প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২০

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২০
নওরিন কবির তিশা

রাত হয়েছে বেশ, ঘড়ির কাঁটায় দশটা চলমান।মাহা রাওফিনের সাথে সন্ধ্যার পরপরই এসেছিল ‌। যার দরুন বাড়ির সকলের সাথে বেশ ভালো আলাপচারিতা হয়েছে তার। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে রাওফিনের মা শুধু তার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে, সম্ভবত চিনতে পারেনি।
তবে একটা জিনিস খুব ভালোভাবে আবিস্কার করেছে মাহা, এবাড়ির প্রতিটা সদস্যই অমায়িক। বিশেষত মির্জা সায়মা আর রুমিন আরা খান। মির্জা সূচনা একটু কঠোর স্বভাবের, তবে অনেক স্নেহময়ী আর যত্নশীল।
তিহু আর নীল ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে।খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ির সব নবীনেরা নাহা’র ঘরে উপস্থিত। এটা চিরচরিত ঘটনা, প্রতিদিনই খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর আগে সবাই একবার নাহা’র রুমে আড্ডা দেয়। হঠাৎই নিহিত বলল,,

“কি করা যায় বলোতো?
রাফা:“কি আর করবে? তুমি তোমার রুমে যাও। এতগুলো মেয়ের মধ্যে তোমার কি হ্যাঁ?
নিহিত:“থাপড়াইয়া কান লাল করে দিব। চুপচাপ বস।
রাফা:“পারোতো খালি ওইটাই।
নাহা:“আহ,কি হচ্ছেটা কি? থামবি তোরা? মনে নেই আজকে আমরা মাহার সাথে গল্প করব।
রাফা:“সেটা তো আমি জানি। কিন্তু দেখো নিহিত ভাই কি করে।
তিহু:“তাহলে এভরিঅন, ডিসিশন ফাইনাল তো? যে কালকে আমরা একটা গাড়িতেই যাব।
নাহা:“উমম, সেটাই তো জানতাম। কিন্তু আমার বউ পাগলা ভাই কি তার বউকে আমাদের সাথে যেতে দিবে?
তার সাথে এবার সায় মেলালো মাহাও।
“হুম। যে পিরিত দেখছি।
তিহু কটমটিয়ে তাকাতেই নাহা আর মাহা একেবারে দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মূলত বাড়ির সব নবীনদের সাথে এই কয়েক মুহূর্তের মাঝেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মাহার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিহু:“মাহার বাচ্চা।
মাহা:“আমার বাচ্চা নাই।
রাফা:“বউমনি ওসব বাদ দাও, তোমাদের একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস বলবো?
তিহু মাহার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, রাফার দিকে তাকালো। রাগ সংবরণের চেষ্টা করে বলল,,,
“হুম,বলো।
“একটা জিনিস জানো? রাওফিন ভাইয়ার একটা গার্লফ্রেন্ডের নামও মাহা ছিল । নাহা আপুও তো জানে। বলো আপু?
সে নাহার দিকে তাকালো।নাহা’র চোখে মুখে বিষ্ময়। কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করে সে বলল,,
“কে বলতো?

“ঐযে,যাকে আম্মু বকেছিলো বলে,ভাইয়া রাগ করে কানাডা চলে গেছিলো পড়াশোনার জন্য।
এত কিছুর মাঝে অপ্রস্তুত হয়ে ওঠেছে মাহা। এদিকে তিহু বিষ্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার মানে কি, তার মানে সে যা ভাবছে তাই! কিন্তু কেমনে কি? মনে চলা হাজারটা প্রশ্নকে দমিয়ে রেখে সে রাফার উদ্দেশ্যে বলল,,,
“মানে? ব্রাদার কোনো মেয়ের জন্য, কানাডা চলে গিয়েছিল?
“হ্যাঁ তো। ও তোমাকে তো বলা হয়নি, ভাইয়ার কোচিংয়ে একটা মেয়ে ছিল….
কথা শেষ করতে পারল না সে। নিহিত তার মাথায় সজোরে গাট্টা দিয়ে বলল,,,
“পাকনামির পরিমাণটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
রাফা গাট্টা মারা স্থানে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“আমি মিমিয়ার কাছে বিচার দিব দেখো। অভিশাপ দিচ্ছি তোমায় জীবনে তোমার বিয়ে হবে না।
নিহিত বিড়বিড় করে বলল,,,“বউ তো স্বয়ং আমার সামনেই বসে আছে!
এতটাই আস্তে যে কেউ সেটা বুঝতেই পারল না। রাফা নিশ্চিত হতে বলল,,,“কি বললে?
“কিছু না। চুপ কর নাহলে আরো একটা গাট্টা খাবি।
তিহু স্থির হয়ে আছে। তারমানে তার ব্রাদার রাওফিনই সেই রাওফিন। এজন্যই মাহা আগের দিন আসতে চাচ্ছিল না, অদ্ভুত বিহেব করছিল। সবটা স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় স্পষ্ট তিহুর সম্মুখে। আলাদা করে আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।সে একবার মাহার দিকে তাকালো, মেয়েটার চোখে মুখে এখনো অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।তিহু বুঝলো না কি করবে। তৎক্ষণাৎ নাহা বলল,,,

