প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৪

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৪
নওরিন কবির তিশা

তিহু ধুপধাপ পা ফেলে সোজা রাফার রুমের সামনে এসে থামে । কোনরূপ অনুমতি না নিয়েই সোজা ঢুকে পড়ে ভেতরে, অবশ্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই কেননা রাফার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ গভীর । তবে ভেতরে ঢুকেই হচকিত হয় তিহু, কেননা সেখানে রাফা আর নীরার সাথে উপস্থিত নিহিতও। ছেলেটাকে এর আগে অনেকবার দেখলেও কখনো কথা হয়নি তার সাথে । তাই ‌নিহিতকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে সে।
তবে তাকে দেখে কোনো রকম জড়তা ছাড়াই নিহিত বলে,,,,

—–“আরে,ভেতরে এসো।”
তিহু কিছুটা অপ্রস্তুতি হেসে রুমে প্রবেশ করতেই নিহিত ফের বলে উঠে,,
———“আমাকে দেখে চলে যাচ্ছিলে?”
তিহু:“আসলে..”
নিহিত:“কিসের আবার আসলে নকলে!”
রাফা:“আসলে বউমনি কখনো তোমার সাথে কথা বলে নি তো । তাই হয়তো..!”
নিহিত:“ওহ এই ব্যাপার!”
তিহু:“হুম।”
নিহিত:“এইটা কোনো কথা? অ্যাকচুয়ালি আমি তো স্কোপ পাইনি কথা বলার এজন্যই।”
তারপর সে নিজের ডান হাতটা তিহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,,,—-“বাই দ্যা ওয়ে আমি নিহিত,ওয়াহিদ খান নিহিত। এই বাড়ির ছোট ছেলে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিহুও জবাবের নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে, হ্যান্ডসেক করে বলল,,,—“আমি নুরাইন, নুরাইন হক তিহু।”
হ্যান্ডসেক শেষে নিহিত চিন্তিত ভঙ্গিমায় বলল,,,—“সে না হয় বুঝলাম,তবে তোমায় আমি ডাকব কি।”
‌ ‌ তার কথার জবাবে রাফা কিছু না ভেবেই বলল,,,—“ওমা,এ আবার কেমন প্রশ্ন? তুমিও বউমনি ডাকবা!”
তিহু:“এই না না, আই থিংক আমি তোমার বয়সী। বউমনি বললে একদম ভালো শোনাবে না, তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো।”
নিহিত: “নু-রা-ই-ন, ওরে বাবা এত্ত বড় নাম! এ তো আমার মনে হচ্ছে কতদিন ধরে শুধু মুখস্ত করা লাগবে।”
তিহু,নিহিতের এমন কথায় হেসে বলল,,—-“আমার আরো একটা নাম আছে,তিহু । তুমি চাইলে আমাকে ওই নামেই ডাকতে পারো, আমার সব ফ্রেন্ডরা আমাকে ওই নামেই ডাকে।”
নিহিত:“উম… এটা ঠিক আছে।”
তিহু এক ঝলক সবার দিকে তাকালো। সকলের পরিধানে নতুন জামা আর সবার সাজগোজ দেখে সে বলল,,,—“তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ?”

রাফা ঝটপট উত্তর দিয়ে বলল,,,—“হুমম, আজকে তো উত্তরায় একটা মেলা আছে। তুমি জানো না? আমরা তো ভেবেছিলাম,তুমি ভাইয়ার সাথে যাবে । এজন্য কিছু বলি নাই।”
তিহু:“কই না তো । আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা।”
নিহিত: “কি বলো? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ভাইয়ার সাথে যাবে। এজন্যই তো রাফা আর নীরাকে বারণ করেছিলাম তোমার ওখানে যেতে। কেন তোমাকে ভাইয়া কিছু বলেনি?”
তিহু মনে মনে মুখ বাঁকিয়ে বলল,,,—“উনি আমাকে কি বলবেন? সারাদিন তো ওই চুন্নিটার সাথে ব্যস্ত ছিলেন.” মুখে বললো,,—“না, আই থিঙ্ক ওনার মনে নেই!”
রাফা:“তাহলে তুমি আমাদের সাথেই চলো। তোমাকে
রেখে আমরা যাচ্ছি না। কি বলিস নীরা?”
নীরাও সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকালো,বলল,,,—-“হ্যাঁ হ্যাঁ!”
এবার নিহিতও সম্মতি জানালো তাদের সাথে।তিহু পড়ল মহাবিপদে। এদেরকে এখন কি করে বোঝাবে? যে সে একটু আগেই নীলের সাথে ঝগড়া করে এখানে এসেছে। তার কথা না শুনেও তিনজন মিলে হাঁটা লাগালো নীলের রুমের উদ্দেশ্যে। তিহু কি করবে বুঝতে পারল না, দিক-বিদিক হারিয়ে সে নিজেও এগিয়ে চলল তাদের সাথে।

