প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৩৪
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সেই রাতে রোহান প্রথমেই যে আগ্রাসী আচরণটা রাহার প্রতি দেখাল তাতে রাহার ভয় হলেও পরমুহুর্তেই একটা উষ্ণ চুম্বনে পরিবেশ শান্ত করে দিয়ে রোহান বের হয়ে গেল। রাহা নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকল কেবল রোহানের চলে যাওয়ার পানে। অতঃপর রোহানকে সে রাতে আর দেখাই গেল না। রোহানের উপস্থিতিও পাওয়া গেল না পুরো বাসায়।রাহা বার কয়েক কলও দিল। লাভ হলো না বিশেষ৷ কল তোলা হলো না। রাহা যখন বুঝে উঠল না রোহান কোথায় গেছে তখন না পেরে সকালে রোহানের মাকেই জিজ্ঞেস করল তা।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে উনিও জানেন না! রাহা হতাশ! নিষ্প্রাণ হয়ে অফিসে গেল এই ভেবে যে এইবার অন্তত রেহানকে দেখতে পাবে। অথচ তাও হলো না। সে অফিসেও আসে নি। বিনিময়ে অফিসে দেখা মিলল মিস সাদিয়ার। এতক্ষন নাকি রাহার জন্যই অপেক্ষাতে ছিল। রাহা কিছুটা অবাক হলেও সাদিয়ার সাথে কথা বলল। তারপর একে একে সাদিয়া জানাতে লাগল সে যা বলে এসেছে তা মিথ্যে, রোহান আর তার মাঝে কোন ক্লোজ সম্পর্কই নেই। যা আছে তা শুধু অফিসের লেনদেনের খাতিরে৷ রাহা সবটা শুনল, চুপচাপ সাদিয়াকে দেখে হুট করেই প্রশ্ন ছুড়ল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ উনার শার্টে আপনার লিপস্টিকের দাগ , তা কি মিস সাদিয়া?”
মিস সাদিয়া মুখ টানটান করে তাকাল৷ সে বেধহয় এসব বলতে চাচ্ছে না, তবুও অদৃশ্য কোন চাপে পড়ে এসব যেন তাকে বলতেই হচ্ছে এমনই মনে হলো। বলল,
” আমি শুনেছিলাম ও বিয়ে করেছিল। বাইরে থেকে দেশে আসার পর হঠাৎ এই কথা শুনে কেন জানি না রাগ লাগছিল আমার। আর তাই ইচ্ছেকৃত ভাবে সেদিন ঝুঁকে পড়ে লিপস্টিকের দাগ বসালাম যাতে তার ওয়াইফ দেখে সন্দেহ করে।”
রাহা এবারে হেসে ফেলল। বলল,
“ গুড! কিন্তু অফিস স্টাফরা? ওরা কীভাবে জানল আপনার আর উনাে সম্পর্ক সম্বন্ধে?”
“ আমাদের তো আজকের দুদিনের বিজন্যাস নয় মিসেস রাহা! যখন থেকে আমি বিজন্যাস জয়েন করেছি তখন থেকে রোহানের সাথে আলাপ বলা চলে। এবং এই আসা যাওয়ার খাতিরে বিভিন্ন মিটিং, প্রোগ্রাম এই সেইতে আমিই তার প্রতি অত্যাধিক দুর্বলতা দেখিয়েছি যা স্টাফদের মনে সন্দেহ জাগানোর জন্য এনাফ! দ্বিতীয়ত আমিই একবার সবাইকে বলেছিলাম যে সে আমার উডবি, আমাদের মাঝে সম্পর্ক আছে। ”
রাহা ছোট শ্বাস টেনে উত্তরে বলল,
“ সে জানে না আপনি তাকে পছন্দ করেন? আপনাকে বিয়ে করল না কেন? ”
মিস সাদিয়া এবারে দৃঢ় নজরে তাকাল। বলল,
“ জানে, অলরেডি রিজেক্টও করেছে। তবে বিয়ে কেন করল না এর হিসেব তো ওই জানে। কোনকিছুর তো কমতি ছিল না আমার। অন্তত তোমার থেকে কোনকিছুতে কমতি নেই। ”
রাহা হাসল। বলল,
“ ঠিক বলেছেন। তবে উনি যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন আমি অবশ্যই আপনার হয়ে উনাকে বুঝাব। ”
মিস সাদিয়া ভ্রু বাকাল। বলল,
“দ্বিতীয়বার বিয়ে করার আশংকা আছে বলছো? ”
রাহা মুহুর্তেই জানাল,
“ অবশ্যই আছে!”
