প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৩

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৩
ফিজা সিদ্দিকী

একটা এলোমেলো, দুর্বিষহ তান্ডব শেষে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়, ধূসরও থামলো তেমন করেই। লাইব্রেরী রুমের সবকিছু এলোমেলো। যেখানে সামান্য ধুলোবালিও সহ্য করতো না সে, আজ সব নন্ডভন্ড। এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে একটা মাঝারি আকারের শেলফ। বইগুলো অনাদর, অবহেলায় বিছিয়ে মেঝেতে। অগোছালো ঘরে সবচেয়ে অগোছালো, ছন্নছাড়া ধূসর নিজে।

নন্দিতার মৃত্যুর খবরটা প্রতিটা নিউজ চ্যানেল, মিডিয়ায় রটে গেছে আজ। সেই সাথে হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছে বিধ্বস্ত এক মানুষের কথা, সম্পর্কে যে তার স্বামী। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি এখন হাসপিটালের বিছানায়। নিউজচ্যানেল থেকে এই খবরটা শুনে সাথে সাথেই ধূসরের লোকরা তাকে জানায় সব। আর এরপরই গর্জে ওঠে ধূসর। চোখে মুখে তার অসহায়ত্বের সাথে সাথে ক্রোধের ছাপও স্পষ্ট।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেলফের কোণা লেগে বাম হাতের তালুতে অনেকখানি কেটে গেছে ধুসরের। ক্ষত গভীর হওয়ায় রক্ত ঝরছে বেশ। অথচ সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই, তাড়া নেই তার। শরীরের ব্যথার চেয়ে যন্ত্রণা বেশি হচ্ছে বুকে। কেউ বোধহয় বড্ডো নিষ্ঠুরভাবে তার বুকে খামচি দিয়ে বের করে ফেলছে সেখানে থাকা মানুষটাকে। ভীষণ রকম যন্ত্রণা, হাহাকারে দেয়ালে পিঠ এলিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে ধূসর।

বামহাত হাঁটুর উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। হাত চুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। অথচ তার সম্পূর্ণ নজর ডানহাতে ধরে রাখা ফোনটায়, সেখানে চলছে আজকের নিউজ। দেখানো হচ্ছে তুর্জয়কে ঘিরে নানান শান্তনার বাণী। ধূসর থুতনি ঠেকায় হাঁটুতে। মিনমিনিয়ে বলে,
“সম্পর্কের নাম নেই বলে তোমার বেদনা জিতে গেল এডভোকেট তুর্জয় আহসান। এবারও জিতে গেলে তুমি। তাকে পেয়েও জিতলে, হারিয়েও জিতলে। অথচ আমি না পেয়েই সব হারালাম।”
কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধের কারণে বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছেন নওরীন। ধূসরের সাহস হলো না এই খবর তাকে দেওয়ার। দরজাটা লাগিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল সে আউটহাউজ ছেড়ে।

শিকদার বাড়ির বিশাল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো ধূসর। চোখে মুখ তার ভীষণ রকম কঠিন। এই ভবনের দিকে আজীবন সে গর্ব নিয়ে তাকাতো। অহংকার করতো এই সুন্দর, পরিপাটি, দম্ভে ভরা ভবন নিয়ে। অথচ আজ কয়েক লহমায় কেমন যেন গিলতে আসা রাক্ষসপুরী লাগছে এই ভবনকে। যেন এখানে যারা থাকে তারা মানুষ নয়, এক একটা নরপিশাচ। অবশ্য তার চেয়ে কম বা কি?
সাদা রঙের বিশাল ভবনে ওঠার আগে রয়েছে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি। এগুলো যেন দম্ভের সাথে জানান দেয় এই ভবন উচ্চতায় হোক বা দম্ভে সকলের চেয়ে উপরে। প্রথম সিঁড়িতে পা ফেলে ধূসর তেরচা নজরে তাকায় ভূবনের দিকে। অতঃপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে তার। শক্ত কণ্ঠে বলে,

