প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৩

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৩
নওরিন কবির তিশা

সন্ধ্যা থেকেই ঈশান কোণে কালো মেঘ পুঞ্জিভূত। তবে তার অন্ধকারময়তা ছাপিয়ে মির্জা মহলে আজ নেমে এসেছে আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি। সমগ্র মহলসহ আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চল সজ্জিত স্ট্রিং লাইট এর মৃদু আলোক রশ্মির ঝলকানিতে।
যদিও ছেলেদের বাড়িতে মেহেদী অনুষ্ঠান ততটা সাড়ম্বরে পালিত হয় না, তবে জমিদার বাড়ির একমাত্র বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা, কোথাও কোনো খামতি রাখতে চান না বাড়ির কর্তারা। সেই উদ্দেশ্যেই বেশ বড়সড় আয়োজনে মেহেদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

ড্রয়িং রুমে বাহারি মেহেদির সম্ভার সাজানো হয়েছে। একটা কাসার কারুকার্যিত ডালার মাঝে ফুল বিছিয়ে সজ্জিত রাখা হয়েছে সেগুলোকে।চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মখমলের কুশন আর বাহারি নকশার শতরঞ্জি,ঝলমলে তারুণ্য-চঞ্চলতায় মুখর স্থানটা। এতকিছুর মাঝেও অনুপস্থিত তিহু।
জুনাইয়া সবে নিজের চার বছরের ছোট্ট মেয়ে আইরাত কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে। উপস্থিত সকলের ভিড়ে তিহুকে না দেখে নাহার উদ্দেশ্যে সে বলল,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—’তিহু কইরে নাহা? ও মেহেদি দিবে না?
তার কথার প্রত্যুত্তরে রাফা বলল,,—’বউমনি তো বলল মাথা যন্ত্রণা করছে। তাই একটু রেস্ট নিতে গেল।চোখ গুলোও দেখলাম ফোলা, সেজন্য তো আমি আর জোর করিনি।
জুনাইয়া তার পাশে বসতে বসতে বলল,,—’কি হলো বল তো মেয়েটার?আজ সারাদিন আপসেট ছিলো, আমাদের সাথে শপিংয়েও গেলো না।
—’বউমনি তো কাল রাত থেকেই আপসেট। কাল রাতেও তো আমার সাথে ঘুমাতে এসেছিল। কিন্তু না ঘুমিয়ে সারা রাত ব্যালকনিতে বসেছিল।
রাফার এমন কথায় বেশ অবাক হলো উপস্থিত সকলে। জুনাইয়া মাহার দিকে ফিরে বলল,,—’তুমি কিছু জানো মাহা?
মাহাও সকাল থেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, অস্থির কন্ঠে সে বলল,,—’ওতো আমার সাথেও কিছু শেয়ার করেনি আপু। কি জানি কি হয়েছে?
বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো সকলে। চঞ্চল মেয়েটার এমন হঠাৎ শান্ত রূপকে মেনে নিতে পারল না কেউই। তবে তৎক্ষণাৎ তার কাছে গেল না কেউ। কিছুটা সময় দিলো একান্তে।

নীল ধুপ ধাপ পায়ে এগিয়ে চলেছে রাফার রুমের দিকে। উদ্দেশ্য নিজের অসভ্য বউটাকে খুঁজে বের করা, সারা মহল তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাপাত্তা সে। কাল থেকে শত প্রচেষ্টা, আর হাজার বার ডেকেও তিহুকে কোত্থাও পায়নি নীল। রাগের শরীর রি রি করছে,ক্রোধে কম্পিত হচ্ছে শৈল্পিক দেহ।
দোতলার উত্তর প্রান্তের শেষ রুমটা ‌রাফার। রুমের সামনে এসে সর্বোচ্চ ক্রোধে দরজা খুলল নীল। তিহুকে কোথাও না দেখে ডাক দিতে যাবে ঠিক তক্ষুনই সে শুনতে পায়, ব্যালকনি থেকে ভেসে আসা কারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কন্দনরতন মৃদু আওয়াজ। মুহূর্তেই পা থেমে যায় তার,রুদ্ধ হয় কণ্ঠস্বর।
অনুশোচনার গরিমায় দগ্ধ হয় সে। শীতল হয় দৃষ্টি, মলিন হয় মুখশ্রী। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে,তিহুর পিছনে দাঁড়ায় সে। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে সর্বোচ্চ মোলায়েম ভাবে বলে,,,

