প্রেমের সমর পর্ব ৩২
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
স্বচ্ছ আগে আগেই খেয়ে ঘুমিয়ে গেল আজ। সকালে আবিরকে আনতে যাবে। আবির একটু আগেই তাকে জানিয়েছে যে ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে সে দেশে ফিরছে।এবং কেন ফিরছে সে কারণ টুকুও বলেছে। খবরটা শুনে স্বচ্ছ নিজে বিস্মিত হয়। মনে মনে ভাবে নারী আসলেই অবহেলা পেয়ে সব করতে পারে। যেমন সুহাও ভালোবেসে তাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেনি। স্বচ্ছ ভাবে যদি কখনো সুহাও এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়? যদি কখনো সেও সুহাকে অবহেলা করে বসে? না, না! সে এবার থেকে দরকার হলে বউকে সারাক্ষণ ভালোবাসবে। তবুও বউ হারাতে দিলে চলবে না। স্বচ্ছ এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বুঝে। অপরদিকে সুহা কিঞ্চিৎ অবাক হয়। স্বচ্ছের অসময়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণ কি তা চিন্তা করে। তারপর নিজেও খাওয়ার সময়ে খেয়ে এসে আলো নিভিয়ে একপাশে শোয়। একদিকে কাত হয়ে শুঁয়ে স্বচ্ছর ঘুমন্ত মুখটা মৃদু আলোতে পর্যবেক্ষন করে কিছুটা সময় ধরে। পরমুহুর্তেই অপর পাশে মুখ করে শোয় সুহা। ঠিক তখনই টের পায় সে স্বচ্ছ ঘুমোয় নি।বরং জেগে আছে।গোলাপি সুতি শাড়িটার তলেই অবস্থান নিয়েছে স্বচ্ছর অবাধ্য হাত।স্পর্ষ করেছে সুহার উদরের মসৃন ত্বক। পরক্ষণেই কিছুটা কাছে টেনে নিল নিজের দিকে।খোঁচা দাঁড়ি সমেত মুখটা ঘেষে সুহার পিঠে। সুহা তখন কিঞ্চিৎ কাঁপে। মিনমিনে স্বরে বলে,
“ না ঘুমিয়েও এমন মরার মতো পড়ে থেকে ঘুমের অভিনয় করার মানে কি স্বচ্ছ? সবসময় ঘুমের অভিনয় করেন আপনি। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে এবারে। সুহারে পিঠে সেভাবেই মুখ ঘেষে থেকে ঠোঁট নাড়িয়ে শুধায়,
“ দেখছিলাম তুমি আমার ঘুমের মাঝে কি কি সুযোগ নাও।তুমি যা সুতরাং সুযোগসন্ধানী!”
কথাগুলো বলার সাথে সাথেই স্বচ্ছর ঠোঁটজোড়া বারংবার স্পর্শ করে সুহার পিঠ। সাথে খোঁচা দাঁড়ির আলতো সংঘর্ষ! সুহা চোখ খিঁচে। কন্ঠে রাগ নিয়ে শুধায়,
“ আমি সুযোগসন্ধানী?”
স্বচ্ছ তখনও মুখ ডুবিয়ে রেখেছে সুহার পিঠে। উত্তরে বলে,
“ সেদিন তো ঘুমের মধ্যে পুরো মুখেই হাত বুলিয়ে দেখলে। গলায় এ্যাডামস এ্যাপলে তো আটকেই গেলে। ”
সুহা এবারে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়েই বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ স্বচ্ছ! ”
“কি? ”
“মুখ ঘেষছেন কেন এভাবে? আপনার খোঁচা দাঁড়িগুলো লাগছে। ”
স্বচ্ছ এবার মুখ নিয়ে ঠেকাল পিঠ থেকে সুহার কাঁধে। ফিসফিস স্বরে শুধায়,
“ লাগুক। ”
ফের আবার শুধায় গাঢ় স্বরে,
“ সুহাসিনী? ”
“ হু? ”
স্বচ্ছ সেভাবেই জড়িয়ে রেখেই গমগম স্বরে শুধায়,
“ শাড়ি পরেছো কেন আজ?”