এইটুকু বলেই রাহা উঠল। পা চালিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসল। অতঃপর রোহানের পি এ কে জরুরী তলব দিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে শুধাল,
“ আপনার স্যার কোথায়? অফিসে আসবেন না আজ? ”
ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিল দ্রুত,
“ আমার জানামতে আসবেন না ম্যাম।
“ কেন? আজ অফিসে কোন ইম্পোর্টেন্ট মিটিং নেই?”
ভদ্রলোক আবারও উত্তর করল,
“ না, একটা মিটিং আছে যদিও। স্যার বলল, স্যারের হয়ে আপনি জয়েন করবেন তাতে।”
রাহা মুহুর্তেই বিস্ময় নিয়ে তাকাল। বিস্মিত চোখে তাকিয়েই শুধাল,
“ আমি? কিসব কি বলছে! আমি এসব কিছু বুঝি নাকি! ”
লোকটা নিরাশ হয়ে জানাল,
“ স্যার তো তাই বলেছে ম্যাম। ”
রাহা জলদি করেই বলল,
“ কল দিন তো, আমার কল তো তুলে না ঐ লোক! কত বড় ধূর্ত লোক। আমায় এভাবে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে। ”
অতঃপর পিয়াশ নামের লোকটি কল দিল তার স্যারকে। একবার, দুইবার, তিনবার। সে পড়েছে বেকায়দায়। স্বভাবত স্যারকে একবার কল দেওয়ার পর কল না তুললে সে বুঝে নেয় স্যার ব্যস্ত। তারপর আর কল দেয় না। কিন্তু আজ রাহার তাড়ার জন্য দিতেই হচ্ছে। ওপাশ থেকে রোহান কল তুলে শুধাল,
“ কি আশ্চর্য! এতবার কল কেন দিচ্ছো পিয়াশ? সব তো ঠিক আছে তাই না? ”
রাহা মুহুর্তেই ফোন টেনে নিল। বলল,
“ জ্বী না স্যার, ঠিক নেই৷ আমি মিটিং ফিটিং এ গিয়ে বসতেও পারব না। আপনি অফিসে আসবেন এক্ষুনি। ”
রোহান ভাবে নি রাহা যে এপাশে থাকবে। ভরাট স্বরে শুধাল,
“ নবনী? বোনের বাসায় যাওনি?”
রাহা মুহুর্তেই চটফট স্বরে উত্তর করল,
“ যাইনি যে সেটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। নয়তো আপনার পি এ কে বলতেন না আমি মিটিং জয়েন করব। ”
“ আমি তো ভেবেছি তুমি বোনের বাসায় চলে গিয়েছো রাতেই, বোধহয় ওখান থেকেই অফিস জয়েন করবে তাই ভাবলাম।”
রাহচ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে মুহুর্তেই বলল,
“ চলে যাই এটাই তো চাচ্ছেন? ”
রোহান এবারে হাসল একটু রাহার কথা শুনে। তবে হাসিটা রাহাকে বুঝতে দিল না। বলল,
“ থাকতে চাচ্ছো? ”
রাহা নিজের কথা না শুনিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে জানাল,
“ আম্মু আপনার জন্য চিন্তা করছে। বাড়ি ফিরবেন। ”
“ আম্মুর সাথে কথা বলেছি আমি। ”
“ কি বলেছেন? বাড়ি ফিরবেন না? ”
রোহান উত্তর করল,
“ হ্যাঁ!”
“ কয়দিন? ”
“ অনেকদিন! ”
রাহার মুখ চুপসানো দেখাল। হতাশ হয়ে সে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল রোহান কল রেখে দিয়েছে। আশ্চর্য!এভাবে বাড়ি আসবে না মানে কি? তার উপর রাগ দেখিয়ে? তার উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ি ফিরবে না এই লোক?