—’নুর?
একটা মাত্র শব্দ, পিনপতন নীরবতার মাঝে সেই একটি শব্দই যেন বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়।তিহু কণ্ঠস্বর চেনা মাত্র, তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়ায়। ঝটকা মেরে কাঁধে রাখা হাতটা সরিয়ে। সর্বোচ্চ গতিতে এগিয়ে চলে রুমের মধ্যে। পিছু নেয় নীলও। তার সমস্ত রাগের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন, মুহূর্তে শীতলতায় রূপ নিয়েছে।
—’আমার কথাটা তো একবার শোনো,নুর?
তিহু তাকায় না, সর্বশক্তিতে এগিয়ে চলে দরজার দিকে। তার উদ্দেশ্য টের পাবা মাত্র নীল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। তার এমন কান্ডে তিহু শুধুমাত্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়, পরক্ষণে‌ই দৃষ্টি ঘোরায় অন্যদিকে।
—’কি হয়েছে বলোতো? আচ্ছা আ’ম স্যরি। আর কক্ষনো এমন হবে না।আসলে রেগে গেলে আমার মাথা কাজ করে না। দেখো, একটিবার তাকাও।
এতকিছুর মাঝেও কোনো হেলদোল দেখায় না তিহু।

—’শুনছো নুর?
তার এমন ডাকে বারংবার হৃদয় কেঁপে ওঠে তিহুর, তবু দৃঢ় দৃষ্টিতে, প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সে স্তব্ধ-নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
—’একটু, একটুখানি রিয়্যাক্ট করো। প্লিজ।
তিহু এখনো নির্বাক।
—’তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না?
তিহুর এমন নির্লিপ্ততা বারংবার আঘাত করে নীলের হৃদ কুঠুরিতে। অসহ্য যন্ত্রনায় অস্থির উন্মাদের ন্যায় সে বলে ওঠে,,—’আচ্ছা বলা লাগবে না তোমার কথা।
তিহু ভাবে লোকটা হয়তো চলে যাচ্ছে তবে তাকে অবাকের তুঙ্গে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষীন দেহকে নিজের শক্ত পৌরুষিক হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে নীল। এক হাত তার পায়ের নিচে, অপর হাত পিঠের নিচে রেখে কোলে তুলে নেয় তাকে। তার এমন কাণ্ডে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে তাজ্জব বনে যায় তিহু। নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াসে অদ্ভুত রকম ছটফটায়। তবে তাতে নীল বাঁকা হেসে রুমের দরজা খুলতে খুলতে বলে,,

—’ডোন্ট মুভ,অ্যান্ড কান্ট ট্রাই টু স্টপ মি।
তার কন্ঠে যেন অদ্ভুত কিছু ছিল,তবে তিহু খেই হারিয়ে এবার চিৎকার করে বলে ওঠে,,
—’নামান আমায় বলছি। নইলে এক্ষুনি চিৎকার করবো আমি।
—’উফস, এত জোরে কথা বলো কেন? কি বলে চিৎকার করবা তুমি? শুনতে পারছ না নিচে সাউন্ড বক্সের শব্দ, কেউ শুনতে পাবে না তোমার চিৎকার।
—’আপনি আমাকে নামাবেন কিনা?
—’না।
ছোট্ট কথায় সমস্ত উত্তর সারল নীল।তিহু ক্রোধেরঞ্জিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তবে তাতে কোনো হেলদোল দেখাচ্ছেনা নীল। সাবলীলভাবে তাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিজের রুমের দিকে। তিহু শত চেষ্টাতেও কোনো সমাধান না পেয়ে এক পর্যায়ে নিজে থেকেই শান্ত হয়ে গেল। ঘাপটি মেরে পড়ে রইল, রাগান্বিত অবস্থায়।

