প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৭ (২)

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৭ (২)
নওরিন কবির তিশা

খান মহলে আজ নেমেছে নিস্তব্ধ অপরাহ্ন । সমগ্র ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা । উপস্থিত গুটিকয়েক জীবের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু গুঞ্জন ব্যাতিত থমকে আছে সেখানকার বায়ুর সঞ্চালন । সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, দোতলার ঝুল বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, রাফা আর নীরা । রাফা হা হয়ে নিচে তাকিয়ে বড়দের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করছে, এদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেল নীরা । রাফাকে ঝাঁকিয়ে সে বলল,,,

———“কি এত দেখছিস? চল না রুমে যাই। আমার বায়োলজি টা এখনো পড়া বাকি আছে।”
নীরার কথায় মেজাজ হারালো রাফা। সে কখন থেকে সে চেষ্টা করছে নিচের কথোপকথন শোনার। খরগোশের ন্যায় কান খাঁড়া করে দাঁড়িয়েছিল সে। হঠাৎই নীরার এমন ধাক্কায় মনোযোগে বিঘ্ন ঘটতেই সে নীরার মাথায় এক গাট্টা দিয়ে বলল,,,
———“কিসের এতো পড়াশোনারে তোর? পড়িস তো সবে নাইনে। কিছুদিন পর আমার এসএসসি, তাও তো আমি বোধহয় দিনরাত মিলিয়ে ৫ ঘণ্টার বেশি কক্ষনো পড়ি না । ”
নীরা:“এই জন্য তো ফুফু আম্মুর কাছে মারও কম খাস না। যাইহোক এখন আমাকে ছাড় আমার যাওয়া লাগবে । আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বম্মা যদি জানতে পারে, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে দিয়ে বড়দের কথা শুনছি তাহলে মাইর একটাও নিচে পড়বে না কিন্তু।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাফা: “তুই এতো ভীতু কেন রে? আচ্ছা চল। এমনিতেই কিছু শোনা যাচ্ছে না।”
তারা দুজনেই নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ায়। এদিকে নিচে…
গ্রামের বাড়ি থেকে আজ প্রায় পাঁচ দিন পর ফিরেছেন, ওয়ালিদ খান। তবে মহলে এসেই ছেলের কান্ড শুনে হচকিত তিনি ‌। তবে এটাও সত্যি যে যতটা ঘটেছে তার থেকে বেশি বেশি ভাইকে বলেছেন রৌশানারা খান । বর্তমানে ভীত, থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই, সকলের চোখে মুখে সামান্য ভীতি দৃশ্যমান হলেও, নিশ্চুপ মির্জা সূচনা।
মির্জা সায়মা চোখ দিয়ে বড় বোনকে বোঝাচ্ছেন যেন তিনি শান্ত থাকে, কেননা মির্জা সূচনার রাগ সম্বন্ধে খুব ভালো করেই অবগত তিনি। ওয়ালিদ খান গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। হঠাৎই রৌশানারা খান বললেন,,,
———“ভাইজান, তোমার কথার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। এখন তো কিছু বলো। শুনলেই তো তোমার বউ কি বলেছে আমায়?”

ওয়ালিদ খান,,,———“কি হয়েছে সূচনা তোমাদের? কয়টা দিন আমি বাসায় নেই, এরই মধ্যে এত কিছু?”
মির্জা সূচনা আর নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। সারা জীবনই অতি গাম্ভীর্যময়ী রমণী তিনি। জমিদার বাবার একমাত্র বড়মেয়ে বলে কথা । গাম্ভীর্য আর আভিজাত্য তার রন্ধে রন্ধে প্রবাহমান । বলা চলে তার এই গুণের কারণেই ওয়ালিদ খানের বাবা ওমর খান, তাকে বাড়ির বড় বউ করে নিয়ে এসেছিলেন ।বরাবরের মতোই রাশভারী গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে তিনি বললেন,,,
———“কি এমন হয়েছে? আমার ছেলে বিয়ে করেছে? এটাতেই তোমাদের আপত্তি তো? যেহেতু আমার ছেলে একটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে, সেজন্য সে মেয়েটার দায়িত্ব আমারও। তবে এটাতে তোমার যদি কোনো সমস্যা থাকে একবারই বলে দাও, আমি এক কাপড়ে আমার ছেলে আর আমার বউ মাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।”

