প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৩

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৩
নওরিন কবির তিশা

আরেকটি রাঙা প্রভাত, উদীয়মান সূর্যের আরক্তিম রশ্মি সবে ছুঁয়েছে সদ্য ফোঁটা বকুলগুচ্ছ। প্রতিদিনের রৌদ্রকে রণে আবৃত করার ন্যায় সূর্যকিরণ এখনো অনুপস্থিত। যার দরুন শান্ত এক নরম উষ্ণতায় মোড়ানো গোটা ধরণী।
কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে তিহুর, ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকেই একবার দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। সময়টা সকাল সাতটার কাঁটায় এসে থমকেছে। সরু নেত্রে একবার সমগ্র রুমটাতে নজর বুলালো তিহু। নীলকে কোথাও দেখতে না পেয়ে সে বুঝলো, হয়তো নীল সুইমিং পুলের কাছে হবে। কেননা ওখানেই প্রতিদিন সকালে জিম করার অভ্যাস তার।

তিহু আর কিছু না ভেবেই, একবার কিচেনের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো । তৎক্ষণাৎ সেন্টার টেবিলের উপর রাখা নীলের ফোনটা টিং করে বেজে উঠল। পরপর বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরও নীলের কোনো খোঁজ না দেখে,তিহু ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি মুখে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে তুললো। ক্রিনের উপর ভাসছে সেভ করা নাম্বারটা,“Minister(Ishtiyak)”।
ইশতিয়াক স্যার? তিনি তো পানিমন্ত্রী, কিছুদিন আগেই না ভার্সিটিতে এসেছিলেন? মুহূর্তেই তাকে চিনে ফেললো তিহু। দ্রুত ফোনটা নিয়ে সে এগিয়ে গেল, সুইমিং পুলের দিকে।
সুইমিং পুলের পাশটা নিস্তব্ধ-নিরব। ভেসে আসছে‌ ‌শুধু কিছু নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সুবাস, আর পানির মৃদু মন্দ কলরব। তিহু সন্ধানী দৃষ্টি মেলে খুঁজতে থাকলো নীলকে। এদিকে খুঁজতে খুঁজতে সে খেয়ালই করল না যে সামনেই পানির কারণে বেশ কিছুটা স্থান পিচ্ছিল হয়ে আছে। হঠাৎই তার পিছন থেকে কেউ বলে উঠল,,,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

———“আমাকে খুঁজছো?”
হুট করে পিছন থেকে কারো কণ্ঠস্বরে ভূত দেখার মত চমকে উঠল তিহু। ভীত দৃষ্টিতে তৎক্ষণাৎ পিছন ঘুরতে গিয়েই, পিচ্ছিলতার কারণে সুইমিংপুলে পড়ে যেতে যেতে পেছনে থাকা মানুষটিকে আঁকড়ে ধরল। নীলও তিহুর হঠাৎ এমন আঁকড়ে ধরার দরুন, ভারসাম্য হারিয়ে পানিতে গিয়ে পড়ল।
একসঙ্গে পানিতে পড়ে দুজনের অবস্থাই ভিঁজে একাকার। তিহু দ্রুত পানি থেকে মুখ তুলে,লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে,বুকে আলতো থাপ্পড় দিয়ে বলল,,,
———“আপনার ঘাড়ে কি জ্বীন ভূত কিছু আছে নাকি? অমন ভূতের মতন পিছন থেকে এসে ডাক দিলেন কেন?”

নীল কিছুটা রাগী, গমগমে কণ্ঠে বললো,,,—-“জাস্ট শাট আপ স্টুপিড! ইডিয়েট এর মত, পিচ্ছিল জায়গাটা এসে দাঁড়িয়েছিলে কেন?”
তিহু সামনে চলে আসা ভেঁজা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিতে দিতে, ঠোঁট বাঁকিয়ে ঝগড়াটে কন্ঠে বলল,,,
———“আমি ইডিয়েট? ইডিয়েট তো আপনি!আমি কি জানতাম নাকি এখানটা পিচ্ছিল ছিল? আর তার ওপর আপনি আবার এসে, ভূতের মত পিছন থেকে কথা বলে উঠেছেন!”
নীল কিছু একটা বলতে গিয়েও থামলো, তার লক্ষ্যগত হলো তিহুর শরীরে থাকা বস্ত্রগুলো ভিজে,শরীরের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে তার। নীল তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে, সেখান থেকে উঠে গেল। তিহু নিজের কথার জবাবে কিছু না পেয়ে, কোমরে হাত দিয়ে মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো।
নীল চলে যেতেই, সে বিরক্ত হয়ে যখন সাইডের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ নিজের দিকে চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠল তার। শরীরের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে আছে, ওড়নাটাও একেবারে সেটে আছে শরীরের সাথে। লজ্জায় দম বন্ধ হয়ে আসলো তিহুর। তারমানে এতক্ষণ সে এভাবেই নীলের সাথে তর্ক করছিল? হায় আল্লাহ! সাধে কি আর নীল তাকে ইডিয়েট বলে!

