প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৭
নওরিন কবির তিশা
বিস্তৃত সবুজ মণ্ডিত প্রকৃতি, নাম না জানা মিষ্টি ফুলের সুবাস, সঙ্গে পাখ-পাখালির গুঞ্জন আর শত পর্যটকের কলরবের মাঝে শান্ত স্নিগ্ধ পর্বতচূড়াটা। দিগন্ত জুড়ে শুভ্র মেঘেরা ভেলার ন্যায় অলসভাবে ভেসে চলেছে, যেন কোনো সাদা তুলোর এক বিশাল স্তূপ। তা কখনো ছুঁয়ে যাচ্ছে পর্বত চূড়া, কখনোবা দূর আকাশের সুনীল ক্যানভাসে একে চলেছে নিঃশব্দ প্রেমের নীলকাব্য।
তিহুর ব্যথাটা স্প্রে করার পর থেকে বেশ কমেছে। বলা বাহুল্য সে যে খুব বেশি চোট পেয়েছিল তেমন নয়। যা সামান্য ব্যথা পেয়েছিল নীলের যত্নে তা মুহূর্তেই উবে গিয়েছে। বর্তমানে নীরা,রাফা জুনাইয়া কুহেলিকা আর মাহার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। সকলের হাত সজ্জিত হরেক রঙের পাহাড়ি ফুলের হস্ত তৈরি গাঁজরায়।
একে একে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল তারা। হঠাৎ কোত্থেকে এসে ফারিসা বলল,,~’বউমনি তোমরা জানো আজকে খাসিয়া পল্লীতে মেলা আছে!
‘মেলা?’——মুহূর্তেই কথাটা ছড়িয়ে পড়লো সবার মাঝে। শুরু হলো নানা জল্পনা কল্পনা।
কুহেলিকা:’কি বলো? মেলা তো বছরের প্রথমে হয় আর এখন তো….
ফারিসা:’আমিও তো সেটাই জানতাম। কিন্তু এখানকার একটা আপু বলল সম্প্রীতি কিছু সমস্যার কারণে মেলার সময়সীমা পিছিয়ে আনা হয়েছিল। শুরু হয়েছে দিন দুয়েক হল আজ শেষ দিন।
রাফা:’কি বলিস? আমি যাবো বউমনি। আমি কখনো নৃ-গোষ্টিদের মেলা দেখিনি।
তিহু:’ডোন্ট ওয়ারি। আজ যেহেতু শেষ দিন আর আমরা এখানে উপস্থিত অবশ্যই সকলে যাব।
মাহা:’মাথায় সমস্যা হয়েছে তোর? ঘড়ির কাটায় দেখেছিস কয়টা বাজে? সাড়ে পাঁচটা বাজতে গিয়েছে প্রায়।
তিহু:’সো হোয়াট? এমনিতেও মেলায় রাত্রিবেলাতেই বেশি মজা হয়।
তিহুর সঙ্গে সাঁয় মেলালো উপস্থিত সকলে। হঠাৎ জুনাইয়া বলল,,~’সবই তো ঠিক আছে কিন্তু নীলকে কে মানাবে?
কুহেলিকা:’তোমার কি স্মৃতিভ্রম হয়েছে জুনুপু? একটু আগে দেখলে না আমাদের নীল ভাইয়া কি পরিমাণ বউ পাগল। বউয়ের পা সামান্য মোচকে গিয়েছে বলে সমগ্র পথটাকে কোলে করে নিয়ে আসলো। এখনো তুমি বলতে পারছ না নীল ভাইয়াকে কে মানাতে পারবে?
বলেই তিহুর দিকে ইশারা করলো সে। সঙ্গে সঙ্গে তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকালো আর সকলে শব্দ করে হেসে উঠলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~’এই যে শুনছেন?