সুহাও তৎক্ষনাৎ উত্তর করে,
“ইচ্ছে হয়েছে তাই। ”
স্বচ্ছ হাসে এবারে। কাঁধে নাক ঘেষে শুধায়,
“ নাকি আমায় পাগল করার জন্য? ”
সুহা এবারে ফিরে তাকায়। স্বচ্ছর মুখোমুখি করে মুখ রেখে বলে,
“ আপনি পাগল হয়েছেন? ”
স্বচ্ছ আবছা আলোয় তাকায় তার সুহাসিনীর দিকে। মোহময় লাগছে বোধহয় এই মেয়েটাকে। স্বচ্ছর তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয় যেন। ইচ্ছে হয় এই মেয়েটাকে কাছে টানতে, ছুঁয়ে দিতে। কে বলেছিল সারাটা দিন শাড়ি পরে পরে টইটই করে ঘুরে বেড়াতে তার আশপাশে? বলেছিল স্বচ্ছ? এই যে এখন রাত্রিতে এসে তার বউ বউ ফিলিংস হচ্ছে বউয়ের প্রতি? দোষ কার? স্বচ্ছ বিড়বিড় স্বরেই জানায়,
“ হতে মন চাইছে। ”
সুহা হাসে এবারে। স্বচ্ছর মাথার চুলে হাত রেখে বলে,
“ আপনি তো এমনিতেও পাগল।”
কথাটা শুনে স্বচ্ছ শান্তভাবেই চেয়ে থাকে। মিনিট খানেক পর আগের মতোই সুহাকে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠে,
“ তুমি কখনো হারাবে না সুহাসিনী। আমার থেকে কখনো হারাবে না। চিন্তাও করবে না। কথা দাও হারাবে না!”
হুট করে এই কথার অর্থ বুঝে উঠে না সুহা। তবুও শুধায়,
“কেন মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাব? ”
স্বচ্ছ তখন উত্তরে বলে,
“ অবহেলা পেয়ে নারী নাকি জেদ করে সব করতে পারে। যদি কখনো তোমায় অবহেলা করি তবুও মেনে নিবে, আমার থাকবে।আমার প্রতি ভালোবাসা যাতে না পুরায় সুহাসিনী!”
“অবহেলা করবেনই কেন? ”
স্বচ্ছ এবারে ঠোঁট বাঁকায়। সুহার নাকে নিজের নাক ঠেকিয়ে ফিচেল স্বরে শুধায়,
“ ভালোবাসা উচিত তাহলে? ”
সুহা এতক্ষন দৃঢ় স্বরে জবাব দিয়ে আসলেও এই একটা প্রশ্নেই বোধ করল তার উত্তর আসছে না। গলা আটকে আসছে। লজ্জ্ব্ পাচ্ছে কি সে? সুহা তবুও কোনরকমে শুধায়,
“ যা ইচ্ছে। ”
স্বচ্ছ এবারে আবারও হাসে। নাকে নাক ঠেকিয়ে আগের মতো করেই ফিচেল গলায় জিজ্ঞেস করে,
“যা ইচ্ছে? শিওর তুমি সুহাসিনী? যা ইচ্ছে করার অনুমতি দিচ্ছো তাহলে?”