তারা দোতলার অন্দর ঝুলবারান্দা দিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে, হঠাৎ তাদের দৃষ্টিগত হলো নিচে বসা সকলের। নিহিত আর সামির জোরে সিটি বাজিয়ে উঠলো। জুনাইয়া,মাহা,নাহা,রাফা,ফারিসা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে মুখ চেপে হাসছে, হঠাৎ তারা একযোগে গেয়ে উঠলো,,
🎶 তুমি ছুঁয়ে দিলে হায়….
আমার কি যে হয়ে যায়….🎶
সাউন্ড বক্সে থামিয়ে তাদের এমন কাণ্ডে, তাদের দিকে এক ঝলক তাকালো নীল। সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল সবকয়টা। তবে জুনাইয়া দুষ্টু হেসে বলল,,,
—’আহারে আমার আনরোমান্টিক ভাইটা! অমনে কি দেখিস হ্যাঁ?
নীল কোন জবাব না দিয়ে সোজা তিহুকে নিয়ে এগিয়ে চলল কাঙ্খিত গন্তব্যে।

রুমের এসে, সন্তর্পণে অতি যত্নে সহিত তিহুকে কোল থেকে নামালো নীল। তবে পরক্ষণেই যেন শুরু হলো প্রবল ঘূর্ণিঝড়, ক্রোধান্বিত কন্ঠে তিহু বলল,,
—’হাউ ডিয়ার ইউ? আপনি আমাকে কোলে তুললেন কোন সাহসে? কোন অধিকারে?
—’তোমার স্বামীর অধিকারে।অ্যাজ হাজবেন্ড আই ক্যান টাচ ইউ,অ্যান্ড সো মাচ মোর দ্যান দ্যাট….!
শেষ কথাটা সামান্য ফিসফিসিয়ে বলল নীল। এমনিতেই রাগের সর্বাঙ্গ কম্পিত হচ্ছে তিহুর, আর তার রাগের আগুনেই যেন ঘি ঢালার মত কাজ করলো নীলের কথাটা। দাঁতে দাঁত চেপে দুহাত সর্বশক্তিতে মুষ্টিবদ্ধ করে সে বলল,,,

—’ইউউউউ….!আই জাস্ট…
কথা শেষ হলো না তার। তার আগেই, তার নরম কোমল ওষ্ঠে নিজের তর্জনী ঠেকালো নীল।
—’উসস! আর কোনো কথা না। রেডি হয়ে নাও বেরোবো আমরা।
তার এমন আচরণে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল তিহু। তবে পরক্ষণেই ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিল নীলের আঙুলটা। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,,
—’আমি কোথাও যাবো না।
—’তুমি যাবে তোমার ঘাড়ও যাবে। তাই বেশি তর্ক না করে রেডি হয়ে নাও।
— ‘বলছি তো যাব না।
—’তর্ক কোরো না নুর, রেডি হয়ে নাও, আমি দুই মিনিটে রেডি হয়ে আসছি । আর হ্যাঁ অবশ্যই হেজাব বাঁধবে।
—’পারবো না।

—’পারতে হবে।
—’বললাম তো পারব না।
—’বললাম তো পারতে হবে।
—’বাঁধবো না আমি হেজাব।কি করবেন আপনি,হ্যাঁ?
তার কথায় এবার তার দিকে এগিয়ে আসলো নীল। তার এমন কাণ্ডে দু পা পিছালো তিহু, নীল এবার দ্রুত কদমে তার কাছাকাছি এসে দূরত্ব ঘুচিয়ে বলল,,
—’চাইলে তো আমি অনেক কিছুই করতে পারি। যার ফলে তুমি শুধু বাইরে কেন, বাসার ভেতরেও হেজাব ছাড়া কারো সামনে বেরোতে চাইবে না।

