়িয়ে শব্দ করে কাঁদছে সে। তার জীবন এতো দুর্বিষহ কেন? আচ্ছা, বাবা মার মৃত্যুটা আদৌ স্বাভাবিক তো?
অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা শব্দ করে বাজছে। দুইবার, তিনবার রিং বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে আপনাআপনি। ওপারের ব্যাক্তিটি একটুও ধৈর্য না হারিয়ে লাগাতার কল করে যাচ্ছে তাকে। নন্দিতা বিরক্ত হলো। মুঠোফোনটা আছাড় দিতে চেয়েও না পারলো না। অগত্যা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো কারোর কিঞ্চিৎ হাসির শব্দ। নন্দিতা বেজায় রাখ দেখিয়ে বললো,
“আমাকে বারবার ফোন করেন কেন?”
“যদি বলি প্রয়োজনে তবে মিথ্যা বলা হবে। কারন প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য খুঁজে নিই প্রয়োজন।”
“আপনার সস্তা প্রেমকাহিনী শোনার মতো কোনো মুড নেই আমার এখন, রাখছি।”
“কোন সময় শুনবেন বলুন? গভীর রাত নাকি বৃষ্টিভেজা বিকেল? বৃষ্টিতে কাকভেজা হতে হতে শুনবেন?”
“আপনি কী মানুষ না? আমি এতো বিরক্ত হই, এতো কথা শোনাই তাও কেন যেচে পড়ে অপমান হতে আসেন?”
নন্দিতার বিরক্তিভরা তেজি কণ্ঠের বিপরীতে হাসলো ধূসর। বললো,
“উত্তরটা বড্ডো কুরুচিকর, তাও সত্য। তাই সত্য দিনে একশবার বলা যায়। আমি আপনাকে ভালোবাসি। স্বামী নামক পুরুষে আসক্ত এক বিবাহিত নারীকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। শুধু ভালবাসিনি, নিজের সবটা সঁপে দিয়েছি।”
নন্দিতা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। কণ্ঠের গতি খানিকটা নরম করে তাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
“মৃত্যু এলেও আমি শুধু ওই একজন পুরুষকে ভালোবেসে মরবো। ওই একজনের জন্য, একজনের হয়েই মরব।”
“আয়ু তো আর কয়দিন তার, এরপর আমার ঘরে নিয়ে চলে আসবো আপনাকে। জোর করে আনবো। বুকে নয়, আপনার পায়ের কাছে থাকতে দিলেই হবে।”
নন্দিতা মিছে হাসতে হাসতে বললো,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪০
“আমাদের কবরটা পাশাপাশি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন ধূসর সাহেব। আমাকে তার বুকে মাথা রেখে কবর দেবেন। এটুকু আপনার ভালোবাসার শাস্তি।”
ধূসর কেঁপে উঠলো আচমকা। তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে উঠে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়, আপনি কাঁদছিলেন?”