নীলের রুমের সামনে এসে থমকালো তারা, এই একটা মানুষকে য’মের মতো ভয় পায় বাড়ির সকলে। একে অন্যের সাথে খোঁচাখুঁচি করতে লাগলো কে রুমে আগে যাবে। কেউই সাহস করে দরজায় টোকাটাও দিতে পারছে না। রাফা নিহিতের দিকে ফিরে বলল,,—-“খুব তো চোটপাট, দেখাচ্ছিল এবার যাও। গিয়ে বলো বউ মনি কে আমরা সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”
নিহিত:“মারবো টেনে এক চড়। তোর এত সাহস থাকে তাহলে তুই যা না।”
রাফা:“আমি কখন বললাম আমার অনেক সাহস? বরং তুমিই তো বেশি ভাব নিয়ে আসলে!”
তারা যখন এমন ঝগড়ায় ব্যস্ত তখনই হুট করে দরজা খুলল নীল। তাদেরকে দরজার সামনে এমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকালো। অন্যদিকে তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে বোকার মত দাঁত কেলিয়ে হাসলো নিহিত। নীল সন্ধিহান দৃষ্টিতে বলল,,,—-“কি হলো এভাবে ক্যাবলার মত হাসছিস কেন?”

নিহিত:“আসলে ভাইয়া… হয়েছে কি ওই যে!”
নীল:“কি হয়েছে?”
তৎক্ষণাৎ পিছনে এসে দাঁড়ালো তিহু। তাকে দেখে নীল নিহিতের দিকে তাকিয়ে বলল,,,—-“তুই কি বলবি নাকি আমি চলে যাব?”
রাফা:“আসলে ওই যে উত্তরায় একটা মেলা হচ্ছে না। ভাইয়া আমরা না, বউ মনিকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই দম নিলো রাফা। নীল তিহুর দিকে চেয়েই রাফার উদ্দেশ্যে বলল,,,—-“ওকে ‌তোরা রেডি হয়ে আয় । আমি নিচে অপেক্ষা করছি!”
সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল নীল তাদের কথা একবারেই রেখেছে দেখে। অতঃপর তিহুর দিকে ফিরে, রাফা বলল,,,,—-“বউমনি তুমি রেডি হয়ে নাও! আমরা আসছি।”
সেখান থেকে চলে গেল তারা। তিহু মুখ কুঁচকে তাকালো নীলের দিকে। নীল তার পাশ কেটে যেতে যেতে বললো,,,—-“প্লিজ শাড়ি পরবেন না সাহেবা!”
তিহু একই ভঙ্গিমায় তার দিকে তাকালো। নীল আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা দাম্ভিকতা বজায় রেখে হেঁটে চলে গেল। যেন সে কিছু জানেই না।

নীল গাড়িতে অপেক্ষা করছে বেশ অনেকক্ষণ হলো। হঠাৎই আনমনে একবার মহলের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেল তার। তিহুর পরনে, ডার্ক মেরুন কালার পাকিস্তানের থ্রি পিস, যার ভাঁজে ভাঁজে সুক্ষ এমব্রয়ডারীর কারচুপি। হালকা রঞ্জকে আবৃত অধরজোড়া, ডাগর ডাগর চোখ দুটোতে চিকন করে দেওয়া আইলাইনার। একেবারে সাধারণ, তবে নীলের চোখে তা অসাধারণত্ব কে ছাঁপিয়ে যাচ্ছে। অপলক সেদিকে তাকিয়ে থাকাকালে, হঠাৎ নিহিত এসে গাড়ির গ্লাসে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,,,

