প্রেমের সমর পর্ব ৩০
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আজ শহরে রোদ উঠেছিল কড়াভাবেই। গরমে নাজেহাল অবস্থা। ভ্যাপসা গরমে সারাদিন ঘামে নাজেহাল অবস্থা হলেও রাতে স্বস্তি মিলেছে এক পশলা বৃষ্টির মাধ্যমে। ছুটি অবশ্য সেই বৃষ্টিতে রাতের আকাশ মাতিয়ে ভিজে এল। আজ অনেকটা দিন পর আবারও ঝুম বৃষ্টিতে গা ভেজাচ্ছে সে। আজ অনেকদিন পর আবারও বর্ষণের প্রতিটা কণা তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে তারই চোখে অশ্রকণার সঙ্গে। ছুটি মনে পড়ে সর্বশেষ বৃষ্টি ভেজার মুহুর্তটুকু! আবির ভাই ও ছিল সেদিন। খুব শাসিয়েছিল। সাথে নিজের পরণের ব্লেইজারটাও খুলে দিয়েছিল। ছুটি তাচ্ছিল্য করেই হাসে এবার। যাকে চেয়েছিল তাকে তো পেলই না উল্টে তার ব্লেইজারটা তার কাছে থেকে গেল। উহ! সেইদিন যে আবির ভাইকে সে দেখল এরপর আর দেখা হলো না মানুষটাকে। এরপর আর সরাসরি দাঁড়িয়ে কথা বলা হলো না।ছুটি বৃষ্টি শেষে ভিজে চুপচুপে হয়ে যখন বাসায় ফিরল তখনই ভেজা গায়ে থাকা অবস্থাতেই দেখতে পেল ফোনে অনেকগুলো কল এসেছিল। তাও আবিরেরই। হয়তো বিয়ের প্রস্তাবের প্রত্যাখানের বিষয়টা এতক্ষনে কানে গিয়েছে। নয়তো এতগুলো কল দিত? ছুটি কল রিসিভড করে। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ধমকে সুরে কথা আসে,
“ ভাব দেখাচ্ছিস আমার সঙ্গে ছুটি? অবহেলা দেখাচ্ছিস? এতকাল যে আমি তোকে অবহেলা করেছি তার প্রতিশোধ নিতে চাইছিস? নাকি অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? আমার প্রতি আর মন টানছে না তাই তো?”
ছুটি এবারে হাসে। আরাম করে ভেজা গায়ে গিয়ে বেলকনিতে বসে। পরপরই উত্তরে বলে,
“ আবির ভাই? আপনাদের প্রস্তাবে না করেছি তাই গায়ে লেগেছে খুব? তবে একটা সত্যি বলি? আপনারা বন্ধুরা বোধহয় সবাইই সেইম সেইম!তাই না?”
অপর পাশ থেকে আবির রেগে উত্তর করে,
“ তুই আমার বন্ধুদের কয়জনকে চিনিস? কয়জনকে চিনে কথাটা বলছিস?”
ছুটি ফের হাসে। উত্তর করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ যে দুইজনকে চিনি সে দুইজনের একজনও এমন ভুল করেছিল অতীতে। সুহা প্রস্তাব নাকোচ করাতে ইগোতে লেগেছিল আপনার বন্ধুর। যার কারণে সুহাকে প্রেমে ফাঁসিয়ে বিয়েটা করে প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমার মনে হয় আপনিও বোধহয় একই কারণেই এমন রেগে আছেন এই মুহুর্তে। তাই না?”
