প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২
ফিজা সিদ্দিকী

“আপনি কাঁদছিলেন?”
“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
“স্বাভাবিক। এতো রাতে একা একা না বেরোলেও পারতেন।”
নন্দিতা মৃদু হাসলো। এমনটাই চেয়েছিল সে। চেয়েছিল ধূসর নিজেই থেকে স্বীকার করুক সত্যিটা। তাদের উপর নজরদারি করা বন্ধ করে দেওয়ার মতো নির্বোধ নিশ্চই তারা নয়, এটা নিয়ে এতদিন সন্দেহ থাকলেও আজ স্পষ্ট। ধূসর তবে সেদিন মিথ্যা বলেছিলো। কিংবা হয়তো ফাইল দিতে আসা থেকে শুরু করে যা কিছু সে করেছে এবং করে চলেছে সবটুকই সাজানো গোছানো স্ক্রিপ্টেড নাটক। ধূসর শিকদারের মতো লম্পট ছেলে, যে কিনা জামাকাপড়ের মতো মেয়ে বদলায়; সে ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভূতির শিকার হওয়া প্রায় অসম্ভব। হয়তো তাদের উপর নজরদারি আরও দৃঢ় করতে এবং নন্দিতাকে হাতিয়ার বানিয়ে তুর্জয়ের ক্ষতি করাই তাদের মুখ্য প্ল্যান। ধূসরের কথাটুকু যেন শুনতেই পায়নি এমন একটা ভান করে নন্দিতা প্রসঙ্গ পাল্টালো। বললো,

“এতো সকালে কল দেওয়ার কোনো বিশেষ কারণ?”
“জি। আপনাকে শুনতে বিশেষ কারণ খুঁজতে হয় আমাকে। নাহলে তো অযথা একটাও আলাপ করবেন না আমার সাথে।”
নন্দিতা প্রত্যুত্তর করলো না। কোমর পিঠ তার ধরে গেছে। ফোনটা কানে রেখেই একহাতে ডায়রিটা তার সাইডব্যাগে ঢোকালো। কোমড় ধরে উঠে বসলো বিছানায়। সাথে সাথেই ব্যাথাতুর শব্দ করে উঠলো। ধূসর চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি ঠিক আছেন?”
“তাতে আপনার কী? এক মিনিট অপেক্ষা করব, যদি কিছু বলার থাকে বলুন, নয়তো আসতে পারেন।”
“কোথায় আসবো? আপনার কাছে? একদম কাছে? দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে কতটুকু কাছাকাছি চাইছেন আমাকে?”
“যতটুকু কাছাকাছি থাকলে আপনার বিশেষ অঙ্গে দারুন জোরে একটা কিক দেওয়া যায়।”
ধূসর শব্দ করে হেসে উঠলো। ঘর কাঁপিয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে হাসতে লাগলো সে। অতঃপর দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠে বললো,
“ইশ! ভীষণ দুষ্টু মাইন্ডের তো আপনি, সব ছেড়ে প্রাইভেট পার্টটা চুজ করলেন?”
ঝট করে কল কেটে দিয়ে মনে মনে ধূসরকে বেশ কয়েকটা গালি দিলো নন্দিতা। সাথে সাথেই ফোনের লাইট জ্বলে উঠলো। নোটিফিকেশন থেকে উঁকি দিলো ছোটো একটা বার্তা।
“প্রাইভেট কার আর ড্রাইভিং রুট দুটোই এভয়েড করতে বলবেন মিস্টার আহসানকে। লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে জার্নি করেন না অনেকদিন, কয়েকদিন সেই অভ্যাস রিনিউ করলে মন্দ হয়না।”