নীল ফোনে কথা বলছিল। অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে । পেছন থেকে হঠাৎ তিহুর ডাকে অপর প্রান্তের মানবটাকে থামিয়ে,ফোন মিউট করে সে বলল,,
~’জ্বী?
~’আপনি কি ব্যস্ত?
‘না!’——মুখে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অগোচরে নিঃশব্দে ফোনটা করে কেটে দিলো নীল। নিঃসন্দেহে এমন কাণ্ডে অপর প্রান্তের মানুষটা চূড়ান্ত বিস্মিত হয়েছে। কেননা খুব জটিল একটা অফিসিয়াল ইস্যু নিয়ে কথা বলছিল তারা।
~’ওহ, আমার না আপনার সাথে একটা কথা ছিল।
~’তো বলো?
~’ইয়ে মানে…….
~’কি মানে?
~’পাশেই তো খাসিয়া পল্লী, আর আজকে খাসিয়া পল্লীতে মেলা আছে। তাই আমরা চাচ্ছিলাম একটু মেলায়….
তার কথা শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে শব্দের ঝংকার তুলে বেজে উঠলো নীলের ফোন খানা। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আসলো নীলের। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে সেপানে তাকিয়েই বিরক্তিতে সেটা রিসিভ করল সে। তবে ফোন তুলেই গর্জে উঠলো সে,,
~’হোয়াটস রাবিশ! আমি যখন ফোন কেটে দিয়েছি তার মানে আমি ফোনের কনভারসেশনের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে ছিলাম। আবার কেন ফোন করেছিস ইডিয়েট?
অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো ইফাজের ভয়ার্ত কন্ঠ,,~’ভ-ভাই আপনি ইমরান স্যারের ফোন কেটে দিয়েছেন। উনি আমার সাথে ফোন দিয়ে রাগারাগি করছিল। আপনারা তো একটা জরুরী ক্লায়েন্ট মিটিং এর কথা বলছিলেন। তার মাঝে হঠাৎ….
পাশের কথার মধ্যে গর্জে উঠল নীল। চিৎকার করে বলল,,~’ফা*ক ইউর ইমরান স্যার। ফোন রাখ।
‘স্যার প্রায় পঞ্চাশ কোটির প্রজেক্ট।’——কথাগুলো আর বলা হলো না ভয়ার্ত ইফাজের, শব্দ গুলো উচ্চারিত হওয়ার আগেই,থেমে গেল গলার মাঝে। অজানা এক বাঁধা অতিক্রম করতে সক্ষম হলো না সেগুলো।কোন মতে সালাম দিয়েই ফোনটা কাটতে যাবে ঠিক তখনই ফোন কেটে দিল নীল। এদিকে তিহু নীলের গর্জনের শঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। নীল ফোন রেখেই তার উদ্দেশ্যে বললো,,
—’কি বলছিল যেনো তুমি?