আবির এই মুহুর্তে এসে রাগ থামিয়ে শান্ত হয়ে গেল। ছুটি তাকে স্বচ্ছর সঙ্গে তুলনা করছে? কেন? নিশ্চয় এমনি এমনি নয়? আবির হুট করেই আবিষ্কার এতকাল সে যে ভয়টা পেয়েছিল তাই যেন সত্যি৷ ছুটি সত্যিই পাল্টে যাচ্ছে। সত্যিই ছুটি দূরে সরে গিয়েছে।এই মুহুর্তে এসে আবিরের মনে হয় ছুটি সত্যিই তাকে আর চায় না৷আবির নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে,
“ আমাকে তোর স্বচ্ছর মতো মনে হচ্ছে কেন ছুটি? কেন মনে হচ্ছে আমি বিয়ে নিয়েও হ্যাংলামো করছি? ”
ছুটি এই পর্যায়ে চোখ বুঝে। ফোন কানে নিয়ে একগুচ্ছ অভিযোগ ঢেলে বলে উঠে,
“ আপনাকে তো স্বচ্ছ ভাইয়ার থেকেও জঘন্য মনে হয় আমার। অন্তত আপনার বন্ধু এমন একজন মেয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলেছিল যে মেয়েটার তখনও উনার প্রতি অনুভূতি জম্মায় নি। শুধু প্রস্তাবটাই নাকোচ করেছিল মেয়েটা। বিনিময়ে উনি মেয়েটার মনে তার জন্য অনুভূতি জম্ম দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল। আর আপনি? যে মেয়েটা আপনার প্রতি এতোটা অনুভূতিপ্রবণ, এতোটা সময় যাবৎ আপনার প্রতি দুর্বল। আপনি নিজেও জানের সে কতোটা পাগল ছিল আপনার জন্য। আর আপনি?আপনি স্বার্থ পূরণের জন্য তার অনুভূতিটাকেই ব্যবহার করেছেন। খুব জঘন্য নয় বলুন? ”
আবির বিস্ময় নিয়ে তাকায় এইবারে। সে ব্যবহার করেছে? সত্যিই ব্যবহার করেছে? কিন্তু সত্যিটা তো হলো সে ব্যবহার করেনি। উল্টে অনেক আগ থেকেই সে ছুটিকে ভালোবেসেছিল। শুধু প্রকাশ করেনি। সাদাফ যখন ছুটির অনুভূতিটাকে ব্যবহার করতে বলেছিল তখনও তো সে এসবে রাজি হয়নি। তাহলে? ছুটি এই কথাটা কেন বলল তাকে?আবির মুহুর্তেই শুধাল,
“ আমি ব্যবহার করেছি তোর অনুভূতিকে? ”
ছুটি কঠিন স্বরে উত্তর করে,
“ জানি না, নিজেকে প্রশ্ন করুন। ”
আবিরের এই মুহুর্তে অসহায় লাগে। কোথাও যে ছুটি তাকে ভুল বুঝছে তা তো সে বুঝতে পারছে কিন্ত কোন বিষয়ে? সে তো এমন কিছু করেনি। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝানোর ন্যায় বলে,
“ আমি তোর অনুভূতিকে ব্যবহার করিনি ছুটি। বরং যখন তোর অনুভূতি ব্যবহারের জন্য সাদাফ আমায় বলেছিল তখন আমি তার বিরুদ্ধেই বলেছিলাম।তুই একটা গর্দভ ছুটি। আজেবাজে কিছু ভেবে উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিবি না। ”
“ আমি খু্ব জেদি আবির ভাই। শুধু আপনার ক্ষেত্রেই আমি বোকা ছিলাম। মনে হতো না আমার মতো নরম মনের সহজ সরল মেয়ে বুঝি দুনিয়াতেই নেই? কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি মাত্রাতিরিক্ত জেদিও আবির ভাই।আপনার হয়তো ধারণাও নেই আমার জেদ কতটুকু। ”
আবির শুধায়,
“ কতটুকু? ”
ছুটি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসে। উত্তর করে,
” কোন একদিন দেখতে পাবেন। তার আগে বলুন, আমায় নিয়ে উপহাস করে লাভটা কি হচ্ছে আপনার? আমি নিশ্চয় কোনদিন আপনার ক্ষতি করিনি?”
