প্রেমের সমর পর্ব ৩৩

প্রেমের সমর পর্ব ৩৩
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আবিরের কথাটা মুহুর্তেই ছুটিদের পরিবারের সবাই জানল। বাড়ির প্রত্যেকটা লোক যখন বহিরাগত এই ছেলেটার এবং ছেলেটার কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে পারল তখনই ছুটির বাবাও বিষয়টা জানতে পারল। হুড়মুড় করে মেয়ের ঘরে আসতেই চোখে পড়ল মেয়ের টলমল করা চাহনি। আরেকটু হলেই বোধহয় কান্না করে দিবে। আবির তখনও ছুটির গাল চেপে দাঁড়িয়ে কিছু বলছিল। তোফায়েল সাহেব মেয়ের চাহনি আর নিরব কান্না সইতে না পেরে মুহুর্তেই ছুটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আবিরের হাত ধরে সরানোর চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠল,
“ আবির! তোমার সাহস কি করে হলো আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার? তোমাকে এতটুকু সাহস হয় কি করে যে আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকেই তুমি শাসাচ্ছো? ”
আবির এই মুহুর্তে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ছুটির গাল ছেড়ে হাত ঠিক করে তাকায় তোফায়েল সাহেবের দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে টানটান স্বরে বলে উঠে,

“ আপনার সাহস হলো কি করে ওকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দিতে? প্রস্তাব দিই নি আমি? দেয় নি আমার পরিবার? রিজেক্ট করেছেন আপনি। বললেন মেয়ে এখন বিয়ে করতে চাইছে না। আর এদিকে চুপিচুপি মেয়েকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছেন? আমাকে কি যোগ্য মনে হয় নি আপনার? ”
তোফায়েল সাহেব এবারে গম্ভীর দৃষ্টিতেই তাকালেন আবিরের দিকে। সচারচর ছেলেটাকে এভাবে রাগতে উনি দেখেননি। কখনো এইভাবে কথা বলতেও দেখেননি। আজ দেখলেন। তবুও গম্ভীর স্বরে বললেন,
“ কাকে যোগ্য মনে হবে সেটা তো আমাদের বিষয় আবির। তুমি প্রস্তাব দিয়েছো মানেই যে তোমার সাথে বিয়ে দিতে হবে কথা ছিল? তাছাড়া যেখানে আমার মেয়ে রাজি নয় সেখানে কিসের বিয়ে? ”
আবির হাসে আর ছুটির দিকে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে ছুটির দিকে চেয়ে থেকে শুধায়,
“ আপনার মেয়ে কি এখানে রাজি? শিউর আপনি? ”
তোফায়েল সাহেব এবার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর করলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ পাত্র ও নিজেই পছন্দ করেছে। এবং বিয়ের আয়োজনটাও আমরা ওর কথাতেই করছি আবির। ”
কথাটুকু শুনেই আবির ছুটির দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। বাহ! এত বছরের ভালোবাসা উধাও! নিজের পছন্দেই বিয়ে করছে তাহলে? নিজেই পাত্র পছন্দ করেছে? আবির ছুটির দিকে তাকায়। ব্যঙ্গ স্বরে বলে উঠে,
“ তাই নাকি? তো তোর পছন্দ করা সে লাল টুকটুকে বরটা কোথায় রে ছুটি? একটু দেখা। এতদূর ছুটে এলাম, বর না দেখে চলে যাব নাকি? ”
ছুটি টলমল চাহনিতেই তাকায় আবিরের দিকে। চোখ জোড়া অসম্ভব লাল ঠেকছেে।চুলগুলো অগোছাল হয়ে পড়ে আছে কপালে। কেমন অগোছাল, উম্মাদ লাগছে এই আবিরকে। ছুটি মনে মনে ভয় পায় এই আবিরকে দেখে। চোখের শীতলতা বলে দিচ্ছে মানুষটার ভেতরটা ঠিক কতোটা ভয়ানক ঠেকছে এই মুহুর্তে। ছুটি শুকনো ঢোক গিলে। ধীর গলায় শুধায়,
“ আসে নি। ”

আবির এবারে হেসেই উঠে। মূলত স্বচ্ছ যখন ছোটনকে সকালে পাঠিয়েছিল বরকে আটকানোর জন্যই পাঠিয়েছিল। বেচারা বর মাঝখান দিয়ে ফেঁসে গেল। আবির অবশ্য তা জানে না। তবে বর আসে নি শুনে ব্যঙ্গ স্বরেই বলতে লাগল,
“ আসেই নি? বাহ বাহ! কি বর পছন্দ করলি? আসলই না একেবারে? আমি তো ভাবলাম তুই এইংগেইজমেন্ট সেরে বসে বসে রিং দেখছিলি। ”
কথাটা বলেই হাসে সে। ছুটির হাতটা টেনে নিয়ে দেখে রিং আছে কিনা। ছুটি এমন আচরণ দেখে কিঞ্চিৎ ইতস্থত বোধ করে। রোধ হয়ে আসা গলায় কোনরকমে শুধায়,
“ আবির ভাই। ”