“যে কোনো গল্পে নায়ক হয় একজন, অতিরিক্ত যে থাকে পরিস্থিতি তাকে বানায় ভিলেন। তার গল্পে নায়ক ছিল, ভিলেনের অভাবটা এবার পূরণ হোক। আর ভিলেন কখনও আপোষে আসে না, ক্ষমাও করতে জানে না।”
তার সেই কণ্ঠে কী যেন ছিলো, মুহূর্তেই রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ বদলে গেল। সারি সারি কালো মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। আর তারপরই ঝমঝমিয়ে নেমে এলো বজ্রপাতসহ বৃষ্টি।
নিজের ঘরে বারান্দার রিলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ধুসর বললো,
“ধূলিঝড়, যেখানে ধুলো বালিতে সব আবছা। কেউ ঠাহর করতে পারবে না কোথায় তার উৎস। ঠাহর করার আগেই ঝড়ের তাণ্ডবে সব নন্ডভন্ড।”

নন্দিতাকে যেখানে রাখা হয়েছে সে খবর স্বয়ং জাওয়াদ শিকদার আর তৈমুর ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত, ছোটো ভাই লাবিবকেও জানায়নি কিছু। বিগত দিনগুলোতে একের পর এক যেভাবে তার চালে তাকেই মাত দেওয়া হচ্ছে, এই কাজ তার কাছের মানুষ ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ঘরশত্রু বিভীষণটা কে ঠাহর করতে পারছে না সে। এজন্য আপাতত কাউকেই বিশ্বাস করছে না সে। নিজের নিজেকে ছাড়া এই দুনিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য কেউ না।

নন্দিতা সরাতে তার যে ছেলেপিলেগুলো সাহায্য করেছিলো, সেই তিনজনের লাশ পড়ে আছে তার সামনে। খুব বেশি কষ্ট হয়নি এতে তার। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়েছিলো শুধু। আর গর্ধবগুলো ভেবেছিলো তাদের কাজে খুশি হয়ে বকশিশের সাথে সাথে ভালোমন্দ খাওয়াও পাচ্ছে। হাহ্! বোকা পাবলিক। এই জাওয়াদ শিকদার ভালো করেই জানে তাজমহলের রহস্য। তাজমহল বানানোর পর যেমন শ্রমিকদের হাত কেটে দেওয়া হয়েছিলো, যাতে দ্বিতীয় কোনো তাজমহল এই দুনিয়ায় না বানানো হয়। ঠিক তেমনই নিজের গোপনীয়তা বহাল রাখতে সেও মেরে ফেলেছে এই তিনজনকে। নাহলে কারোর হাতে ধরা পড়ে যদি নন্দিতার বেঁচে থাকার খবরটা ফাঁস করে দিতো বড্ডো লস হয়ে যেত তার। এমনিতেই পুলিশের তীর্যক নজর তার দিকে রয়েছে।

দোতালা ভাঙ্গাচোরা একটা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যাওয়ার শিকদার। এ বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বহু যুগ ধরে পোড়ো একটা বাড়ি। যার চতুর্দিকে আগাছা, ঘাস আর লতানো গাছগুলো এমনভাবে পেঁচিয়ে আছে যেন কতযুগ ধরে এদিকে কেউ আসে না। অথচ বাড়িটা বছর পাঁচেকের পুরোনো। জাওয়াদ শিকদারের সবচেয়ে গোপন ঘাঁটি এটা। পুরোনো ঘাঁটির সন্ধান কোনোভাবে তার ছোট ভাই লাবিব শিকদার জেনে গিয়েছিল। সরাসরি বিক্ষোভ না দেখালেও মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। লাবিব যতই তার ক্রাইম পার্টনার হোক, তার ছেলে নাঈমকে তাদেরকে শত্রুর চোখে দেখে। আর ছেলের মোহে পড়ে লাবিব যে কোনোদিন তাকেই ধোঁকা দেবে না, তার নিশ্চয়তা আছে? নেই। তাইতো সেসময় তার প্রয়োজন পড়ে নতুন একটা জায়গার।