পোশাক বদলে, চুলগুলোতে টাওয়াল পেঁচিয়ে সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে তিহু। নীল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলোতে ব্যাকব্রাশে ব্যস্ত। তিহু লজ্জায় তাকাতেই পারছে না তার দিকে। হঠাৎ রুমের দরজায় নক করলো কেউ একজন। নীল আরসিতে চোখজোড়া আগের ন্যায় স্থবির করেই বলল,,,,
———“কাম ইন!”
প্রবেশ করল বাড়ির একজন কম বয়স্কা কর্মচারী। নতজানু মাথায় সে বলল,,,
—-“ভাইজান,ভাবি। আপনাদেরকে খালাম্মা নিচে খেতে ডাকছেন।”
নীল:“তুই যা, গিয়ে বল আমরা আসছি।”
মেয়েটি এবার মাথা উঁচু করে, একঝলক নীল পরক্ষণেই তিহুর পানে চাইলো। দুজনের পরনেই সদ্য বদলানো কাপড়, আর তিহুর ভেজা চুল দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় লাজুক হেসে মেয়েটি দ্রুত প্রস্থান করল রুম থেকে। তিহু সেদিকে চেয়ে মুখ কুঁচকে বলল,,,,

———“ও ওভাবে হাসলো কেন?”
নীল এক ঝলক তার দিকে তাকিয়ে বলল,,,—-“সেটা আমি কি জানি!”
কিছুক্ষণ নীরবতা। অতঃপর নীল রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল,,,—-“দ্রুত আসো, আম্মু ডাকছে!”
তিহু নিজের দীর্ঘ কেশরাজিতে দ্রুত চিরুনি চালনা করতে করতে বলল,,,—-“হুম আপনি যেতে লাগেন আমি আসছি.!”
নীল প্রায় রুম থেকে বেরিয়ে গেল, পরক্ষণ এই ফের ফিরে এসে আবার বলল,,,—-“ বাই দ্যা ওয়ে, স্ট্রবেরির উপর শর্ট কিছু একটা পড়া উচিত। জাস্ট ফর সেফটি।”

বলেই সেখান থেকে বের হয়ে গেল নীল। তিহু আয়না থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালো নীলের দিকে। তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না সে। বলতে গেলে তার মাথার এক হাত উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে ‌নীলের কথাটা । ফের চিরুনি চালনায় মনোনিবেশ করতেই, নীলের কথার মর্ম বুঝে হঠাৎ হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেল তার। ড্রেসিং টেবিলের বিশাল আয়নায় নিবদ্ধ চোখগুলো আপনা আপনি বড় বড় হয়ে গেল,লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল ফর্সা মুখশ্রী।

খাওয়া-দাওয়া শেষে কিচেনে ব্যস্ত বাড়ির সকল রমনীরা। তেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস না থাকায়,তিহু আজ ভার্সিটি যাবেনা। তাই সেও হাতে হাতে বিভিন্ন কাজ গুছিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই সেখানে উপস্থিত হলো নাহা আর মুন্নি। মুন্নিকে দেখে চোখ সরু করে এক ঝলক তাকালো তিহু। নাহা মির্জা সূচনার উদ্দেশ্যে বলল,,,
———“আম্মু?”
মির্জা সূচনা হাতের কাজটি করতে করতে একবার মেয়ের দিকে তাকালেন,———“ভার্সিটি যাচ্ছিস?”
নাহা:“জ্বী।”
মির্জা সূচনা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুন্নিকে দেখে বলল,,—“তুই কোথায় যাচ্ছিস মুন?”
‌ মুন্নি:“মামিমা, আসলে আমার একটা ফাইল আজকে জমা দিতে হবে। এজন্যই ভাবছিলাম একবার ভার্সিটি যাব।”
নাহা, মুন্নি দুজনেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। দুজনের ভার্সিটি এক হওয়ায়, একসঙ্গে যেতে কোনো অসুবিধা নেই তাদের। তবে বাড়ির মেয়েদের একা একা ছাড়া, এই নিয়ে ঘোর আপত্তি রয়েছে গুরুজনদের।

