প্রেমের সমর পর্ব ৬
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
চিকন একটা মেয়েলি হাত।স্বচ্ছ আড়চোখেই তাকিয়ে দেখল জামার আড়ালে থাকা সুহার হাতটা। সুহা এখনও আবিরের সামনে হাত মেলে দেয় নি। তবে যেভাবে আছে সেভাবেই স্বচ্ছ দেখল।ছবির হাতের সাথে মিলাতে পারল না যেন। অবশ্য ওভাবে আড়চোখে দেখে বুঝা যায়? স্বচ্ছ ছোট শ্বাস ফেলতেই আবির আবারো সুহার হাত দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে বলে উঠল,
“ আপু? আমরা আসলে একজনকে খুঁজছি। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার হাতটা দেখান প্লিজ! ”
সুহা তখনও কানে ফোন চেপে দাঁড়িয়ে। আবিরের কথা শুনে মহা বিরক্ত হয়েছে এমন ভাব করে অবশেষে বলল,
” জ্যোতিষি নাকি আপনি? হাত দেখে মানুষ খুঁজে বের করতে পারেন? ”
আবির, সাদাফ, স্বচ্ছ আর নিধি চারজনই বুঝে নিল এই মেয়ে ত্যাড়ামি দেখাবেই। স্বচ্ছ বিরক্ত হয়। এই মেয়েকে বেশিবার হাত দেখাতে বললে নির্ঘাত ভাব বেড়ে যাবে। খুব মুখ চালাবে। তাই বুদ্ধি করে সুহার নাম্বারেই কল করল সে মুহুর্তে। অন্তত ফোন বেঁজে উঠলে তো বুঝতে পারবে এটা সুহা কিনা?তাই সেই মোতাবেক চ্যাক করল ফোন বেজে উঠে কিনা। অথচ দুই তিনবার কল দেওয়ার পরও ফোন বাঁজল না। স্বচ্ছ যেন মনে মনে নিশ্চিত হলো এই বেয়াদব মেয়েটা সুহাসিনী না। দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তার বউ নিশ্চয় এমন একটা বেয়াদব মেয়ে হবে না? মনে মনে মেয়েটাকে দু চারটা কথা শুনানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে গেল সে। বিরক্ত স্বরে বলল,
“না, ও আসলে হাত দেখে বলতে পারে কার মাথায় কয়টা তার ছিড়া আছে। যায় হোক, আপনার মাথার সব তার যে ছিড়াই তা আমাদের জানা কথা আপু!এখন যান, আপনার হাত দেখার দরকার নাই আমাদের।”
অপমানে সুহার ফর্সা মুখ লাল হয়ে এল। মুখ বিকৃত করে তেজ নিয়ে জবাব দিল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আশ্চর্য! আমি কি গলা ফাঁটিয়ে চিল্লাইয়ে বলতেছিলাম যে, ‘আসুন, আমার হাত দেখে যান। আমার হাত না দেখলে আমি গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করব।’ বলেছি?”
স্বচ্ছ ফোঁড়ন কেঁটে উত্তর দিল,
“ আপনার যা গলা এতে চিল্লানোর প্রয়োজন নেই। এলাকার মানুষ এমনিতেই শুনবে। ”
সুহা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর করল,
“ আর আপনাদের যা চরিত্র তাতে আমি এতটুকু অন্তত বুঝেছি মেয়েদের বিরক্ত করা ছাড়া আর কোন কাজকাম নাই আপনাদের। সব কয়টাই ইভটিজার! ”
“এই হ্যালো! ইভটিজার বলছেন কাকে? কিছু করেছি আপনার সাথে?”
সুহা হাত চালানে ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“ এ্যাঁ! আমার সাথে কিছু করার সুযোগ দিব নাকি?মে’রে কোমড় ভেঙ্গে দিব একেবারে।”
স্বচ্ছর হাসি আসে। এই এইটুকু দেখতে মেয়ে কিনা তার মতো ছেলের কোমড় ভেঙ্গে দিবে? যা মুখেই কথা এই মেয়ে! তাই তো হেসে হেসে উপহাস করে বলে,
“ ঐদিনের মতো ঐটুকু ঘুষি দিয়ে কোমড় ভাঙ্গবেন? ”
মুহুর্তেই পেঁছন থেকে ভেসে এল অট্টহাসির আওয়াজ। সুহা ফিরে দেখল। ছেলেটা সুহার স্টুডেন্ট, ওরফে স্বচ্ছর কাজিন তিহান।তিহানদের বিল্ডিং আর স্বচ্ছদের বিল্ডিং পাশাপাশিই! সে হিসেবে প্রায়সই যাতায়াত হয়। আর সে যাতায়াতের বিষয় ধরেই তিহান কথাগুলো শুনে ফেলেছে এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছেে।সুহা হাসির আওয়াজ শুনেই ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকায়। স্বচ্ছকে এই মুহুর্তে সহ্য হচ্ছে না তার। সত্যিই মে’রে কোমড় ভেঙ্গে ফেললেও সে নিজেকে দোষারোপ করবে না এই মুহুর্তে। তবে তা করল না সে। উল্টো তিহানের দিকে তাকিয়ে সুন্দর ভাবে ডাকল,
“ একটু এদিকে আয় তো তিহান!”
