প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫২
ফিজা সিদ্দিকী
আউট হাউসের ঘরে নওরীনকে খাবার দিতে এসেছিল ধূসর। আগের চেয়ে খানিকটা সুস্থ হলেও শরীরের ক্ষতগুলো সেরে উঠছে না কোনোভাবে। বরং ইনফেকশন হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়। পকেট থেকে ফোন বের করে চটজলদি কল দিলো সে নাঈমকে। কোনপ্রকার বিবৃতি না দিয়ে তাড়া দেওয়া কণ্ঠে বললো,
“নাঈম ভাই, কোনরকম প্রশ্ন না করে আমার আউটহাউসে আসতে পারবে একবার? ইটস ইমার্জেন্সী।”
নাঈম কলটা কেটে দিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। সাদা ধবধবে বিছানায় বসে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সুযোগ পেলে সে নাঈমের উপর ঝাপিয়ে পড়তে একটুও দ্বিধা করবে না। সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা মশকরা সুরে নাঈম বলে উঠলো,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? মনে হচ্ছে ছাড়া পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন আমার উপর।”
মেয়েটা উত্তর দিলো না। তবে তার চোখের ভাষায় স্পষ্ট ফুটে উঠলো কয়েকটা শব্দ,
“ছাড়াটা পাই শুধু একবার।”
নাঈম খানিকটা ঝুঁকে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। অতঃপর তার বাঁধা দুইহাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বললো,
“পুরুষের উপর কোনো মেয়েলী শরীর ঝাঁপিয়ে পড়লে সেটাতে রোম্যান্স হয়, ডু ইউ ওয়ান্ট?”
নাঈমের লাগামছাড়া, নির্লিপ্ত কথায় তব্দা খেয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো তনুজা। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“নির্লজ্জ ডাক্তার”
নাঈম ঠোঁট কামড়ে হাসলো। সাথে সাথে বললো,
“কবুলটা শুধু একবার বলুন, নির্লজ্জ ডাক্তারের নির্লজ্জতা হাতে কলমে বুঝিয়ে দেব আপনাকে।”
“মরে গেলেও আপনাকে বিয়ে করব না আমি।”
“বিয়েটা তো করতেই হবে, তাও আমাকেই। আর রইলো মরার ব্যাপার, সেটা নাহয় দুজন একসাথে প্র্যাকটিস করবো।”
খানিকটা থেমে নাঈম আবারও বলে উঠলো,
“আমি এখন আসছি, জরুরি ডাক পড়েছে। এসে আপনার হিসেব পুরো করছি।”
তনুজা খানিকটা তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“সব পেশেন্টকেই এভাবে ধরে বেঁধে বেডরুমে নিয়ে আসেন নাকি? সেখান থেকেই কেউ কল দিয়েছিলো নিশ্চই।”
“সবাইকে আনি কিনা সেটা তো দেখতেই পাবেন। আফটার অল আমার বেডরুমের পার্মানেন্ট পার্টনার আপনি।”
কথাটা শেষ করে আলতো করে হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় নাঈম। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তনুজা তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে। করুণ কণ্ঠে বলে,
“ব্যথা পাচ্ছি আমি।”
নাঈম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে ঝড়ের গতিতে ফিরে এসে তনুজার হাতের বাঁধনটা খুলে দিয়ে ডানহাত রাখলো তার গেলে। বড্ডো নরম কণ্ঠে বললো,
“প্লীজ কোথাও যাবেন না। ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার চোখে ঘুম নেমে আসবে। আপনার ভীষণ পরিমাণ ঘুমের প্রয়োজন। একটু শান্তিতে ঘুমান প্লীজ। আপনাকে এভাবে দেখলে আমার যে এখানে ব্যথা হয়।”
নিজের বুকের দুই ফুসফুসের ঠিক মাঝে সামনে স্টারনাম আর পিছনে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ পাঁজর দ্বারা বেষ্টিত খানিকটা বামপাশে হেলে অবস্থান করা হৃদপিন্ডের উপর আঙুল তাক করে শেষোক্ত কথাটা বলে নাঈম। তনুজা কেমন যেন মিইয়ে গেল এ কথায়। বালিশ টেনে মাথায় নিয়ে শুয়ে পড়ল চুপচাপ। মুখে হাসি ফুটে উঠলো নাঈমের। সেটুকু বহাল রেখে খানিকটা ঝুঁকে তনুজার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সাথে সাথেই দুর্বল কণ্ঠে তনুজা বলে উঠলো,
“সবসময় এভাবে ছোঁবেন না আমাকে।”
“ঠিক আছে। তাহলে মাঝে মাঝে ছোঁবো, আর একটু গভীরভাবে ছোঁবো।”
ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা দুষ্টু হাসিটুকু নিয়েই ঘর ছাড়লো নাঈম। তনুজার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুঁজে ফেলল সে। যেন কতরাত ঘুম হয়নি তার। কিডন্যাপিং এর পর থেকে সত্যিই তো ঘুম হয়নি তার। প্রথমের রাতগুলো শারীরিক ব্যথা, যন্ত্রণায় আর পরের রাতগুলো মানসিক যন্ত্রণায়। ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে পাগলের মতো ছটফট করতে দেখে, তার ভালোবাসায় যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে দেখে সেও যে পুড়ছিল, মরছিল, ছটফট করছিলো। অথচ এ যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ কেউ দেখেনা, কেউ বোঝেনা। স্বীকৃতি নেই যে!
