প্রেমের সমর পর্ব ৪১

প্রেমের সমর পর্ব ৪১
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

ছুটির মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি বিদ্যমান। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে আবিরের কথাগুলোকে উপহাসই করছে। আবিরের চোখ লাল হয়ে আসে। শরীর চিরচির করে নিরব রাগে। বাইরের শীতল বৃষ্টিতেও রাগে- ক্ষোভে তার অসহ্য লাগে। মুহুর্তেই ছুটির থুতনিতে হাত রেখে মুখ উপর করে সে। শীতল স্বরে রাগ মিশিয়ে বলে উঠে,
“ বল, কোন মেয়ে? কাকে ভালোবাসার কথা পাঠিয়েছি আমি? ”
ছুটি এবারেও উত্তর দেয় না। বরং নিরব চেয়ে থাকে সেভাবেই। আবিরের এই মুহুর্তে মেয়েটার গালে দু দুটো চড় বসাতে ইচ্ছে হয়। রাগে দুঃখে শরীর বিষিয়ে উঠে তার। এক হাতে ছুটির গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে এবারে,

“ ফাইজলামি করছি তোর সাথে? কথা কানে যায় না? ”
নরম গালে শক্ত হাতের চাপ পড়ায় ব্যাথা অনুভূত হলেও ছুটি স্থির থাকে। প্রকাশ করে না।দৃষ্টি থাকে আবিরের মুখচাহনিতেই স্থির। চোখ টলমল করে নিস্তব্ধ প্রকৃতির ন্যায়।অতঃপর ছোটশ্বাস ফেলে শুধায়,
“ যাকে আপনি খুব করেই চেনেন তার নাম আমার কাছে জানতে চাওয়াটা কেমন হাস্যকর ঠেকছে আবির ভাই।”
আবির আবারও দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর করল,
“তোর কাছে যেটা হাস্যকর লাগছে সেটা আমার কাছে হাস্যকর ঠেকছে না। সুতারাং ফটাফট বলে ফেল কে সে মেয়ে? ”
ছুটি ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“ সত্যিই চেনেন না? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবির ছোটশ্বাস ফেলে। ছুটির গাল থেকে হাত সরায় তৎক্ষনাৎ। মেয়েটার গালে আঙ্গুলের লালচে চাপ দৃশ্যমান। আবিরের মায়া হয়। নিজেকে মনে মনে দোষারোপও করল রেগে যাওয়ার জন্য। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বলল,
“ যে মেয়েটাকে ভালোবাসি বলে মনে হয়েছে সেটা তুই। এই ব্যাতীত অন্য কোন মেয়ের নাম যেহেতু আমার মাথায় আসছে না সেহেতু আমি চিনি না! ”
ছুটি হাসে। আবিরের মুখেে দিকে স্থির চেয়ে থেকে বলে,
“ রাহাকে ভালোবাসতেন না বলছেন?”
রাহা?নামটা শুনেই আবির ভ্রু কুঁচকে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। রাহাকে ভালোবাসবে কেন সে. ছুটি কি রাহার সাথে সন্দেহ করে এসেছে এতদিন? ছিঃ! আবির ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
“ রাহা? ”
ছুটি তাচ্ছিল্য করে বলল,

“ শুনেননি নামটা?ওকে, নবনী আহমেদ রাহা? এবার বলুন, শুনেছেন নামটা নিশ্চয়?”
আবির গলা শক্ত রেখে বলে,
“ শুনিনি,তবে রাহার নামটা শুনেছি।স্বচ্ছর শালিকা!”
“ গুড। তাও অবশেষে চিনতে পারলেন আবির ভাই।”
আবির ফের বলে,
“ রাহাই সেই মেয়েটা? যাকে আমি ভালোবাসার কথা বলেছি বলে তোর ধারণা? ”
“ বলেননি শিওর? ”
আবির সঙ্গে সঙ্গেই দৃঢ় স্বরে বলে,
“ শিওর বলিনি। মনে করিয়ে দে কবে বলেছি? ”
ছুটির চোখ টলমল করে। এতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানুষ মিথ্যে বলে কিভাবে? আবির ভাই এত দক্ষতার সহিত মিথ্যে বলতে পারে বলে তো তার ধারণাই ছিল না।ছুটির গলা রোধ হয়ে আসে। বলে,
“ নিজ চোখে দেখেছিলাম আবির ভাই!”
আবির কপাল কুঁচকে। নিজ চোখে? আবির কখনো রাহাকে সে নজরে দেখেইনি যে ভালোবাসি বলার প্রশ্ন উঠবে। এদিকে ছুটি যেভাবে বলছে বিষয়টা যেন অবশ্যই সত্য। আবির কপাল কুঁচকে শুধায়,