“বাদ দে তো ওসব। দেখ মাহা নিজেও কি পরিমান অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। তোরাও না!
সে মাহার দিকে ফিরে বলল,,“প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, মাহা। অ্যাকচুয়ালি ওরা অমনই।
মাহা আলগাছে মাথা নাড়লো।হুট করে তার দৃষ্টিগত হলো দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো কাউকে । চোখ কুঁচকে তাকালো সে, তাকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো তিহু নিজেও। সঙ্গে সঙ্গে দন্ডায়মান ছায়া মূর্তিটি প্রস্থান করল সেখান থেকে। তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকালেও, মাহা ঠিকই চিনতে পারল তাকে।
“রাত তো অনেক হলো। আম্মু আবার বলেছে সকাল সকাল রওনা দিবে, তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়া যাক? নিহিত, তুই নিজের রুমে যা।
নাহা’র কথায় তার দিকে তাকালো সকলে।
নিহিত:“ওকে।
ভদ্র ছেলের মত বেরিয়ে যেতে যেতে সে আবারো ফিরে এলো। রাফার দিকে তাকিয়ে বলল,,,“তুই যাবি না?

“হু!
রাফা নাহা ,মাহা আর তিহুর দিকে ফিরে বলল,,,“আচ্ছা আমি বরং যাই।
বেরিয়ে গেল তারা দুজন। পরপর মায়ের ডাকে গেল নীরা।তারা যেতেই নাহা বলল,,,“বউমনি, তুমি বরং রুমে যাও। আমি আর মাহা এখানে ঘুমিয়ে পড়বো।
“কেন বলোতো? আমিও আজকে তোমাদের সাথেই ঘুমাবো।
“কি বলো? ভাইয়া যদি….
তাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই তিহু হাত নাড়িয়ে বলল,,“আরে চুপ করো তো। আমি এখানেই ঘুমাবো কেউ কিচ্ছু বলবেনা। তোমরা বরং রেস্ট নিতে লাগো, আমি রুম থেকে পাশবালিশটা নিয়ে আসি।
বলেই দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল সে।

রুমের সামনে এসে থমকাল তিহুর পদচরণা। কারণ একটাই, ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে নীলের গর্জন।
“ইডিয়েট, তোদেরকে আমি ওটা বলেছিলাম? স্টুপিটের দল একটা কাজ যদি ঠিকমতো করতে পারিস। জাস্ট শাট আপ!
তিহু সামান্য একটা ঢোক গিলল। আল্লাহ জানে কার কপালে, এত সুন্দর সুন্দর কথা গুলো জুটছে? যার কপালে জুটুক তার কি! সে বিন্দাস ভঙ্গিমায় রুমে প্রবেশ করল। নীল অপর পাশে ফিরে কথা বলছিল, তাকে দেখেও একপ্রকার না দেখার ভান করল তিহু।

“শাট আপপপপপ!
নীলের চিৎকারে কিছুটা কেঁপে উঠল তিহু। একবার পিছন ঘুরে তার দিকে তাকালো, এখনো ফোনে কথা বলছে সে। তিহু তিনবার বুকে আলতো থাপ্পড় দিয়ে,বিড়বিড় করে বলল,,,
“আল্লাহ গো। চিৎকারে মনে হচ্ছে এবার, পুরো খান মহলই কেঁপে যাবে।
সে চটজলদি পাশ বালিশটা কোন মতে হাতে নিলো। অতঃপর বেরিয়ে যেতে নিতেই পেছন থেকে কোনো কিছু যেন তার ওড়না টেনে ধরল। তিহুর চোখগুলো সামান্য বড় হলো।লজ্জায় আরক্ত হলো ফর্সা মুখশ্রী।
“কি করছেন টা কি?
বলে পিছন ঘুরতেই সে দেখতে পেলো নীল এখনো অপর পাশে ফিরে কথা বলছে, ইস কি লজ্জার ব্যাপার ! নীল তো তার ওড়নাটা ধরেও নি। আল্লাহ! নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা দিলো তিহু। অতঃপর ওড়না ছাড়াতে যাবার জন্য পা বাড়াতেই, বিছানার পাশে বেঁধে থাকা ওড়নার কোনাটা খপ করে ধরল নীল।

“কোথায় যাচ্ছ?
“নাহা’র রুমে।
নীল ওড়নাটা ছাড়িয়ে নিজের হাতে শক্ত করে ধরল। সামান্য পেঁচিয়ে নিল সেটা হাতের সাথে,,,
“কেন?
“ঘুমাবো!
“এই রুমে কি প্রবলেম?
“এই রুমটাই পুরোটা প্রবলেম”——বিড়বিড় করে বলল তিহু।
“কি বললে?
“কিছু না।
“চুপচাপ লাইট অফ করে এসে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।
“আমি নাহা’র রুমেই ঘুমাবো। ছাড়ুন আমার ওড়নাটা।
“নুর!
“আস্তে বলুন আমার কানে সমস্যা না।
“বাড়াবাড়ি করো না একদম।
“যদি করি তো?