মির্জা সূচনা: “তা তোমরা কার সাথে যাচ্ছ?”
মুন্নি মিন মিন করে বলল,,—-“একা….!”
তাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই, এক লহমায় তার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে মির্জা সূচনা অবাক কণ্ঠে বললেন,,,,—-“একা মানে…?”
মুন্নি,নাহা দুজনেই মির্জা সূচনার কন্ঠে চুপসে গেল।নাহা কাচুমাচু কণ্ঠে বললো,,—-“কিন্তু, আব্বু চাচু আর ফুপ্পা তো ড্রাইভার সহ গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছে। আর আজিজ আঙ্কেলও তো ছুটিতে। তাহলে কার সাথে যাব আম্মু?”
মির্জা সূচনা কেও কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখালো। সত্যিই তো এখন, কোন ড্রাইভারই নাই, তার ওপর মেয়েদের ভার্সিটিতে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তখনই শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত নীল সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। তাকে দেখে মির্জা সূচনার মুখের দুশ্চিন্তার কালো মেঘ কেটে গেল, ছেলেকে ডেকে তিনি শুধালেন,,,
——“কোথায় যাচ্ছ নীল?”
নীল:“পার্টি অফিসে।”
মির্জা সূচনা:“একটু পরে যেও, তুমি বরং মুন্নি আর নাহাকে ভার্সিটি পর্যন্ত ফার্স্টে ড্রপ করে দিয়ে আসো।”

মায়ের কথায় নীল সম্মতি জানালেও, তিহু তাৎক্ষণিক হাতের কাজ রেখে তড়িৎ বেগে তাকালো তার দিকে। নাহাকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু এই মুন্নি! তাকে নিয়ে ঘোর আপত্তি রয়েছে তিহুর । মুখ কুঁচকে নীলের দিকে তাকলো সে। শাশুড়িকে তো কিছু বলতে পারবে না, এদিকে মুন্নি নীলের সাথে যাক, এটাও সহ্য করতে পারবে না সে। বিরক্তি-লজ্জা-ভীতি, সবকিছু একসাথে আঁকড়ে ধরল তাকে। এদিকে নীলের কোনো ভাবান্তর নেই, মায়ের থেকে নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই বোনকে নিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করলো সে।

মুন্নি ফাইল গুলো জমা দিয়ে, সবে গাড়িতে এসে বসেছে। নীল আগে থেকে ড্রাইভিং সিটে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজকের দিনটা অনেক বড় প্রাপ্তি মুন্নির জন্য। জীবনে এই প্রথম নীল ভাইয়ের সাথে কোথাও একান্তে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। যদিও নাহা’র বদৌলতে, তবে ক্ষতি কি? একদিন নিজের প্রিয় মানুষটার সাথে ঘোরা, তা সে যে অজুহাতেই হোক না কেন।
যদিও এটাকে ঠিক ঘোরাঘুরি বললে ভুল হবে, তবে মুন্নির কাছে এটা ডেটিংয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সে গাড়িতে বসে এক ঝলক নীলের দিকে তাকালো। নীলের তীক্ষ্ণ নীলচক্ষু রোদ চশমার আবরণে আবৃত। শক্ত মুখশ্রী সম্মুখের সড়কের দিকে নিবদ্ধ। মুন্নি আলগোছে সিটবেল্টটা বেঁধে নিল। সঙ্গে সঙ্গে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সোজা এগিয়ে চলল নীল।

ঢাকার রাস্তা আর জ্যাম নেই, এমন দিন হয়তো ডুমুরের ফুল। গতানুগতিক নিয়ম অনুসারে আজও প্রচুর জ্যাম,আর সেখানেই আটকা পড়েছে নীলের গাড়িটা। নীল বিরক্তি মুখে স্টেয়ারিং এ থাকা হাতটা দিয়ে বারংবার আঘাত করছে সেটাতে । আর মুন্নি আড়চোখে বারংবার পর্যবেক্ষণ করছে নীলকে। হঠাৎই দুইটা পিচ্চি পিচ্চি ছেলে মেয়ে ছোট পাত্রে কিছু একটা এনে নীলের সাইডে দাঁড়ালো।
ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে গাড়ির জালনার কাঁচ ধীরে ধীরে নামিয়ে দিল নীল, কিছুটা হেসে বলল,,,,—–“কিছু বলবে?”