খানিকটা জঙ্গলা ভূমি দেখে এ জায়গাটা কিনেছিলেন জাওয়াদ শিকদার সে সময়। হাইওয়ের পাশ দিয়ে জঙ্গল মাড়িয়ে বেশ খানিকটা ভেতরের দিকে আসতেই বেশ খানিকটা জায়গা একজনের কাছে স্বল্পমূল্যে পেয়ে সুযোগটা লুফে নেন। এরপর শ্রমিক লাগিয়ে এখানে দুইতলা বাড়ি বানান। আর একজন মালি ডেকে এমনভাবে সবকিছু সাজান যেন ভ্রূণাক্ষরেও কেউ টের না পায় এই বাড়ি সদ্য বানানো। বরং বাইরে থেকে দেখলে যেন পোড়ো, ভূতুড়ে গা ছমছমে একটা ভাব দেয়।

বাড়ির পিছন দিকে বেশ বড়ো বড়ো গাছ ঘেরা ঘন জঙ্গল। এ জঙ্গল তারই হাতে গড়া। আর সেখানে ছাড়া রয়েছে তারই পোষা দুইটা পিট বুল টেরিয়ার প্রজাতির কুকুর। এই জায়গাটা এভাবে গড়ে তোলার পিছনে হ্যা যে সব শ্রমিকদের তারা সকলে একে একে খাদ্য হয়েছে এই কুকুরদের। অর্থাৎ এখানের ঠিকানা যে একবার জেনেছে, সে আর দুনিয়ার মুখ দেখেনি।

বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে কুকুরের ডাকার শব্দ হচ্ছে। হবে নাই বা কেন? বিগত দুইদিন ধরে যে জাওয়াদ শিকদার খাবার দেয়নি তাদের। তাদের জন্য স্পেশাল খাবারের প্রিপারেশন নিচ্ছিলো যে এই দুইদিনে।
ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি তার। পরনের সাদা লুঙ্গির একটা খোঁট হাতে উঠিয়ে গাল ভর্তি গজিয়ে ওঠা দাড়ি গোঁফের উপর হাত চালালো সে। সামনে পড়ে থাকা লাশগুলো টানাহেঁচড়া করে সরিয়ে কবর দেওয়ার মন চাইছে না জাওয়াদ শিকদারের। তাই মনে মনে কিছু একটা ভেবে খানিকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আধখাওয়া খাবারের প্যাকেট, হাতে গালে লেপ্টে থাকা খাবারের দিকে। খেতে খেতেই মরেছে সবগুলো। যাক অভুক্ত পেট নিয়ে মারেনি সে কাউকে। কথাটা ভেবে মনে মনে নিজেই হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। অতঃপর একটা একটা করে তিনটা লাশই লাথি দিয়ে ফেলে দিলো বাড়ির পিছনের দিকে। শব্দ পেয়ে কুকুরগুলো ছুটে এলো। তাদের ডাকের তীব্রতা বাড়লো আরও। এরপর খাদ্য পেয়ে উল্লাসে মেতে উঠলো ডেকে উঠল আরও খানিকটা।

ঘরের মধ্যে থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কাছেই কোথাও বড্ডো হিংস্রভাবে ডাক দিচ্ছে কুকুরগুলো। ডাক এমন যেন দেওয়ার ফুঁড়ে এখনই চলে আসবে তারা। আর ভেতরে থাকা মানুষকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে ফেলবে। নন্দিতার আত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে এই ডাকে। নিঃশ্বাস থেমে থেমে আসছে। না চাইতেও ভয় পাচ্ছে সে। ভীষণ রকম ভয়। এখান থেকে বের হওয়ার পথ তার জানা নেই, এখানে বেঁচে থাকার অবলম্বনও নেই। কতোদিন বেঁচে থাকবে এখানে, কিংবা বলা যায় কতদিন বাঁচিয়ে রাখা হবে তাকে তাও জানে না সে। শরীরের ব্যথা ভুলে খানিকটা উঠে বসলো সে। হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ভয়ে। চোখের কোল ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে। একহাত পেটে চেপে উপরে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ভাঙ্গা কন্ঠে মৃদু স্বরে বলল,

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫২

“হে রব, তোমার নামে সঁপে দিলাম আমার সন্তানকে। তুমি আমাকে আমার সন্তানের খুনি বানিওনা, যেটুকু দুর্ভোগ, যেটুকু খারাপ হওয়ার আমার হোক। কোনো মায়ের সামনে তার সন্তানকে যন্ত্রণা দিও না। তবে সেই মা যে আর বেঁচে থাকে না।”

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৪