তার কথার মানে না বুঝে তিহু ভ্রু গোটালো। বিরক্তি কণ্ঠে বললো,,,—’মানে?
তার প্রত্যুত্তরে নীল খানিক বাঁকা হাসলো, সরাসরি মুখে কিছু না বলে চোখের ইশারায় তিহুর বিউটি-বোর্নের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তিহু সেদিকে তাকাতেই বুঝলো নীলের কথার মর্মার্থ। মুহূর্তেই ডাগর ডাগর চক্ষুদ্বয় সামান্য বড় হয়ে গেল। তা দেখে কিছুটা শব্দ করে হেসে উঠল নীল, পরক্ষণেই বলল,,
—’দ্যাটস লাইক মাই লেডি, রেডি হয়ে নাও না হলে তোমার কল্পনাটা সত্যি হয়ে যেতে পারে। এন আই থিংক দ্যাট উইল বি ভেরি আন্সপেক্টেড ফর ইউ।
বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করল নীল, আলমারিতে ঝুলিয়ে রাখা হ্যাঙ্গার থেকে একটা শার্ট নিয়েই প্রবেশ করলো ওয়াশরুমে। তিহু কয়েক মুহূর্ত বেকুবের মত চেয়ে থাকলো সেদিকে।

নীল ওয়াশরুমে যাওয়ার পরপরই রুমে এসেছিল জুনাইয়া আর মাহা। আসতে আসতে শুনেছিল নীলের বলা হেজাব পরার কথাটা। আর গুলো অবশ্য ফিসফিসিয়ে বলায় শুনতে পায়নি তারা। তাই এবারকার মতো রক্ষা হলো তিহুর। যাই হোক জুনাইয়া সাজুগুজুতে বেশ পটু,সে একপ্রকার ধরে বেঁধেই হেজাব পরিয়ে দিয়েছে তিহুকে। সঙ্গে একটা অফ হোয়াইট কালার পাকিস্তানের ড্রেস। এতেই সুন্দরীতমা লাগছে তিহুকে। সবশেষে জুনাইয়া হঠাৎ বলল,,
—’তিহু সুইটহার্ট, আসো তোমাকে একটু লিপস্টিক পরিয়ে দেই। এই ডার্ক মেরুন শেডটা তোমার স্কিনের সাথে একদম পারফেক্ট।
তিহু বাঁধা দিয়ে বলল,,—’না আপু, আমি লিপস্টিক দিব না।

পাশ থেকে মাহা টিটকারি কেটে বলল,,—’ওলেলেলেলে, আমার বিয়েত্তা মহিলাটা। আচ্ছা আপু বাদ দাও। বোঝোনা? এত সাজুগুজু করে বরের সাথে গেলে, যদি সে কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ে।
তিহু কটমটিয়ে তাকালো মাহার দিকে। তাতে সামান্য দুষ্টু হাসলো মাহা আর জুনাইয়া। পরক্ষণেই পিছন থেকে নীলের কন্ঠে, থ’ বনে গেল সবাই।
—’আর ইউ রেডি নুর?
তার কন্ঠে সকলে ঘুরে তাকালো তার দিকে। অফ হোয়াইট কালার, সাটিন শার্টে অমায়িক লাগছে মানবটাকে। তীক্ষ্ণ জ-লাইনের পুরুষটাকে খানিকটা বলিউডের জনপ্রিয় তারকা হৃত্বিক রোশনের মত লাগছে। প্রথম দৃষ্টিতে ঘোর লেগে যাওয়ার মত অবস্থা। অবশ্য নীলকে সর্বদা এমনই লাগে।