আবিরের মাথায় তখন আগুন জ্বলছেে।বলা চলে রক্ত টগবগ করছে যেন। রাগে জেদে যখন মাথার ঠিক নেই ঠিক তখনই ছুটির এই ডাকটা তার রাগ দ্বিগুণ করল। চিৎকার করে ধমকে উঠল আবির,
“ চুপ। কথা বলবি না তুই৷ ”
তোফায়েল সাহেব বিস্ময় নিয়ে চাইলেন। তারই সামনে তার মেয়েকে এই ছেলেটা এমন ভাবে ধমক দিচ্ছে কোন অধিকারে? এই ছেলের কাছে উনি মেয়ে দিবেন? এই ছেলের তো রাগেরই শেষ নেই। তোফায়েল সাহেব মুহুর্তেই বলে উঠলেন,
” তুমি আমার মেয়েকে আমার সামনে ধমকাচ্ছো আবির? ”
আবির হাসে। ঠোঁট এলিয়ে বলে উঠে,

“ হ্যাঁ, ধমক দিচ্ছি আঙ্কেল।কি করব বলুন? আপনার মেয়েকে যত্ন করে বললে তো শুনে না। কত যত্ন করে যাওয়ার আগে বললাম বিয়ে করবি আমায়? বউ হবি? আপনার মেয়ে সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেল।আবারও ভয় পেলাম হারিয়ে ফেলব না তো মেয়েটাকে। বাসায় বলে প্রস্তাব পাঠালাম তাও কৌশলে আপনারা আমায় ঠকালেন। আর এখন তো একপ্রকার ষড়যন্ত্র করেই ঠকাচ্ছেন।ঠকাচ্ছেন না বলুন? ”
তোফায়েল সাহেবকে এবারে বিভ্রান্ত দেখাল। ঠকাচ্ছেন? কিভাবে ঠকাচ্ছেন? এমন তো কথা ছিল না যে ছুটি আর আবিরের বিয়েটা হবেই। কিংবা ছুটি আর আবিরের কোন সম্পর্কও ছিল না। তাহলে? উনি বললেন,
“ তোমার আর ছুটির কোন সম্পর্ক ছিল না আমার জানামতে। ”
আবির এবারে রাগে কপাল ঘষে রাগ শান্ত করার চেষ্টা করে। অতিরিক্ত রাগ লাগছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথাটা নিজেই ফাঁটিয়ে ফেলুক। আবির রাগ থাকা স্বত্ত্বেও শান্ত স্বরে বলতে চাইল,
“ আপনার মেয়ে আমায় এতবছর যাবৎ ভালোবেসেছে। বলেছিলাম আমি ভালোবাসতে? ভালোবেসেছে যেহেতু বিয়েও করতে হবে এখন। এখন বলুন, এখানে কাজী পাওয়া যাবে কিনা? না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই, স্বচ্ছ আর ছোটন গেছে কাজী আনতে। ”

তোফায়েল সাহেব এই পর্যায় রেগে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে শুধালেন,
“ এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে আবির। তামাশা করার একটা লিমিট থাকে। ”
আবির ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। কন্ঠ গম্ভীর করে চাহনি টানটান করে শুধায়,
“ আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি তামাশা করছি? তামাশা করলে এতদূর ছুটে আসতাম আমি? ”
তোফায়েল সাহেব এই পর্যায়ে আবিরের রাগের কাছে চুপ হলেন। বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় সামলানোর বুদ্ধি খুঁজলেন।আবিরকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে শান্ত স্বরে জানালেন,
“ গ্রামের লোকজন খারাপ বলবে। তুমি এখন বাসায় যাও। আমরা পরে এই বিষয়ে কথা বলব আবির। ”
আবির মানল না। বহু মেনে এসেছে সে। কিন্তু বিনিময়ে তাকে বারবার মিথ্যে বলে দমিয়ে রেখেছে। কি নিশ্চায়তা আছে যে সে যাওয়া মাত্রই ছুটি বিয়েটা করে ফেলবে না? শক্ত স্বরে জানাল,