আবির এই পর্যায়ে শক্ত স্বরে উত্তর করে,
“ আমি তোকে ইগ্নোর করেছি বরাবর এটা সঠিক!তবে উপহাস করিনি কখনো ছুটি। ”
ছুটি হেসে উত্তর করে এবারে,
“ এই যে কন্টিনিউসলি করছেন। এখনো করছেন। ”
“ করছি? কিভাবে? ”
“ জানেন আপনি। ”
আবিরের মেজাজ খারাপ লাগে যেন এবারে। এই মেয়েটাকে সহজ সরল ভাবা বোধহয় ভুল ছিল তার। নয়তো এতগুলো দিন লুকিয়ে লুকিয়ে তার উপর রাগ পুষত? সরাসরি কিছু না বলে ভুল বুঝত? এভাবে বদলে যেত? আবির দাঁতে দাঁত চাপে এবারে। বলে,
“ জানি না বলেই জিজ্ঞেস করেছি। কথা ঘুরাবি না। তোর মতো ঘুরানো পেঁচানো কথা আমি বলি না। কাজেই তোর ঘুরানো পেঁচানো কথার অর্থ বুঝতে আমার কষ্ট হয়।”
“ঘুরানো পেচানো তাও ঠিক আছে আবির ভাই, কিন্তু ভেতরে এক বাইরে আরেক হলে? তখন কি করে মেনে নেওয়া যায় বলুন? ”
“ মানে? ”
ছুটি শ্বাস টানে। কিছুটা সময় চুপ থেকে ভেবে চিন্তে হুট করে বলে,
“ কিছু না।ভালো থাকুন, যাকে ভালোবাসেন তাকে নিয়ে সুখে থাকুন এই প্রার্থনাই করি আবির ভাই। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে হাসির পাত্র বানানো তো শেষ তাই না? উপহাস তো অনেকটাই করলেন বন্ধুদের সাথে নিয়ে। এবার ছাড় দিন আমায় এসব থেকে। আর হ্যাঁ, একটাই অনুরোধ! আমার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবেন না।এই অনুরোধটুকু রাখবেন প্লিজ!”
কথাটুকু বলেই ছুটি কল রেখে দিল। বোধহয় ওপাশ থেকে আবারও কল আসবে। বোধহয় না। অবশ্যই আসবে। ছুটি তা জেনেই মুহুর্তের মধ্যে আবিরকে ব্লকলিস্টে ফেলল। যত জায়গায় যোগাযোগ করার পথ থাকে সব কিছু থেকেই সে আবিরকে ব্লক করল। পরমুহৃর্তেই সিদ্ধান্ত নিল সে এই শহর থেকেও হারিয়ে যাবে। এই শহরও তো তার কাছে বিষাক্ত ঠেকে। প্রতিটা নিঃশ্বাস বিষাক্ত ঠেকে!
ভোরের দিকে সুহার যখন ঘুম ভাঙ্গল চোখ গেল স্বচ্ছর দিকে। টের পায় স্বচ্ছর এক হাত আঁকড়ে আছে তার পিঠ।জড়িয়ে রেখেছে। স্বচ্ছর সাথে এতগুলো দিন একসাথে ঘুমালেও স্বচ্ছ কখনো তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে নি। জ্বালিয়েছে ঠিক! তবে সুহার রাগের কাছে হার মেনে কখনো সুহাকে জড়িয়ে ধরার সাহসই করে উঠেনি হয়তো। আর যখনই সুহা এই প্রথম সুযোগ দিল তখনই আজ এই প্রথম স্বচ্ছ তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। ইচ্ছে করেই জড়িয়ে রেখে ঘুমানোর সময় বলেছিল,
“ তুমি চাইলে কাছে আসতে। তাই এতোটুকু কাছে টানা যায় ভাবলাম সুহাসিনী।তুমি যদি চাও আরেকটু বেশিই কাছে টানতে পারি। তবে সেটা দ্বিতীয়বার আপনাকে আমার ঘরে আনার পর ম্যাম। ”
সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল ঐ মুহুর্তে।আর সে তাকানো দেখেই স্বচ্ছ মুচকি হাসে। সুহার কপালে চুমু এঁকে বলে,
“ একবার বিয়ের অনুষ্ঠান মিস করেছি, তাই বলে বিয়ে বিয়ে ফিল না করেই বাসর সেরে ফেলব? অতোটাও অমানবিক নই সুহাসিনী। নয়তো তোমার সম্মতি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কাছে টানতাম। ”
সুহার ঐ মুহুর্তে কান মুখ গরম হয়ে এল যেন। ছিহ! স্বচ্ছ কি বুঝাল? সে বাসর করতে মরিয়া হয়ে আছে নাকি? নাকি সে স্বচ্ছকে বলেছে এমন কিছু? ছিহ! স্বচ্ছ এটা বলতে পারল? সুহার রাগ হয়। রেগে কিছু বলতে যেতেই স্বচ্ছ হাসে। ফের বলে,
“ এভাবে রেগে তাকিয়ে পাগল করে দাও সুহাসিনী। বারবার মাথার ভেতর তোমার রাগকে লজ্জায় পরিণত করার কৌশল আনতে বাধ্য করো। যায়হোক, তোমার হারামি দাদাজানকে রাজি করিয়েই বাসরটা সেরে ফেলব সুহাসিনী। আমি খুবই অপেক্ষা করে আছি। ”
সুহা মুহুর্তেই নাক মুখ কুঁচকাল। বলে,
“ছিঃ!”