—’ক-ক কই কিছু না তো।
—’মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই, মেলায় যেতে চাও তো? আচ্ছা চলো এক্ষুনি রওনা দিব না হলে রিসোর্টে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে ।
উচ্ছ্বাসে তিহু চিৎকার করে উঠল, এক প্রকার জড়িয়ে ধরতে গেল নীলকে। পরক্ষণেই নিজের এমন কান্ডে নিজেই লজ্জা পেল সে। পরক্ষণেই ছুটে পালালো জুনাইয়াদের উদ্দেশ্যে। তার এমন কাণ্ডে মুচকি হাসলো নীল।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে খাসিয়া জাতিসত্তা অন্যতম। সিলেট বিভাগের ছোট্ট এক টুকরো জায়গা জুড়ে আবাস তাদের। অদ্ভুত সুন্দর তাদের জীবন অভ্যাস, বিচিত্র সৌন্দর্যে মোড়ানো। বিশেষত মেলার সময়টিতে খাসিয়া পল্লীর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। খাসিয়া পল্লী অর্থাৎ পুঞ্জিটি সজ্জিত হয় নতুন রঙে। চারিদিকে অসংখ্য কণ্ঠের সপ্রাণ কলরব আর ঘন পানের বরজের সবুজ গন্ধ সঙ্গে কমলা বাগিচার স্নিগ্ধতা।
সন্ধ্যার আকাশটা রঙিন হয়ে উঠেছে। রক্তবর্ণ জমা হয়েছে নীল আকাশের পশ্চিম প্রান্তটায়। দিগন্ত জুড়ে রক্তিম মেঘের ঘনঘটা। ধীরে ধীরে সূর্যের আলো ম্লান হতে হতে একেবারে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখিগুলো মৃদুগুঞ্জনে নীড়ে ফিরছে। বিচিত্র আলোক রঙে সজ্জিত খাসিয়া পল্লীর মেলার প্রান্তরটা। একে একে চারখানা জিপ এসে থামলো। নামলো সকলে।
কপোত-কপোতিরা আলাদা আলাদা ভাবে মেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। সৌভিক-কুহেলিকা আর জুনাইয়া-আদিত্য প্রসাধনীর দোকানের সামনে ভিড় জমিয়েছে। জুনাইদের কোলে ঘুমন্ত আয়রাত। ব্যাচেলর মামাদের এই একটাই কষ্ট, কোথাও বেরোলেই বোনের ছেলে মেয়েদের বহনের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। জুনাইদের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। সামির অবশ্য ফাহাদ আর ফারিসাদের সাথে অন্যদিকে।
নিহিত রাফা আর নীরাকে নিয়ে অন্যস্থলে।সামির রুদ্র আর রিশাদ একে অন্যের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ানো। হঠাৎ রুদ্র বলল,,
—’কি এক জ্বালায় আছি ব্রাদার। বাড়ি থেকে বিয়ে দেয় না,এদিকে মেলায় এত কাপল। সয়না সয়না, বুকটা ফাইট্টা যায়।
তার কথায় সামির তার পশ্চাৎ দেশে আঘাত করে বলল,,-—’তোর এমনিতেই বিয়ে হবে না শা*লা।
রুদ্র তাকে কিছু বলতে গিয়েও থমকালো, দুষ্টু হেসে বলল,—’শালা যে বললি তা তোর বোনকে কি আমারে দিবি।
—’কক্ষোনা।
কথাটা বলতে দেরি সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র সামিরের পশ্চাৎ দেশে আঘাত করে বলল,,—’বোন দিবি না তা শা*লা বললি কেন?
সামির ব্যথায় উফ করে বলল,,—’তোর বিয়ে হবে না, বেডা বদ দোয়া দিলাম তোরে।
—’আরে যা যা, তোর বদ দোয়ায় আমার কিছু হবে না। আর এমনিতো আমি কি তোর মত দুর্বল নাকি? দশ দশটা বউ সামলানোর ক্ষমতা রাখি আমি।
পাশ থেকে রিশাদ বলল,,—’কেন ভাই তোমার কি কলিকাতা হারবালের প্রভাব বেশি?
তার এমন কথায় শব্দ করে হেসে উঠল সামির।
—’দেখি হাতটা দাও তো।
নীলের কথায় তার দিকে ঘুরলো তিহু। দেখলও নীলের হাতে একজোড়া কারুকার্যখচিত রেশমি চুড়ি। অন্যরকম সুন্দর সে জোড়া।তিহু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে দিল। নীল অতি যত্নে ধরল তার হাতখানা, পরম আবেশে পরিয়ে দিল চুড়ি জোড়া।
হঠাৎ দোকান থেকে একজন বৃদ্ধা বলল,,—’তোর বর নাকি রে মা?
তার কথায় তিহু লাজুক দৃষ্টিতে তাকালো নীলের দিকে। সামান্য মাথা নাড়তেই বৃদ্ধা হেসে বলল,,
—’চিরসুখি হ। কত্ত ভালো তোর বর আর আমার পাঠাটা!কত যত্নে বিয়ে করে ঘরে তুললাম বছর খানেকের মধ্যে সব নিয়ে পালিয়ে আরেক ছেড়িরে বিয়া করলো!
