প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৭
নওরিন কবির তিশা
দীর্ঘ এক নিশীথ প্রহরের চেতনাহীনতার অবসান ঘটিয়ে, জ্ঞান ফিরলো তিহুর, শরীরের তাপমাত্রা এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে । তবে এখনো চারিধারে হালকা কুয়াশার আবরণ যেন আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে তাকে । কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আজ সকালটা একটু অন্যরকম আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে তার অবচেতন মনে, কেন যেন মনে হচ্ছে এটা তার গতানুগতিক বিছানা নয়।
অত্যাধিক নমনীয় আর কোমলতার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করছে তিহু । হঠাৎই হাতে কারো রেশম কোমল ঘন কেশরাজের নরম স্পর্শ উপলব্ধি করল সে । ঘুমঘোরের আনমনা তন্দ্রাচ্ছন্নতার মাঝে সেই স্পর্শ বেশ ঠেকছে তার । ধীরে ধীরে তিহু নিজের হাতের বিচরণ শুরু করলো, সেই নরম কোমল কেশরাজের উপর।
এমন নরম আবেশের মধ্যিখানে অবস্থানরত তিহু কি জানি মনে করে দ্রুত চোখ খুলল । সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ পানে চেয়ে এক পরিচিত তবে অজ্ঞাত মানবের উপস্থিতিতে এক প্রকার চেঁচিয়ে উঠল,সে,,,
———-“আপনি?”
গতকাল সারারাত তিহুর জ্বর কমার যেন নামই নিচ্ছিল না। এক প্রকার সমগ্র রাত জুড়েই তার মাথায় অনবরত জল পটি দিয়ে গিয়েছে নীল। শেষ রাতের দিকে তার জ্বরটা যখন সামান্য নিয়ন্ত্রণে তখন আর ক্লান্ত শরীরকে শান্ত রাখতে পারল না নীল । তিহুর পায়ের ধারে বসেই বিছানায় নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল সে । তবে হঠাৎই কারো এমন চিৎকারের আকস্মিকতায় ঘুম ভেঙে গেল তার । চোখ কুঁচকে সে বলল,,,
———“হোয়াট দা হেল? সকাল সকাল চিল্লাচ্ছো কেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিহু এক লহোমায় লুফে নিল তার মুখের কথাটা। ঝটকা মেরে বিছানার উপর উঠে বসতে গিয়ে,একবার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। তবে সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে সে বলে উঠলো,,,
———“আপনি আমার রুমে কি করছেন? আপনার ক্যারেক্টার তো একদম ঢিলা দেখছি, ফলো করতে করতে আমার রুম পর্যন্ত চলে এসেছেন? অসভ্য লোক কোথাকার!”
সারারাত যার সেবা করে নির্ঘুম রাত কাটালো নীল, সকাল সকাল তার মুখেই এমন কথা শুনে মেজাজ ধরে রাখতে পারল না সে । আগ্নেয়গিরির লাভা-স্রাবের ন্যায় এক দুরন্ত দাহ ঝড়ে পড়ল তার কণ্ঠস্বর দিয়ে,,,
———“এই মেয়ে চুপ। অসভ্যতার একটা লিমিট থাকে, এটা আমার রুম। আর তুমি বর্তমানে আমার বিছানায় শুয়ে আছো। সো সাট আপ, আর এক্ষুনি নামো আমার বিছানা থেকে। কুইক!!”