সুহার এই পর্যায়ে ইচ্ছে হয় লোকটার মাথায় ঠাস করে এক থাপ্পড় বসাতে। বারবার তাকে লজ্জায় ফেলছে। বারবার ইচ্ছে করেই এমন ভাবে বলছে কথাগুলো। সুহা রেগেই শুধায়,
“ স্বচ্ছ! ইচ্ছে করেই এমন করছেন তাই না? লজ্জায় ফেলছেন আমায়? ”
স্বচ্ছ মজার স্বরে শুধায়,
“ লজ্জ্বা পাচ্ছো তুমি? সুহাসিনী লজ্জাও পায়? ”
সুহা তখন ধমকে বলে উঠে একমুহুর্তে,
“ মজা করবেন না একদম! ”
আবির ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে দেশে ফিরেছে ভোরভোরই। তখনও বাংলাদেশে সকাল হয়ে উঠেনি৷ আবির তখনও রাগে হাঁসফাঁস করে। কিভাবে যে এতোটা সময় সে নিজেকে শান্ত রাখছে তা বোধহয় সে নিজেই বুঝে উঠে না। আবির শান্ত প্রবৃত্তির ঠিক। তবে প্রচন্ড রেগে গেলে ওকে মানানো কঠিন। ছুটির বোধহয় ধারণাও নেই আবিরের এই রাগটা কতোটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে তার উপর। আবির স্বচ্ছকে আগেই জানিয়েছিল যে দেশে ফিরছে। স্বচ্ছও সে অনুসারে গাড়ি নিয়ে এসেছিল বন্ধুকে নিয়ে যেতে। অবশেষে যখন বন্ধুকে দেখতে পায় তখনই এগিয়ে আসে। হেসে শুধায়,
“ তোর বউ তো আমার বউয়ের থেকেও ডেঞ্জারাস রে আবির। এতকাল সহজ সরল সেঁজে এখন এই কঠিন রূপ! সাংঘাতিক! ”
আবিরের মন মেজাজ ভালো নেই। সঙ্গে ব্যাগপত্র তেমন কিছুই আনে নি সে। মন মেজাজের এই তিরিক্ষি অবস্থার মাঝে স্বচ্ছর কথাটা তার কাঁটা গায়ে নুন ফেলার মতোই বোধ হলো। শক্ত গলায় গাড়িতে উঠতে উঠতে শুধাল,
“ তোর বউয়েরই তো বান্ধবী৷ আগে ছুটি বেয়া’দব এমন ছিল না। আমি নিশ্চিত তোর বউই ছুটিটাকে এমন বেয়াদব বানিয়েছে। ”
স্বচ্ছ নিজের বউয়ের এহেন অপমান মেনে নিতে পারে না যেন। মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,
“ হু, এখন যত দোষ সব আমার বউয়েরই তাই না?”
আবিরও দাঁতে দাঁত চেপে শুধায়,
“ সব দোষ তোদের। তোর বউ খোঁজার চক্করে আমার ফিউচার বউ আমায় ভুল বুঝে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছে হা’রামি। ”
স্বচ্ছও বিরোধী স্বরে বলে,
“ মোটেই না। বরং আমার বউ খোঁজার চক্করে তোর সাথে ছুটির সম্পর্ক ভালোই হয়েছিল। মাঝখানে তুই কি করেছিন তুইই ভালো জানিস। ”
আবির ভাবে। সত্যিই তো। সম্পর্ক তো সুন্দর হচ্ছিল। ছুটি তো তখনও ঠিকঠাক ছিল। কথা বলত। এমনকি হসপিটালেও তো ঠিক ছিল। তারপর? তারপর হুট করে কি হয়ে গেল ছুটির? সেদিন যে হসপিটালে এই ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে ছুটির প্রতি সে নিরাগ্রহতা দেখিয়েছে তার কারণেই কি? এই অবহেলা টুকুর কারণেই এমন শাস্তি? আবির বুঝে উঠে না। পরমুহুর্তেই বন্ধুদের উপর দোষ চাপিয়ে বলে,
“ কিছুই করিনি। সব তোদের বদের হাড্ডিগুলার দোষ। এখন আমার বউ আমায় ফিরিয়ে দিবি, যেভাবেই হোক। ”
স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“মনে হচ্ছে যেন বিয়ে করা বউ তোর। ”
আবির তৎক্ষনাৎ উত্তর করে,
“ বিয়ে করা বউয়ের থেকেও ইম্পোর্টেন্ট। তুই বুঝবি না। ”
“হু, সব তো তুইই বুঝিস।
আবির রেগে তাকায়। বলে এবারে,
“ তো তুই বুঝিস? ”
স্বচ্ছ এবারে ঝগড়া এগোয় না। বরং শুধায়,
“ মাথা ঠান্ডা করে আগে ভাব ছুটির এংগেইজমেন্ট হয়ে গেল কিনা। ”
আবিরের দাঁত কিড়মিড় করে। ছুটির এংগেইজমেন্ট হলে সর্বপ্রথম সে ছুটিকেই মেরে ফেলবে। দ্বিতীয়ত নিজে মরবে। বলে,
“ হবে না, এই সাতসকালে এংগেইজমেন্ট অবশ্যই হবে না। ”
স্বচ্ছ ফের বলে,
“ ধর হয়ে গেলে? ”
আবিরের এই মুহুর্তে স্বচ্ছর গালে চড় বসাতে ইচ্ছে হয়। অথচ বসায় না। বলে,
“ তুই কি আমার সঙ্গে ফাইজলামি করছিস?”