তিহু সামান্য হেসে উঠলো বৃদ্ধার এরূপ সম্মোধনে। পরক্ষনেই মস্তিষ্কে দোলা দিলো অন্য চিন্তাধারা। সত্যিই তো নীল আসলেও অন্যরকম।একটু বেশিই কেয়ারিং সে। যেকোনো মেয়েই নীলের প্রেমে পড়তে বাধ্য। হঠাৎ মনে হলো হৃদয়ে মহাপ্লাবন উঠেছে তার, ঢেউয়ের তোড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব,ভেসে যাচ্ছে কোনো এক অতলস্পর্শী মহাসমুদ্রে।তবে কি সেও….!
ভাবনার ইতি টানলো তিহু। দ্রুত নীলের দিকে চেয়ে চটজলদি বলল,,
—’চলুন বাসায় যাবো।
তার কথায় সামান্য ভ্রু জোড়ালো নীল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,,
—’এক্ষুনি? ফুচকা খাবে না?
—’না।
—’ওকে অ্যাজ ইউর উইশ।
তিহু সম্মুখে অগ্রসর হতে যেতেই ওড়নার আঁচলে বেঁধে হোঁচট খেল সে।পরে যেতে গেলেই নীল দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরল তার মেদহীন মসৃন পেটখানা। পরতে পরতে বেঁচে যাওয়া তিহুর খিঁচে রাখা চোখজোড়া শিথিল হলো। পরক্ষণেই নিজের অবস্থান টের পাবা মাত্র মৃদু ঝাকুনি দিলো সর্বাঙ্গ। চারিধারে বয়ে গেল এক অস্থির প্রেমপবন। অজানা শিহরণ জাগলো দেহ জুড়ে।
—’সাবধানে চলতে পারো না?
তিহু নিজেকে নীলের থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,,-—’না পারি না!
তিহুর সঞ্চালন টের বাবা মাত্র, নীল বন্ধন শিথিল করে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল তাকে। পরক্ষণেই তিহু হাঁটা লাগালো সম্মুখ পানে। নীল তিহুর মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া ওড়নার আঁচলটা সামান্য ঝুঁকে তুলে নিল নিজ হাতে।
মেলা থেকে একে একে বের হচ্ছে সবাই। সকলের হাতে পাহাড়ি প্রসাধনী সামগ্রী আর মৃৎশিল্পের ছোট ছোট প্রদর্শনী সামগ্রী।রাওফিনের দৃষ্টিতে যতগুলো প্রসাধনীই ভালো লেগেছে সব কিনে নিয়েছে মাহার জন্য । তবে বিপত্তি বেঁধেছে দিতে গিয়ে, মাহা যে তার উপহার কিছুতেই গ্রহণ করবে না সেটা ভালো করেই জানা। তবুও শেষ প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখেনি সে। কিন্তু মাহা প্রথম চেষ্টা তেই নাকোচ করেছে।
বর্তমানে মাহার ধমক খেয়ে তার পিছু পিছু চুপিসারে গাড়িতে এসে উঠেছে। একে একে ভর্তি হচ্ছে গাড়িগুলো। তিহুরা সবে বের হচ্ছে। নীল এখনো তিহুর পিছনে। হঠাৎ পদচারনা থমকালো তিহুর। বিস্মিত দৃষ্টি জোড়া সম্মুখে উঁচুতে তাকালো দারুন মুগ্ধতায়। মুখ থেকে হঠাৎই বেরিয়ে আসলো,—’হাউ কিউট!