ওয়ালিদ খান,,———“সে কথা আমি কখন বললাম?”
মির্জা সূচনা আর এক মুহূর্ত বসলেন না । ধৈর্য হারা পথিকের ন্যায় সবেগে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন,,
———“সে কথা তোমরা মুখে বলোনি, এটা যেমন সত্য। তেমনি তোমাদের আচার-আচরণ ইঙ্গিত করছে, তোমরা মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলতে চাও। আর আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলের বউয়ের এক বিন্দু পরিমাণ, অসম্মান হতে দেবো না । আর সেটা যদি তোমার সাম্রাজ্যে লঙ্ঘিত হয়, তবে আমার বৌমার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আমি তোমার সাম্রাজ্য ছাড়বো।”

ওয়ালিদ খান বাবার একটা কথা খুব মানেন,,‘সৎকর্মশীল নারী, নিজে যেমন ভাগ্যবতী। তেমনি সে যে পরিবারে থাকে সেই পরিবারের ভাগ্যের চাবিকাঠি। তবে সেই নারী যদি নিজের মত প্রকাশের সুযোগ না পায়, তাহলে সে ভাগ্যবতী থেকে ধ্বংসবতী হতেও মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় নেয়।’নিঃসন্দেহে মির্জা সূচনা ভাগ্যবতী নারী। কেননা সে এই সংসারে আসার পর থেকেই, সংসারের উন্নতি কখনো থেমে থাকে নি।
পরপর তিনবার এমপি হয়েছেন ওয়ালিদ খান। প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গড়ে তুলেছেন এই সাম্রাজ্য। যার জন্য এতকিছু সেই যদি বলে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা, তাহলে নিশ্চিত এখানে এমন কিছু আছে, যা ওয়ালিদ খান ধরতে পারছেন না। তিনি মির্জা সূচনার দিকে ফিরে বললেন,,,,,

———“শান্ত হও সূচনা। আমি বুঝছি ব্যাপারটা। না তো তুমি কোথাও যাবে,নাতো তোমার ছেলে, আর না তো ছেলের বউ. এটা ভুলোনা যে সে যতটা তোমার ছেলে ঠিক ততটাই আমার ছেলে। অর্থাৎ বউমাটাও আমার।”
ভাইয়ের এমন কথায় আরেকবার নিজের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল যেন রৌশানারা খানের। তিনি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যেতেই রুমিন আরা পাশ থেকে তাকে থামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,,,
———“আপা, এখন অনন্তত চুপ থাক। ভাইজান যদি রেগে যায়, আর ভাবি তো অলরেডি ফায়ার হয়েই আছে।”
বোনের কথায় থামলেন,, রৌশনারা। তবে কিছুতেই এই বিয়েটা মানতে পারলেন না তিনি।
সন্ধ্যার কিছুটা পরে…………
নীলের রুমের, ছাদ খোলা বেলকনিটাতে বসে গল্প করছিল রাফা নীরা আর তিহু। একদিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তিহুর। বেশ অনেক ব্যাপারে গল্প আলাপচারিতা শেষে হঠাৎই রাফা তীহুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,,,

———“আচ্ছা বউমনি, বাড়ির সবার ভাষ্যমতে যা বুঝলাম তাতে তো তোমাদের লাভ ম্যারেজ । আই জাস্ট শকড, নীল ভাইয়ার মতো মানুষ কোনোদিন লাভ ম্যারেজ করতে পারবে এটা তো আমরা কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারিনি। অবশ্য সেটা নিহিত ভাই হইলে মানা যাইত। তা বউমনি বলোনা তোমাদের লাভ স্টোরি।”
রাফার কথায় রীতিমত আকাশ থেকে পড়ল তিহু। তাদের লাভ ম্যারেজ মানে? ওটাকে লাভ ম্যারেজ বললে, নিশ্চিত লাভ ম্যারেজের অবমাননা হবে। ওটাকে তো তিহু আনওয়ান্টেড ফোর্স ম্যারেজ ছাড়া অন্য কোনো ম্যারেজ হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না । তবে এখন সে কি বলবে? হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে সে বলল,,,

———“আচ্ছা রাফু, শুনলাম নাকি আমার আরো দুইটা ননদিনী আছে, তারা কোথায়?”
রাফা:“ওহ হ্যাঁ আছেই তো। নাহা আপু আর মুন্নি আপু।”
তিহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বললো,,
———“ তারা কোথায়?”
নীরা:“মনি আপু তো আজকে সারাদিন, রুম থেকেই বের হয়নি। আর নাহা আপু সারাদিন তার কাছেই ছিল।”
‌তিহু:“কেন? সে কি অসুস্থ নাকি?”

