প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬৪
ফিজা সিদ্দিকী
ঘন জঙ্গলের শেষপ্রান্তে বিশালাকার খাদ। খাদের গভীরতা এতো বিশাল যে নীচ অব্দি গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যায়না।
বাড়ির পিছনের দিকের একটা সরু রাস্তা সোজা চলে গেছে সেই খাদের দিকে। পাথুরে এবড়ো থেবড়ো রাস্তাটা। দুইপাশে গজিয়ে বিশালাকার গাছ। সরু পথের মাঝেও লতাপাতায় ঘেরা। একজন গার্ড সেই লতাপাতা কেটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পিছন পিছন সকলের মাথায় বন্দুক তাক করে রেখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একেবারে শেষে ধূসর হাঁটছে ধীর গতিতে। কৌশলে জাওয়াদ শিকদারকে তার ডেরা থেকে বের করেছে সে।
কারণ, পরিচিত ঘরে জখমের মলম থাকে, ঘাতের বদলে প্রতিঘাতের অস্ত্র থাকে, আক্রমণের বদলে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি থাকে। জাওয়াদ শিকদারকে এবার আর কোনো সুযোগ দিতে চায়না ধূসর। এবার তাকে হারতে হবে। জাওয়াদ শিকদারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ তার হাঁটু ভেঙে দিতে না পারলে সেও জাওয়াদ শিকদারের অংশ না।
একটা বড়ো পাথরের চাঁইয়ের উপর পায়ে পা তুলে বসে জাওয়াদ শিকদার। ধূসর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ধীরভাবে। অতঃপর ধীর কন্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওই মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।”
ধূসরের আঙুল অনুসরণ করে তাকালো জাওয়াদ শিকদার। বললো,
“ছেড়ে দেব। কিন্তু এর বদলে কাউকে না কাউকে তো তার প্রাণ খোয়াতে হবে।”
ধূসর আবারও আগের মতো নীচু কন্ঠে বলল,
“শেষবারের মতো বলছি, ছেড়ে দাও মেয়েটাকে।”
“কে হয় মেয়েটা তোমার?”
“সম্পর্ক তো অবশ্যই আছে, তবে আমার সাথে না। নাঈম ভাইয়ের সম্পদ সে। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না করাই ভালো।”
জাওয়াদ শিকদার উঠে দাঁড়ালেন। ধুসরের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ছাড়বো না। এখানের একটাকেও ছাড়বো না। নাঈমের উচিৎ ছিল তাকে সামলে রাখা। সাপের লেজে পা দিয়ে ছোবল না খেয়ে আজ অব্দি কেউ ফিরে যায়নি।”
কথাটা শেষ করে আর অপেক্ষা করলেন না জাওয়াদ শিকদার। পাশে দাঁড়ানো গার্ডটাকে ইশারা করতেই সে পিছন থেকে এসে চেপে ধরলো ধূসরকে। জাওয়াদ শিকদার প্রথম বন্দুক তাক করলেন তনুজার দিকে। ট্রিগারে চাপ দিতে দিতে বললেন,
“ফনা তোলা সাপের বিষদাঁত আগে ভেঙে ফেলতে হয়।”
কথাটা শেষ করতেই তুর্জয় পা দিয়ে একটা পাথর ছুঁড়ে দিলো জাওয়াদ শিকদারের দিকে। আচমকা পাথরটা পায়ে এসে লাগতেই লক্ষ্যচ্যুত হলো তার। হাত থেকে পড়ে গেল বন্দুকটা। ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটলো যে সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সুযোগ বুঝে তুর্জয় গার্ডকে ছাড়িয়ে সেই বন্দুকটা উঠিয়ে ফেললো। ট্রিগার চেপে ধরে জাওয়াদ শিকদারের দিকে তাক করে বাজখাঁই কন্ঠে বললো,
“ছেড়ে দে সবাইকে। নইলে আজ এখানে আমার হাতেই শিকদার বংশের পতন হবে।”