স্বচ্ছ এই পর্যায়ে চাপা হেসেছিল। বলে,
“ কার যেন খুব অভিযোগ আমি তাকে এড়িয়ে যাই বলে? দূরে দূরে রাখছি বলি? কে যেন এটাকে শাস্তি হিসেবে নিয়ে কান্না করছিল? তাছাড়া কে যেন হসপিটালে চুমুর শোধবোধও করতে বলেছিল আমায়। তো করতে হবে না চুমুর শোধবোধ,ভালোবাসার শোধবোধ? ”
সুহা এরপর আর উত্তর করেনি যেন। চোখ মুখ খচে চোখ বন্ধ করে ছিল। নাহয় এই ছেলে আর কি যে বকবক করবে জানা নেই। সুহা কাল রাতের কথাগুলো ভেবেই শুকনো ঢোক গিলে। তাকায় স্বচ্ছর দিকে।তখনও চোখ বুঝে আছে স্বচ্ছ। তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়ে ঠেকেছে স্বচ্ছর গলায়,মুখে। সুহা এক হাতে চুলগুলো স্বচ্ছর মুখচোখ থেকে সরানোর চেষ্টা চালায়। অথচ পরমুহুর্তেই মনে হয় এই দৃশ্যটি তার দেখা অন্যতম সুন্দর একটি দৃশ্য।চোখ বুঝে আছে ছেলেটা। সুহা নড়চড় করতে গিয়েও করে না। চুল সরাতে গিয়েও সরায় না।চুপচাপ ঘুমঘুম চোখে দেখতে থাকে স্বচ্ছকে। মুখে আলতো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যেন আরো সুন্দর বোধ হয়।মুহুর্তেই তার বোধ হয় এই ছেলেটা সত্যিই সুন্দর। সত্যিই এই ছেলেটা সুদর্শন! সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সুদর্শন পুরুষটার দিকে। হাত বাড়ায় আলতো করে। স্বচ্ছর কপালে আসা চুলে হাত রেখে আলতো করে সরিয়ে দেয় তা। পরমুহুর্তেই হাত রাখে স্বচ্ছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে। হাত বুলিয়ে নিয়ে পরক্ষণে ছুঁয়ে দেয় স্বচ্ছ পুরু ঠোঁট,নাকের ডগা এবং গাল।অবশেষে গলার কাছটায় হাত নিতেই চোখে পড়ে গলায় উঁচু হওয়া জায়গাটা। অ্যাডমস অ্যাপল! সুহা যেন কেমন করেই চেয়ে থাকে। হাত এগিয়ে ছুঁয়ে দিয়েও যেন শান্তি মেলে না। সুহা ছোটশ্বাস ফেলে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেই স্বচ্ছর ঠোঁট বেঁকে উঠে এবারে। চোখ বুঝে রেখেই ঘুমঘুম স্বরে শুধায় এবারে,
প্রেমের সমর পর্ব ২৯
“ চাইলে তো দুয়েকটা মর্নিং চুমুও দেওয়া যেত সুহাসিনী। শুধু শুধু এতক্ষন মুখ, ঠোঁট, দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে অ্যডামস অ্যাপলে গিয়ে পড়ে আছো।কাহিনী কি? ”
সুহার কাছে স্বচ্ছর ঘুমঘুম কন্ঠটা দারুণ শোনায় মুহুর্তেই। পরমুহুর্তেই কথার অর্থ বুঝে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার মানে এতোটা সময় স্বচ্ছ বুঝতে পারছিল সব? জেনেবুঝেই চুপচাপ শুয়ে ছিল? আস্ত ধূর্ত এক লোক তো। সুহা মনে মনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও উপরে উপরে ফুঁসে উঠে বলে,
“ আশ্চর্য!আমার চুল আটকে ছিল আপনার মুখে গলায়। তাই সরিয়ে নিচ্ছিলাম। ”
স্বচ্ছ তাও হাসে। সুহাকে সেভাবেই জড়িয়ে রেখে মুখ গুঁজে সুহার গলায়। ঘুমঘুম স্বরে চোখ বুঝে থেকেই বলে,
“ উহ! তোমার লজ্জা লুকানোর কৌশলটা দারুণ সুহাসিনী! ”