হসপিটালের বেশিরভাগ ডিউটি নাঈমের ডে টাইমে শিফট। তাই বেশ সকাল সকাল ওঠার অভ্যাসও তার আছে। আর সকাল সকাল ওঠা মানেই টানা কয়েকমিনিট মর্নিং ওয়ার্ক করে এসে বেশ খানিকটা সময় ব্যালকনিতে বসা। এ সময়টা মূলত গরম ধোঁয়া ওঠা চা আর সাথে বই নিয়ে বসে সে। এই ফাঁকে মাঝেসাঝে বেফাঁস চোখ যায় তার পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে। তার থেকে দুই তলা নীচের ব্যালকনিতে তার মতই একজন রোজ আসে। সময় নিয়ে বারান্দার গাছগুলোতে জল দেয়, একপাশে খাঁচায় বন্দী বুলবুলিকে খাবার দিয়ে নিজেও দাঁড়ায় তার সামনে চা হাতে। অতঃপর বাকবাকুম কণ্ঠে কথা বলে অনেকটা সময়।
দৃশ্যটা চোখে ধরার সাথে সাথে কখন যে মনে ধরে যায় টের পর্যন্ত পায়না নাইম। অভ্যাস! অভ্যাস মূলত ভীষণ খারাপ একটা জিনিস। তার ছন্দপতন হলেই হাহাকার ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। ঠিক এমনই এক হাহাকারে জর্জরিত করেছিলো তাকেও। যখন দিন যায়, রাত যায় অথচ ওই বারান্দা ফাঁকা পড়ে থাকে। গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যায় দিনে দিনে। পাখিটার জন্য মন ছটফট করতে থাকে তার। দুইদিন যেতে না যেতেই অনাহারে মুমুর্ষ পাখিটাকে দেখে যেন নিজের কথা মনে পড়ে তার। মেয়েটার উপস্থিতির অভাবে যেমনভাবে মিইয়ে যাচ্ছে বুলবুলি পাখিটা, তেমন করেই যেন শূন্যতায় মিলিয়ে যাচ্ছে সেও। সেদিন রাতেই তাই ফন্দি করে পাইপ বিয়ে উঠে পড়ে সে ওই বারান্দায়।
তিনতলার রুম হওয়ায় খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি তাকে। সকলের চোখের আড়ালে উঠে গিয়ে গাছগুলোতে পানি দেয় সে, এরপর খাঁচায় বন্দী পাখিটাকে নিয়ে নেমে পড়ে সেখান থেকে। এরপর থেকে পাখিটা তার কাছেই রয়েছে। ঠিক যেমনটা করে যত্ন করতো মেয়েটা, সেভাবেই আদরে, যত্ন রেখেছে সেও। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আজকের আগে মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানতো না সে।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাপমুক্ত একটা জীবন বেছে নিয়েছে নাঈম বহু আগেই। নিজের মেধা আর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছে নিজের একটা পরিচয়। পেশায় একজন কার্ডিওসার্জেন। ভারতের নামী দামী হসপিটালের মধ্যে অন্যতম অ্যাপোলো হসপিটালের কলকাতার হাই কোর্টের সান্নিধ্যে অবস্থিত শাখার একজন জুনিয়র কার্ডিওসার্জেন সে।
হসপিটাল চত্বরে আচমকা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় বেশ ভিড় জমে সেখানে। দুইজন নার্স মিলে টেনে তোলার চেষ্টা করে তাকে। সেখানে খানিকটা দূরে উপস্থিত ছিলো নাঈম। ভিড় দেখে এমার্জেন্সি ভেবে সেদিকে এগিয়ে এসে এমন অভাবনীয় কাউকে চোখের সামনে দেখবে কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। এতদিন ধরে মন যাকে খুঁজে চলেছে নীরবে, আজ তাকে এই অবস্থায় দেখে বুকের মাঝে মোচড় দিলো তার। অতঃপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই উঠিয়ে নিয়ে গেল তাকে কেবিনে। পাশ থেকে একজন নার্স সেসময় বেশ রসাত্মক কণ্ঠে বললো,
“ডক্টর নাঈম কী আজকাল জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাজও করছেন নাকি?”
