প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬
ফিজা সিদ্দিকী

শার্টের বোতাম এলোমেলোভাবে লাগানো, পরণের ট্রাউজারের ডান পা হাঁটুর উপর অবদি তোলা, চুলগুলো খোপা করে টঙে তুলে রাখা। নন্দিতাকে দেখে ভীষণ রকম হাসি পায় তুর্জয়ের। কিন্তু কোনরকমে নিজের হাসি কন্ট্রোল করে এলোমেলোভাবে লাগানো শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে ঠিক করে লাগিয়ে দেয় সে। অতঃপর নন্দিতাকে বেডে বসিয়ে নিজে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেঝেতে। তার ডান পা নিজের হাঁটুর উপর নিয়ে ট্রাউজারটা প্রথমে আরও খানিকটা উঠিয়ে দেয়। অতঃপর কাটা জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে। ব্যথায় শিরশিরিয়ে ওঠে নন্দিতা। তুর্জয় কাঁপা কাঁপা হাতে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে যাচ্ছে অনবরত ব্যাথার উপর। নন্দিতা সেদিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,
“ব্যথা কিভাবে পেলাম একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না তো!”

“কিভাবে আবার, কোনো বাঁদরামি করতে গিয়েই পেয়েছ নিশ্চই।”
“কেউ ছুরি মেরেছে। হাতের কাছে পেলে তো গলা দিয়েই চালিয়ে দিত মনে হয়।”
নন্দিতার শেষোক্ত কথা শুনে হাত থেমে যায় তুর্জয়ের। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় নন্দিতার দিকে। নন্দিতা জানে এই লোক এই দৃষ্টির চেয়ে বেশি কিছু করবে না। মুখ দিয়ে কথা বলতে চরম কষ্ট হয় তার। পেটে জমে থাকা শব্দ ভান্ডার ফুরিয়ে যায়, কথা খরচ হয়ে যায়, তাই মুখ ফুটে কিছুই বলবে না। অগত্যা ফোঁস করে এক শ্বাস ছেড়ে নিজেই বলতে শুরু করলো সেদিনের পুরো ঘটনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনার জন্য সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিল নন্দিতা। পড়ন্ত বিকেলের সময় বাজারে সাধারণত লোকসমাগত একটু বেশীই থাকে। সবজি, ফলের বাজার, এমনকি মাছ, মাংসের বাজারেও বেশ গা ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থা। অধিকাংশ চাকুরীজীবী লোকজন বাড়িতে ফেরার সময় বাজার করেন কিনা! নন্দিতার অবশ্য এসব হাট বাজারের প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। মেয়েলী প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনার জন্য ফার্মেসী যেতে হতো তাকে। আর ফার্মেসি যাওয়ার রাস্তা এই বাজার পেরিয়ে। অগত্যা ভীড় ঠেলে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যায় সে। এমন সময় তার চোখ পড়ে তার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে হেঁটে চলা এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার দিকে। বয়সের ভারে মাজা বাঁকা, ঝুলন্ত চামড়ায় তার বয়সের বহর পরিমাপ করা যায় সহজেই, হাঁটতে গিয়ে তাকে ভোর দিতে হয় লাঠিতে। অথচ এ বয়সেও বাজার হাটে তার আগমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার মত এক সমাজের অবস্থান।

আচমকা নন্দিতার চোখ যায় বৃদ্ধা মহিলার ঠিক পিছনে দাঁড়ানো এক ছেলের দিকে। বয়স নিতান্তই কম, পাতলা গড়নের এক ছেলে। আশেপাশে তাকাতে তাকাতে আস্তেধীরে বৃদ্ধার ব্যাগের চেইন খুলছে। ঘটনা বুঝতে আর বেগ পোহাতে হলো না তাকে। সে ভীড় ঠেলে যথাসম্ভব দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু আশেপাশের মানুষের জন্য ব্যর্থ হয়ে সেই পিছিয়ে যেতে হয় আবার। উপায়ান্তর না পেয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই জোরে চিৎকার করে বলল,
“চোর, চোর, দাদিমা আপনার ব্যাগ সামনে নিন।”