তিহান বেচারা গদগদ হয়েই সুহার সামনে এসে দাঁড়াল। কিছু বলবে এমন ভঙ্গিতে উৎসুক হয়ে তাকাল সুহার দিকে। উল্টোদিকে সুহা তিহানের দিকে মৃদু হেসে চাইল। তারপর স্বচ্ছর উপর জম্মানো রাগটা এক নিমিষেই ঝেড়ে ফেলল তিহানে সফেদ গালের উপর। এক মুহুর্তেই চড়ের আওয়াজ ভাসল সবার কানে। তিহান বেচারা তখনও বুঝেই উঠতে পারেনি তার সাথে কি হয়েছে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে গালে হাত রেখে সুহার দিকে তাকাতেই সুহা বলল,
“ এবার বল তো তিহান ? ঐটুকুই? নাকি বল আছে আমার হাতে?”
তিহানের গাল জ্বলছে। এই সুহা আপু তাকে চড় মেরে মেরেই পড়া শিখায় বরাবর! তাই বলে সবার সামনে চড় বসাবে তার গালে? মুখ কালো করে গালে ওভাবে হাত রেখেই তিহান জবাব দেয়,
” বল আছে আপু!”
সুহা হেসে বলে,
“ গুড! যদিও আমি ভদ্র মেয়ে।হাত উঠাতাম না সবার সামনে কিন্তু এনাদেরকে প্রমাণ দেখাতেই উঠালাম। ডোন্ট মাইন্ড হুহ?”
পরমুহুর্তেই আবার স্বচ্ছদের উদ্দেশ্য করে বলে গেল,
“ আর শুনুন? নেক্সটটাইম মেয়েদের বিরক্ত করবেন না এভাবে। ফল ভালো হবে না বুঝলেন? ”
কথাগুলো বলেই হনহন করে চলে স্বচ্ছদের সামনে দিয়েই চলে গেল সুহা। আবির, সাদাফ, নিধি তখনও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। আর তিহান গালে হাত বুলাচ্ছেে।সাদাফ তিহানের কাঁধে হাত রেখেই স্বচ্ছকে বলে উঠল,
“ কি সাংঘাতিক মেয়ে! স্বচ্ছ?কোন ভাবে যদি এই মেয়ে তোর বউ হয়? ও মাই গড!দিনরাতে মেরে মেরে সব হাড্ডি নরম করে ফেলবে তোর! ”
তিহান মিনমিন করে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,
“ বউ হওয়ার কি আছে! অলরেডি এই সাংঘাতিক মেয়েই স্বচ্ছ ভাইয়ের বউ হয়ে আছে! শুধু স্বচ্ছ ভাইয়াই জানে না।”
স্বচ্ছ যদিও তিহানের মনের কথক পড়তে পারল না। তবে এগিয়ে এসে তিহানের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
“ ছাগল কোথাকার!তুই না পুরুষ মানুষ? মেয়েদের হাতে একটা চড় খেয়েই এমন ভেড়ার মতো করছিস যেন তার গালের হাড্ডি বাঁকা হয়ে গেছে। ”
তিহান বোকা বোকা স্বরে উত্তর দিল,
” ভাইয়া, গালের মাংস ঝলছে এখনো আমার! দোষ করলে তুমি আর শাস্তি পেলাম আমি? আপু আমার সাথে অন্যায় করল এটা! সবসময় আমারে এমন মা’রে আপু! ”
নিধি কৈাতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ কেমন আপু তোমার? ”
” আপু আমার টিচার। পড়ায় আমায়। পড়া না পারলেই এভাবে চগ বসায় গালে। ”
তিহানের উত্তর পেয়েই সবাই হেসে উঠে।নিধি হাসতে হাসতে বলে,
“ এই মেয়ে যদি তোর বউ হয় তাহলে মেরে মেরে সোজা বানিয়ে ফেলবে ভাই। এজ এ্যা স্টুডেন্ট হিসেবে ট্রিট করবে!”