“ ছিঃ! তোর এই বিপদে আমি ফাইজলামি করব? মনে হয় তোর? ”
“ তাই-ই তো মনে হচ্ছে আমার! ”
স্বচ্ছ এবারে রেগে তাকায়। বলে উঠে,
“ আবিরের বাচ্চা আবির, সাতসকালে বউ রেখে চলে এসেছি তোর বউ উদ্ধার করত। ফাইজলামি করার হলে নিশ্চয় আসতাম না? ছোটনকে পাঠাতাম না অনুষ্ঠান আটকাতে?”
আবির এবারে আগ্রহ নিয়ে শুধায়,
“ ছোটনকে কি বলে পাঠিয়েছিস? ”
স্বচ্ছ দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
“ কিছুই বলিনি, ওকে বাসে তুলে দিয়ে বলেছি ওর আপুর এইংগেইজমেন্টটা যাতে জমিয়ে খেয়ে আসে। কি? ভালো বলেছি না?”
“ তোর উচিত ছিল ওকে এইংগেইজমেন্ট আটকানোর জন্য বলা। ”
আবির আর স্বচ্ছরা ছুটিদের গ্রামের বাড়িতে পৌছায় দুপুরের আরো পরে। রাস্তায় জ্যাম ছিল। আবির ততক্ষনে কপাল চাপড়ায়। যদি এইংগেইজমেন্টটা হয়ে যায়? এই রাগে তার গাড়ি অব্দি ভেঙ্গে ফেলতে মন চাইছিল। রাস্তায়ই বা আজই এত জ্যাম থাকতে হবে কেন? আজই এত লেট হতে হবে কেন? আবির ভেতরে ভেতরে রাগে গিজগিজ করলেও বাইরে তাকে দেখায় শান্ত। চোখ দুটো রক্তিম ঠেকছে। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে এই মানুষটা এই মুহুর্তে সবচাইকে কঠিন রূপ ধারণ করে আছে। আবির পা বাড়ায়। ছোটনের থেকে জেনে নিয়ে ছুটির জন্য বরাদ্ধকৃত রুমে গিয়েই চোখে পড়ে ছুটিকে। বিছানায় বসে আছে। পরণে খয়েরি রংয়ের দামী শাড়ি। চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। সাথে আবার কানে গুঁজেছে গোলাপ ফুল। নিঃসন্দেহে সুন্দর দেখাচ্ছে ছুটিকে। তবে আবিরের কাছে এই মুহুর্তে সব চাইতে তিক্ত দৃশ্য ঠেকে ছুটির এই সাজগোজটাই। অসহ্য ঠেকের।অন্য পুরুষের জন্য সেঁজেছে? অন্য পুরুষের জন্য এত বেশি টান ওর? আবির এগোয়। গম্ভীর মুখচাহনি নিয়ে ছুটিকে কয়েক সেকেন্ড দেখে নিয়েই আচমকা হাত চেপে ধরে। দাঁড় করায় তার সামনে। পরমুহুর্তেই এক হাত দিয়ে ছুটির গাল চেপে ধরে। গমগম স্বরে শুধায়,
“ বলেছিলাম না আমায় ঠকানোর সাহস করিস না ছুটি? বলেছিলাম কিনা?তুই সেই সাহসটাই করলি? এত সাহস তোর? ”
প্রেমের সমর পর্ব ৩১
ছুটির গালটা এত জোরেই চেপে ধরা হলো যে ব্যাথায় কুকড়ে উঠল সে। আবিরকে এই মুহুর্তে প্রত্যাশা করেনি এটা যেমন ঠিক তেমনই আবিরের এমন আক্রমনও প্রত্যাশা করেনি সে। সাথে আবিরের শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলা কথাগুলো যেন হৃদয় কাঁপিয়ে তুলে। ছুটি ব্যাথায় টলমল স্বরে শুধায় এবারে,
“ আবির ভাই? ব্যাথা পাচ্ছি আমি মুখে। ”
আবির হাসে। শান্ত গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ এইটুকু ব্যাথাই সইতে পারছিস না? অথচ তুই জানিসও না এই দুঃসাহস দেখানোর জন্য তোর কপালে ঠিক কতখানি দুঃখ লেখা আছে ছুটি! সইতে পারবি তো?”