তাদের মধ্য থেকে মিষ্টি করে দেখতে মেয়েটা বলল,,,—-“ফুল নিবে ভাইয়া? দেখো কি সুন্দর ফুল!”
নীল এক ঝলক উঁকি মেরে পাত্রটার দিকে তাকালো। হরেক রকম গোলাপে সজ্জিত এক তোড়া দেখে হঠাৎই এক সুশ্রীর রমনীর মুখাবয়ব ভেসে উঠল তার সম্মুখে। তবে সেখানে শুধু ফুল নয়, রয়েছে একখানা গাঁজরাও। নীল মুচকি হেসে, পাত্রে থাকা সমস্ত দ্রব্যাদি কিনে নিল। ছেলে মেয়ে দুইটাও খুশি মনে হাসতে হাসতে বিদায় জানালো তাকে।
নীল ফুলসহ গাঁজরাটা সম্মুখের ক্যাশ বোর্ডের ফাঁকা স্থানটিতে রেখে, গাড়ির স্টার্ট দিল। ততক্ষণে যানজট বেশ শিথিল। শান্ত বেগে চলমান গাড়িটা এগিয়ে চলল নিজ গন্তব্যের দিকে।

হন্যে হয়ে ঢাকার প্রত্যেকটা অলিগলিতে নিজের শ্যামাঙ্গিনীকে খুঁজেছে রাওফিন । তবে সে লাপাত্তা, তার খোঁজ কেউ দিতে পারে না। এমনকি যে কোচিংয়ে প্রথম তাদের দেখা হয়েছিল, তারাও ঠিক মতো মেয়েটির বর্তমান ঠিকানা দিতে সক্ষম হয়নি। বিধ্বস্ত-হতাশাগ্রস্থ-ভঙ্গুর মস্তিষ্কে, গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল রাওফিন। হতাশার কালো মেঘ জমে আছে ফর্সা মুখশ্রীতে। ক্লান্ত হয়ে পাশের একটা ফাঁকা স্থানে গাড়ি পার্ক করতে বেশ জোরে গাড়ি চালিয়ে সেদিকে যাচ্ছিল সে। কিন্তু হঠাৎই তার সামনে চলে আসে কেউ একজন।
রাওফিন অপ্রস্তুত হাতে দ্রুত ব্রেক কষলো। সামনে থাকা ব্যক্তিটির কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা দেখতে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে, নেমে আসলো সেখান থেকে। এদিকে কিছু নোটস নিয়ে অতি দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল মাহা। দ্রুতগতির কারণে সে লক্ষ্য করেনি, কখন সামনে গাড়ি চলে এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় গাড়ির ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গিয়ে হাতে থাকা নোটসগুলো সব ভূপতিত হলো তার।