কথাটা বলতে বলতেই নিধি হাসল। স্বচ্ছ গম্ভীর গলায় বলল,
“ আমার বউ এত বেয়াদব হবে কি করে মনে হলো তোর? আমার বউ অতি ভদ্র আমি যতটুকু জানি। নেহাৎ এখন সে অভিমানে, অনুরাগে ফুলে আছে বলে একটু ঘুরাচ্ছে। নয়তো বিয়ের আগে একমাস কথা বলে আমি এইটুকু তো বুঝেছিলাম যে সে খুব ভালো মেয়ে। ”
আবির গলা নামিয়ে বলল,
“ শিওর তুই? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়েই তোর বউ! ”
স্বচ্ছ জবাব দিল,
“ এই মেয়ে আমার বউ হলে আমি যখন কল দিলাম, রিং হলো। ওর হাতে ফোন ছিল তবুও আওয়াজ হলো না। রিং বাঁজল না। তাহলে? ”
সাদাফ সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিন্ত হলো এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“ যাক তাহলে চিন্তামুক্ত যে এই মেয়ে আমাদের ভাবি না! ”
সময়টা সন্ধ্যার অনেকটা পরের। আকাশে আঁধার ছেয়ে এসেছে তখন। প্রকৃতিতে শীতল হাওয়া। সুহা বেলকনিতে বসে সে হাওয়া উপভোগ করছিল। গিটারে টুং টাং সুর উঠাচ্ছে।কিন্তু বেলকনিতে আলো জ্বলছে না। স্বচ্ছ সুদূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সে বেলকনিটায়। যখনই এক মেয়েলি ছায়া বুঝে উঠত পারল তখনই বুকের ভেতর কেমন করল যেন। মনে হলো এটাই সুহা। এটাই সে সুহাসিনী। বোধহয় হাতে গিটারও! স্বচ্ছ দূর থেকেই ছায়া দেখল। কিন্তু সুর ভেসে আসছে না। চায়ের টং দোকানটা থেকে চায়ের কাপ যখন ঠোঁটে ছোঁয়াল ঠিক তখনই তার ফোনে কল এল। স্বচ্ছ বেলকনিটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই কল তুলল।ওপাশ থেকে কেউ বলল,
“ এখন কি দিনরাত এই বেলকনিতে নজর রেখেই কাঁটাবেন অস্বচ্ছ সাহেব? কিসব পাগলামো এসব?”
স্বচ্ছ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। বুঝে নেয় যে বেলকনির মেয়েটাই সুহাসিনী।তাকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে আলোতে দেখেই হয়তো কল দিয়েছে।স্বচ্ছ কিছু সময় পর উত্তর দিল,
” সারাদিন অনেকগুলো কল করা হয়েছিল তোমায়। রেসপন্স করো নি কেন? ”
“ রেসপন্স করার প্রয়োজন বোধ করিনি। আপনাকে বলেছিলাম যে এসব পাগলামি না করতে। তবুও দাঁড় করিয়ে করিয়ে হাত চ্যাক করছিলেন! ”
স্বচ্ছ ছোটশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়,
“ পেয়েছি দুইজন মেয়েকে। তার মধ্যে কেবল একজনের হাত চ্যাক করেছি সুহাসিনী। আরেকজন তো চরম বেয়াদব! তুমি এই মেয়ের সাথে একই বাসায় থাকো কি করে? কি ঝগড়ুটে! ”
সুহার হাসি আসল। তবুও বলল,
“ কেন? কি করেছে সে? ”
“ এই নিয়ে দুইতিনবার ঝগড়া করেছে মেয়েটা৷ ”
সুহা বলে,
“ ঝগড়া করার মতো কাজ করেছিলেন? ”
“ আমি কি ঝগড়া করার জন্য মরিয়া হয়ে আছি নাকি? ”
সুহা চাপা হাসে। শ্বাস টেনে বলে,
“ এসব বাদ দিন এবারে। ”
স্বচ্ছ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ কোনসব? ”
“ বউ খোঁজাখুঁজি। ”
“ দেখা দিয়ে দাও তাহলে। ”
“ দেখা পাওয়ার এতোটা আগ্রহ কেন?”
স্বচ্ছ গম্ভীর গলায় বলে,
“ তুমি একটা খেলা খেলছো আর আমি সে খেলার গুঁটি হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। তোমার ইচ্ছেমতো ঘুরাচ্ছো আমায়। আমি কিছুই করতে পারছি না। ”
সুহা চুপ থাকে। এতোটা আগ্রহ অথচ সে আগ্রহটাও শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। একটু ভালোবেসে আগ্রহ দেখালে কি হতো?সুহা ভাবে।তারপর অনেকটা সময় পর জড়ানো সুরে বলে,
“ কখনো সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেছেন স্বচ্ছ? স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট অনুভব করেছেন? নিজেকে অবহেলায়, অপমানে এক নির্জীব বস্তুর মতো ভেবেছেন কখনো? ভাবেন নি। আমি ভেবেছি। আমি এখন স্বপ্ন দেখতে পারি না, বিশ্বাস করতে পারি না, ভালোবাসতে পারি না। আমার সব অনুভূতিই পরাজিত আজ!”
প্রেমের সমর পর্ব ৫
কথাগুলো বলেই সুহা কল রাখল।পরপরই বেলকনি থেকে উঠে চলে যায় রুমে। স্বচ্ছ চুপচাপ বসে থেকে তা দেখে। আনমনে ভাবে যে, মেয়েটা কি কাঁদছিল? কেন কাঁদছিল? স্বচ্ছর কেন একটা চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে মেয়েটার জন্য? কিসের কারণে? সে তো মেয়েটার প্রতি দুর্বল নয়। তবুও? কেন? নাকি এসবের জন্য কেবলই সে দায়ী বলে? মেয়েটাকে একটা সময় প্রচুর কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল বলে?