“ নিজ মুখে বলেছি? ”
ছুটি ছোটশ্বাম টানে। বলে,
“আপনার নাম্বার থেকেই এসেছিল ওর ফোনে কল। যেদিন আমাকেও কল দিলেন? ঐ যে দেশ ছাড়ার আগের দিন আবির ভাই। নিশ্চয় রাহাকে দেখতেই ওদিকে গিয়েছিলেন। তারপর আমাকে দেখে বোধহয় আমায়ও কল করেছিলেন। যায় হোক আপনি যে প্রায়সই ওকে বিভিন্ন নাম্বার থেকে কল করে ভালোবাসার কথা জানাতেন তা আমি সেদিনই জেনেছিলাম। কারণ আপনার নাম্বারটা আমার চেনা ছিল । ”
আবিরের কাছে এবার যেন সবটাই স্পষ্ট। সেদিন তো সাদ কার ফোন থেকে রাহাকে কল করেছিল। আর বোকা ছুটি বোধহয় সাদকেই আবির ভেবে বসে আছে। আবির দীর্ঘশ্বাস টানে। সাথে হাসিও পায়। কার ছুটিটা কতো বোকা। একদম বোকাপাখি!আবির হাসে। মেয়েটার মুখ আগলে ধরে সামান্য ঝুঁকে। গালের যে অংশে আঙ্গুলের লালচে দাগ সেখানটাতেই চুমু এঁকে বলে,
“ বোকাপাখি! তুই আসলেই আজীবন বোকাই থাকবি ছুটি। ”
ছুটি হতবিহ্বল নজরে শুধায়,

“ হ্ হু?”
আবির স্পষ্ট হতে ফের বলে নেয়,
” প্রথম কারণটা আমি তোর অনুভূতিকে ব্যবহার করেছি,দ্বিতীয় কারণটা আমি রাহাক ভালোবাসি এই ধারণা? এই দুটোই তো কারণ? পরে আর কারণ বাড়াবি না তো বোকাপাখি?”
“ বুঝিনি…..”
“ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার এই দুটোই তো কারণ? আর কোন কারণ নেই তো? ”
ছুটি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“ এই দুটো কারণকে এতোটা সামান্যভাবে দেখছেনই বা কিভাবে?”
আবিরের হাসি পায়। দুটো কারণ!অথচ একটারও ভিত্তি নেই। বলে,
“ বৃহৎ রূপে দেখব? ”
উত্তর এল,

“ আমার কাছে এই দুটো কারণই অনেকটা বৃহৎ আবির ভাই! এবং আর কোনদিন আপনাকে আমি আগের মতো চাইতে পারব কিনা তাও সন্দেহ! ”
“ আর যদি এসব মিথ্যে হয়?”
“ নিজের চোখ, কান মিথ্যে হবে? ”
আবির হাসে। ছুটির মাথায় এলোকেশী চুলে চুমু বসিয়ে বলে,
“ বোকা,বোকাপাখি আমার! অনেক সময় চোখ কানও আমাদের ভুল বুঝায়। হতে পারে তুই চোখে যা দেখছিস তা সত্য কিন্তু দৃশ্যটার বর্ণনা অন্য রকমও হতে পারে!পরেরবার থেকে একটু যাচাইবাচাই করে রাগ করিস প্লিজ।”

অতঃপর একটা অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিময় রাত্রি!দুইজন মানব-মানবীর অপূর্ণ কিছু অনুভূতির প্রকাশ। সুহার চোখে তখন সমুদ্রসমান লজ্জা। অথচ স্বচ্ছকে দেখা গেল না এইটুকুও লজ্জা পেতে। সে নিজের মতো ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছে বাঁকা হাসি। সুহায় যখন লজ্জায় কথাই বলতে পারছিল না তখন স্বচ্ছ বেফাঁস কথা বলতে বলতেই সময়টা কাঁটাচ্ছে।সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। পেট গুড়মুড় করছে ক্ষিধায়। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বুঝে এখন রাত সাড়ে দশটা! সন্ধ্যা থেকে এখন অব্দি তারা ঘরে বন্দি ভাবতেই সুহার মনে আবারও লজ্জা ঝেকে বসে। বাইরে সবাই কি ভাবছে? সিয়া, আব্বা-আম্মা সবাই কি বলছে? ছিঃ ছিঃ! সুহার এই মুহুর্তে মন চায় লজ্জায় মরে যেতে। মুখ দেখাবে কি করে সে সবার সামনে? স্বচ্ছ অবশ্য সুহার এমন লজ্জ্বায় মরিমরি অবস্থা দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। নাকে নাক ঘষে বলে,