ভীতির কারণে দ্রুত সেখানে বসেই চোখ খিচে রাখলো সে। মুহূর্ত কয়েক পর যখন সে টের পেল তার কোনো ক্ষতিই হয়নি, বিক্ষিপ্ত মস্তিস্কটা নিশ্চিন্ত হলো তার। তবে গাড়ির চালককে এমন দ্রুত গতিতে ফাঁকা স্থানে গাড়ি চালানোর দায়ে গালাগালি দেওয়ার জন্য যেই না সে কিছু বলছে যাবে,তৎক্ষণাৎ রাওফিন এগিয়ে এসে বলল,,,
—–“স্যরি,স্যরি আ’ম রিয়েলি স্যরি। অ্যাকচুয়ালি, অ্যাকচুয়ালি আমি একটু স্ট্রেস ছিলাম, এজন্য আপনাকে নোটিশ করিনি। আ’ম রিয়েলি স্যরি ফর দ্যাট।”
লোকটার কন্ঠ আর উপস্থিতিতে হঠাৎই চারিধারে কেমন একটা অদৃশ্য অনুভূতি অনুভূত হল মাহার। হাজারটা গালাগালি মুহূর্তেই গুলিয়ে সে বলল,,,,—-“ইটস ওকে!”
ইটস ওকে? নিজের কথায় নিজেই বোকা বনে গেল মাহা, লোকটাকে তো সে বকবে, রীতিমতো ঝগড়া লাগিয়ে দিবে এমন কর্মকাণ্ডের জন্য ‌। তা নয় সে কিনা ‘ইটস ওকে’ বলছে? কি হলো তার? নিজের মনের সাথে নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে মাহা, হঠাৎই অপরপ্রান্তে থাকা পুরুষটি বলল,,,—–“আপনার নোটস তো সব নিচে পড়ে গিয়েছে। ওয়েট আমি হেল্প করছি!”
কথাটা বলে লোকটি যেই না মাহার নোটস-এ হাত দিতে যাবে তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে মাহা বলল,,,—“স্টপ, আপনার কিছু করা লাগবে না আমিই করছি।”

বলেই এক নিশ্বাসে সেখানকার পড়ে থাকা সবগুলো নোটস একসাথে গুছিয়ে, কয়েক মুহূর্তের মাঝেই সেখান থেকে প্রস্থান করল মাহা। যাওয়ার আগে শুধু একবার বলল,,,,—-“এরপর থেকে দেখেশুনে গাড়ি চালাবেন। আর দ্বিতীয়বার এমন হলে, ইটস ওকের পরিবর্তে অন্য কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।”
মাহা চলে গেল। রাওফিন মাহার দেওয়া শীতল ধমকানিতে, এখনো তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। কি অদ্ভুত না শ্যাম বর্ণের মেয়েটা? প্রথমে নিজেই ইটস ওকে বলে, পরবর্তীতে এমন অদ্ভুত ধমকানি ! আনমনে মুচকি হাসলো রাওফিন। কতদিন পর যে এমন প্রাণবন্ত হাসিটা ঠোঁটের কোণে ফুটেছে, হয়তো সে নিজেও জানেনা।
মুহূর্ত কয়েক পর গাড়িতে ওঠার জন্য, যেই না সে পা বাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টিগত হল পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটা। ফোনটা তুলে ‌সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। এটা কার? মনে করতে করতেই, তার স্মৃতির পাতায় দোলা দিল কিছুক্ষণ পূর্বের শ্যামবর্ণ মেয়েটির কথা! ওয়েট আ মিনিট! এটা ওই মেয়েটার নয় তো? সাতপাঁচ না ভেবে, রাওফিন সেটা হাতে রেখেই, গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চলল কাঙ্খিত গন্তব্যের দিকে।

শব্দের ঝংকার তুলে খোলা হলো খান মহলের গেইট। কংক্রিটের রাস্তাটা পেরিয়ে এগিয়ে চলল নীলের গাড়িটা। মূহুর্ত খানেকের মধ্যে সেটি থামলো পার্কিং এরিয়ায়। নীল স্বভাবতই তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে মহলে প্রবেশ করল। মুন্নিও ধীরে সুস্থে নামতে যাবে ঠিক তক্ষুনি তার দৃষ্টিগত হয় ক্যাশবোর্ডের ধারে অবহেলিত আসামির ন্যায় পরে থাকা গাজরাটা আর ফুলগুলোর দিকে।
সে মুচকি হেসে একবার নীলের যাওয়ার পানে তাকালো অতঃপর হাত বাড়িয়ে সযত্নে ফুলসহ গাঁজরাটা নিজের কাছে এনে‌ পরম আবেশে গাঁজরাটা পরে নিলো।