তিহু বোকা দৃষ্টি মেলে তাকালো। এই লোকের রুম মানে? পরক্ষণই তার মনে পড়ল কাল সন্ধ্যা পরবর্তী ঘটনা গুলো। সঙ্গে সঙ্গে নিজের বোকামির জন্য নিজেই কপাল চাপড়ালো সে। তবে সেও কি দমবার পাত্রী নাকি? সে তো নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেনি, বরং নীল তাকে জোর করে বিয়ে করছে । তাহলে সে কেনো বিছানা থেকে নামবে? তিহু বিছানায় গাঁট মেরে বসে থেকে বলল,,
———“এই যে মিস্টার লাল মিয়া শুনুন, আমি কোনো শখ থেকে আপনাকে বিয়ে করিনি, আর শখ কি জিনিস আমি তো আপনাকে বিয়েই করতে চাইনি । আপনি জোর করে আমাকে বিয়ে করেছেন। সো এখন থেকে এই বিছানা আমার । বেশি নিজের নিজের করবেন তো……”
তিহুর প্রত্যেকটা কথায় মেজাজ হারাচ্ছে নীল । তার ভাসমান শিরাযুক্ত হাতটা ক্ষণে ক্ষণে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিবারণের চালাচ্ছে সে। কেননা তার খুব ভালো করেই জানা এই মেয়েকে এখন বেশি ঘাটানো ঠিক হবে না। এমনিতেই বাড়ির কেউ বিয়ের ব্যাপারটা এখনো মানে নি, সবাই জানে তাদের লাভ ম্যারেজ।
তার উপর এখন যদি তিহু সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দেয়। তাহলে মান সম্মান একদমই জলাঞ্জলি যাবে তার। সে আর কোনো কথা না বলে, সেখান থেকে উঠেই পা বাড়ায় ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে । সে চলে যেতেই তিহু এক শয়তানি হাসি হেসে মনে মনে বলে,,,,
———“আহারে চান্দুটা, আমার কয়টা কথা শুনেই সোজা ওয়াশরুমে? আমাকে জোর করে বিয়ে করার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবো তোমায় । জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ ।”
কিছুটা শব্দ করে ঠোঁট চেপে হাসলো তিহু। অতঃপর নরম বিছানাটাতে ফের শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,,,
———“ব্যাডা যাই হোক , হেতির বিছানাটা নরম আছে। আহারে! এত নরম বিছানা রেখে কি লাভ, যদি নিজেই না শুতে পারে । ইস রে তুমি বিছানাটা ভীষণ বাজেভাবে মিস করবা সোনা আমার ।”
ঘন্টাখানেক………
বেলা বেশ চড়াও হয়েছে। দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক ধ্বনি, সকাল দশটার জানান দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই নীল ফরমালি ড্রেস আপ করে সম্ভবত অফিসে গিয়েছে। তিহু ঘুমের ভান করে, বেশ পর্যবেক্ষণ করছিলো লোকটাকে। লোকটার ফ্যাশন সেন্স, মারাত্মক লেগেছে তার । তারউপরে লোকটার ব্যবহৃত এক্সপেন্সিভ পারফিউমের স্মেলটা এখনো সমগ্র রুমের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। নীল রুম থেকে বের হবার পরপরই তিহু ঝটপট, ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিলো ।
বর্তমানে নীলের রুমের পূর্ব পাশের ছাদহীন বিশাল বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে আছে,তিহু । এখান থেকে পুরো খান মহলটাই বেশ ভালো পর্যবেক্ষণ করা যায়। তিহু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে পুরো মহল পর্যবেক্ষণ করছে। ঢাকার বুকে এমন বাড়ির উপস্থিতি দুষ্কর । দুই তলা বাড়িটি, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের, কিছুটা ইউরোপিয়ান আর প্রাচীন স্থাপত্য শৈলী বাড়িটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে তুলেছে।