—–“ভাইয়া? তোমরা কি গাড়িতেই যাবা! না মানে আমি চাচ্ছিলাম বাইকে যেতে!”
নিহিতের ধাক্কায় ধ্যান ভাঙল নীলের‌। সৎবিৎ ফেরার ন্যায় সে বলল,,,
———“না না। বাইকে করে একদম যাওয়া চলবে না। সোজা গাড়িতে গিয়ে বস।”
নিহিত মন খারাপ করে গাড়িতে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো রাফা আর তিহু। নীরাকে দেখতে ‌না পেয়ে নীল বলল,,,
—-“নীর কোথায়?”
রাফা গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল,,,—-“আর বোলো না ভাইয়া। লাস্ট মোমেন্টে এসে তার এক বান্ধবী তাকে ফোন দিয়ে বলছে,কাল তার কেমিস্ট্রি এক্সাম আছে। ক্লাস টেস্ট তাও,সে অত্যন্ত সিরিয়াস। সেজন্যই আর যাবে না। বউমনি কত করে বললো!”
পড়াশোনার ব্যাপারে নীল সর্বদাই অত্যাধিক তৎপর। তাই আর বেশি কিছু বলল না সে । তিহু রাফার পাশে বসতে যেতেই নিহিত বলল,,—-“তুমি এখানে বসছো কেন? তোমার না ভাইয়ের পাশে বসার কথা!”
তিহু মুখ কুঁচকে তাকালো নীলের দিকে । নীল স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলল,,,—-“নিহিত যা করবি দ্রুত কর। আমার হাতে আর টাইম নেই।”
তিহু বুঝল এখানে রাগারাগি করাটা ঠিক হবে না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে গিয়ে নীলের পাশে বসলো। নীল এক ঝলক তার দিকে তাকিয়ে,ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল।

অজ্ঞাত কন্যার ফোন নিয়ে,রাওফিন পড়েছে মহা বিপাকে। একের এক, কাল এসেই চলেছে তাতে। বিরক্ত হয়ে এবার, ফোনটা সাইলেন্ট করার জন্য সেটি হাতে নিল সে। স্ক্রিনে একঝলক তাকিয়ে সাইলেন্ট মুড অন করে,ফের মনোনিবেশ করলো গাড়ি চালনায়। হঠাৎই ভ্রু কুঁচকে আসলো তার। মনে হলো ফোনটার লক স্ক্রীনে বহু কাঙ্খিত কিছু দেখেছে সে।
তৎক্ষণাৎ ফোনটা হাতে নিয়ে, একবার অন করতেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো এক শ্যাম কন্যার সুশ্রী মুখশ্রী। কিয়ৎক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করলো রাওফিন। চেনার সঙ্গে সঙ্গেই, স্টিয়ারিং এ থাকা হাতটা থমকে গেল হলো তার, শিথিল হলো কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয়, আকুল হলো দৃষ্টি ‌। ফিসফিসিয়ে সে বলে উঠলো,,,—-“মাহা!”

মাহা! হ্যাঁ,মাহাই তো। তার শ্যামাঙ্গিনী, মায়াবিনী, তার হৃদয়হরনী। তবে ফোনটা মাহার, তাহলে কি?তাহলে কি?তখনকার মেয়েটা মাহাই ছিল?
“শিট,শিট, শিট!”———স্টিয়ারিং এর উপর রাখা হাতটা দিয়ে সজোরে তাতে আঘাত করল রাওফিন।
এত বড় ভুল তাকে দিয়ে কিভাবে হল বুঝতে পারল না সে। সারা শহর জুড়ে যাকে খুঁজে বেড়ালো, তাকে এতটা কাছাকাছি দেখেও চিনতে পারল না? কি করে এতটা বেকুবের মত কাজ করলো সে! নিজের ওপরই নিজের রাগ হলো রাওফিনের। অবশ্যই এটা স্বাভাবিকই,কেননা মাহার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছে আজ থেকে আরও বছর পাঁচেক আগে ।
যখন মাহা নিতান্তই কিশোরী। আর এখন?১৯ বছরের ‌সুশ্রী তরুণী! প্রথম দেখায় তাকে চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক। তবে তাও নিজের উপর অভিযোগের শেষ নেই রাওফিনের।কেন?কেন?কেন!কেন চিনলো না নিজের প্রেয়সীকে!