ড্রয়িংরুম প্রায় জনমানবহীন। মুন্নি ফুলগুলো নিয়ে গাঁজরা সজ্জিত হাতটার পানে মুগ্ধ দৃষ্টি রেখেই দোতলায় নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যেই দেখায় হয় তিহুর সঙ্গে। নীলের আগমনী বার্তায় দ্রুত রুমে যাচ্ছিল তিহু । মুন্নিকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তার, একপ্রকার না দেখার ভান করেই চলে যেতে গেলেই মুন্নি গাঁজরা পরিহিত হাতটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে শয়তানি হাসি হেসে বলল,,,,
———“দেখো সুন্দর না?”
বলেই একবার হাত ঝাঁকালো সে,তিহু বিরক্তি মুখে তাকাতেই সে ফের বলল,,,,
———“নীল দিয়েছে!”
অন্যান্য সময় নীল ভাই আর এখন নীল! মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল তিহুর। তার উপর নীল নাকি তাকে গাঁজরা কিনে দিয়েছে ! কোনো কথা না বলে তিহু সেখান থেকে চলে যেতে গেলেই, মুন্নি তার পথ আটকে, হাতের ফুল গুলো উঁচিয়ে বলল,,

———“এগুলোও…!”
থেমে গিয়ে,আবার করুন মুখ করে বলল,,,,—-“উফস,সো স্যরি নুরাইন । অ্যাকচুয়ালি আমারই না বোঝা উচিত ছিল…!তোমাকে নীল কখনো ফুল বা গাঁজরা, এগুলো দেয়নি না!আহারে মন খারাপ করো না।আসলে ও একটু এরকমই,যদিও আমাকে অনেকবার দিয়েছে…!”
তিহু যেতে যেতে থামলো। মুন্নির কথার জবাবে তার দিকে ফিরে বলল,,,,
———“আমি একদমই কিছু মনে করিনি বিশ্বাস করো। কারন আমি জানিই নীল একটু অন্যরকম। জনদরদী,ইভেন ও তো রাস্তার পাশের অবহেলিত কুকুরগুলোকেও নিজ দ্বায়িত্বে খাবার কিনে সযত্নে খাওয়ায়,মানবতার ফেরিওয়ালা কি না! আশা করি বোঝাতে পেরেছি।”
মুন্নি তার কথার মর্ম বুঝে নিশ্চুপ রইল। তিহু বাঁকা হেসে প্রস্থান করতে গেলে, মুন্নি ফের নির্লজ্জের ন্যায় বলে উঠলো,,,,

———“কথার জোরে জিততে চাইছো নুরাইন হক? বাট জেনে রাখো যত যাই করো না কেন, নীলকে পাওয়ার প্রচেষ্টায় আমি সর্বদা একধাপ এগিয়েই থাকব।”
তিহু চলতি পথে থামলো। মুন্নির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ হেসে বলল,,,,,—-“ইউ নো?আ’ম আ স্টুডেন্ট অফ ল’ডিপার্টমেন্ট । সো কথার জোরে জেতা,ইটস মাই প্রফেশন বেবজ। আর কি বললে তুমি? নীলকে পাওয়ার প্রচেষ্টা!হাহ!

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল তিহুর অধরজুড়ে। ফের বলল,,,—–“তোমার জানা উচিত এই নুরাইন হক কখনোই কাউকে পাওয়ার জন্য পা বাড়ায় না, বরং সবাই এই নুরাইনকে পাওয়ার জন্যই একপায়ে খাড়া হয়ে প্রস্তুত থাকে। যেমনটা নীল করছে! আর যেখানে আমি পা বাড়াইনি ,সেখানে একধাপ বা শত ধাপ,এগিয়ে থাকার কোনো প্রশ্নই উঠে না। বুঝেছ মিস চু্ন্নি!”
জিভ কাটলো সে, সংশোধনীর ন্যায় ফের বলল,,,—-“স্যরি মুন্নি!”
বলেই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা সেখান থেকে প্রস্থান করল তিহু। মুন্নি ক্রোধে রজ্ঞিত রক্তিম নয়ন জোড়া স্থবির করলো তিহুর যাওয়ার পানে। ফুঁসে উঠলো সর্পিনীর ন্যায়।