এদিকে মাহা পড়েছে মহা বিপাকে। আল্লাহ জানে, নীল তার বলা কথাটা শুনে ফেলেছে কিনা? লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত জুনাইয়ার হাত ধরে, রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে। তারা চলে যেতেই নীল ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তিহুর দিকে তাকালো।তিহু কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সামান্য হাসলো নীল।
—’চলুন ম্যাডাম।
তিহু মুখ কুঁচকে এগিয়ে চলল বাইরের দিকে। মাটিতে হুটুপুটি খাওয়া তার ওড়নার আঁচলটা সামান্য ঝুঁকে হাতে তুলে নিল নীল। মুচকি হেসে এগিয়ে চলল তার পিছু পিছু।

পার্কিং এরিয়ায় এসে থামলো দুজনে। গাড়িতে যাবে নাকি বাইকে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল নীল। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিল রাতের এই জাফলং এর বুকে প্রেয়সির সঙ্গে এক দীর্ঘ বাইক রাইড নিলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না। তাই অবশেষে নিজের বাইকটা, বের করে তাতে চড়ল একজোড়া কপোত-কপোতি।

বাইক চলছিল নিজ গতিতে, তিহু আর নীলের মাঝে ইঞ্চি খানিকের দূরত্ব স্পষ্ট। ব্যাপারটায় মেজাজ গরম হলো নীলের। এতকিছুর পরেও রেগে থাকার কি মানে? তবুও তৎক্ষণাৎ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না সে। যথা সম্ভব শান্ত থেকে এক দুষ্টু চাল চাললো। হঠাৎ বাড়ালো বাইকের গতি, সঙ্গে সঙ্গে তার পিঠের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়ল তিহু। কিঞ্চিৎ বিষ্ময়ভাবাপন্ন তার মুখশ্রী, লুকিং গ্লাসে তার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মুচকি হাসলো নীল।

চলতি গাড়িতে নীল একটা জিনিস বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করল।তিহু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে থাকলেও, তার দৃষ্টি বারংবার লুকিং গ্লাসে নীলের ওপর নিবদ্ধ হচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ লাগল নীলের। হেলমেটের আবরণে ঢাকা মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো সামান্য হাসির ঝলক।
বেশ কয়েকবার একই জিনিস লক্ষ্য করে, নীল এবার হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে গেয়ে উঠলো,,
🎶Mujhe tum chupke chupke jab aise dekhte ho.(যখন তুমি চুপিসারে এভাবে আমার দিকে তাকাও)
Achcha lagta hai…..
( ভালো লাগে)
Kabhi zulfon se, kabhi aanchal se……
( কখনও চুলের গোছা দিয়ে, কখনও আঁচল দিয়ে)
Jab khelti ho……
(যখন খেলা করো)
Achcha lagta hai……🎶
(ভালো লাগে)
গানের মর্মার্থ বুঝে দ্রুত দৃষ্টি ফেরালো তিহু‌। পরমুহূর্তেই গানের দ্বিতীয় কলিতে মনে পড়ে গেল কাল সকালের মুহূর্তটির কথা সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো মুখশ্রী। সেই সঙ্গে সচল হলে মস্তিষ্ক, তবে কি সেদিন নীল জেগেছিলো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে দোলা দিতেই, সন্ধিহান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিহু।

বাইক এসে থামলো সিলেট নগরীর অন্যতম অভিজাত এক শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। বাইক থেকে নেমে, কপত-কপতি মিলে এগিয়ে চলল ভেতরের দিকে। আজ আর তিহু আপত্তি করল না। কেননা সে ভালো করেই জানে, এই লোকের সাথে তর্কে জড়ানো আর নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা একই কথা।

শপিং কমপ্লেক্সে এসে একটু বেশি তাড়াহুড়ো দেখালো নীল, যেন এরপর তার মহা গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ বাকি আছে। আর সে খুব ভালো করেই জানে তিহু বর্তমানে মুখে কুলুপ এঁটেছে। শত প্রচেষ্টাতে ও তার থেকে কোনো জবাব পাবে না সে। তাই আর কোনোরকম চেষ্টাও করল না, নিজের পছন্দমতো প্রায় দশখানা শাড়ি আর সাথে ম্যাচিং হেজাব কিনলো সে।
কসমেটিক্সের তত একটা ধারণা না থাকায়, চোখে ধরা এক্সপেন্সিভ সেটগুলো কিনে নিলো চট জলদি। তবে বেরোবার পূর্বে, সে লক্ষ্য করল তিহু একটা ড্রেসের দিকে তাকিয়েছে, খুব সম্ভবত পাকিস্তানি। নীল সেদিকে না তাকিয়েই দোকানের স্টাফদের উদ্দেশ্যে বলল,,