গাড়ির গতি মন্থর, আর কিছু মুহূর্ত। তারপরেই তারা পৌঁছাবে কাঙ্খিত গন্তব্যে। তাই আপাতত গাড়িটা ধীরে চালানোই যুক্তিযুক্ত মনে করছে নীল। এদিকে তিহু থ’মেরে ‌বসে আছে, সেই তখন থেকে । নীলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বারংবার তিহুর মিষ্টি মুখশ্রীতে নিবদ্ধ হচ্ছে। চাইলেও নিজেকে সামলাতে পারছে না নীল। হঠাৎই তিহু এক ঝলক তার দিকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফেরালো নীল। মনোনিবেশ করলো ফের ড্রাইভিং এ। তবে সেটা শুধুই লোক দেখানো, তার মন পরে আছে এখনো তিহুর আরক্তিম মুখশ্রীতে।
এদিকে ব্যাকসিটে লেগেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নিহিত কথায় কথায় রাফা কে ভাঙাচ্ছে, আর রাফাও খেঁপছে স্বভাবত। শেষমেষ না পেরে মেজাজ হারিয়ে রাফা, নখ বসিয়ে দিল নিহিতের হাতে। বেচারা ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে, যখনই তাকে কিছু বলতে যাবে, তৎক্ষণাৎ গাড়ির ব্রেক কষলো নীল। অর্থাৎ গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে তারা। নিজের উদ্দেশ্য সফল না হতে পেরে, মুখ কুঁচকালো নিহিত। রাফা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে, তাকে ভেঞ্চি কেটে এগিয়ে চলল নীলদের সাথে।

মেলায় এসে থমকালো তিহু। এর আগে কখনো এমন লোক সমাগম দেখেনি সে। অবশ্য টেলিভিশন আর মোবাইল ফোনে এমন জিনিস অহরহ। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে কখনোই, এমন জায়গায় আসা হয়নি তার। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে কিনা! মনে পড়ে সেবার ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পরও বাবা,বিশেষ করে চাচারা তাকে আসতে দিতে চায়নি। তবে তিহুর মায়ের কথায় আর মাহার উপর ভরসা রেখেই একপ্রকার এখানে আসতে পেরেছে সে। নতুবা ঢাবিতে ল পড়ার ইচ্ছা, পুরোটাই জলাঞ্জলি যেত তার।
এত লোকজনের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র জীব সে,তবে হঠাৎই সে খেয়াল করে তার নরম কোমল হাত কারো শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ। পাশে না তাকিয়েই বুঝতে পারে, গম্ভীর পুরুষটির উপস্থিতি। তিহুর বেশ লাগছে, ইচ্ছা করছে মেলার প্রতিটি জিনিস নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখতে। একটা চুড়ির দোকানের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে। ছোটবেলা থেকেই শাড়ি আর চুড়ি, এই দুইটা জিনিসের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত সে।

অবশ্য প্রতিটি বাঙালি মেয়েরই অত্যন্ত শখের জিনিস এই দুটি। তিহুর সঙ্গে, সেখানে গেলো নীল নিজেও। নেতা হওয়ার দরুন তাকে সব জায়গায় তত একটা দেখা যায় না। তবে আজ প্রসঙ্গ সম্পন্ন ভিন্ন। অবশ্য সন্ধ্যা নেমে আসায় এত লোকজনের ভেতর, তার উপস্থিতি ততটা লক্ষ্যগত নয়।
বাহারি রকম চুড়ির মেলা বসেছে সেথায়, রেশমি চুড়ি কাজের চুড়ি! হাজারটা চুড়ির সেই সাম্রাজ্যে,মুগ্ধ তিহুর নয়ন জোড়া। হঠাৎই তা আটকালো একজোড়া গাঢ় নীল রঙা কাঁচের চুড়িতে। সে চুড়ি জোড়ার দিকে হাত উঁচিয়ে দেখাতেই দোকানের ছেলেটা, সেগুলো হাতে এনে তিহুকে পড়াতে যেতেই এক লহমায় সেগুলো লুফে নিল নীল। অতঃপর নিজে সযত্নে এগুলো পরিয়ে দিল তিহুকে।

তিহু চোখ সরু করে, মুচকি হেসে তাকালো নীলের পানে। লোকটা কি জেলাস? যাই হোক, তাকে এইরূপে বেশ লাগছে তিহুর। চুড়ির সাথে একজোড়া পাথরের দুলও কিনলো তিহু। সেগুলোও নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিলো নীল। অতঃপর রাফা আর নীরার জন্য বেশ কিছু, জিনিস কেনাকাটা সারলো কপতো-কপতি।
কেনাকাটার পাট চুকিয়ে,তিহু সোজা এগিয়ে চলল সামনের ফুচকার স্টলটার দিকে। ফুসকা ওয়ালা লোকটা তিহুর পরিচিত। ভার্সিটির সামনে প্রতিদিনই, ফুচকা বিক্রি করেন তিনি। তিহুকে দেখে আন্তরিক হেসে সে বলল,,,