এদিকে রুমে আসতেই নীলের মনে পড়ল গাঁজরা আর ফুলগুলোর কথা। সে আবার সেগুলো আনার জন্য যেইনা রুম থেকে বের হতে যাবে, তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্ত তিহু ধুপধাপ পায়ে রুমে প্রবেশ করল। তাকে এমন রাগান্বিত দেখে নীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিহু বলে উঠলো,,,
——“কি হলো পেয়ারের মুন্নি কে মিস করছেন?”
নীল ভ্রু কুঁচকে বলল,,,,—–“মানে?”
তিহুর প্রশ্নটা পছন্দ হলো না যেন,ক্ষুব্ধ সৈনিকের ন্যায় সে বলে উঠলো,,—-“মানে আপনি বোঝেন না? দিনভর ডেটিং করেও তৃপ্তি হয় নি? আবার দেখার জন্য মন আকু-পাকু করছে?”
এবার মেজাজ হারালো ‌নীল।রেগে গিয়ে বলল,,,,—-“স্টপ টকিং লাইক ননসেন্স।”
তিহু:“এখন তো আমাকে ননসেন্স লাগবেই! যখন পেয়ারের মুন্নিকে গাঁজরা পরিয়ে দিচ্ছিলেন তখন নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগছিলো তাই না?”
তিহুর কথায় এবার থামলো নীল। সন্দিহান দৃষ্টিতে বলল,,,—–“ওয়েট কি বললা?”

তিহু নিশ্চুপ।
নীল ফের বলল,,,—–“আমি কাকে গাঁজরা পরিয়ে দিয়েছি?”
তিহুর ধৈর্যেরা এবার বাঁধ ভাঙল, ঘন‌ হলো নিঃশ্বাস, ক্ষিপ্ত বাঘিনী ন্যায় সে বলে উঠলো,,
—–“নাটক হচ্ছে?পেয়ারের মুন্নিকে গাঁজরা পরিয়ে এখন আবার নাটক! শেইম অন ইউ মিস্টার নীল,আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্যদের মতো নন। কিন্তু আপনি….!আপনি তাদেরই মতো। ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে! ছিঃ!”
তিহুর প্রথম কথাগুলোতে নীল রেগে গেলেও, শেষ কথাটায় থমকালো সে।চোখ সরু করে বলল,,,
—–“বউ?”
তিহু সজ্ঞানে নেই যেন। আনমনে ক্রোধিত কন্ঠে সে বলল,,,,,——“হ্যাঁ বউ!”
নীল:“কে বউ?”
তিহু:“আমি বউ!”
নীল:“কার বউ?”
তিহু:“আপনার…”

কথার মর্ম বুঝে থমকালো তিহু । ফিরল সজ্ঞানে,একে একে মনে করতে লাগলো এতক্ষণ যাবৎ কি কি বলছিলো সে। তৎক্ষণাৎ জিভ কেটে,একঝলক নীলের দিকে তাকালো সে। লোকটার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা স্পষ্ট। তিহুকে তাকাতে দেখেই বাম ভ্রুটা সামান্য নাচিয়ে সে বোঝালো,,,
———“বলো বলো!”
থামলো তিহু, দৃষ্টি হলো আরও তীক্ষ্ণ। বুঝলো নীল এতক্ষণ তার রাগের উসিলায় একে একে তার পেটের কথা সব শুনে নিচ্ছিলো। আর সেও গাধার মত সব উগলে দিচ্ছিলো। থমথমে মুখে সেখান থেকে প্রস্থান করতে গেলেই বাঁধা হলো নীল। চোখে অন্যরকম জ্যোতি, ঠোঁটে দুষ্টু হাসির রেখা আরো গাঢ় করে,ফিসফিসিয়ে বলল,,,,
——“আর ইউ জেলাস।”
তিহু সবে দু’কদম এগিয়েছে কি এগোয় নি। নীলের এমন কন্ঠে থামলো সে । মুখে রাগী রাগী ভাব টেনে বলল,,,
—–“আমার অত ফালতু সময় নেই। ”
নীল ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,,,—–“গুড!”
তবে তাকে অবাক করে দিয়ে পরক্ষনেই তিহু ফের বলল,,,,—–“আমি জেলাসিতে নয় জ্যা*ন্ত ক*ব*র দিতে বিশ্বাসী!”

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১২

নীল থ বনে গেল,তিহুর এমন কথায়। তবে পর মূহুর্তেই পরিবর্তিত হলো আনন, বাহবার সুরে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,—–“দ্যাটস লাইক মিসেস খান সাহেবা।মাই ডেয়ার ওয়াইফি!”
তিহু ততক্ষণে রুম ত্যাগ করেছে। নাহলে হয়তো সে দেখতে পেত, একজোড়া নীল চক্ষু কিভাবে মুগ্ধতার সাগরে অবগাহন করছিলো তাকে নিয়ে।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here