“ কোন পরের টরের কাহিনী নেই। আজ হয়তো আপনার মেয়েকে বিয়ে করে বাসায় ফিরব আর নয়তো আপনার মেয়েকে খু’ন করে রেখে যাব। দুটোর একটা। ”
তোফায়েল সাহেব এবার শক্ত গলাতেই বললেন,
“ আবির! ”
ঠিক তখনই স্বচ্ছ আর ছোটন এল মধ্যবয়স্কা এক কাজীকে নিয়ে। আবির তা দেখে হাসে। বলে,
“ কাজী এসে গেছে। অনুমতি দিয়ে দিন আঙ্কেল। বিয়েটা করে নিই। ”
তোফায়েল সাহেব এই মুহুর্তে কি করবেন বুঝে উঠলেন না যেন। একবার ছুটির দিকে চাইলেন, মেয়েটা ভয় পাচ্ছে বোধহয়। আবার আবিরের দিকেও তাকালেন। এই রাগ, জেদ বলে দিচ্ছে ছেলেটা উনার মেয়েকে ভালোবাসেন। কিন্তু, তবুও একটা কিন্তু তো থেকেই যায়।বাবা হন তিনি। তাই তো শান্তভাবে বিষয়টা ঘুরানের জন্য একগ্লাস পানি এনে আবিরের সামনে ধরে বলেন,

“ দেখো আবির, মাথা ঠান্ডা করো। পানিটা খাও, শান্ত হও। আমরা বড়রা আছি বিষয়টা আলোচনা করতে। আমার মনে হয় আমাদের আরেকটু সময় নেওয়া উচিত। ”
আবির পানির গ্লাস টা হাতে নিল ঠিক তবে শান্ত হলো না। তাকাল ছুটির দিকে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই দৃষ্টি সরাল মেয়েটা। আবির সেভাবে থেকেই শুধায়,
“ হলে আজই হবে বিয়েটা। ”
এই পর্যায়ে তোফায়েল সাহেব একটা কঠিন কথা বলে ফেললেন,
“ ছুটি তোমায় বিয়ে করতে রাজি নয়! ”
ব্যস! এই কথাটা শুনেই আবিরের হাত পা চিরচির করে উঠল। ছুটির প্রতি জম্ম নিল ক্ষোভ। ইচ্ছে হলো এক থাপ্পড়ে গাল লাল বানিয়ে দিতে। আজীবন ভালোবেসে এখন এসব নাটকের মানে হয়? নাটকই যখন করবি ভালোবাসলি কেন? আবির সরাসরি দাঁড়ায় ছুটির সামনে। পকেটে হাত গুঁজে ছুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ সত্যি করে বল? রাজি নোস তুই? তোকে কেউ বাধ্য করেছে ছুটি? কেউ কি জোর করেছে তোকে? বল। ”
ছুটি তাকায় আবিরের দিকে। ভয়ার্ত সে লাল রঙ্গা চোখে তাকাতে ভয় হয় তার। কেঁপে উঠে। সে এই শীতল চাহনি কত কি ভয়ানক গল্পের সমন্বয় ঘটাচ্ছে। ছুটি কাঁপা স্বরেই উত্তর করল,

“ ন্ না। ”
আবির উত্তরটা শোনার আশায় ছিল না। তবুও শুনতে হলো। দাঁত কিড়মিড় করে তার রাগে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বলে,
“ তাহলে রাজি নোস তুই? বিয়ে করতে চাস না? শিউর তো? ”
ছুটি এবারেও কাঁপা স্বরে উত্তর করে,
“ শ্ শি শিওর! ”
কথাটা বলতে দেরি হলো ঠিক তবে আবিরের হাতের কাঁচের গ্লাসটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে সময় লাগল। হাতের মধ্যে সেভাবেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল। মুহুর্তেই ধারালো কাঁচগুলো বিঁধল আবিরের হাতে। লাল টকটকে রক্তে রক্তাক্ত ঠেকল হাতটা। টপাটপ রক্ত পড়ে রক্তিম হচ্ছে ফ্লোরটাও। তবুও যেন ব্যাথা নেই। আবির শক্তপোক্ত স্বরেই জবাব দিল,
“ ওকে ফাইন। হয় আজ তোকে বিয়ে করব, আর নয়তো মরব। দুটোর একটা। তুই জানিস ছুটি, তুই জানিস না আবিরের কতোটা জেদ।”

প্রেমের সমর পর্ব ৩২

ছুটি ভয় ভয় চোখে তাকিয়েই কেঁদে ফেলে। কতগুলো রক্ত পড়ছে। কতগুলো কাঁচ এখনো আবিরের হাতের মুঠোয়। ছুটি হাত বাড়ায়। টলমলে চাহনি ততক্ষনে কান্নায় রূপ নিয়েছে। কোনরকমে বলে,
“ আবির ভাই? হাত কেঁটে রক্ত পড়ছে। কষ্ট হচ্ছে তো আপনার, এদিকে দিন।”
আবির হাত এগোয়না। বরং তাচ্ছিল্য হেসে জবাব করে,
“ পড়ুক। তোকে ভাবতে হবে না। ”

প্রেমের সমর পর্ব ৩৪