“ সুহাসিনী? বিয়ের অনুষ্ঠানের দুদিন আগেই বাসর ডান!বোধহয় আমরাই এমন… ”
সুহা রেগে তাকায়। কন্ঠ শান্ত রেখে বলর,
“ আমরা নই। আপনি স্বচ্ছ। ”
স্বচ্ছ হাসে চাপা। সুহার রাগ বুঝে উঠে ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“ আমি একা? শিওর?”
সুহা সমুদ্রসমান অভিযোগ নিয়ে স্বচ্ছর দিকে তাকায়। বলে,
“ আপনি চাইলে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারতেন। ”
স্বচ্ছ হাসে। সুহার নাকে গাঢ় চুমু বসিয়ে বলে,
“ উপায় রাখেননি আপনি। আর এখন আমার দোষ সুহাসিনী? ”
সুহার কান্না পেল এবারে। লজ্জায় সংকোচে রোধ হওয়া স্বর নিয়ে বলে,
” সবাই কি ভাববে? সন্ধ্যা থেকে এতক্ষন রুমে কি করছিলাম জিজ্ঞেস করলে?ছিঃ! ”
স্বচ্ছ হেসে উঠে। সুহার দিকে চেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“ যা করছিলে তাই বলবে। ছিঃ এর কি আছে?”
সুহা রেগে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“স্বচ্ছ!”
স্বচ্ছর পেট ফেটে হাসি পায়। তবুও না হেসে গম্ভীর মুখ করে উত্তর দেয়,
“ হু বলো সুহাসিনী। ”
সুহা অসহায় গলায় বলল,
“ সবাই কি ভাবছে?আপনি, আপনি এই সময়টায়…
স্বচ্ছ হাসে। উত্তরে বলে,
“ যা ভাবার তাই ভাববে।”
“ ছিঃ! মুখ দেখাব কি করে? ”
স্বচ্ছ এবারেও উত্তর করে,
“ যেভাবে মানুষ মুখ দেখায় সুহাসিনী। আর ওরা জানে প্রেমে পড়লে মানুষ সময় ক্ষণ ভুলে বসে। বুঝলে? সুতারাং ওরা কিছুই মনে করবে না। রিল্যাক্স! ”

কথাটা বলেই স্বচ্ছ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। একপাশে অবহেলায় পড়ে থাকা নিজের টিশার্টটা নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতেই কাপড় নিয়ে গেল ওয়াশরুমে। অতঃপর মিনিট পাঁচ পর গোসল সেরে ভেজা চুলে আর একটা টিশার্ট আর টাউজার পরে বেরিয়ে এল। এসেও সুহাকে সেভাবে থাকতে দেখেই হেসে বলে,
“ গোসল সেরে আসো সুহাসিনী, খাবার আনছি। ”

কথাটুকু বলেই স্বচ্ছ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সুহা যেন স্বস্তি পায়৷অতঃপর নিজেকে আলগোছে গুঁছিয়ে নিয়ে অন্য জামা নিল।শরীরময় তখন সুপ্ত ব্যাথা জানান দিচ্ছে একটু আগেকার স্বচ্ছর পাগলামোর কথন। দুনিয়ার অবাধ্য কাজকর্ম ছেলেটার!সুহা স্বচ্ছর অবাধ্য কাজকর্ম আর পাগলামোর কথা মনে করেই লজ্জায় হাঁসফাঁস করে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উঠে দাঁড়ায় আলগোছে। অতঃপর দ্রুত জামা নিয়ে পা বাড়ায় ওয়াশরুমে। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে গোসল সারে। তারপর জামা পরে যখন ওয়াশরুমের আয়নাটার সামনে দাঁড়াল ঠিক তখনই চোখে পড়ল গলায় কিছু লালচে দাগের অস্তিত্ব!এমনকি গলার নিচেও! বেচারি সুহা মুহুর্তেই স্বচ্ছকে বিড়বিড় করে বকতে থাকে। হিসেব মতো দুদিন পরই তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান৷ অথচ আজই! সুহা ছোটশ্বাস ফেলে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানে মাথায়। একদম মাথা, বুক, গলা সব ডেকে নেয় সে।তারপর যখন বের হলো দেখল স্বচ্ছ খাবার নিয়ে বসে আছে। তার দিকে চেয়েই ক্রুর হেসে বলে উঠে,

প্রেমের সমর পর্ব ৪০

“ মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসা পেয়ে তোমার রূপ বেড়ে গেছে সুহাসিনী৷ ফের কাছে টানব?”
সুহা রেগে তাকায় এবারে। স্বচ্ছ হাসে। বলে,
“ স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া প্রতিটি নারীর সৌভাগ্য সুহাসিনী৷ সেদিক থেকে তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে না করে রেগে যাচ্ছো?নির্দয় রমণী! ”
সুহা ফের রেগে তাকায়। এগিয়ে এসে ওড়না সরিয়ে লালচে দাগগুলোকে সাক্ষী করে বলে,
“ নির্দয় পুরুষ! করেছেন কি আমার? এইসব যদি সবাই দেখে মানসম্মান থাকবে আমার? ”
স্বচ্ছ হেসে খাবারের গ্রাস এগিয়ে ধরেে।ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“ এইগুলো ভালোবাসার চিহ্ন সুহাসিনী। ”

প্রেমের সমর শেষ পর্ব