তিহুর কথায় নীল একবার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে উন্মোচিত হলো কয়েকশত ঝিলমিল বেলুন। রাতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আলো ছড়াচ্ছে তারা। তিহু মুগ্ধ দৃষ্টিতে অনিমেষ চেয়ে আছে সেদিকে। নীল কিছু একটা ভেবে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতঃপর এগিয়ে এসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
—’ ডু ইউ ওয়ান্ট দ্যাট?
তিহু কিছু না ভেবেই মাথা ঝাঁকালো। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি পরক্ষণে কি ঘটতে যাচ্ছে। নীল তাকে রেখে এগিয়ে গেল ঝিলমিল বেলুনের মালিকের দিকে। দাম শুনেই মানিব্যাগ থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট বের করে ধরিয়ে দিল। তিহুর মস্তিষ্ক এতক্ষণে বিশ্লেষণ করতে পেরেছে সবটা।
সে বিস্ফোরিত নয়নের চেয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল নীলের দিকে। তবে ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। লোকটা টাকা বুঝে প্রস্থান করছে । নীল বেলুনগুলো হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে তিহুর হাতে দিতে যেতেই তিহু বলল,,
—’আর ইউ ক্রেজি? মাথায় প্রবলেম হয়েছে আপনার? এতগুলো বেলুন দিয়ে আমি কি করবো?
নীল এবার হাতের দিকে তাকালো, দন্ডে বিদ্ধ কমপক্ষে শ’খানেক বেলুন। তবে তাতে কোনো হেলদোল দেখালো না নীল। বরং সেগুলো তিহুর হাতে দিয়ে বলল,,
—’অ্যাজ ইওর উইশ, তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।কেনার দায়িত্ব আমার ছিল,এখন এগুলো নিয়ে তুমি কি করবা সেটা তুমি জানো। দ্যাট ইজ নন অফ মাই বিজনেস।
তিহু নিজের কপাল নিজেই চাপড়ালো যেন। এই মানুষটাকেউ না!ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। সে তো অবাক হয়েছিল এখানেও ঝিলমিল বেলুন থাকতে পারে দেখে। তার ওপর কিছু না ভেবেই সে নীলকে কেনার কথা বলেছিল কিন্তু কে জানতো নীল সবগুলো বেলুন কিনে নিবে। অপরদিকে তিহুকে এমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,নীল জলদি কণ্ঠে বললো,,
—’কি হলো নাও।
—’এতগুলো বেলুন দিয়ে আমি কি করব?
—’বললাম তো যা ইচ্ছা।
তিহু বুঝলো, এই লোকের সাথে ঝামেলা করে লাভ হবে না। একবার যখন বলেছে তখন কথার আর কোনো নড় চড়ও হবে না। অগত্যা বেলুন গুলো নিলো সে। বলা বাহুল্য তার নিজেরও যে খুব বেশি খারাপ লাগছে তেমনটা নয়। বরং ইচ্ছা করছে বেলুনগুলোকে মুক্ত হওয়ায় ছেড়ে দিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। হাজার হলেও ঝিলমিল বেলুন অতি পছন্দের তার।
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে, আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। মৃদুমন্দ সেই বাতাসে হিজাবের পাড় উড়ে চলেছে তিহুর। পাহাড় থেকে কিছুটা দূরে সামান্য উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আছে তারা। হঠাৎ কোত্থেকে এক ঝাপ্টা বাতাস তীব্র বেগে ধেয়ে এলো, সঙ্গে সঙ্গে তিহু বেলুন গুলোকে একে একে ছেড়ে দিল মুক্ত আকাশে। বাহারি রঙা সেগুলো উড়ে চলল মুক্ত ডানায় ভর করা পাখির ন্যায়, উন্মোচিত দিগন্তের দিকে।