তবে অদ্ভুততম সুন্দর জিনিসটা হচ্ছে, ভবনের বাইরের গম্বুজ আকৃতির গোল চত্বর, আর সুইমিং পুলটা। বেশ ইন্টারেস্টিং। তার ওপর মহলের প্রধান গেইট থেকে, মহলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রবেশের রাস্তাটা সাদা কংক্রিটের। ঠিক যেন কোনো সাউথ ইন্ডিয়ান ট্র্যাডিশনাল কোনো মুভিতে ব্যবহৃত বিশালাকার রাজপ্রাসাদ।
তিহু যখন এ সকল কল্পনার কল্প লোকে ডুব দিতে ব্যস্ত ঠিক তৎক্ষণাৎ, রুমের দরজায় নক করে কেউ । ব্যতিব্যস্ত তিহু জলদি, রুমে প্রবেশ করে। ঝটপট বলে ওঠে,,
———“জ্বী আসুন।”
কিছুক্ষণের মাঝে এই রুমে হরেক রকম ফলফলাদি আর খাবার সুসজ্জিত এক ট্রে হাতে প্রবেশ করলেন দামি তসর সিল্ক শাড়ি পরিধানরত একজন মধ্যবয়স্ক নারী। তার সঙ্গে দুজন কিশোরী, একজনের বয়স হয়তো ১৫ কিংবা ১৬ বছর হবে, আর অপরজনের হয়তো ১৩ কিংবা ১৪ । তবে বয়সের ছোট মেয়েটার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো তিহু। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে কিছু বলল না। হয়তো মেয়েটা অনেক বেশি পড়ুয়া।
তিহু শুধু সবার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। মহিলাটি খাবারগুলো বেড সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,,,
———“এখন তোমার কি অবস্থা মা? জ্বর কমেছে?”
এক স্নেহময়ী মাতৃসুলভ কন্ঠে প্রশ্নখানা করলো মহিলাটি । তিহু মুচকি হেসে জবাব দিল,,,———“জ্বী এখন একটু কমেছে।”
মহিলাটি এগিয়ে এসে তার কপালে হাতে ঠেকালো। কিছু মুচকি হেসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে তিনিও খানিক হেসে বললেন,,, ———“আমাকে দেখে অবাক হও না মা । আমি হচ্ছি তোমার, খালা প্লাস চাচী শাশুড়ি । বুঝলে না তো?”
তিহু মাথা ঝাঁকালো, অর্থাৎ সে বোঝে নি। মহিলাটি হেসে বললেন,, ———“আমি, নীলের ছোট খালা প্লাস ছোট কাকিয়া। এবার বুঝেছো?”
তিহু:“জি আন্টি!”
মির্জা সায়মা, তৎক্ষণাৎ তীব্র বিরোধিতার সহিত মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,,,———“উহু, আন্টি না, তুমি আমাকে কাকিয়া বোলো। ঠিক আছে?”
তিহু মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো ।———“আচ্ছা কাকিয়া।”
তাদের এমন কথোপকথন এর মাঝে বাগড়া দিয়ে রাফা বলল,,,
———“ও মিমিয়া, শুধু কি তুমিই কথা বলবে? আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে না বউ মনির সাথে?”
মির্জা সায়মা হেসে তাকালেন। অতঃপর তাদের দুজনের সাথে একে একে পরিচয় করে দিলেন তিহুকে। সর্বপ্রথম রাফাকে দেখিয়ে সে বলল,,———“এই হচ্ছে তোমার সবচেয়ে অধৈর্য ননদ, তোমার সেজো ননদ।”
তাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে;রাফা তিহুর দিকে এগিয়ে এসে বলল,,———“উফ মিমিয়া, এভাবে কেউ পরিচয় করায়। আচ্ছা তুমি শোনো, আমি বলি, আমি রাওফিয়া হক রাফা। তোমার বড়,কি জানি বলে ওইটাকে? হ্যাঁ ফুফু শাশুড়ি, তোমার বড় ফুফু শাশুড়ির একমাত্র মেয়ে। বুঝেছ?”
রাফার কথায় হেসে উঠল তিহু। সে রাফার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,,———“ওহ ইউ আর সো সুইট, বাই দ্যা ওয়ে আমি নুরাইন, নুরাইন হক তিহু।”
রাফা: “তুমিও অনেক কিউট, বউমনি।”
তাদের এমন কথোপকথনের মাঝেও নিশ্চুপ চশমা পরা মেয়েটা।তিহু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,,———“কি ব্যাপার? সুইটি, তুমি কথা বলছো না কেন?”