আশেপাশের বেশ কিছু মানুষের কানে সেই শব্দ পৌঁছালেও বয়স্ক বৃদ্ধার কানে গেল না তা। হয়তো বয়সের জন্য কানেও কম শোনেন তিনি। নন্দিতার চিৎকারের শব্দে ভীড় থেকে কিছু মানুষ কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলে দুইপাশে সরে গেল। নন্দিতাও সুযোগ বুঝে দৌড় দিলো সেদিকে। কিন্তু ততক্ষণে বাকি সবার মত সেই ছেলের কানেও গেছে নন্দিতার কথা। ফলস্বরূপ ব্যাগের খোলা চেইন হতে একটা লাল রঙের পুঁটলি উঠিয়ে দৌড় দিলো সে। নন্দিতাও দৌড়ালো তার পিছে। বাজারের জনতা তখন সেই ছেলেকে আটকানোর জন্য পথ অবরোধের বদলে তার হাতে থাকা ছোটো সাইজের ছুরির দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যে যার মতো দুইপাশে সরে যায়। এতে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে তারও দৌড়ে বেরিয়ে যেতে সুবিধা হয়।

ছোটো থেকে এথলেটসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার হেতু ছেলেটা নন্দিতার সাথে দৌড়ে পেরে উঠলো না। বাজারের শেষ প্রান্তে গিয়ে পাকড়াও করে ফেললো তাকে নন্দিতা। অতঃপর ঘাড়ের কাছের কলার ধরে তাকে মাটিতে বসাতে চায় এমন সময় ছেলেটা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় হাতে থাকা ছুরিটা দিয়ে আঘাত করে নন্দিতার পায়ে। পায়ে ব্যথা পেয়ে হাত খানিকটা আলগা হতেই যেই দৌড় দিতে চায় অপরপাশ থেকে একদল পুলিশ এসে পাকড়াও করে ছেলেটাকে। জিজ্ঞাসাবাদে স্পষ্ট হয়, মহিলাটিকে বেশ অনেক্ষণ যাবৎ ফলো করছিলো সে। বাজারের আগের এক গহনার দোকানে এই গহনাগুলো বেচতে গিয়েছিল সে। কিন্তু ভালো দাম না পাওয়ায় অন্য দোকানের খোঁজে তিনি বাজারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর এই সুযোগেই ছেলেটা এগুলো চুরি করে পালানোর ধান্দা করছিলো।
নন্দিতা গহনার পুঁটলিটা বৃদ্ধা মহিলার হাতে তুলে দিতেই কাঁদো কাঁদো গলায় তিনি বলেন,

“বাবা মরা নাতনিটার বিয়ে সামনে। আমার জমানো যা কিছু ছিল তা বেচে তার বিয়ের আয়োজন করবো বলে বেচতে এসেছিলাম। আজ তুমি না থাকলে আমার নাতনিটার কী হতো? বিয়ে ভেঙে যেত তার। আল্লাহ তোমার কপালে অনেক সুখ দিক। অনেক সুখী হও মা। স্বামীর সোহাগে আহ্লাদী হয়ে থাকো।”
শেষোক্ত কথাটা বলার সময় আড়চোখে তুর্জয়ের দিকে তাকায় নন্দিতা। আগের মতই গম্ভীর মুখভঙ্গীতে বসে সে। মুখের ভাব ভঙ্গিমা দেখে বোঝার উপায় নেই মনে কী চলছে।
নন্দিতা ভেবেছিল এতগুলো কথা শুনতে তুর্জয় বেশ বিরক্ত হবে। হয়তো মাঝপথে থামিয়ে দেবে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। অথচ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু ভীষণ আগ্রহ নিয়ে শুনলো সে। পরপরই প্রশ্ন করলো,
“ফিউচার প্ল্যানিং কী?”