ঝিম ধরা সকালে তুর্জয়ের ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। অচেনা নম্বর দেখে গুরুত্ব দিলো না সে। অবহেলায় ফেলে রাখলো ফোনটাকে আগের জায়গায়। বাজতে বাজতে কেটে গেল কলটা। এরপর আবারও বেজে উঠলো শব্দ করে। তুর্জয় এবার কালবিলম্ব না করে রিসিভ করলো। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে শোনা গেল কারোর ভয়ার্ত কণ্ঠে।
“স্যার, আপনি ভাবতেও পারবেন না কী নিষ্ঠুর চক্রান্ত কষা হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে। আপনার, আপনার খুব কাছের লোক জড়িয়ে আছে এসবের মধ্যে।”
মেয়েলী কন্ঠটা বিধ্বস্ত। যেন ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছে সে। তুর্জয় মনে মনে ভেবে নিলো সে নন্দিতার কথা বলছে। তাই লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন কণ্ঠে বললো,
“সে এমন একজন, যে আমার আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। গাছের সুদূরবিস্তারি শিকড়ের মতো লেপ্টে আছে যে আমার হৃদয়ে, তাকে নিজের থেকে আলাদা করার কোনো উপায় নেই। তবে যে নিজেকেই শেষ করে ফেলতে হয়। তার চেয়ে বরং চুপচাপ দেখে যাই তার ধ্বংসলীলা, দেখে যাই তার নিষ্ঠুরতা।”

“আপনি যাকে শত্রু ভাবছেন হতে পারে শত্রু সে নয়, বরং চোখ বন্ধ করে ভরসা করে বসে আছেন যার উপর শত্রুতার খেলা সেই খেলছে।”
তুর্জয় চমকায়। সবকিছু কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে তার কাছে। এই কেস নিয়ে এতো জটিলভাবে ভাবেনি সে। অথচ যত দিন যাচ্ছে সবকিছু কেমন যেন জটিল হয়ে পড়ছে আরও। ছোটবেলায় মেলায় টিকিট কেটে ঢোকা সেই আয়নাঘরের মতো। অনেকে আবার সেটাকে ভুলভুলাইয়াও বলতো। সত্যি মিথ্যা সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে যায় এর মধ্যে ঢুকল। চারিদিকে কাঁচ আর কাঁচ। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে সঠিক রাস্তা খুঁজতে বেগ পোহাতে হয় বেশ। মাঝে মাঝে কত যে ধাক্কা খায় কাঁচের দেওয়ালের সাথে।

চারপাশের কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছে না তুর্জয়। এইযে কেউ তাকে এসব বলছে, এটাও হতে পারে জেনে বোঝা করা চক্রান্ত। তুর্জয় ফোনটা কানে চেপে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“আপনার পরিচয়? আপনাকে বিশ্বাস করার বিশেষ কোনো কারণ?”
তনুজা চটজলদি তাকালো আশেপাশে। এইমাত্র আনসারকে কলে কথা বলতে শুনেছে সে কারোর সাথে। আর সেসব কথা তুর্জয়ের জানা জরুরী।
“আমি তনুজা। আপনাকে বেশ কিছুদিন ধরেই আমি বলতে চাইছিলাম ব্যাপারটা। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করবেন জানিনা। তাই সাহস যুগিয়ে আর বলতে পারিনি। আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু আর কেউ নয় আপনারই……”

কলটা কেটে গেছে। তুর্জয় কল ব্যাক করলো। ফোনটা সুইচ অফ দেখাচ্ছে। এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা আর করলো না সে। মনে মনে ধরে নিলো ফোনে চার্জ নেই বোধহয়। সময় করে তনুজা নিজেই কল দেবে আবার।
দুইদিন পার হলেও তনুজার কোনো খোঁজ নেই। তুর্জয় রোজ নিয়ম করে কল করেছে সেই নম্বরে। কিন্তু প্রতিবারই উত্তর এসেছে একই রকম,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪১

“আপনার কাঙ্খিত নম্বরের সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। চাইলে আপনি ভয়েস নোট….”
রোবটিক এই কথাগুলো শুনতে বিরক্ত লাগছে তুর্জয়ের। ফোনটা কেটে দিয়ে নন্দিতার নম্বর ডায়াল করলো সে। বিগত দুইদিন পর সে কোথায় আছে কে জানে? এতো অভিমান কিসের? একটাবারও কী তার খবর দেওয়া যেত না তার?
জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো কেস নিয়ে লড়াই করা ছেড়ে দিয়েছে তুর্জয়। বিপক্ষের মানুষটাই যদি হয় সবচেয়ে আপনজন। তবে কার বিরুদ্ধে লড়বে সে?

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২ (২)