রাফা:“আরে না কিসের আবার অসুস্থতা? এমনিই বের হয়নি। আর আমাদের দুজনকেও রুমে ঢুকতে দিচ্ছে না। সকাল থেকেই নাহা আপু আর মনি আপু রুমে দরজা দিয়ে বসে আছে।”
ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলো তিহুর কাছে। তার উপস্থিতি কি এতটাই বিভ্রান্তিকর যে,কেউ রুমে দরজা দিয়ে বসে থাকবে। আর তিহু রাফার কাছ থেকে যতদূর জেনেছে, নাহা নীলের নিজের বোন, আর মুন্নি নামক মেয়েটা কাজিন। সে আবার নাকি নীলের একটু বেশিই যত্ন করতো । তবে কি..? সে যখন কল্পলকে ডুব দিতে ব্যস্ত ঠিক ততক্ষণাৎ দরজার কড়া নাড়ার শব্দ ধ্যান ভাঙলো তার। বাড়ির একজন পুরাতন মেড রহিমা এগিয়ে এসে বললেন,,,

———“রাফামনি,নীরামণি, তোমরা বউমনিকে নিয়ে রুমে আসো। ভাবি আর ভাইজান ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।”
ভাবি আর ভাইজান বলায় কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে তাকালো তিহু। চিনতে পারল না বোধহয়, তবে রহিমা খালার এমন সম্বোধনে রাফা আর নীরার বুঝতে বাকি রইলো না সে কার কথা বলছে। তারা ঝটপট কাউচ থেকে উঠে তিহুর উদ্দেশ্যে বলল,,,
‌ ———“বউমনি, রুমে চলো। বড় মামু আর মামিমা তোমার সাথে দেখা করবে।”
রাফার কথায় তিহু বুঝলো । যে এখন তার সাথে দেখা করতে আসবে স্বয়ং এমপি ওয়ালিদ খান আর তার সহধর্মিনী । আল্লাহই জানে কি ঝড়-তুফান অপেক্ষা করছে তার জন্য .। ওয়ালিদ খান কি সবটা জেনে গিয়েছে, আর তিহু এতক্ষণে নীলের মায়ের যে পরিচয় পেয়েছে; তদানুযায়ী অনেক রাশভারী এক মহিলা তিনি। যদি তারা এখন তিহুকে বিয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করে, কি বলবে? চিন্তার দোলাচলে বন্দিনী তিহু, একপ্রকার নিজের মনের সাথে সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে চলে রুমের দিকে।

তিহু রুমে এসে ঝটপট নিজের মাথায় সিল্কের ওড়নাটা টেনে দেয়। ওড়না সহ পুরো ড্রেসটা মির্জা সায়মা দিয়েছে তাকে । হালকা নীলচে কালার থ্রি পিচের আবরণে বন্দিনী তিহু, একবার সম্মুখপানে তাকায়। নীলের রুমের প্রবেশদ্বারের গলি পথটা অতিক্রম করে, কতগুলো পথচারণার শব্দ একযোগে কর্ণকুহরে এসে ভিড়ছে। মুহূর্ত কয়েকের মাঝে রুমে প্রবেশ করল একজোড়া দম্পতি।
তাদের পোশাকে-আশাকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। স্বর্ণচারীর সূক্ষ্ম আঁচড়ের বালুচরি শাড়ি পরিহিত মহিলাটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত,তবে গাম্ভীর্যে মোড়া ।তিহু বেশ খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকে নিরক্ষণ করল। মহিলাটির শাড়ির প্রতিটা ভাঁজে যেন মিশে আছে এক বনেদি গাম্ভীর্য।তবে মুখে সদা জাগ্রত এক স্নেহময়ী মাতৃত্বের ছায়া।
পাশের দামি পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তিটি খুব সম্ভবত এমপি ওয়ালিদ খান নিজেই। তিহু কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে নরম কন্ঠে সালাম দিয়ে বলে,,,