তার মুখের কথাটা মুখেই থাকলো, নীল হাতে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা সজোরে নিজের দিকে টান দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিহুর বুকে জড়ানো ওড়নাটা স্থান পেল তার শৈল্পিক হাতে। তিহু বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে, দ্রুত হাতে রাখা পাশবালিশটা দিয়ে নিজেকে আবৃত করল। নির্জনে একাকি থাকাকালীনও কখনো ওড়না খুলে না সে, আর এখানে তো স্বয়ং নীল তার সামনে দাঁড়িয়ে । লজ্জায় মিনমিনিয়ে সে বলল,,,
“ওড়নাটা দিন।
তাকে এমন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যেতে দেখে, নীল ওড়নাটা হাতের সাথে পেঁচাতে পেঁচাতে বাঁকা হেসে বলল,,,
“সামান্য ওড়না খোলাতেই তোমার এই অবস্থা? এই সাহস নিয়ে তুমি আমার সাথে তর্ক করো?
ফের বাঁকা হাসল নীল, তবে এবার সামান্য শব্দ করে।

“আপনি আমার ওড়নাটা দিবেন কিনা?
“যদি না দেই?
“চিৎকার করবো কিন্তু আমি!
“নো প্রবলেম, আমার রুমটা সাউন্ড প্রুফ। সারা জীবন চিল্লালেও বাইরের একটা জড় পদার্থ তাও শুনতে পাবে না।
সে ওড়নাটা হাতে রেখেই পিছন ঘুরে ভাবলেশহীন ভাঙ্গিমায় ল্যাপটপ খুলতে গেল।
“দেখুন, আমি কিন্তু এবার সত্যি আপনাকে কামড়ে দিব।
“ওহ,শাট আপ লিটল গার্ল, সবসময় শুধু ভয় দেখাও কেন? কাজটা করতেও তো পারো।
“আপনি আমার ওড়নাটা দিবেন কিনা?
“উম…ম নিজে এসে নাও।
তিহু উপায়ান্তর পেল না। খানিক বিরক্ত আর লাজুক ভঙ্গিমায় পাশ বালিশটা সামনে শক্ত করে ধরে, এগিয়ে এসে নীলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,,,

“দিন।
নীল সবে সোফাটাতে বসেছে, তিহুকে সামনে দাঁড়ানো দেখে তার আপাদমস্তক নিবিড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলল,,
“বিউটিফুল!
কথাটা এত্তই আস্তে বলেছে সে, যে তিহু কিছু বুঝতেই পারেনি। শুধু দেখতে পেয়েছে তার গোলাপি ঠোঁটের হালকা সঞ্চালন।
“কি হলো? দিন তো!
সে হাত বাড়িয়ে রাখলো, নীল ওড়নাটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে, তিহুর হাতের দিকে এগিয়ে দিল। তবে এবার একটা দুষ্টু চাল চালল নীল,তিহু যক্ষুনি ওড়নাটা নিতে তার দিকে সামান্য এগিয়ে এলো, তৎক্ষণাৎ নীল নিজের পা’টা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হোঁচট খেয়ে নীলের ওপর পড়লে সে। ভারসাম্য হারিয়ে নীল পরল সোফার উপর, আর তিহু তার বুকের উপর।

“স্যরি,স্যরি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”——লাজুক আর অপ্রস্তুত কন্ঠে কথাটা বলেই তিহু উঠতে যাবে ঠিক তখনই রুমের সমস্ত আলো নিভে যায়। কিছুটা ভরকে সে আবার পরে নীলের প্রশস্ত বুক খানার ওপর, কিছুটা খামচে ধরে বুকের কাছে থাকা টি শার্ট টা। নীল সামান্য বাঁকা হেসে স্পর্শ করে তিহুর, পাতলা কোমরটা।
অদ্ভুত ভঙ্গিমায় কেঁপে ওঠে তিহু। তার মনে পড়ে, পাশ বালিশটা নিচে পড়ে গিয়েছে। আর সে ওড়না বিহীন অবস্থায় নীলের উপর। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে তার। তার উপর নীল আবার তার পাতলা কোমরটা কেমন করে যেন ধরে আছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে সে, খামচে ধরে নীলের গলার কাছটা। নখগুলো কলার ভেঁদিয়ে সামান্য আঁচড় কাটে নীলের ফর্সা গলায়।
নীল বাঁকা হাসলেও লজ্জায় মিইয়ে আসে তিহু‌। পরপর সে টের পায় কপালে কারো শীতল স্পর্শ।
আমেরিকা……….

বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড শহর জুড়ে সূর্যের উষ্ণ আভা। ঘড়ির কাঁটায় সকাল পাঁচটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। জগিং শেষে সবে ড্রুইড হিল পার্কের প্রশস্ত রাস্তাটার পাশে অবস্থিত জলধারটার কার্নিশ বেয়ে স্থপিত বেঞ্চিটার উপর বসেছে আরহাম।ফর্সা মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ বিষন্নতা। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি অনুভূত হয় তার। না তাকিয়েই সে বুঝতে পারে মানবিটির অবস্থান। ফ্লোরা এনার্জি ড্রিংসটাতে আলতো চুমুক দিয়ে সেটিকে পাশে রাখে। আরহামের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে চেয়ে হুট করে প্রশ্ন করে বসে,,,,
——“হোয়াট হ্যাপেন আরহাম? এনি প্রবলেম?
আরহাম কোনোরূপ ভাবান্তর না দেখিয়ে বলে,,——“নাথিং।
“তাহলে এভাবে বসে আছো কেন?

