প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ২
অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সুহার প্রেগনেন্সির শুরু থেকেই নানা রকমের জটিলতা ছিল। এখনও ব্যাতিক্রম নয়।এতসব সমস্যার কারণেই সে রাহার বিয়েতে উপস্থিত হয়নি। কারণ জার্নি অনেকটা। তার উপর নিজে ওখানে গেলে সবাইকে আরো বেশি ব্যস্ত হতে হতো। কিন্তু তাই বলে রাহার বিয়েটা যে রোহানের সাথে হয়ে গেল এটা মেনে উঠতে পারল না যেন সে। স্বচ্ছকে বারবার বলা হয়েছিল যেভাবে হোক বিয়েটা আটকাবে। অথচ স্বচ্ছ করল কি? নেচে নেচে বিয়ে খেয়ে চলে এসেছে। সুহা রেগে দাঁত কিড়মিড় করে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসেই ঘড়িকে চোখ বুলাল। সময়টা তখন রাত তিনটা। এই সময়টাতেই পেটে ক্ষিধেটা মাথাচড়া দিয়ে উঠল যেন৷ সুহা ছোটশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে যাবে ঠিক তখনই সুহাকে চোখ বন্ধ রেখেই খুঁজল স্বচ্ছ। অবশেষে না পেয়ে চোখ মেলে তাকাল৷ সুহাকে ওভাবে উঠে যেতে দেখেই সে হুড়মুড় করে উঠে বসল। জলদি জিজ্ঞেস করল,

“ একি? এই মাঝরাতে উঠে কোথায় চলে যাচ্ছো? ”
সুহা মুখ কালো করে তাকায়। স্বচ্ছ সেদিকে খেয়াল না করে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সুহার মুখ আগলে ধরে বলল,
“বলেছিলাম না ক্ষিধে পেলে আমায় জানাতে? এনে দিব আমি। আগ বাড়িয়ে আলো অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে? ”
সুহা মুখ ভার করে উত্তর দিল,
“ পড়ে গেলে পড়ে যাব৷ সমস্যা কি? ”
স্বচ্ছর মুখ গম্ভীর দেখাল এবারে। স্বর গম্ভীর করে উত্তর দিল,
“ পড়ে গেলে যদি শুধু পড়ে যাওয়াই হতো আমি তোমায় পড়ে যেতে বারণ করতাম না সুহাসিনী। কিন্তু তুমি পড়ে গেলে তোমার এবং আমার আম্মুটার দুইজনেরই বিপদ।এমনিতেই তোমার প্রেগনেন্সির শুরুর থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটাই আমি চিন্তায় চিন্তায় মরে যাওয়ার অবস্থা যখন থেকে ডক্টর বলেছে অনেক কম্প্লিকেটেড ইস্যু আছে তখন থেকেই।এইজন্যই সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে। এবং আমি জানি আমার থেকেও তুমি দ্বিগুণ সতর্কতা অবলম্বন করো যাতে তার কোন ক্ষতি না হয়। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুহা হালকা হাসে। বিনিময়ে বলে,
“যাক। বুঝলেন। এখন যেমন গুরুত্ব দেখাচ্ছেন আমি না থাকলেও কিন্তু ওকে এভাবেই প্রায়োরিটি দিবেন। মনে থাকবে? ”
কথাটা কেন জানি না স্বচ্ছর পছন্দ হয় না। ভ্রু কুঁচকে নেয় সে৷ বলে,
“ মানে? ”
সুহা কথা ঘোরাতে বলে উঠে,
“ কিছুই না, ক্ষিধে পেয়েছে তো। কিছু এনে দিবেন না? ”
স্বচ্ছ আগের মতো গম্ভীর থাকল। কন্ঠ শক্ত রেখে বলল,
“ তুমি না থাকলে মানে সুহাসিনী?তোমাকে থাকতেই হবে। মনে রাখবে। ”
সুহা মৃদু হাসে। কেউ থাকতে চাইলেই যদি তার থাকা হয়ে যেত তাহলে তো আর কোন কথাই ছিল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,

“ এমনিই বললাম। প্রেগনেন্সির শুরুর দিক থেকেই তো কত জটিলতা। ডক্টর বলল না কম্প্লিকেটেড সিচ্যুয়েশন তৈরিও হতে পারে বেবি জম্মানোর সময়। যদি কিছু হয়ে যায় আমার তখন আমার মেয়েকে অবহেলা করবেন না। আর যদি একান্তই অন্য বিয়ে করতে ইচ্ছে হয় তো আমার মেয়েকে রাহা অথবা ছুটির কাছে দিয়ে দিবেন। ওরা দেখভাল করবে ওর। ”
স্বচ্ছর বুকে মোচড় মারে। কথাগুলো যে সে এই কয়েক মাসে একবারও ভাবেনি এমন নয়। অনেকবারই এই কথাটা ভেবেছে সে।প্রত্যেকবারই ভয়ে তার বুকের ভেতর অস্থির লেগেছে।আবার মানিয়েও নিয়েছে কিছু হবে না বলে বলে। অথছ সুহা কত স্বাভাবিক ভাবেই কথা গুলো বলছে। কতোটা স্বাভাবিক! একবার যদি বুঝত তার সামনে দাঁড়ানো পুরুষটির বুকের ভেতর কি তোলপাড়। স্বচ্ছ ছোট শ্বাস ফেলে জানায়,
“ তুমি খুব নিষ্ঠুর সুহাসিনী। এই যেমন স্বাভাবিক ভাবে তুমি কথাগুলো বলে গেলে, অথচ আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে এই কথাগুলোই যথেষ্ট। ”
সুহা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট এলিয়ে বলে,
“ আগে থেকেই জানিয়ে রাখা ভালো নয় বলুন? যদি কিছু হয়ে যায় তখন তো বলতে পারব না। এইজন্য বলে রাখলাম। ”