জাওয়াদ শিকদার মুহূর্তকালের জন্য থমকে গেল যেন। তনুজাকে ইশারা করে তুর্জয় বললো সবাইকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। জাওয়াদ শিকদারের দিকে বন্দুক তাক করা দেখে গার্ডগুলোও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ছেড়ে দিলো সবাইকে। তনুজা সবার আগে তুহিনা বেগম আর আশরাফ সাহেবকে জঙ্গলের ভেতরে রাস্তার দিকে এগিয়ে দিলো। এরপর নন্দিতার কাছে আসার জন্য পিছু ফিরতেই পরপর দুটো গুলির শব্দ হলো।
চমকে সেদিকে তাকালো সকলে। সশব্দে ঢলে পড়লো দুটো দেহ মাটিতে। তুহিনা বেগম আর আশরাফ সাহেব নিভু নিভু চোখে তাকালেন শেষবারের মতো একবার। তুর্জয় যেন কথা বলতে ভুলে গেল। হাত থেকে বন্দুকটা ফেলে ছুটে গেল তাদের কাছে।
জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো আনসার। হাতে বন্দুক, চোখে মুখে হিংস্র চাহনী। জাওয়াদ শিকদার ছাড়া বাকিরা চমকে উঠলো তাকে দেখে। তুর্জয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনো। যে মানুষটাকে সে সর্বোচ্চ বিশ্বাস, ভরসা করতো সেই মানুষটার হাতে নিজের বাবা মায়ের খুন। এই কঠিন সত্য তার বুক চিরে রেখে দিলো। ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে আনসারের উপর। দুইহাতে কলার ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“হাত কাঁপলো না একটুও? মানুষগুলো নিজের ছেলের মতো ভালবাসতো তোকে। তাদের বুকে গুলি ছুঁড়তে তোর বুকে কাঁপন ধরলো না?”
তুর্জয়ের হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিলো আনসার। অতঃপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে বললো,
“শত্রুর একটাই পরিচয় সে শত্রুপক্ষ। আর শত্রুর প্রতি মায়াদয়া দেখাতে নেই।”
নন্দিতা হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। শরীরটা তার ছেড়ে দিচ্ছে। এতো ধকল যেন সইছে না আর। তার চোখের সামনে তুহিনা বেগম আর আশরাফ সাহেব ঢলে পড়লো। দ্বিতীয়বারের মতো অনাথ হলো সে। নতুন করে শূন্যে আবিষ্কার করলো নিজেকে। এই দুনিয়ায় আর কোনো মমতায় ভরা বুক তার জন্য রইলো না। দমবন্ধ হয়ে এলো তার। দুইহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো। তুর্জয় দ্রুত এগিয়ে এলো তার কাছে। বুকের সাথে চেপে ধরলো তার মাথা। কোমল কন্ঠে বললো,
“নিজেকে শক্ত করো। শান্ত হও প্লীজ। আমি দূর্বল হয়ে পড়ছি। দয়া করে আমাকে দূর্বলতা উপহার দিও না আর।”
নন্দিতা কান্নাভেজা চোখ তুলে তাকালো তুর্জয়ের দিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
“আমি দায়ী, আমার জন্য এসব হচ্ছে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমাকে মাফ করবেন না একদম।”
তুর্জয় তার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে পিঠে হাত বোলাতে লাগলো আলতো করে। নরম কন্ঠে বললো,
“দায়ী সব দায় মেটাবে, আজ মৃত্যু মাতম মানাবে।”
নন্দিতাকে টেনে হিঁচড়ে বসা থেকে ওঠালো জাওয়াদ শিকদার। হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেল একদম কিনারে, খাদের কাছে। ধূসর চমকে উঠলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো তার। জাওয়াদ শিকদারকে থামাতে তৈমুরের হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে সরাসরি মাথায় গিয়ে ঠেকালো তার। জাওয়াদ শিকদার থেমে গেলেন। চমকে তাকালেন পিছন ফিরে। ধূসরের হাতে বন্দুক দেখে সে এমনভাবে অবাক হলো যেন এরচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা দুনিয়ায় আর ঘটেনি। অবাক কন্ঠে বললেন,
“তুমি আমার মাথায় বন্দুক ধরেছ?”
