প্রেমের সমর পর্ব ৩৮

প্রেমের সমর পর্ব ৩৮
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

অন্যসব প্রভাতের থেকে আজকের সকালটা ছুটির কাছে ভিন্ন। সম্পূর্ণই আলাদা৷ আশপাশের আলোয় তখন আবিরের মুখটা দৃশ্যমান। ছুটির অবস্থান হয়েছে আবিরের বাহুবন্ধনীতে। মাথা গিয়ে ঠেকেছে পুরুষালি বক্ষে। ছুটি নড়চড় করে না। ঘুম ভেঙ্গে চোখজোড়া মেলেই যখন এই সুপুুরুষের মুখখানা চোখ ভাসল তখনই স্তব্ধ হয় চেয়ে থাকল। সুন্দর! নিঃসন্দেহে তার চোখে এই পুরুষটিই পৃথিবীর সর্বোত্তম সুন্দর পুরুষ! ছুটি ফ্যালফ্যাল করেই চেয়ে থাকে। অল্প নড়চড় করে ওপাশ ফিরতে নিতেই আবির তার হাতের বন্ধন আরেকটু দৃঢ় করল। ঘুম জড়ানো স্বরে শুধায়,

“ সমস্যা কি? এমন করছিন কেন? ”
ঘুমজড়ানো স্বরটায় অদ্ভুত মাদকতা! ছুটি শুনে তাকায়। আবির তখনো চোখ বুঝে আছে। কোনরকমে জড়তা নিয়ে উত্তর করে,
“ দেরি হয়ে যাচ্ছে, উঠব। ”
আবির মুহুর্তেই নাকোচ করল কথাটার অর্থ। সেভাবেই দুই হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে নিয়ে শুধায়,
“ এখন না। ”
ছুটি চুপ থাকে এবারে। পরমুহুর্তেই ঘড়ির দিকে চেয়ে বুঝে সময়টা বহু পেরিয়েছেে।বেলা এগারোটা প্রায়! ছিঃ! মানুষজন কি ভাবছে তাকে নিয়ে? ছটি এই পর্যায়ে ফের বলে,
“ সকাল অনেক হয়েছে। এগারোটা বাঁজল আবির ভাই।”
আবির চোখ মেলে বিরক্তে কপাল কুঁচকায়।কিছুটা উপর হয়ে শুয়ে ছুটির এক হাত চেপে রাখে বিছানার সাথে। শুধায়,
“বাঁজলে বাজুক,আমার ঘুম শেষ হয়নি আপাতত। সুতারাং তোর কাজ হলো চুপচাপ এভাবেই আরো কিছুক্ষন আমার সাথে এভাবে পড়ে থাকা। ”
ছুটি ফের বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আপনি ঘুমালেই তো হলো আবির ভাই,আমায় ছেড়ে দিন। ”
আবির হাসে এই পর্যায়ে। ছুটির গালে হাত রেখে পরমুহুর্তেি ঠোঁট ছোঁয়ায় মেয়েটার কপালে। একটা গভীর চুম্বন এঁকে শান্ত স্বরে ফিসফিস করে শুধায়,
“ না, হলো না। তোকে বিয়ে করার চক্করে কালকের দিনটা সারাদিন ঝামেলা সয়ে গিয়েছি। এর আগেরদিন ও ঘুম হয়নি তোর কান্ডকারখানা শুনে। সুতারাং এই মুহুর্তে শান্তিতে ঘুমানোটা জরুরী৷বুঝলি? ”
ছুটি ফ্যালফ্যাল করে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কখনো কখনো মনে হয় আবির ভাই তাকে সত্যিই ভালোবাসে।সত্যিই মন থেকে চায়। কখনো মনে হয় সবই মিথ্যে। নাটকীয়তাই কেবল। এইযে এখন কপালে চুম্বন আঁকল, শান্তস্বরে এতগুলো কথা বলল ছুটির মনে হলো এই মানুষটা সত্যিই তাকে চায়। সত্যিই ভালোবাসে। আবির ছুটির তাকানো দেখে অল্প হাসে। পরক্ষণেই ফের সন্দেহী স্বরে বলে,
“ তোর এত শান্তরূপও হজম হচ্ছে না আমার। আগের মতো মনে মনে কিছু প্ল্যান করে ফেলছিস না তো? সত্যি করে বল। ”