———“কি ব্যাপার মা? এখানে?”
তিহু:“এইতো আঙ্কেল। ঘুরতে এলাম!”
ফুচকা ওয়ালাটা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,,,—“মাহা মা নাই?”
তিহু:“না আঙ্কেল, আমি অন্য একজনের সাথে এসেছি।”
ফুচকা ওয়ালা:“ওহ আচ্ছা। তো তুমি প্রতিদিনের মতো ঝাল ফুচকা খাবে তো?”
তিহু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই তিনি ফুচকা তৈরীর কাজ শুরু করলেন। এদিকে হঠাৎই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো নীল। তিহুকে সেখানে দাঁড়িয়ে ফুচকার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে এর রাগী কণ্ঠে বললো,,,
—-“এখানে আসছো । বলে আসবা না স্টুপিড?”
তিহু এক ঝলক তার দিকে তাকালো। অতঃপর এমন একটা ভাব করলো, যেন তার কোন দোষই নেই। এদিকে ফুচকা তৈরির কাজ শেষে, ফুচকা ওয়ালা তিহুর কাছে ফুচকার প্লেটটা দিতেই, ভক্তি ভরে সেটি খেতে শুরু করলো তিহু। নীল শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সেথায়।
খাওয়ার মধ্যিখানে, নীলকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎই একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তিহুর মস্তিষ্কে।সামান্য দুষ্টু হেসে সে নীলের দিকে ফিরে, নরম-কোমল-মিষ্টি কন্ঠে বলল,,,

—“একটা খাবেন? প্লিজ!”
তার কন্ঠে যেন আবেদন ঝরে পড়ল, মাধুর্যময় সে কন্ঠকে নীল শত চেষ্টায়ও প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সে তাকালো। তিহুও মুচকি হেসে একটা ফুচকা এগিয়ে দিল তার দিকে। গম্ভীর নীল সেটা গ্রহণ করলো ঠিকই, তবে মুহূর্ত কয়েকের মাঝেই তার চেহারায় আসলো আমুল পরিবর্তন।
ঝালের তোপে চোখমুখ লাল হয়ে গেল তার। তিহু তার এমন অবস্থায় ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো, সে খুব ভালো করেই জানে নীল ঝাল খেতে পারে না। আর ফুচকাতেও আজকে ঝাল খুব, ইচ্ছা করেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে সে। মুখ চেপে হাসতে থাকা তিহুর দুষ্টু হাসির হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল, যখন দেখলো নীলের পুরো মুখাবয়ব রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটো দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে।

তার এই করুন অবস্থায়, অনুশোচনার সাগরে ডুব দিল তিহু। নিজের কাছেও বেশ খারাপ লাগলো, ঝাল প্রেমি হওয়া সত্ত্বেও, আজ ঝালে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। সেখানে নীল তো ঝাল খেতেই পারে না। কি করবে বুঝতে পারল না তিহু। দিক-বিদিক হারিয়ে, অসহায় কণ্ঠে সে বলল,,,—–“ঝালটা কি বেশি লেগেছে?”
অতঃপর আশেপাশের চেয়ে পানির সন্ধান করতে লাগলো সে। সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা শরবতের দোকান দেখে দ্রুত সেটিকে এগিয়ে যেতে গেলেই হাতে কারো প্রবল বাঁধনের টান অনুভূত হয় তার। পিছন ঘুরে দেখতে পায় নীল শক্ত হাতে আবদ্ধ করেছে তার ডান হাতটা। তিহু ভীত কন্ঠে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, নীল তাকে সেখান থেকে কিছুটা দূরে, একটা ফাঁকা নির্জন স্থানে নিয়ে গেল।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৩

মেলা থেকে বেশি দূরে না হওয়ায় কোলাহলপূর্ণ স্থানটি গোধূলির রক্তিম আলোয় আলোকিত। তবে লোকজন একদমই নেই সেথায় । তিহু অসহায় কণ্ঠে বললো,,—“এখানে আনলেন কেন? পানি আনতে যাচ্ছি…”
তার কথা শেষ হলো না, হঠাৎই নিজের নরম কোমল অধরে কারো আকষ্মিক আক্রমণে কম্পিত হল তার তরু দেহ। থর থরিয়ে কেঁপে উঠল ক্ষীন কায়া, ছন্দ হারালো হৃদযন্ত্রটা। ঘটনার আকস্মিকতায় মনে হলো চোখ দুটো এক্ষুনি কোটর থেকে বের হয়ে আসবে তার। মুহূর্ত কয়েকের মাঝে অনুভূত হলো, কোমরে কোনো শক্তপোক্ত পৌরুষিক স্পর্শ। মনে হলো, ভূমি থেকে সামান্য উপরে, হাওয়ায় ভাসছে সে।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here