—’ম্যাডাম যেদিকে তাকিয়েছেন, সেগুলো প্যাক করে দাও।
স্টাফগুলো কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে বলল,,—’কিন্তু স্যার ম্যাম তো স্পেসিফিক্যালি কোনোটার দিকে তাকায়নি, উনি তো প্রায় এই লাইনে থাকার সবগুলো ড্রেসের দিকেই তাকিয়ে ছিল।
“তাহলে সবগুলোই প্যাক করে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিও।”——অকপটে কথাটা বলল নীল।
স্টাফগুলোর সাথে বিস্মিত হল তিহু নিজেও সাথে বিস্মিত হল তিহু নিজেও।স্টাফগুলো অবাক কণ্ঠে বললো,,—’সবগুলো?
—’হুম।
বলেই নীল বেরিয়ে যেতে নিলেই তিহু তাকে বাধা দিয়ে বলল,,—’আপনার কি মাথা খারাপ? এত ড্রেস দিয়ে আমি কি করব?

—’ড্রেস দিয়ে অন্যান্য মেয়েরা যা করে তুমিও তাই করবে। আর যদি করার কিছু না পাও তাহলে প্রত্যেকটা ড্রেস পরে আমার সামনে এসে ট্রায়াল দিতে পারো, প্রমিস গুড মার্কিং করব। এখন চলো আর একটাও কথা নয়।
তার এমন ত্যাড়া জবাবে মুখ কুঁচকালো তিহু‌। আর কোনো কথা না বলে, এগিয়ে চলল বিরক্তি মুখে।
তারা চলে যেতে স্টাফ গুলো একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,,—’এতো ড্রেস। এতগুলো অর্ডার একসঙ্গে আগে কখনো এসেছে স্যার?
তারা মালিকের দিকে তাকাতেই লোকটা বলল,,—’এটা যেন-তেন লোক নয় রে আনযার। এটা জমিদার বাড়ির বড় নাতি সঙ্গে দেশের নামকরা বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন ওয়াহাজ খান নীল, এনার ভাব-সাবই অন্যরকম।
পাশ থেকে একটা ছেলে বলল,,—’এনাকে তো আমি মিডিয়াতেও দেখেছি, মেইবি ছাত্রনেতা উনি তাই না?

—’হ্যাঁ। ভবিষ্যৎ মন্ত্রী।
—’ভবিষ্যৎ মন্ত্রী মানে?
—’মানে বর্তমানে ওনার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে,শুধুমাত্র বয়সের কারণে পিছিয়ে আছে। উনি নির্বাচনে দাঁড়ালে প্রথম চান্সেই সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ার উপযুক্ত। আর ওনার যোগ্যতা নিয়ে কথা বললে উনাকে ভবিষ্যৎ মন্ত্রীর থেকেও বড় কিছু মনে হয়।

প্রায় অর্ধ ঘণ্টার রাইড শেষে বাইক এসে থামলো এক আলোক সজ্জিত নির্জন স্থানে। তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকালে নীল বললো,,
—’বাইক থেকে নামুন ম্যাডাম।
—’এখানে নামবো কেন? বাসা তো অন্যদিকে।
—’আপনার সঙ্গে পরকীয়া করতে এসেছি এখানে।তাই নামুন।
—’মানে?
—’মানে আর কি? বিয়ে করা বউ তুমি আমার, কিন্তু প্রশ্নটা এমন ভাবে করছো মনে হচ্ছে কোনো অপরিচিত লোকের সাথে পরকীয়া করতে এসেছ। নামো।