———“আসসালামু আলাইকুম!”
জবাব দেয় উপস্থিত দম্পতি দুজনেরই। প্রবেশ করে আরো কয়েকজন মহিলা কর্মচারী। তাদের হাতে ডালা জাতীয় কিছু ছিল, যার উপরিভাগটা দামি কাপড়ের আবরণে ঢাকা। জিনিসপত্র গুলো রেখেই বেরিয়ে যায় তারা। মির্জা সূচনার নির্দেশে রুম ত্যাগ করে রাফা আর নীরা। সকলে বেরিয়ে যেতেই মির্জা সূচনা তিহুর উদ্দেশ্যে রাশভারী কন্ঠে বলে,,

———“না দাঁড়িয়ে থেকে বিছানার উপর বসো। শুনলাম কালকে রাতে নাকি তোমার অনেক জ্বর এসেছিল।”
কন্ঠটা রাশভারী হলেও তাতে আজ তীব্র মাতৃসুলভ মমতার লুকায়িত ছিল । তিহু এক ঝলক তাকালো তার দিকে। মির্জা সূচনা, আর মির্জা সায়মা অনেকটা একরকম দেখতে। দুজনেরই মাতৃসুলভ নমনীয় একটি দিক আছে, যেটা মির্জা সায়মা আর নরম স্বভাবের হওয়ায় সহসা প্রকাশ পায়। তবে মির্জা সূচনার ব্যাপারটা বুঝে নিতে হয়। এটুকুই যা তফাৎ।

নীরা‌ স্বভাবতই ধীর পায়ে হেঁটে, নিজের রুমে চলে গিয়েছে। তবে চঞ্চল রাফা, বেশ ভালো করেই জানে এখন রুমে গেলেই মা তাকে ধরে বেঁধে পড়তে বসাবে । তার ওপর জুটেছে আরেক দজ্জাল টিউটর। প্রতিদিন গাঁদা খানেক পড়া না দিলে হয়তো তার পেটের ভাত হজমই হয় না। বিরক্ত একটা! রাফা মনে মনে হাজারটা গালাগাল দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল ছাদের দিকে।
সিঁড়িঘরে পৌঁছাতেই হঠাৎই ভেসে আসা একটা কন্ঠে থমকালো তার পথচারণা। গুনগুন করে কেউ গাইছে,,,

🎶 ইরানি বালিকা যেন মরুচারিনী….
পল্লীর প্রান্তর বনমনহারিনী……
ছুটে আসে সহসা গৈরীর বরণী….
ছুটে আসে সহসা গৈরীর বরণী….
বালুকার উড়নি গায়….
জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়…..🎶
রাফার বুঝতে বাকি রইল না কণ্ঠস্বরটা আসলে কার। ছাদে এসেই পরিচিত পুরুষাবয় দেখে খানিক শয়তানি হাসলো রাফা। অতঃপর গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে বলল,,,

———“মরুচারিনী, মনোহারিনী আহা আহা! কি সুর? পুরো কিডনি টাচিং. তা ভাই ইতনি রোমান্টিক আপ কিসকো লিয়ে হুয়া, বাতাইয়ে?”
মৃদু কন্ঠে গানটা গাইতে গাইতে ফোনে এক অপরূপার ছবি বিশ্লেষণে ব্যস্ত ‌নিহিত হঠাৎই রাফার গলায় দ্রুত ব্যতিব্যস্তের ন্যায় ফোন অফ করতে গিয়ে, সেটি নিচে ফেলে দিলো । তা দেখে রাফা এগিয়ে এসে বলল,,,———“হায় হায় রে, গেল গেল সবটা গেল। তোমার সাধের আইফোনটা গেল। কি এমন দেখতেছিলা হ্যাঁ যে আমায় দেখে লুকাইলা? দেখি দেখি?”
সে দেখতে যেতেই নিহিত তার মাথায় জোর একটা গাট্টা মেরে বলে,,———“বেশি পাকনামি করলে এমন মারবো না পুরো সানডে মানডে ক্লোজ হয়ে যাবে! এক্ষুনি যা গিয়ে পড়তে বস বলছি । যা।”
রাফা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,,———“মারলা কেন?”