বাংলা কথাগুলো বেশ ঝটপট বলে ফ্লোরা। মেয়েটা ইদানিং বাংলা শেখার চেষ্টা করছে,আরহামের সাথে একটু ক্লোজ হওয়ার প্রচেষ্টায় আর কি। যাতে প্রফেশনের বাইরেও, কিছুটা সময় তাদের আলাদা থাকে। আরহাম এবার তার দিকে তাকালো, ফ্লোরা মেয়েটা একটু অন্যরকম।
এখানকার উপস্থিত অন্যান্য বিদেশিনীর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সে। পরনে হালকা ফেব্রিকের অফ হোয়াইট টপ, কাঁধসম চুলগুলো স্লিক হাই পনিটেল করা, সামনের বেবি হেয়ার গুলো আবৃত হেডব্যান্ডের কড়া বন্ধনে।
“Why are you trying to speak Bengali?(তুমি বাংলা বলার চেষ্টা কেন করছ?)
ফ্লোরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে,,,“Nothing… just!
“You are beautiful in your own words ,your own tongue Flora.(তুমি তোমার নিজের ভাষায়, নিজের ধরনে সুন্দর ফ্লোরা।)

“But.
“Nothing Flora..
“আমার কথাটা তো শোনো, I Like Bengali.
“ওকে,বাট এরপর থেকে জোর করে বাংলা বলার চেষ্টা করবা না,আই ফিল আনইজি।
“ওকে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ ফ্লোরা বলল,,,——“তুমি কি বিডি ব্যাক করতে চাচ্ছ?
“ইচ্ছা আছে!
“কবে যেতে চাইছো?
“এই মাসের মধ্যেই।
“এই মাসের মধ্যেই?
ফ্লোরার কন্ঠটা কেমন শোনায়। আরহাম তার দিকে ফিরে বলে,,,——“এনি প্রবলেম?

“উম?নাথিং।
সে একবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকায়।
“ফ্ল্যাটে যাবে না?
“হুম তুমি এগোও আমি আসছি।
ফ্লোরা আর দাঁড়ায় না। চটজলদি প্রস্থান করে সেখান থেকে। আরহাম এক ঝলক তাকায় তার দিকে, মেয়েটা ইদানিং বেশ বদলেছে। কেন বদলেছে জানা নেই আরহামের, ইচ্ছাও নেই। পকেটের ভাঁজের ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে অতি যত্নের সাথে ভেতরে রাখা কিশোরীটির ছবিটায় আদুরে হাত বুলায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে আনমনে বলে,,,
——“আমি ফিরছি তোতা, শুধু তোমার জন্য। তোমাকে আপন করে নিতে।

মিষ্টি হাওয়া আর সোনালী রোদ্দুরের আলতো স্পর্শ সঙ্গে পাখ-পাখালির মনকাড়া গুঞ্জনে আবৃত অপার্থিব সেই সকালে হঠাৎ ঘুম ভাঙলো তিহুর। পিটপিট করে খুলল ডাগর চক্ষুদ্বয়। পাশে ফিরে অনুভব করল ওড়নার উপস্থিতি, কিছুটা অবাক হলো সে। সে তো কখনো ওড়না খুলে ঘুমায় না,তাহলে ওটা ওখানে….. পরক্ষণেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। তড়িৎ বেগে বিছানার উপর উঠে বসলো তিহু।আশেপাশে একবার তাকিয়ে নীলের উপস্থিতি বোঝার বৃথা চেষ্টা করল সে।

কোত্থাও নেই নীল। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে শত সহস্র গালি দিলো অভদ্র লোকটাকে। আচানকতার বোধগম্য হলো কাল রাতে তো সে নীলের কাছে ছিলো। তাহলে সকালে এখানে অর্থাৎ বিছানায় কিভাবে? মস্তিষ্ক যেন অসাড় হয়ে আছে, কিচ্ছু বুঝতে বা ভাবতে পারছেনা সে। আর না তো তিহু কিছু ভাবার চেষ্টা করল। এখন তার নাহা’র কাছে যাওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কাল রাতে কথা ভঙ্গ করেছে যে! দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো তিহু।

ফ্রেশ হয়ে একটা কুর্তি আর আফগান পরে চটজলদি রেডি হয়ে নেয় তিহু। জলে সিক্ত লম্বা কেশরাজকে চিরুনির আলতো আঁচড়ে কোনোমতে দমিয়ে রেখেই দ্রুততার সহিত রুম থেকে বের হয় সে। তবে দু কদম এগোতেই তার দেখা হয় তার জীবনের মহা বিপর্যয় নামক মুন্নির সঙ্গে। মেয়েটাকে দেখলেই তিহুর ইচ্ছা করে চুলের মুঠি ধরে সারা শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে।

তবে এমন অদ্ভুত বাসনা পূরণ হওয়ার নয়। তিহু তাকে এক প্রকার না দেখার ভান করে, পাশ কেটে এগিয়ে যেতে চায়। তবে কথায় আছে না ঘোটুক হাজার বিপর্যয় তবে তাতে কখনো বেহায়ার লজ্জা নাহি হয়। মুন্নি হচ্ছে সে চূড়ান্ত ধাপের বেহায়া, তাইতো লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে সে তিহুকে চলে যেতে দেখেও পিছন থেকে বলল,,,
——’একা পারছিলে না বলে কি এবার সঙ্গী নিয়ে আসলে?তা ওটাকে আমাদের বাড়ির আর কোন ছেলের ঘাড়ে ঝুলাতে চাও?
তার এমন বাজে ইঙ্গিত পূর্ণ কথায় পিছনে ঘুরলো তিহু, রেগে থাকলেও ততক্ষণাৎ মুখে প্রকাশ করল না তা। গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,,,