স্বচ্ছ আরেকটু এগিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সুহাকে। তার বুকের ভেতর যন্ত্রনা হচ্ছে। অদ্ভুত যন্ত্রনা। কি করে বুঝাবে এটা সে? সুহা কি টের পাচ্ছে তার বুকের ভেতরের অস্থিরতা?স্বচ্ছ ঢোক গিলে শুধায়,
“ এতোটা স্বাভাবিক কি করে থাকো সুহাসিনী? যাকে ভালোবাসি তাকে হারানোর ভয় কতোটা থাকে জানো? তোমার কি কখনো কষ্ট হয় না আমি থাকব না ভাবলে? তো আমাকে কেন বারবার মনে করাও কথাটা? কি বুঝাতে চাও? ”
সুহা ম্লান হাসে। স্বচ্ছর কন্ঠ আটকে আসছে বুঝা যায়। হৃদয়ের হৃদকম্পন বলে স্বচ্ছর বুকের ভেতর কি চলছে। প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলে,
“ কিছু না, ক্ষিধে চলে গিয়েছে। ঘুমাব। ”
স্বচ্ছ কন্ঠ আটকে আসে। তখনও সুহাকে জড়িয়ে আসে। সেভাবে থেকেই অপরাধবোধ নিয়ে বলল,
“বিশ্বাস করো? যদি এমন জানতাম আমি কখনোই বাবা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতাম না সুহাসিনী। আমার শুধু তুমি হলেই চলবে।”
সুহা হাসে। স্বচ্ছকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে রেখে বলে,
“ কিন্তু আমার অবশ্যই মা হওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে হতো জনাব। কারণ মা হওয়ার স্বাদ না পেলে আমি বেঁচে থাকলেও শান্তি পেতাম না। ”

স্বচ্ছর কন্ঠ এবার ভেজা অনুভব হয় যেন। সুহা পেটে এক হাত রেখে বলে,
“ আমি জানি আমার ছোট্ট আম্মুটা আমার জীবনের সুখ কাড়বে না। আমি ওকেও চাই, তোমাকেও চাই।তোমাদের যে কাউকে হারালেই আমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে সুহাসিনী। ”
সুহা হাসে। স্বচ্ছর ভেঙ্গে পড়াটা দূর করতে হেসে বলে,
“ নো চিন্তা! আমি আপনার জীবন থেকে অতো সহজে পালাব না অস্বচ্ছ সাহেব। এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছি। আর এখন এত সহজেই আপনাকে না জ্বালিয়ে ছেড়ে যাব? এত সহজ নাকি হুহ? ”
স্বচ্ছ সুহার চোখের দিকে তাকায়। বাচ্চাদের মতো করে বলে,
“ আমায় ছেড়ে যাবে না সুহাসিনী, যাবে না। প্রমিজ করো যাবে না। ”
সুহাও হেসে বলে,
” প্রমিজ। ”

রাহাদের ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম আছেে।মূলত গান নাচ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরই আয়োজন করা হয়েছে।রাহার সেখানে গান গাওয়ার দায়িত্বও আছে সাথে কিছু প্রাসঙ্গিক কাজকর্ম। মূলত এই কারণেই বিয়ের পরদিনই ঘুম থেকে উঠে সাতসকালে গিটার নিয়ে দৌড় মারতে হয়েছে ভার্সিটিতে। অপরদিকে রোহান যখন ঘুম থেকে উঠে তখন আটটা। রাহাকে রুমের কোথাও না দেখে হালকা স্বস্তির শ্বাস ফেললেও পরমুহুর্তেই নিজের মায়ের আগমণে ভ্রু কুঁচকাল সে। শুনতে পেল,
“ নবনী তো সেই সাতসকালে বেরিয়ে গেল রে, একটু গিয়ে পৌঁছেছে কিনা জিজ্ঞেস কর তো। ”
রোহান ভ্রু কুঁচকায়। সকাল সকাল এই মেয়ে আবার কোথায় গিয়েছে? বাবার বাড়ি? রোহান ভ্র কুঁচকেই জিজ্ঞেস করে,
“ কোথায় গিয়েছে? ”
“ ভার্সিটিতে। ”
রোহান কপাল কুঁচকাল। কি এমন পড়ুয়া মেয়ে যে বিয়ের পরদিনই তাকে দৌড় মারতে হলো ভার্সিটিতে? রোহান তপ্তশ্বাস ফেলে। ব্রাশ করর এসে আয়েশ করে বসে রাহাকে কল দেয়। যখন কল তুলল তখনই সে বলে উঠল,
“ নবনী? ভার্সিটিতে গিয়ে পৌঁছেছো? ”