ঠিক তখনই নাঈম গাঢ় চোখে তাকে তনুজার মুখের দিকে। অতঃপর কণ্ঠে বেশ অধিকারবোধ ঢেলে বলে,
“শি ইজ মাই স্পেশাল ওয়ান।”
কথাটুকুর গভীরতা সেখানে উপস্থিত সকলেই বুঝল। তাইতো তাদেরকে ছেড়ে যে যার মতো ব্যস্ত হতে পড়লো নিজের কাজে।
আউট হাউজের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো ধূসর। নাঈমকে দেখে শুকনো হাসলো। অতঃপর তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে আগের মতোই লক করে দিল দরজা ভেতর থেকে।
নওরীনকে ড্রেসিং করতে করতে বেশ কয়েকবার চোরা চোখে তাকালো সে ধূসরের দিকে। শেষে বেশ কিছু ওষুধ লিখে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো তার হাতে। সবকিছু ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়ে বের হওয়ার সময় ধূসরের দিকে আরও একবার তাকালো সে। নাঈমের যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না এটা ধূসর, সেই ধূসর যে দিনরাত মেয়ে আর মদে ডুবে থাকতো।
নাঈমকে বারবার এভাবে তাকাতে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো ধূসর। অতঃপর ঘাড় কাত করে খানিকটা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকে বললো,
“সেসব বেশ বড় কাহিনী, অন্য একসময় বলবো নাহয়। আপাতত জেনে রাখো, কারোর ভালোবাসা আমাকে জানোয়ার থেকে মানুষ বানিয়েছে। অথচ সে আমাকে ভালোবাসে না।”
নাঈমকে এখনও একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধূসর আবারও বলে ওঠে,
“তার মা, আমার আম্মা। তাকে তো পেলাম না এ জীবনে, তবে আমার মায়ের অভাববোধ পূরণ হতে আম্মা পেলাম। আমি মা মা গন্ধ পাই তার আঁচলে জানো? আমার বাপের মৃত্যুপুরী থেকে বাঁচিয়ে লুকিয়ে রেখেছি আমি আম্মাকে এখানে।”
শেষের কথাটা শুনে চমকে তাকালো নাঈম তার দিকে। ধূসরের মুখে কথাটা শুনে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে সে। কারন জাওয়াদ শিকদার খুন করে এলেও ধূসর সেটাকে মাটি চাপা দেওয়ার মতো অন্ধভক্তি করা বাপের ছেলে সে।
নাঈম আর খুব বেশি আগ্রহ দেখালো না বিষয়টাতে। এই পরিবার এমনকি নিজের বাপের থেকেও যথেষ্ট দূরত্ব রাখে সে। মায়ের সাথে কথা হয় যার মাঝে মধ্যে। তবে তার স্থায়িত্ব খুবই কম। ধূসর তার চাচাতো ভাই হলেও তার সাথে যোগাযোগ তার নেই বিশেষ। বলতে গেলে, এই বাড়ি, এই পরিবারের অংশ হয়েও নিজেকে বেশ সুন্দরভাবে সবকিছু থেকে দূরে রেখেছে সে।
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫১
নওরীন ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছে নাঈম তাকে। পাশের ঘরে অনরবত পায়চারি করছে ধূসর। আজ দুইদিন নন্দিতার কোনো খোঁজ নেই। ফোন বন্ধ, ফ্ল্যাটের বাড়িতে, গড়িয়ার বাড়িতে সব জায়গায় তালা দেওয়া। নওরীনের অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি ফেরার খুব একটা বের হতে পারছে না সে। কিন্তু লোক লাগিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে সে নন্দিতাকে। সেদিনের ঘটনার পর আর কিছু জানতে পারছে না। অস্থিরতায় নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। এমন সময় একটা কল এলো তার ফোনে। আর সাথে সাথেই বিশাল লাইব্রেরী রুমের নীরবতার মাঝে সশব্দে ঝড় উঠলো।