প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২ (২)
ফিজা সিদ্দিকী
“আপনার মা বেঁচে আছেন”
সাতসকালে এমন একটা খবর পেয়ে ঘুম ছুটে গেল নন্দিতার। বিলাসবহুল হোটেল রুমের নরম গদিতে বেশ রাত করেই ঘুম নেমেছিল তার চোখে। কিন্তু সকাল সকাল ফোনের রিংটোনের শব্দে সেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। বিরক্তি নিয়ে ঘুনের ঘোরেই হাতড়ে ফোনের নাগাল পেল। চোখ বন্ধ রেখেই কোনমতে রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই পুরুষালী কণ্ঠের এমন বাক্যে ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা দেখে মানুষটাকে চিনতে খুব একটা বেগ পোহাতে হলো না তাকে। এই লোকটাকে সে চেনে, চরম নির্লজ্জ, রুচিহীন, অসহ্যকর একজন।
“মশকরা করছেন আমার সাথে? এমন সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে মশকরা করার সাহস কিভাবে হলো আপনার? এতোদিন জানতাম একজন অসভ্য, নোংরা মন মানসিকতার লোক আপনি। অথচ আস্তাকুড়ে পড়ে থাকা একটা কিটও যে আপনার চেয়ে ঢের ভালো, আজ বুঝলাম।”
রাগে পুরো শরীর জ্বলছে নন্দিতার। কেউ যেন পেট্রোল ঢেলে এরপর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তার শরীরে। লোকটার সাহস দেখে অবাক না হয়ে আর পারছে না। এতোদিন শুধুমাত্র তুর্জয় আর নিজের ঠুনকো মানবিকতার খাতিরে লোকটাকে সহ্য করেছে, কিন্তু এবার সবকিছু মাত্রা ছাড়িয়েছে।
ধূসর হাসলো। ভীষণ ফিকে সেই হাসির গা গলিয়ে ঠোঁট আলগা করে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ধূসর শিকদার কারোর উচ্চকন্ঠ পর্যন্ত সহ্য করে না, জানেন? অথচ আপনার প্রতিটা অপমান চুপচাপ মেনে নেয়, নির্লজ্জ হাসে।”
নন্দিতা প্রত্যুত্তর করতে গিয়েও থেমে গেল। সকাল সকাল অযথা কথা বাড়াতে পছন্দ করলো না। তাই ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
“দ্বিতীয়বার এমন কিছু জিয়ে মশকরা করার আগে দুইবার নয়, কয়েকশ বার ভাববেন।”
“আপনার কেন মনে হলো এই সকাল সকাল আপনার সুন্দর ঘুম নষ্ট করে আমি মশকরা করতে যাব?”
আচমকা নন্দিতা কিছু অনুভব করলো। গলা তার কাঁপছে। মনে পড়ে গেল তুর্জয়ের সেদিন দেওয়া আংটির ঘটনাটা। কেউ একজন এটা তার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। এমন নয় তো, যে সত্যি মা বেঁচে আছেন। আর জরুরী কিছু সংকেত দিতেই ওই আংটিটা তার কাছে পাঠিয়েছেন। উপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরলো নন্দিতা। দিন দিন ভীষণ কাঁদুনি হয়ে যাচ্ছে সে। সামান্য কিছুতেই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এমনভাবে তাকে দেখলে, মা কি খুব বেশি বকা দেবে? মা! মা! আমার মা! মনে মনে কয়েকবার এই নাম আওড়ালো নন্দিতা। উত্তেজনায় শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আআআপনি সত্যি বলছেন?”
“আপনাকে মিথ্যা বলেছি কখনও?”
নন্দিতা চোখ বন্ধ করলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে ভাবলো ধূসরকে বিশ্বাস করবে কিনা! এমন কি হতে পারে না, ধূসর তাকে গুমরাহ করছে? হলে সবকিছুই তো হতে পারে। কাকে বিশ্বাস করবে সে?
বন্ধ ঘরের দরজা ঠেলে সাবধানে ভিতরে প্রবেশ করলো ধূসর। গার্ডকে গুমরাহ করে এই ঘরে ঢুকেছে সে, যাতে কাকপক্ষীও টের না পায় তার আসার খবর। ভেতরের পরিবেশ পুরোপুরি অন্ধকার বলা যায়না। ভাঙ্গাচোরা আস্তাকুড় মাড়িয়ে ভেতরের দিকে যাচ্ছে সে। বাড়ির পিছনে দিকের এই জায়গাটা পরিত্যক্ত, আস্তাকুড় হিসেবে জানতো সে এতদিন। অথচ এখানে যে এতো রহস্য লুকিয়ে, এ বাড়ির ছেলে হয়েও জানতো না সে। আরও কতো যে এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাড়িতে, কে জানে?
জঞ্জাল, অকেজো আসবাবের ঢের থাকা সত্ত্বেও একটা সরু করে রাস্তা স্পষ্ট। যেন মানুষের চলাচলের স্পষ্ট ছাপ এই রাস্তা দিয়ে। ধূসর সেই পথ ধরেই এগিয়ে গেল। শেষপ্রান্তে একটা ঘর, ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগানো। দরজার নীচ দিয়ে ভেসে আসছে লালচে আলোর রেখা। ভেতরে কী আছে সে জানেনা। হতে পারে এখানেই রাখা আছে নন্দিতার মাকে। কিংবা সে ছাড়া আরও কেউ থাকতে পারে। সাবধানে চারিদিকে নজর বোলালো সে। অতঃপর আলতো করে পুরোনো লোহার দরজার লক খুললো। শব্দ হলো কিঞ্চিৎ। সাথে সাথেই একটা পুরোনো ভাঙ্গা আলমারির পিছনে লুকিয়ে পড়লো সে। উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলো ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসে কিনা।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল, ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বেরিয়ে এলো সে। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই লক্ষ্য করলো লোহার একটা চেয়ারে বাঁধা একজন মহিলা। জরাজীর্ণ কাপড়, উস্কখুস্ক চুলে ঢাকা তার মুখ। শরীরের যেটুকু অংশ উন্মুক্ত সেখানে বেশ কয়েক জায়গায় কালশিটে দাগ। আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে তাকিয়েছে সে দরজার দিকে। বয়সজনিত কারণে চামড়া কুঁকড়ে গেলেও নন্দিতার সাথে তার চেহারার বেশ মিল দেখে ধূসর নিশ্চিত হলো তার পরিচয়। সামনে এগিয়ে যেতে গিয়েও বেশ ভয় করছে তার। ভদ্রমহিলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দৃষ্টি তুখোড়, এই দৃষ্টির সামনে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য।
ধূসর এগিয়ে গিয়ে বসলো ভদ্রমহিলার পায়ের কাছে। আচমকা তার কী হলো জানেনা। নওরীনের কোলে মাথা রাখলো সে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৪২
“আপনাকে আমি মা ডাকতে পারি?”
দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো নওরীনের। চাইলেও হাত বাড়িয়ে সেই হাত ছেলেটার মাথায় রাখতে পারলেন না। তবে তার তীব্র ইচ্ছে হলো এই কাজটা করার। ধূসর থেমে থাকলো না। পরপর আবারও বলে উঠলো,
“কোনো কিছুর বিনিময়ে কী তাকে পাওয়া যাবে না? আমি যে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি।”