রাতের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় ভেসে চলল সেগুলো, পাড়ি জমালো চাঁদের দেশে। তিহু উচ্ছ্বাসিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সেদিকে, আর নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।
রাতের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কালো মেঘের দস্যিপনায় লুকায়িত অর্ধ চন্দ্র খানা। খাসিয়া পল্লী থেকে বেশ অনেকটা দূরে নির্জন স্থানে দাঁড়িয়ে আছে নীল আর তিহু। বেরিয়েছিল সবার সঙ্গে, তবে সকলে এগিয়ে গেলেও কপাল খারাপ তাদের। মাঝপথেই খারাপ হয়ে গিয়েছে গাড়িটা। ইঞ্জিন গরম হয়ে বিশ্রী অবস্থা। আর আজ মেলা সেই সাথে রাত বেশ গভীর হওয়ায় কোনো মেকানিকের দোকানই খোলা পাওয়া যাবে না এখন।
উপায়ন্তু না পেয়ে বাকি সকলকে অন্যান্য গাড়িতে চাপাচাপি করে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গার সংকটে পড়েছে নীল আর তিহু। শেষমেষ এই নির্জন মাঝ রাস্তায় অবস্থান হয়েছে তাদের। যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা গাড়ি তাদের নিতে আসবে। কিন্তু ততক্ষণ এখানেই অবস্থান হবে তাদের।
আকাশটা হঠাৎই কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। পুঞ্জিভূত মেঘগুলো একে একে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র অন্তরীক্ষে। জোৎস্নাপতিটির সমস্ত আলো ম্লান হয়েছে গুরুগম্ভীর মেঘের অন্তরালে। যেন মনে হচ্ছে এখনই আকাশ ভেঙ্গে নামবে ভারী বর্ষণ। তিহু চোখ বুঁজে বৃষ্টির আগ মুহূর্তটা উপভোগ করছে। নীল তখনো ফোন কলে ব্যস্ত। স্থানটা অত্যন্ত নির্জন আর তিহু তার সঙ্গে থাকায় চিন্তার পরিমান দ্বিগুণ তার। হঠাৎ তিহু বলল,,
—’নেতা সাহেব?
তিহুর এমন সম্মোধনে তার দিকে ঘুরলো নীল। ফোনটা অফ করে বলল,,
—’জ্বী?
—’বৃষ্টির আগে প্রকৃতিতে একটা ভেজা ভেজা সোঁদা গন্ধ থাকে। কখনো অনুভব করেছেন?
তার এমন কথায় কিছুটা অবাক হলো নীল।—’না তো।
—’তাহলে আজ করুন।
—’কিভাবে?
—’প্রথমে চোখ দুইটা বন্ধ করুন।
তার নির্দেশনা অনুসারে নীল চোখ বন্ধ করলো। তিহু সেভাবেই চোখ বন্ধ রেখে বলল,,
—’এবার অনুভব করুন আপনার চারিদিক নিস্তব্ধ ।
—’হুম।
—’একটা মিষ্টি ঘ্রান পাচ্ছেন? সঙ্গে একটা অদ্ভুত সুর?
সত্যি সত্যি নীল এক অদ্ভুত ধরনের সুবাস পাচ্ছে, কর্ণগত হচ্ছে এক সুমিষ্ট সুর। সে সেভাবেই চোখ দুইটা বন্ধ রেখে বলল,,
—’হুম, পাচ্ছি।
—’এভাবেই অনুভব করুন। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।
—’সত্যি?
—’হুম।
—’বাই দ্যা ওয়ে,নূর?
—’জ্বী বলুন।
—’তুমি আমাকে নেতা সাহেব কেন বলো? আমি তো নেতা নই।
—’কে বলল আপনি নেতা?
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিহু ফের বললো,,—’হ্যাঁ আপনি নেতা সাহেবই। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র আমার।
তিহুর এমন জবাবে তড়িৎ বেগে চোখ মেলল নীল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,,—’মানে?