নিহিত: “ মারলাম টা কই?এক্ষুনি যদি না যাস তবে এমন মারব না, পুরো বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টির নাম ভুলে যাবি?”
রাফা: “আমি বাপ-দাদার নাম ভুলবো কিনা জানিনা তবে তোমাকে তোমার বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে দেবো । দাঁড়াও, তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের প্রেমিকার ছবি দেখছিলে এটা বলতে চাচ্ছি আমি মিমিয়ার কাছে।”
বলেই সেখান থেকে দৌড়ে প্রস্থান করে রাফা। নিহিত গলাচড়াও করে বলে,,———“যা যা তুই ও যা, আমিও যাচ্ছি ফুফু আম্মুর কাছে, তোর আর কুদ্দুস কাকুর বিয়ে ঠিক করতে.!”
রাফা যেতে যেতে থমকে বলে,,“কুদ্দুস কাকু মানে?”

নিহিত: “ওই যে আমাদের মোড়ের পাশে, বেগুনি আর চপ বিক্রি করে। বেশ ভালোই বানায় কিন্তু। বিয়ের পর তুইও বানাস কুদ্দুস কাকুর বউ।”
রাফা:“আমি যদি কুদ্দুস কাকুর বউ হই, তাহলে তুমিও লায়লার মামুন।”
নিহিত: “কি বললি?”
রাফা এক ছুটে সিঁড়িঘর পেরিয়ে যেতে যেতে একাধিকবার বলে উঠে,,———“লায়লার মামুন,‌লায়লার মামুন,লায়লার মামুন !”
নিহিত তার পিছু করতে গিয়েও ধরতে না পেরে ক্ষুব্ধ সৈনিকের ন্যায় বলে ওঠে,,,———“কুদ্দুস কাকুর বউ, খালি হাতের মাথায় পাই তোকে।”

কিছুক্ষণ আগেই, খানিক আলাপচারিতা শেষে বেরিয়ে গিয়েছেন ওয়ালিদ খান আর মির্জা সূচনা। তার পরপরই ফিরেছে নীল। তবে সেদিকে খেয়াল নেই তিহুর। সে স্তব্ধ হয়ে বিছানার উপর বসে আছে। সবকিছু যেন মাথার এক হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। বিছানার উপর রাখা দামী শাড়ি গহনা, গাঁদাখানিক পোশাক আর টাকার বান্ডিলগুলো ছড়িয়ে রাখা। এক বা দুই লাখ টাকা নয়, পুরো লাখ টাকার দশটা বান্ডেল তাকে দিয়েছেন ওয়ালিদ খান, মুখ দেখার সুবাদে ‌।
রহিমা খালার এনে রাখা খাবারগুলো এখনো অবহেলিত আসামির ন্যায় এক পাশে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হলো নীল। তিহু কে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সে বলল,,———“মুখটা বন্ধ করে বসো, না হলে আবার মুখে মাছি ঢুকবে। তখন আমার সাথে অসভ্যের মতো তর্ক করবা কিভাবে?”
নীল কি তাকে খোটা দিল? ঝগড়ুটে বলল? তিহু কিছু বলতে গিয়েও থামলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,,———“আমি এতগুলো টাকা নিয়ে কি করব?”

নীল নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় ভেজা টাওয়ালটা কাঙ্খিত স্থানে রেখে বলল,,,———“করার কিছু না পেলে, বাদাম কিনে খেও! আর রহিমা খালা খাবারটা দিয়ে গিয়েছেন না?”
তিহু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,———“হু!”
নীল: “তাহলে খেয়ে নাও, এমনিতেই ইউ আর সো উইক, কাল সারারাত জ্বরে কাতরিয়েছো।”
নীলের কথা তিহু শুনতে পেলও কি পেল না, সেটা শুধু সেই জানে। তবে হঠাৎই একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়তেই;বিছানা থেকে এক প্রকার লাফ দিয়ে নামলো তিহু। অতঃপর নীলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,,———“আপনার ফোনটা একটু দিন তো।”
তিহুর এমন আচরণে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীল,,———“ফোন দিয়ে কি হবে?”
তিহু:“প্রেমিকের সাথে কথা বলবো!”