——’ঠিকই ধরেছো, তোমার মত চুন্নিকে তাড়াতে গেলে আমার তো একটা সঙ্গী প্রয়োজন তাই না? আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমার বাড়ি,আমার বাড়ি করা বন্ধ করো। ইটস নট ইওর ওন হাউস বেবজ। এটা তোমার মামা বাড়ি।আর তুমি জেনে খুশি হবে যে, এই বাড়ির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীনি নিয়ে আমি। তো গলা নামিয়ে কথা বলো, মিস চুন্নি।
পরক্ষণেই জিব্বা কেটে সে বলল,,,——’স্যরি মুন্নি। সত্যি বলতে তোমার চুন্নি নামটাই সুন্দর, তোমার ক্যারেক্টারের সাথে ভালো যায়।
কথাগুলো বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো তিহু। একবারের জন্যেও পিছন ঘুরে তাকালো না, নতুবা হয়তো দেখতে পেত তার কথার তোপে থোতা মুখ কেমন ভোঁতা হয়ে আছে মুন্নির।

———’তো মিসেস বিয়েত্তা মহিলা, বরের থেকে ছাড়া পেলেন তবে?
রুমে ঢুকেই মাহার এমন কথায় মুখ কুঁচকে তাকালো তিহু।তার এমন অবস্থায় শব্দ করে হেসে দিল নাহা। মাহাও হাসলো তবে মুখ চেপে।
——’উল্টাপাল্টা কথা বলিস না কিন্তু একদম মাহু!
——’আমি উল্টোপাল্টা কথা বললাম? এমা! সে জিব কাটলো! পরপর নাহা’র দিকে ফিরে বলল,,——’তুমিই বলো নাহু সুইটহার্ট, আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
নাহা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,,——’একদমই নয়।
তিহু মাহার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালে শুধু, অতঃপর বিছানায় এসে বসতে তাদের গোছানো লাগেজের দিকে তাকিয়ে বলল,,——’তোমরা রেডি তাহলে?

——’অলমোস্ট রেডি বউমনি!
——’রাফুর কি অবস্থা?
——’ওতো এখনো ঘুম থেকেই ওঠেনি। একটু পর বড় ফুপ্পির ক্যালানি খাবে, তারপর উঠবে।
——’আর নিরু?
——’নীর কি কখনো নিজের গোছানো নিজে করে নাকি? কাকিয়া গুছিয়ে রেখেছে ওর সবটা। আচ্ছা বউমনি তোমরা গোছাতে লাগো,আমি বরং আমার লেবু-মধুর পানিটা নিয়ে আসি।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নাহা।

‘ওহ’——ছোট্ট করে কথাটা বলেই মাহার দিকে ফিরল তিহু। মেয়েটা এখনো কতটা চঞ্চল, অথচ তিহু বুঝতে পারছে তার ভিতরে চলা তোলপাড়। তবে আরো একটা দুষ্টু বুদ্ধি করেছে সে, জেনে যখন গেছেই যে তার ব্রাদারই মাহার প্রাক্তন। আর দুজন দুজনকে এখনো আগের মতই ভালবাসে, তাহলে আজকে সেই বুদ্ধিটার প্রতিফলন তো ঘটাতেই হচ্ছে। আর শুধু আজকে নয় তিহু নিজেই নিজেকে কথা দিয়েছে, এই জাফলং তাদের প্রনয়ের পুনর্মিলন সংগঠিত করবে সে আবার।তবে এবার তার পরিনতি হবে পূর্ণতা।
তিহুকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহা বলল,,——’ওই?আমি তোর বর না।এমনে কি দেখিস?
মাহার কথায় ধ্যান ভাঙল তিহুর, চটজলদি বলল,——’রিশাদ আসবে না?

——’ও বলেছে সাড়ে সাতটার মধ্যে চলে আসবে।
——’ওহ।
পরক্ষণেই তার মনে পড়ল একটু আগে বলা মাহার কথাটা।তার মর্মার্থ বুঝে তিহু মুখ বাঁকিয়ে বলল,,,
——’এমন ভাবে তখন বললি যেন আমি কোনো ছেলে যে তোকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।
——’এমা ছিঃ ছিঃ আস্তাগফিরুল্লাহ।হোক তুই ছেলে বা মেয়ে ওমনে তাকাবি না।
সে মুখে হাত দিয়ে একটু আদুরে ঢং করে বলল,,——’আমাকে ওভাবে দেখার অধিকার শুধু আমার হাব্বিজির।
তিহু তার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহার পিছনে থাকা আয়নায় সে দেখতে পায় রাওফিনের অবয়ব।যে কি না দরজায় হেলান দিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।তিহু চাপা হেসে সটানে দাঁড়িয়ে পড়ে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,,