বিয়ের এতদিনে তুর্জয়ের এমন প্রশ্নে একেবার হতভম্ব হয়ে পড়ল নন্দিতা। চট করে হাত বাড়িয়ে কপাল, গলা ছুঁয়ে দেখলো তুর্জয়ের। অতঃপর চিন্তাগ্রস্থ কণ্ঠে বলল,
“আপনার কি আবার জ্বর এসেছে, ভেতরে ভেতরে জ্বর? শরীর তো একদম ঠাণ্ডা।”
চট করে তুর্জয়ের মেজাজ চটে গেল। তিরিক্ষ কণ্ঠে বললো,
“সঠিক প্রশ্নের সঠিকভাবে উত্তর দেওয়া কি তোমার ধাতে নেই?”
“সঠিক প্রশ্ন হলে তবেই তো সঠিক উত্তর পাবেন। আপনার প্রশ্নগুলোও আপনার মতই বেকুব।”
“এই বেয়াদব মেয়ে, সোজাসাপ্টা কথা বলা শেখায়নি তোমার বাবা মা? সবসময় ত্যাড়ামি না করলে চলে না?”
“সব যদি বাবা মা শিখিয়ে পাঠায়, তাহলে আর বিয়ে দিয়ে বরের কাছে পাঠাবে কেন? নিজেদের কাছে রেখে দিলেই পারে।”

“আমারই ভুল, তোমার সাথে বেশি আহ্লাদীপনা করে কথা বলা।”
“আপনি আদর, আহ্লাদ করতে চাইছিলেন বুঝি? কাছে আসুন তো একটু, আপনার কোলে বসি। আপনার আদর করতে সুবিধা হবে।”
“অসভ্য মেয়ে” রাগে গজগজ করতে করতে বলে ওঠে তুর্জয়।
“এখনও যথেষ্ট সভ্য আছি। অসভ্য হলে আপনার ওই সিগারেট পোড়া ঠোঁটে কামড়ে ধরে চুমু দিতাম। শার্টের খোলা বোতামের নীচে একটা দুইটা কামড়ের দাগ তো অবশ্যই থাকতো।”
তুর্জয় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় নন্দিতার দিকে। তা দেখে ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বিছানায় উঠে বসে নন্দিতা। অতঃপর আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে অথচ,
“অবশ্য একজনের চুমুর স্বাদ আমার ঠোঁটে লেগে আছে এখনও। আপনার চুমু সেই স্বাদকে বিট করতে পারবে কিনা সন্দেহ।”

তুর্জয় ঘর ছেড়ে বের হতে যাচ্ছিল। নন্দিতার শেষোক্ত কথাটুকু শুনে কদম থেমে যায় তার। বুকের কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। কথাগুলো বড্ডো বিশ্রী শোনালো তার কাছে। মেয়েটার কি তবে প্রেমিক ছিলো? থাকলে থাকতেই পারে। এ যুগে এমন দুই চারটা প্রেমিক তো সব মেয়েরই থাকে। কিন্তু সেটা তো অতীত। তাও কেন তার খারাপ লাগছে? মনে হচ্ছে যেন তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দেওয়ার অপরাধে এখনই ওই লোকের নামে চারটি খানেক কেস ঠুকে দিতে পারলে শান্তি লাগতো তার। কিন্তু মেয়েটাকে তো সে পছন্দ করে না। একদমই না। তাহলে এসব ভাবনার কারন কী?

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫

তুর্জয়কে আরও খানিকটা তাতিয়ে দিতে নন্দিতা পুনরায় বলে ওঠে,
“তার উষ্ণ নিঃশ্বাস, তপ্ত ঠোঁটের চুমু, ইশ! বারবার চাওয়ার মতো জিনিস। ঠিক অনেকটা চকলেট আইসক্রিমের মতো, যত ফ্লেভার টেস্ট করো না কেন, এটার মতো তৃপ্তি পাওয়া যায়না। কেউ পার…….”
নন্দিতার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আচমকা তুর্জয় তার পা ধরে টান দিয়ে তাকে নিয়ে আসে বিছানার কিনারে। অতঃপর ডানহাতে কোমর আঁকড়ে ধরে অপরহাত রাখে মাথার পিছনে। আকস্মিক আক্রমণে নন্দিতা কিছু চাওয়ার আগেই গম্ভীর, পুরুষালী ওষ্ঠ প্রহার চালায় তার নরম ওষ্ঠে।

প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৭