নীল:“হোয়াট?”
তিহু:“এ মা, এতে হোয়াট হোয়াট করার কি আছে? আপনার কোনো প্রেমিকা নেই? আর থাকবেই বা কি করে আপনি যে খাইস্টা! বাই দ্যা ওয়ে আপনার সাথে এখন আষাঢ়ে গল্প করার সময় আমার নেই । ফোনটা দিন আমি আমার বেষ্টির সাথে কথা বলব। আপনার ফোর্স ম্যারেজের চক্করে তো ওর সাথে কথাটাও বলতে পারিনি। না জানি বেচারি কত টেনশন করছে!”
নীল আর কথা বাড়ালো না। সাইডে পড়ে থাকা ফোনটা দেখিয়ে বলল,,———“ওই যে।”
তিহু———“আপনি কি বেকুব নাকি? ফোনটা ওখানে আছে সেটা তো আমিও জানি, কিন্তু আমি কি আপনার ফোনের পাসওয়ার্ড জানি?সেজন্যই তো শুনলাম না হলে কে শুনতে আপনার কাছে । ”
নীল:“ননসেন্স কোথাকার, এখনই যদি এমন স্টুপিড কথা বন্ধ করে,মুখে লাগাম না টানো তাহলে থাপ্পর একটাও মাটিতে পড়বে না।”

তিহু কিছু বলতে গিয়েও থমকালো। নীলের ভাসমান শিরার হাতটা দেখে হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো তার। যদি সত্যি সত্যি নীল এখন থাপ্পর মারে? তাহলে তো তার গাল আর গালের জায়গায় থাকবে না, পুরো ভোঁচকে, চামচিকির আকার ধারণ করবে। সে ফোনটা এনে নীলের হাতে দিল। নীল ফোন খুলে তার কাছে দিতেই সে দ্রুত কল লাগল মাহার নাম্বারে। দুই-তিনবার রিং হওয়ার পরেও ধরল না কেউ। বারংবার ফোন দেওয়ার কারণে ওইপাশ থেকে ভেসে আসলো একটা রাগী রমণীর কন্ঠ,,,
———“হোয়াট দা হেল? ফোন ধরছিলাম না , তার মানে নিশ্চিত আপনাকে চিনি না, রং নাম্বারে ফোন দিয়ে কি ইটিশ পিটিশ করার ইচ্ছে?”

সে আর কিছু বলার আগেই তিহু ভীত কন্ঠে বললো,———“মাহু আমি !”
পরিচিত কণ্ঠস্বরে থামলো মাহা। পরক্ষণেই দ্বিগুণ অগ্নিঝরা কন্ঠে সে বলে উঠল,,———“কোন চুলায় গেছিলি ম’র’তে? ম’রা সম্পন্ন হয়েছে? কোন মা-ম-দো-র সাথে ভাগছিস? মা-ম-দো-টা কি তোর পাশে আছে? দে তো এক্ষুনি তার কাছে? আর তোর সাথে বোঝাপড়া তো আমার পরে হচ্ছে. ফোন অফ করে কোন চুলায় যাস হে?”
মাহার এমন কথায় তিহু একবার নীলের দিকে তাকালো। লোকটা এখনো ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কি জানি করছে? তারমানে শুনতে পাইনি, আল্লাহ বাঁচাইছে! তিহু দ্রুত ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। অতঃপর মাহার উদ্দেশ্যে বলল,,,———“বেবি একটু চুপ কর, শান্ত হ আমার কথাটা পুরোটা শোন।”
মাহা:“কি বা-ল শুনবো তোর কথা.? কোন গর্তে লুকিয়েছিস বল? আমি আর রিশাদ আসছি। আর আন্টিকেও ফোন দিচ্ছি। আন্টি একটু আংকেল কে বলুক তার গুণধর মেয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ।”
তিহু: “আব্বু বা আম্মু কেউ কি তোর কাছে কল দিয়েছিল?”

মাহা:“কল দেয়নি মানে, একটু আগেই তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে। তোর জন্য আর কত মিথ্যে কথা বলব আমি হ্যাঁ? আর রিশাদ যদি জানতে পারে না তুই পুরো একদিন পর কল দিয়ে এখন বলছিস, আব্বু আম্মু ফোন দিয়েছিলো কিনা, ও যে তোর কি অবস্থা করবে গড নোজ। বেচারা কোথায় কোথায় খোঁজেনি তোকে!”
তিহু যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলো। তার মানে বাবা-মা এখনো জানে না তার ব্যাপারে। সে মাহার উদ্দেশ্যে বলল,,
———“ দোস্ত আমার পুরো কথাটা শোন আমি, নীল খানের বাসায়!”
তার কথায় বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে মাহা বলল,,———“নীল খানের বাসায় মানে?”