——’স্টে উইথ ইউর হাব্বিজি।
——’মানে?
মাহা পিছন ঘুরে তাকালো ততক্ষণে, রুম থেকে প্রস্থান করেছে তিহু। আর দরজার ধারে মুচকি হেসে চলেছে রাওফিন। কিঞ্চিৎ হতভাগ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো মাহা। রাওফিন ভিতরে প্রবেশ করতে যেতেই প্রকার চেঁচিয়ে উঠে সে বললো,,,
——’স্টপ, স্টপ রাইট নাও। আর এক পা এগুলোও উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।
রাওফিন দুহাত উঁচিয়ে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে দাঁড়ালো, পরক্ষণেই বাঁকা হেসে রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,,,
——’ট্রাস্ট মি, আমি চাইছি উল্টাপাল্টা কিছু হোক। এমন কিছু যাতে জন্ম জন্মান্তরের জন্য তোমার সাথে এই রাওফিন নামটা লেপ্টে থাকে।

——’বাজে কথা বলবে না রাওফিন।
——’বাজে কথা বলার জন্যই তো আমি আছি, লাভ লাইন।
বলেই রাওফিন মাহার দিকে এগোতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে মাহা পাশ থেকে একটা কুশন তুলে যেইনা তার দিকে ছুড়তে যাবে তৎক্ষণাৎ রুমে প্রবেশ করে নাহা। তাদের দুটিকে এমন অবস্থায় দেখে অবাক কন্ঠে শুধায়,,,
——’ভাইয়া তুমি এখানে? আর মাহা তোমার হাতে কুশন?
মাহা দ্রুত সরে যায়, তবে রাওফিন তাকে হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,,

——’তুই ওর নাম ধরে ডাকলি কেন?
——’এমা, ওতো আমার ব্যাচের।
——’তোর ব্যাচের হোক আর তোর থেকে জুনিয়র হোক। আর কখনো যেন না দেখি তুই ওকে নাম ধরে ডেকেছিস।
——’তো কি বলবো?
——’বউমনি!
কোনরূপ ভাবান্তর ছাড়া কথাটা বলল রাওফিন। তার এমন কথায় নাহা অবাক কন্ঠে বলল,,,
——’বউমনি?কেন বউমনি বলতে যাব কেন? বউমনি তো তিহু।
——’ও হ্যাঁ, সিস্টার তো বউ মনি, তাই না? তাহলে তুই বরং ওকে বড় বউমনি বলে ডাকিস।
——’কিন্তু কেন?

তার জবাবে রাওফিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই, অবস্থা বেগতিক দেখে মাহা বলল,,,
——’নাহা সুইটহার্ট, দ্রুত এদিকে এসো। আমার লাগেজটা একটু গুছিয়ে দাও তো।
নাহা তেমনই অবাক ভঙ্গিমায় এগিয়ে এসে মাহার লাগেজ গোছাতে লাগলো, অন্যদিকে নাহা কাজে ব্যস্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে মাহা কটমটিয়ে তাকালো রাওফিনের দিকে। চোখের ইশারায় বোঝালো রুম থেকে বেরিয়ে যেতে। রাওফিন বোকা দৃষ্টি মেলে বোঝালো, তার কি দোষ? পরক্ষণে মাহার রাগী দৃষ্টির কাছে হার মেনে প্রস্থান করল রুম থেকে।

ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা বেজে ৩৫ মিনিট। বাড়ির সকলে জড়ো হয়েছে বড় গার্ডেন এরিয়ায়। একে একে মহল ছেড়ে বেরোচ্ছে গাড়ির বহর। প্রবীণেরা একটু আগে আগে বেরিয়েছে, বাকি আছে বাড়ির নবীন প্রাণ গুলো। প্রস্তুতি চলছে তাদের বেরোনোর। রিশাদ এসেছে মুহূর্ত খানেক আগে। নিহিত আর সে সেম ব্যাচের হওয়ায় ঠিক করেছে একই গাড়িতে যাবে।
তবে বিপত্তি বেঁধেছে অন্য জায়গায়। রিশাদ আর মাহা মিলে নবীন সদস্য সংখ্যা জন কম দশজন। এতগুলো মানুষের এক গাড়িতে গেলে চাপ বেশি হয়ে যেতে পারে। আর দুটা গাড়িতে গেলে তারা বিভক্ত হয়ে যাবে। অস্থির এই দোলাচলের মধ্যে, রাওফিনকে নিজের বাইক নিয়ে বেরোতে দেখা গেল। সকলে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালে নীল বললো,,,

——’তুই বাইকে যাবি?
——’হ্যাঁ, কোনো প্রবলেম?
——’প্রবলেম নট, তাহলে তুই রাফা কে সঙ্গে করে নিয়ে যা।
তার কথায় রাফা গাড়ির ভেতর থেকে বলল,,——’একদম না নীল ভাইয়া, আমি রাওফিন ভাইয়ার সাথে একদম যাব না।
নীল শান্ত দৃষ্টিতে তাকালে চুপসে গেল রাফাসহ সকলে। মূলত তার সাথে জোর গলায় কথা বলার সাহস কারো নেই। তৎক্ষণাৎ পাশ থেকে তিহু বলল,,