ছুটি তাকিয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে শুধায়
“ আমার কাছে এই সংসারটা ভিত্তিহীন লাগছে আবির ভাই। অথচ এক সময় আমি এই সংসারটা কত করে চেয়েছিলাম৷ কত আশা ছিল আমার এই একটা সংসার নিয়ে।”
আবিরের সুন্দর, মধুর মেজাজটাকে বিগড়ে দেওয়ার জন্য বোধহয় এই দুটো লাইনই যথেষ্ট ছিল। দাঁতে দাঁত চাপে সে। রাগে শরীর চিড়বিড় করলেও অত্যন্ত শান্ত দেখাল তাকে। একহাতে ছুটির থুতনিটা তুলে ধরল। শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে শুধায়,
“ এখন নেই? ”
“ এখন আর আপনার জন্য পাগলামি আসে না আমার। ”
“ ভালোবাসা মরে গেছে? ”
ছুটি সময় নিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,
“ ভালোবাসা মরেনি তবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে আজকাল আমি খুবই ব্যর্থ! বিশেষ করে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি না আর। ”
আবির দীর্ঘশ্বাস টানে। বুকের ভেতর কোথাও এই কথাগুলো রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। বোধহয় যন্ত্রনা হচ্ছে তার। তবুও শান্ত স্বরে শুধায়,

“ কারণ? ”
ছুটি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“ আমি আপনার প্রতি দুর্বল। আর সে দুর্বলতা যে আপনি কাজে লাগাচ্ছেন না তার কোন নিশ্চায়তা আমার কাছে নেই৷ ”
আবিরের রাগটা এবারে প্রকাশ্যে এল। মুখ চোখ লাল দেখাল। চোয়াল শক্ত করে শুধাল,
“ তো এই কারণে শান্তশিষ্ট মনোভাব দেখিয়ে মনে মনে প্ল্যান করছিস যে আমায় ছেড়ে চলে যাবি? খবদ্দার ছুটি, ছেগে যাওয়ার কথা ভেবেছিসও যদি মেরে হাত পা ভেঙ্গে বন্দি করে রাখব। মাইন্ড ইট। ”
ছুটি ভয় পায় না। বরং নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বলে,
“ কেন জানি না কখনো মনে হয় আপনি আমায় ভালোবাসেন, আবার কখনো মনে হয় সবটাই মিথ্যে।”
আবিরের নিজের মাথা নিজেই ফাটাতে ইচ্ছে হয়। এত কেন অবিশ্বাস? কেন ছুটি বুঝে না তাকে? এতোটাই অবুঝ মেয়েটা?আবির ছোটশ্বাস টানে। বলে,

“ মিথ্যে মনে হওয়ার পিছনে কোন যুক্তিযুক্ত কারণ বল। সময় এক মিনিট। ”
ছুটি বলে,
“ অবহেলা! ”
“ আর? ”
“ মুখ চোখের সেই বিরক্তি আপনার। ”
“ আর? ”
“ গুরুত্বহীনভাবে পড়ে ছিলাম মাসের পর মাস, বছরের পর বছর!”
“ তারপর?
ছুটি এই পর্যায়ে চুপ থাকে। আবির লাল রক্তিম চোখ নিয়ে তাকাতেই ফের বলে উঠ,
“ আপনি যে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলছিলেন, স্বার্থ পূরণ করছিলেন তা নিজ কানেই শুনেছিলাম আমি ।”
আবিরের কপালের ভাজ মিলে। গলা দৃঢ় করে বলে উঠে,
“ আমার মুখ থেকে? ”
“ ঠিক তা নয়, তবে আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবির ভাই। ”
“ নিশ্চয় আমার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছিলি?
ছুটি শুধায়,
” সত্যিই তো ছিল। ”
আবির দাঁতে দাঁত চাপে। অত্যন্ত বিরক্ত দেখাল যেন তাকে। বলল,
“ সত্য মিথ্যা আমার উপর ছেড়ে দে বরং?”

সুহা তখন বিছানায় বসা। স্বচ্ছর কান্ডকারখানায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনি ছুটিদের বাসায়। অথচ ছুটির সাখে কথা বলার সুহার প্রবল ইচ্ছা! এই যে এতকিছু হয় গেল, লুকিয়ে গেল তা জানার আগ্রহ। সুহা ছোটশ্বাস টানে। পাশে থাকা চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক বসাতেই ছুটে এল সিয়া। শুধাল,
“ ভাবি,ভাবি আগামী সপ্তাহে তোমার আর ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান আব্বু বলল। তুমি খুশি? ”
সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কি বলবে বুঝে উঠে না। একবার বিয়ের অনুভূতি ছিল প্রখর। খুশি ছিল সে ভালোবাসার সঙ্গীকে পাবে বলে। কিন্তু শেষমেষ সব আনন্দ মাচি করে দিয়ে সে চলে গেল নিজের মতোই করে৷ সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। যদিও এবারের অনুভূতিটাও রঙ্গিন স্বপ্নের ন্যায়। এবারের অনুভুতিটাও উচ্ছল!শুধায়,
“ তোমার ভাইয়া জানে? ”
সিয়া মুহুর্তেই উত্তর করে,