তিহু সবটা খুলে বলল মাহাকে ‌। তিহুর মুখে এমন বর্ণনা শুনে মাথা ঘোরাতে লাগলো মাহার। দিশা-বিশা হারিয়ে সে বলল,,———“তুই কি বলছিস বুঝতে পারছিস তিহু? এগুলো যদি এখন আঙ্কেল বা আন্টি জানতে পারে, সবচেয়ে বড় কথা তোর চাচারা জানতে পারে তাহলে তোকে আস্তো রাখবে?”
তিহু বুক ভর্তি করে শ্বাস ফেলল। অতঃপর বলল,,—-“সেটা আমি ভালো করেই জানি! কিন্তু আমার কিছু করার নেই যা হওয়ার সেটা হয়ে গিয়েছে! এখন তুই আম্মুকে একটু ম্যানেজ করতে লাগ, বল আমার ফোনটা পড়ে ভেঙে গিয়েছে, আর আমি পরশু ভার্সিটি এসে,ম্যানেজ করছি সবকিছু!”

দুই বান্ধবীর কথোপকথন শেষে রুমে আসলো তিহু। ওদিকটা মাহা সামলে নেবে বলে কিছুটা নিশ্চিন্ত সে। রুমে এসে নীলকে ফোনটা দিতে গিয়েই দেখতে পেল নীল বিছানায় সবে শরীরটা এলিয়ে দিতে যাচ্ছে। তিহু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে বাধা দিয়ে বলল,,,———“এই,এই স্টপ স্টপ, কি করছেন টা কি?”
তিহুর এমন আচরণে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো নীল। অবাক কন্ঠে বলল,,—-“কি হয়েছে?”
তিহু ফোনটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বলল,,—“কি হয়েছে মানে? আপনি আমার বিছানায় কি করছেন?”
নীল:“তোমার বিছানা মানে?”

তিহু:“আমার বিছানা মানে আমার বিছানা। এক্ষুনি নামুন বলছি।”
নীল:“নামবো মানে? আমার ঘুম আসছে ঘুমাবো আমি!”
তিহু:“হ্যাঁ তো ঘুমান না । কে বারণ করেছে আপনাকে?”
নীল:“বিছানা ছাড়া কি আমি তোমার মাথার উপর ঘুমাবো?”
তিহু:“কোথায় ঘুমাবেন না ঘুমাবেন সেটা আপনার ব্যাপার । কিন্তু বিছানায় ঘুমানো যাবে না!”
নীল: “হোয়াট দ্যা হেল। আমার বিছানায়,আমি ঘুমাবো না তো কে ঘুমাবে?”
তিহু:“উহু মিস্টার একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে, বিছানাটা আপনার ছিল। এখন এটা আমার। আর আমি কোনো পুরুষ মানুষের সাথে বেড শেয়ার করতে পারবো না, আমার সে অভ্যাস নেই স্যরি।”
নীল:“আমার মনে হচ্ছে তোমার মতো অসভ্য মেয়েদের সাথে বেড শেয়ার করার অভ্যাস আছে?”
তিহু অন্যদিকে ফিরে ধীর কন্ঠে বলল ,,,—–নেতাদের আবার ক্যারেক্টারে ঠিক থাকে নাকি?”
নীল:“কি বললে?”

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৭

তিহু:“কই কিছু নাতো? এটাই বললাম যে আপনি ওই সোফাটাতে ঘুমাতে পারেন। আই থিংক ওটা আপনার জন্য অনেক বেশি কমফোর্টেবল হবে।”
নীল আর কথা বাড়ালো না। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাওয়া হাতটা, নিজ গতিতে আলতোভাবে ছেড়ে দিয়ে। নিজে থেকেই নিজের বালিশটা নিয়ে সোফার দিকে পা বাড়ালো। তিহু এক শয়তানি হাসি হেসে মনে মনে বলল,,,—–ইয়ে তো স্রেফ ট্রেলার হে, পিকচার আভি বাকি হে চান্দু। আরেকটু করো আমাকে বিয়ে!!!”

প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here