——’এমন শকুনের মতো তাকানোর কিছু নেই। রাফার সিট রাফা বুক করে ফেলেছে, ঝামেলা হয়েছে মাহাকে নিয়ে। তাই মাহাই যাবে ব্রাদারের সাথে।
তার এমন কথায় চমকে তাকালো মাহা, তবে কোনোরূপ ভাবান্তর দেখালো না রাওফিন।
——’আমি যেতে পারবো না তিহু, তুইতো জানিসই আমার রাইডিং ফোবিয়া আছে।
——’না জানি না তো। এমন ফোবিয়া আবার তোর কবে থেকে তৈরি হলো?
‘আজ থেকেই,’——ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল মাহা।
রাওফিন বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বলল,,——’যা করার জলদি করো সিস্টার, আমার হাতে বেশি টাইম নেই।
মাহা কিছু বলতে যেতেই তিহু তাকে আটকে বলল,,——’এটা তো আর তোর এক্স বয়ফ্রেন্ড রাওফিন না, এটা আমার ব্রাদার রাওফিন। তাই আর কোনো কথা নাই। দ্রুত ওঠ দেরি হয়ে যাচ্ছে।
একপ্রকার ঠেলে ঠেলে তাকে ‌বাইকে তুললো তিহু‌। মাহা এমন একটা অবস্থায়, যে না তো কাউকে কিছু বলতে পারছে না তো সহ্য করতে পারছে । আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, এমন অবস্থায় বাইকে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার কাছে। সে বাইকে উঠতেই রাওফিন বলল,,,

——’নিজের ইচ্ছেতে উঠছেন, তাই ধরে বসিয়েন মিস। পড়ে গেলে কিন্তু কোনোরকম দায়ভার আমি নিব না।
——’না না ব্রাদার তুমি কোনো চিন্তা করো না, ও ধরেই বসবে। কিরে মাহা ধরে বস।
মাহা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল সবটা, একপ্রকার খামচে ধরল রাওফিনের কাঁধের দিকটা, যেন খুবলে নেবে। রাওফিনের উপর তো এমনিতেই মেজাজ গরম হচ্ছে তার ওপর জুটেছে এই তিহু। তার ইচ্ছে হচ্ছে একটার উপর আরেকটা কে রেখে আছাড় দিতে। সে ধরতেই বাঁকা হেসে বাইকে স্টার্ট দিল রাওফিন, শো শব্দটা চলে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে।
তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়লো নিহিতদের গাড়িটা,রওনা দিলো তারাও। তবে তিহুর জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে সে আর নীল বিভক্ত হয়ে পড়েছে,ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তারা।গাড়িটা দৃষ্টির আড়ালে যেতেই তিহু বলল,,,

——’এভাবেই কি সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?নাকি কোনো ব্যাবস্থাও হবে!
তার কথার জবাবে নীল কিছুই বলল না,একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন ঘাটতে লাগলো।তিহু বিরক্ত হয়ে বলল,,,
——’কি হলো শুনতে পাচ্ছেন না?
নীল ফোন থেকে মাথা না তুলেই বলল,,,——’আমায় কিছু বলছো?
——’তা নয় তো কি হাওয়াকে বলছি?।
——’বলতেও পারো!
——’বাজে বকা বন্ধ করে, আপাতত যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। সবাই চলে গেল কতদূর! সে খেয়াল আছে?
——’আছে।

তিহু মুখ কুঁচকে তাকালো। পরক্ষণেই নীল বললো,,,——’বাই দ্যা ওয়ে, কিসে যেতে চাও?
——’মনে হচ্ছে আমি যদি বলি উনি হেলিকপ্টার ধরে আনবে আমার যাওয়ার জন্য!’
অন্যমনস্কভাবে কথাটা বললেও তৎক্ষণাৎ সেটা ধরে ফেললো নীল,,,
——’বলে দেখতে পারো!
‘উমম! ঢং দেখে বাঁচিনা, পারবেন আমাকেও ব্রাদারের মতো করে বাইকে বসিয়ে নিয়ে যেতে?’——ফিসফিসিয়ে কথাটা বলল তিহু। তবুও সেটা কর্ণগোচর হলো না নীলের। তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তরে সে বলল,,,
——’বাইকে যেতে চাও?

তিহু জবাবে তার দিকে ঘুরলো শুধু, নীল তৎক্ষণাৎ একটা ছেলেকে ইশারা করতেই সে এগিয়ে নিয়ে আসলো নীলের বাইকটা। ইয়ামাহা খচিত নেভি ব্লু কালার বাইকটাতে উঠে বসলো নীল, একটা লেডিস হেলমেট এগিয়ে দিল তিহুর দিকে। বিস্মিত তিহু সেটা গ্রহণ করতে যেতেই, নীল তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসলো। ভারসাম্য হারিয়ে তিহু তার এতটাই কাছাকাছি চলে আসলো যে নীলের বুকে বাঁধলো তার মাথাটা। অবাক হয়ে সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নীল বলল,,,
——’হেজাব কই? হেজাব বাঁধো নি কেন?
কিছুটা ধমকের স্বরে কথাটা বলল নীল। তিহু মাথা তুলে কিছুটা ঘাবড়ানো স্বরে বলল,,,
——’আ-আসলে, আমি তো হেজাব বাঁধতে পারিনা। তাই আর কি!
——’নো এক্সকিউজ। এরপর থেকে আর কখনো যেন হেজাব ছাড়া বের হতে না দেখি। আন্ডারস্ট্যান্ড?
তিহু সামান্য মাথা নাড়ালো। নীল সূক্ষ্ম হাসলো। অতঃপর হেলমেটটা অতি যত্নে পরিয়ে দিল তিহুকে। বাইকে উঠে বসলো সে।