তিহু চোখ বন্ধ রেখেই তাকে থামিয়ে বলল,,-—’উসসসস, আস্তে। চোখ বন্ধ করুন। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।
“মানে?”——নীলের কথাটা বলতে দেরি। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভেঙে শ্রাবণের অমোঘ ধারার ন্যায় ঝড়ে পড়ল বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কন্যারা।তিহু এবার চোখ মেলে তাকালো। মুচকি হেসে নীলের পানে তাকিয়ে বলল,,
—’দেখলেন তো? বৃষ্টি নেমেছে।
সে দু হাত দুদিকে প্রসারিত করে। মুখটা আকাশের পানে দিয়ে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অনুভব করতে লাগলো তীব্র বর্ষন। উচ্ছ্বাসিত ভঙ্গিমায় এগিয়ে গেল সামনের দিকে।নীল অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি থেমে হুট করে শুরু হলো তীব্র বর্ষন। হঠাৎ বর্ষণের তীব্রতায় মুখ কুঁচকে আসলো তিহুর। পরক্ষণেই সেথায় ফুটে উঠলো উচ্ছ্বাসের আভা।
তীব্র বর্ষন সিক্ত করছে গোটা ধরণী। গ্রীষ্মের প্রকট খরতাপ শেষে সবুজ বটবৃক্ষ আর লতাপাতারা যেন প্রাণ খুলে স্নান করছে বারিধারায়। নীল এগিয়ে এসে তিহুর সামনে দাঁড়ালো।তিহু মুচকি হেসে চোখ কুঁচকে তাকাতেই তাকে অবাক করে দিয়ে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো নীল। হঠাৎ কোনোরূপ পূর্বাভাস ছাড়াই তিহুর পা টা তুলে নিল নিজের অন্য হাঁটুতে। বিস্মিত তিহু অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আরোহন করছে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে সে বলল,,
—’কি করছেন?
নীল একঝলক বিস্মিত তিহুতে তাকালো। অতি সতর্কতার সহিত বলল,—’উসস।
তিহু বিষ্ময়ের সীমা চূর্ণ করে তাজ্জব বনে গেছে। স্তব্ধ-স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।নীল অতি সন্তর্পণে পেছন পকেট থেকে বের করল একজোড়া নুপুর। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় স্বর্ণের ন্যায় চিকচিক করছে তা। কাছাকাছি আনতেই অনুভূত হলো আসল স্বর্ণ এটা।তিহু বিস্মিত-শান্ত-স্থবির।নীল অতি যত্নে একইভাবে সেগুলো পরিয়ে দিল তার দুটি পায়ে । ফর্সা পায়ে স্বর্ণ খন্ড গুলো উজ্জ্বল রৌদ্রের ন্যায় আভা ছড়াচ্ছে।নীল অপলক চেয়ে রইল সেদিকে।
এদিকে তিহু যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না তার সাথে এসব হচ্ছে।সে একপলক নিজের পায়ের দিকে তাকালো।পরপর নীলের পানে। রাত-নিস্তব্ধ, নির্জন এক উপত্যকায় বৈশাখ মাসে শ্রাবণের অমোঘ বর্ষণ সিক্ত করছে এক জোড়া কপোত-কপতিকে। কিন্তু তাতে কোনো হেলদোল নেই তাদের। একজনের দৃষ্টিতে অপরেতে স্থির।বড্ড আকুল-নিবিড়-মুগ্ধ সে দৃষ্টি।
হঠাৎ কি ভেবে তিহু সম্মুখ পানে দৌড়ে গেল,তার পায়ের ছোঁয়ায় রাস্তায় জমে থাকা পানি কনার উপচে উঠলো।চারধারে ধ্বনিত হলো নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ,নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠলো,,
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৬
🎶 রিমঝিম এ ধারাতে চায় মন হারাতে…..
রিমঝিম এ ধারাতে চায় মন হারাতে…..
এই ভালোবাসাতে আমাকে ফাঁসাতে…..
এলো মেঘ যে এলো ঘিরে…..
বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগীনি……..
মনে স্বপ্ন এলোমেলো এই কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী..?