রাফা এগিয়ে এসে মেয়েটির মাথায় এক গাট্টা দিয়ে বলল,,———“ওই নীরা, কথা বলিস না কেন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিস নাকি?”
অতঃপর সে মির্জা সায়মার দিকে ফিরে বলল,,———“আচ্ছা মিমিয়া, তুমি তোমার মেয়েকে কোন গ্রহ থেকে ইমপোর্ট করে আনছিলে বলোতো? ও তো কারো সাথে কথাও বলে না, সারাদিন পড়তে থাকে, এই দেখো একটু আগেও পড়ছিল আমিইতো একপ্রকার ধরে বেঁধে নিয়ে আসছি। সারাদিন পড়ে পড়ে চোখটা খাইছে তার পরও ওর পড়া লাগবে।”
মির্জা সায়মা,,———“কি করব বল? বারণ দিলেও কখনো শোনে? কতবার বারণ করছি এত পড়াশোনার দরকার নেই এইটুকু বয়স হবে নাইনে পড়ে, তার ভিতরে এত চাপ নেয় মেয়েটা ।”
তিহু হেসে বলল,,———“টেনশন নট কাকিয়া, আই উইল ম্যানেজ, আপনার মেয়েকে আমি দুই দিনের মাঝে এত দুরন্ত আর চঞ্চল করে ফেলব, যে আপনি নিজেই বলবেন। আমার মেয়ে এমন কি করে হলো?”
মির্জা সায়মা,,———“দেখোতো কি করা যায়। যাইহোক এখন তুমি আসো । তোমাকে একটু নিজের হাতে খাইয়ে দিই। কাল রাতেও তো কিছু না খেয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিলে। নীলটা সারা রাত জেগে তোমার, সেবা করলো।”
তিহু এতক্ষণ হেসে হেসে কথা বললেও, মির্জা সায়মার বলা শেষ কথাটায় সে চমকে তাকালো তার দিকে,,———“সারারাত জেগে সেবা করেছে মানে?”
মির্জা সায়মা পায়েসের বাটি থেকে সামান্য পায়েস, চামচে কেটে ফুঁ দিতে দিতে বলল,,———“তা নয় তো কি, ছেলেটা আমার সারারাত জেগে তোমার সেবা করছে, ও তো মনে হয় কালকে রাতে একদম ঘুমায়নি । খায়ও নি কালকে রাতে কিছু । কি জাদু করেছ বলোতো? আমাদের নিয়মতান্ত্রিক ছেলেটাও , কালকে নিয়ম ভঙ্গ করে সারা রাত জেগেছে।”
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৬ (২)
মির্জা সায়মার প্রত্যেকটা কথায়, যেন আকাশ থেকে পড়ছে তিহু। এমন একটা লোক কাল সারা রাত তার, সেবা করেছে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। তবে সে আর প্রশ্ন করতে পারল না । মির্জা সায়মা এগিয়ে এসে এক এক করে খাইয়ে দিতে লাগলো তাকে । খাওয়ানো শেষে গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টায়, কেটে গেল সমগ্র সকালটা।
মির্জার সায়মার মাধ্যমেই পুরো বাড়ির সবার পরিচয় পেলো তিহু। সে যতদূর বুঝলো, নীলের কাজিনমহল নেহাতই কম নয়। তার একজন ভাসুর একজন দেবরসহ মোট চার চারটা ননদ আছে। বেশ ভালো লাগলো তিহুর ব্যাপারটা । এমনিতেই সে যৌথ পরিবার অনেক বেশি পছন্দ করে, তার উপর সেই পরিবারে যদি থাকে এতগুলো কাজিন তাহলে তো আর কথাই নেই।