“ ভাইয়াই তো আব্বুকে বলল আয়োজন করতে। ”
সুহা কেঁশে উঠে। কেউ নিজের বিয়ের কথা নিজে বলে? তাও বাবাকে? সুহা অজান্তেই লজ্জ্বা পায়। বলে,
“ বাসায় দেখলাম না তো তাই। ”
সিয়া মুহুর্তেই শুধায়,
“ তুমি কি লজ্জ্বা পাচ্ছো? ”
সুহা মুহুর্তে উত্তর করে,
” একদম নয়। বিয়ে তো স্বাভাবিক বিষয়ই। ”
সিয়া উচ্ছাস নিয়ে বলে,
“ আমি অনেক খুশি ভাবি। বহুদিন পরে গিয়ে আনন্দ করব খুব। ”

সিয়ার থেকে কথাটা শোনার পরপরই সুহার দাদাজান এই বাসায় এলেন। বহুটা সময় স্বচ্ছর বাবার সাথে আলোচনা করে অবশেষে সুহাকে বললেন ব্যাগ গোঁছাতে।কারণ বিয়েটা ওখান থেকেই হবে৷ সুহাও বাধ্য মেয়ের মতো ব্যাগ গোঁছাতে গেল। রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাগ গোছাতে নিতেই কোথা থেকে ছুটে এল স্বচ্ছ৷ সুহাকে জামাকাপড় ব্যাগে নিতে দেখে মুহুর্তেই হাত টেনে ধরে সে। বলে,
“ এসব কি সুহাসিনী? নিষ্ঠুর বউদের মতো কেবল নিজের কথাই ভাবছো? স্বার্থপরতা হয়ে যাচ্ছে না?”
“ হ্ হু?”
স্বচ্ছ চোয়াল শক্ত করে। শুধায়,
“ ব্যাগপত্র গুঁছিয়ে নিচ্ছো কেন শুনি? ”
সরল উত্তর,
“ দাদাজান বলল। ”
স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,

“ তোমার দাদাজান তো দ্বান্ধাবাজ লোক।যেই দেখল বিয়েতে কোন বাঁধা দিতে পারছে না ওমনিই আমাকে বউ থেকে দূরে সরানো প্ল্যান কষেছে। ”
সুহার হাসি পায় এবারে। বলে,
“ ইচ্ছে হলে আপনিও যেতে পারেন স্বচ্ছ। যাবেন?”
স্বচ্ছ রাজি হলো না। বরং বলে উঠে,
“ তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
“ পাগলামো করছেন।”
স্বচ্ছ কেমন নজরে তাকায়। শুধ্য়,
“ অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তোমার সঙ্গে থাকা। ”
” বাচ্চা নন আপনি। ”
স্বচ্ছ বাঁকা হাসে। সুহার ধরে রাখা হাতটা টেনে নিয়ে একদম কাছে আনল সুহাকে। বলে,
“ প্রেমিক তো! ”

কথাটা বলেই ফু দিয়ে উড়াল সুহার কপালের উপর চুলগুলো। ঝুঁকে গিয়ে বলে উঠল,
“ এসব পাগলামো খুব কম ঠেকছে সুহাসিনী৷ আরেকটু বেশি পাগলামি দেখার জন্য নিজেকে তৈরি করুন। কেমন? ”
বাঁকা হেসে কথাটা বলেই স্বচ্ছ ফের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বসে সুহার দাদাজানের মুখোমুখি। শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলে,
“ আমার বউ,আমি বিয়ে করব। আপনি আচমকা বউ নিয়ে যেতে এসেছেন কেন দাদাজান? বলেছি আমি? ”
দাদাজান তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
“ অনুষ্ঠান ও বাড়িতেই হবে। এই কারণেই। ”
স্বচ্ছ দ্বিগুণ তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিল,

প্রেমের সমর পর্ব ৩৭

“কিন্তু আমি আমার বউকে দিব না। ”
মুহুর্তেই দাদাজান বলে,
“বেহায়াপনা করছো। ”
স্বচ্ছ হেসে বলে,
“ আপনার বউকেও কেড়ে নিয়ে আসি?তারপর দেখি বেহায়াপনা আপনিও করেন কিনা! ”
দাদাজান রেগে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ বেয়াদব ছোঁকরা।”

প্রেমের সমর পর্ব ৩৯