বিষয়টা হয়তো বা শুধুমাক্র ফর্মালিটি করেই জিজ্ঞেস করা। তবে এর পরমুহুর্তের বিষয়টায় রোহানের কোন ফর্মালিটিই আসল না। বরং রাগ হলো। ওপাশ থেকে কোন এক ছেলে উত্তর দিল,
“ নবনী মানে রাহা এই মুহুর্তেই প্র্যাকটিস করছেে।আপনি আরেকটু পর কল দিলে ভালো হয়। ”
রোহানের দাঁত কিড়মিড় করে। নবনীকে কল দিতে এখন কার সিরিয়াল ধরতে হবে? তাছাড়া অন্য ছেলেই বা কল ধরবে কেন? মোবাইল অন্য ছেলের হাতে থাকবে কেন? রোহান জানে দুইজনেই দুইজনের মতো থাকার শর্ত দিয়েছিল। কেউ কারোর জীবনে নাক গলাবে না। তবুও কেন জানি না রোহান ফারাবীর বউ নবনী মাহমুদ রাহা অনেক ছেলের সাথে মেলামেশা করবে এটা সে মানতে পারে না যেন। ধমক দিয় বলল,
“ তো আপনাকে কি নবনী চাকর রেখেছে মোবাইল রাখার জন্য? ”
আকস্মিক ধমকে ওপাশের ব্যাক্তিটি বোধহয় থমকাল। কি বলবে বুঝে না উঠে দ্রুত কল রেখে দিল। আর এই কল রেখে দেওয়াতেই রোহানের রাগটা দ্বিগুন বাড়ল।এতবড় সাহস? কল রেখে দিল মুখের উপর? তাও ঐ মেয়ের সাথে পরিচয় থাকা কোন ছেলে?

ছুটির চোখের নিচে কালি পড়েছে গাঢ় হয়ে। মুখটা আরেকটু রুগ্ন দেখায়। চোখে চশমা ঠেকিয়ে সে জানালার ধারে বসেছিল। নিচে ফিহাকে ছুটে আসতে দেখা গেল এই বিল্ডিংয়ের দিকেই। ছুটি কপাল কুঁচকায়।এভাবে ছুটে আসছে কেন? কি কারণ? ভাবতে ভাবতেই কলেজ থেকে সদ্য বাসায় ফেরা ফিহা এসে মাত্র খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। মনে হচ্ছিল যেন খুশির রেশ এতটাই যে ফিহার শরীর কাঁপছিল। ছুটি বুঝে উঠে না। একইভাবে চেয়ে থাকতেই ফিহা কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতেই ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে,
“ ছুটি আপু? আমার আজ মন ভালো। অনেকটা মন ভালো। আমি কি তোমায় জড়িয়ে ধরে থাকতে পারি কিছুটা সময়?”
ছুটি বুঝে উঠে না। রোবট মানবীর ন্যায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে সে। ফিহা কিছুটা সময় জড়িয়ে রেখেই মাথা তুলে তাকায়। নিজের ফোনটা এগিয়ে ধরে বলে উঠে,

“ আমি কি তোমার সাথে দুটো ছবি তুলকে পারি ছুটি আপু? ”
ছুটি এবারেও উত্তর করে না। ফিহা নিজেই ছবি তুলে। ছুটি কেমন করে যেন ক্যামেরার দিকে চেয়ে থাকে। আজ কত মাস পে ছবি তোলা হচ্ছে তার। নিজের শখ আহ্লাদ সবই বোধহয় বাদ পড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিহা। ছুটিকে বলে,
“ আজ কি কিছু বলবে না আপু? ভাইয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে না? ”
ছুটি খেয়াল করল ফিহা দ্রুত হাতে ছবিগুলো কোথাও সেন্ড করতে করতেই কথাগুলো বলল। ভ্রু কুঁচকায় সে। পরমুহুর্তেই ক্লান্ত স্বরে বলে,

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১

“ একটা মানুষ প্রথম অবহেলা দিয়ে, পরে ভালোবাসা বিষয়টা কাজেকর্মে সবকিছুতে আমায় বুঝিয়ে হুট করেই আমার সাথে আর কথা বলে না, খোঁজ নেই। অথচ তোমাদের সবার সাথেই নাকি কথা হয়। আমার সাথে কথা বললে কি আমি তার ক্ষতি করতাম ফিহা? সে আমায় এতোটা অবহেলার দৃষ্টিতে কেনই বা দেখে বলবে ফিহা? একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়েছি বলে কি? ”

প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৩