——’শক্ত করে ধরে বসো।
——’বসেছি তো।
——’কই আমি তো ফিল করতে পারছি না?
——’মানে?
——’মানে তোমার মাথা। শক্ত করে আমার দিকে এগিয়ে এসে ধরো। নাইদার তুমি পড়ে গেলে আমাকে দায়ী করবে না।
তিহু কিছুটা এগিয়ে এসে নীলের কলারের দিকটা শক্ত করে ধরল। সামান্য মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলো নীল।

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিট। দিগন্ত জুড়ে রক্তিম মেঘের খেলাঘর। দুটো বাইক পাশাপাশি ছুটছে জাফলং এর নির্জন পথ ধরে। চারিধারে সবুজ শ্যামল বটবৃক্ষ,আর নাম না জানা লতানো ফুলের সমাহার। ডান পাশের বাইকটাতে নীল-তিহু, বাঁ পাশের টাতে রাওফিন-মাহা। মূলত সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রায় দুপুরের খাবার একটা রেস্টুরেন্টে সেরেছে চারজন একসাথে। দেখা হয়েছিল তাদের সেখানেই। তখন থেকেই একসাথে ছুটছে তারা।
রাওফিনের মুখে মৃদু হাসি বিদ্যমান, যেন বিশ্ব জয় করছে আজ। এদিকে মাহা রাগে ফুঁসে চলেছে।তিহুর বিষ্ময় ভাবাপন্ন মুখশ্রীতে সামান্য স্বাভাবিকতা এসেছে কিছুক্ষণ হলো। মূলত জাফলং পৌঁছে গেছে তারা, ঘন্টাখানেকের মাঝেই হয়তো পৌঁছাবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। বাইক চলাকালীন একপর্যায়ে রাওফিন নীলের দিকে ফিরে বলল,,,

——’কতকাল পর তোর মামা বাড়ি যাচ্ছি বলতো?
——’খেয়াল নেই। অ্যাপ্রক্সিমেটলি বছর সাতেক ।
——’একদম। সাত বছর বাদেই যাওয়া হচ্ছে। তবে এবার দেখ একদম জীবন সঙ্গিনীদের সাথে।
তার এমন কথায় মাহা তার ঘাড়ের দিকটা খুবলে ধরল ফের। রাওফিন অপ্রস্তুত হেসে বলল,,
——’ইয়ে মানে তুই সিস্টারকে নিয়ে যাচ্ছিস তাই আর কি!
মাহার খামচানি কিছুটা শিথিল হলো।রাওফিন হেলমেটের আবরণে বদ্ধ ঠোঁট দুটো সামান্য জিব দিয়ে ভিঁজিয়ে বলল,,,

——’তাহলে কি বলিস ব্রো? একটা গান হয়ে যাক। জার্নির টায়ার্ডনেস ও কিছুটা কমবে, সঙ্গে সঙ্গে এটা এনজয়-এবেলও হবে।
তার কথার জবাবে নীল কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিহু তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,,,
——’ইনি আর গান! ওএমজি! তাহলে আর আজ গান শোনা হবেনা। এর থেকে বরং গানটা বরং তুমিই গাও। আমারও ভীষণ বোর লাগছে।
——’কি বলো সিস্টার তুমি কি আমার ব্রো কে ছোট করলে নাকি?
——’সত্যিটা বললাম শুধু!
রাওফিন নীলের দিকে ফিরে বলল,,——’ওই নেতা সাহেব, কিছু বলিস না কেন?
তার কথার জবাবে নীল শুধু বাঁকা হাসলো।

কিছুক্ষণ পর গলা খাঁকারী দিয়ে হঠাৎ রাওফিন গান ধরল,,,
🎶 প্রেমেরই গানে পেয়েছে মানে রাতের অন্ধকার….
দু চোখের কালো মুছে তাকালো পূর্বের বন্ধ দ্বার…..
তিহু যখন গানের অনুভবে বিভোর, ঠিক তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে নীল গেয়ে উঠলো,,,
🎶 রাতজাগা পাখি ডাকে ঐ দূরে…..
স্বপ্নেরা ডানা মেলে রোদ্দুরে…..
দূরে দূরে তবু কেন সাথিয়া…..
তিহু অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লুকিং গ্লাসে ভেসে থাকা নীলের অবয়বে।পাশ থেকে রাওফিন গাইলো,,
দূরে দূরে তবু কেন সাথিয়া…..
মনওওওও, তোকে দিলাম…
নীল:এই ‌মনওওওও, তোকে দিলাম…
রাওফিন মুচকি হেসে ‌একঝলক তাকালো নীলের দিকে, অতঃপর আলগোছে কাঁধে রাখা মাহার হাতটার উপর অগোচরে হাত রেখে গাইলো,,,

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১৯

🎶আমার এই মনে জীবনে শুধু তোরই অধিকার…..
যাব না ভুলে কখনো জানি প্রেমের অঙ্গীকার…….
নীল লুকিং গ্লাসে তিহুর দিকে চেয়ে গাইলো,,,
🎶 উত্তর খুঁজে পেল প্রশ্নেরা…..
সত্যির ছোঁয়া পেলো স্বপ্নেরা……
দূরে দূরে তবু কেন সাথিয়া…..
রাওফিন:🎶দূরে দূরে তবু কেন সাথিয়া….. !
অতঃপর দুজনেই একসঙ্গে গাইলো,,
🎶মনওওওও, তোকে দিলাম…
এই ‌মনওওওও, তোকে দিলাম…!

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here