শেষ কথাটা কিছুটা ধমকের সঙ্গে বলল নীল। তিহু মুখ কুঁচকে সঙ্গে সঙ্গে নামল বাইক থেকে। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ পূর্বক পাশে সরে দাঁড়ালো। নীল অবলীলায় বাইক থেকে নামল। হুট করে স্থানটার সমস্ত আলো নিভে গেল, স্বভাবতই ভয়ে কুঁকড়ে আসলো তিহু। এইটা এমন একটা সময় যখন তার রাগ-ঘৃণা-লজ্জা-অভিমান কিছুই কাজ করে না। ঠিক সেই জিনিস টাকেই কাজে লাগিয়েছে নীল।
আলো নিভিয়ে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে তিহুর হাতটা। তবে তাকে এখনো এমন ভয় পেতে দেখে, সামান্য ঝুঁকে তার কানে ফিসফিয়ে নীল বলল,,
—’আমার সঙ্গে থাকাকালীনও এত ভয় ম্যাডাম? ডোন্ট ওয়ারি, যতক্ষণ এই নীল খান পৃথিবীর বুকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে ততক্ষণ তার অসভ্য বউয়ের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। প্রমিস!
তিহু রাগ দেখাতে গিয়েও, ভয়ের কারণে কিছুই করতে পারল না। নীল তাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। হঠাৎ সে বলল,,

—’চোখ দুটো কি একটু বন্ধ করা যাবে?
—’কেন?
—’ভয় নেই, আমি তো আছিই।
তিহু না চাইতেও চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ জ্বলে উঠলো সমস্ত আলো। বাহারি রঙা আলোয় উজ্জ্বল হলো পুষ্পসজ্জিতস্থানটা। চোখ মেললো তিহু। হঠাৎ এমন আলোক ঝলকানিতে চোখ বুঁজে আসলেও সর্বশক্তিতে সেটিকে খুলে রাখল তিহু। চারিদিকে একঝলক তাকিয়ে বুঝলো স্থানটা শুধু ফুলে নয় বেলুন দিয়েও সাজানো হয়েছে।
খোলা আসমানের নিচে স্থানটা বড্ড মনোরম লাগছে। তবে সে খেয়াল করলো বেলুনের গায়ে কি যেন লেখা। ভ্রু কুঁচকে সে এগিয়ে গেল বেলুন গুলোর দিকে, কাছাকাছি আসতেই দৃষ্টিগত হলো সেখানে বড় বড় করে লেখা।

‘আ’ম স্যরি।
অন্য একটাতে লেখা,,‘স্যরি নুর।
আরেকটাতে,,‘এই নুর, শুনছো? আ’ম স্যরি।
পাশেরটাতে,‘রিয়্যালি স্যরি।
এভাবেই প্রায় হাজারটা বেলুন সজ্জিত হয়ে আছে। একেকটাতে একেক ভাবে দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। তিহু অবাক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালো। তবে এবার নীলের পরিবর্তে হাজারটা উড়ন্ত বেলুনকে দেখতে পেল সে, যেগুলোকে সদ্য বাতাসে ছাড়া হয়েছে। প্রত্যেকটা তে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে দুঃখের বহিঃপ্রকাশ।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২২

শ’য়ে শ’য়ে উড়ন্ত বেলুনগুলো এগিয়ে চলেছে উন্মোচিত দিগন্তের দিকে। রাতের আকাশে আজ রুপালি থালার ন্যায় বৃহৎ চাঁদ, বেলুনগুলো যেন পাড়ি জমাচ্ছে চাঁদের দেশে। হঠাৎ তার মধ্য থেকে ভেসে আসলো গভীর পৌরুষ কণ্ঠের তীব্র অনুশোচনা,,
—’শুনছো নুর? তোমার নেতা সাহেব আর কক্ষনো তোমার উপর রাগ করবে না,সে অনুতপ্ত।

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here