শক্ত করে ধরে রাখা নন্দিতার হাতের দিকে তাকিয়ে ধূসর। রাশভারী কন্ঠে বলল,
“হাতটা ছাড়ো। তোমার হিসেব এতো সহজে মেটাতে চাইছি না আমি। তোমার এত সহজ মৃত্যু দিতে চাইছি না আমি। আমার মায়ের মত যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে তোমাকে। তোমার মৃত্যু এতো সহজ হতে পারে না।”
“কী বলছো এসব?”
“শোনো জাওয়াদ শিকদার, তুমি একজন জঘন্যতম স্বামী। আমার মা কখনোই সুখের সংসার করতে পারেনি তোমার মত লোকের সাথে। একজন ভালো বাবাও হতে পারোনি কখনও। টাকা পয়সা, সম্পত্তি তোমার আসল ভালোবাসা। না তুমি কখনও নিজের স্ত্রীকে ভালবেসেছ না সন্তানদের। তুমি শুধু ভালবেসেছ নিজেকে। তুমি একজন অত্যন্ত স্বার্থপর মানুষ। তোমার মত মানুষকে মারতে আমার খুব বেশি খারাপ লাগবে না। বরং এই দুনিয়া থেকে একটা শয়তান বিদায় হবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার খুব সখ না তোমার? চলো আজ আমরাও একটু সেই খেলা খেলি। সামনে গভীর খাই আর পিছনে বন্দুকের ট্রিগার। কেমন লাগছে বলো তো? চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছ? ভয় করছে? একটু ভয় পাও। এই ভয় তোমার প্রয়োজন। তোমারও বোঝা উচিত মৃত্যু কতো কঠিন। মৃত্যু কতো নির্দয়। আজ অব্দি যত নির্দোষ মানুষকে মেরেছ, তাদের কষ্টগুলোর একভাগ হলেও অনুভব করা উচিত তোমার।”
গার্ডরা ধুসরের দিকে বন্দুক তাক করলে তাদের থামিয়ে দেয় তৈমুর। নরম কন্ঠে বোঝানোর সুরে ধূসরকে বললো,
“ভুল করছিস ধূসর। আব্বাকে ছেড়ে দে। আর যাইহোক ছেলের হাতে বাপের খুন মানায় না।”
ধূসর রেগে গেল তৎক্ষণাৎ। বাজখাঁই কন্ঠে বললো,
“লজ্জা করেনা তোর? মায়ের জন্য কষ্ট হয়না? এইযে এই লোকটার জন্য আমাদের মা আত্মহত্যা করেছিল, তোর রাগ হয়না? প্রতিশোধ নিতে মন চায়না? কিভাবে পারিস এই লোকটাকে সম্মান করতে? তার সব পাপ কাজের সাক্ষী তো তুই নিজে, তোর নিজের প্রতি ঘৃণা হয়না?”
“আব্বা যা কিছু করে আমাদের জন্য করে, আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে করে। তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস, মাথা ঠাণ্ডা কর। বাইরের একটা মেয়ের জন্য তুই আব্বার মাথায় বন্দুক ধরেছিস, ধূসর।”
ধূসর হাসলো খানিকটা। কন্ঠ খাদে ফেলে বলল,
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬৩
“বাইরের মেয়ে! আমার জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপুর্ন নারী সে। মায়ের পরে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছি। আর আমার মায়ের পরে জাওয়াদ শিকদার যাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, সেই নারী সে। আমার হৃদয়ে থাকা দুই নারীকেই যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করেছে এই লোক। তাদের প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের সুদ সমেত হিসেব আমি ধূসর শিকদার নেব।আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা অব্দি আমি জাওয়াদ শিকদারের জীবন নরক বানিয়ে ফেলবো।”