সিয়ার চোখমুখ ফুলে আছে। সারারাত কান্না করতে করতে মেয়েটার যখন চোখমুখের অবস্থা খারাপ ঠিক তখনই সে মারাত্মক একটা কান্ড করে বসল। ধারালো একটা চুরি নিয়ে হাতে বসাল। অতঃপর একবার দাগ কাঁটল হাতে। মুহুর্তেই ফর্সা হাতটা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল লাল টকটকে তরল রক্ত! সিয়া ফুঁফিয়ে উঠে। কাঁদতর কাঁদতে কাঁটা ব্যাথার যন্ত্রনায় কাঁতরে উঠে। যখন অনেকখাণি রক্ত গড়িয়ে সিয়া প্রায় জ্ঞান হারাতে বসল ঠিক তখনই তার এক বান্ধবী তা খেয়াল করল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটাও কেঁপে উঠল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে বার কয়েক পরখ করে যখন বুঝল সিয়া সত্যি সত্যিই একটা ভয়ানক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই তারা সিয়ার পরিবারকে জানাল। এতরাতে স্বচ্ছ সহ সাদাফ, তার বাবা মা, সুহা ছুটে এল। সিয়াকে খুব তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
অতঃপর সিয়ার হাত যখন ব্যান্ডেজ করে কেবিনে দেওয়া হলো ঠিক তখনই খবরটা পৌঁছাল সাদের কানেও। সাদ ঘটনাটা শোনামাত্রই স্থির হয়ে বসে থাকে কিয়ৎক্ষন! একটা চড়? এই চড়টার জন্য সিয়া তার জীবন দিয়ে দিতে চাইল? একটা চড়ের জন্য? সাদের উচিত হয়নি চড়টা মারা। সেটা সে নিজেও জানে। কিন্তু এতরাতে যুবতী একটা মেয়ে বাইরেও বা কেন যাবে? এতবার বলার পরও শুনল না কেন? সাদ মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম সিয়াকে একদিন ভোর হওয়ার আগের রাতের শহরটা দেখাবে।হয়তো কাল সকালেই দেখা হলে সে স্যরিটা বলে দিত। কিন্তু বলা হলো না, তার আগেই মেয়েটা এমন এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলল। সাদ খবরটা শুনেছে নিলয়ের থেকে। নিলয় যে সাদের থেকেও এই কয়দিনে সিয়ার বেশি আপন হয়ে গেছে এটা ভেবেই সাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোথাও একটা চাপা রাগ হয় নিলয়ের প্রতিও। কেন উড়ে এসে ঝুড়ে বসল? সাদ আজকাল নিলয় ছেলেটাকে সহ্য করতে পারছে না। দেখলেই রাগ রাগ লাগছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। নিলয়কে হন্তদন্ত হয়ে তৈরি হতে দেখে সাদ গম্ভীর স্বরে বলল,
“ নিচে দাঁড়ালাম, তাড়াতাড়ি আয়। ”
নিলয় পোশাক পরে তৈরি হলেও সাদ যেমন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর টিশার্ট পড়া ছিল ওভাবেই নিচে নামল। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে এই মধ্যরাতে একটা রিক্সা পেল। অতঃপর দুইজনেই হসপিটালে পৌঁছাল। সাদের বুক ঢিপঢিপ করছে। মেয়েটার এখন কেমন অবস্থা? ভালো আছে তো? সাদ পা মাড়িয়ে সিয়ার কেবিন অব্দি যেতে যেতেই দেখা পেল সাদাফের। মুহুর্তেই শুধাল,
“ ভাইয়া? আমায় চিনতে পারছেন? সাদ। সিয়ার কি অবস্থা এখন? ”
সাদাফ চিনতে পেরেছে এমন ভাব ধরে দ্রুত বলল,
“ আরেহ তুমি তো সে যে স্বচ্ছর শালিকাকে পছন্দ করতে। অলরেডব আমাদের মা’র খেয়ে ভুত হয়ে গেছিলে দুই দুইবার তাই না? ”
সাদ শান্তভাবে উত্তর করল,
“ হ্যাঁ। সিয়া কেমন আছে জানাবেন একটু? ”
সাদাফ তৎক্ষনাৎ জানাল,
“ রক্ত দিতে হবে, এমনিকে বিপদ নেই বলল ডক্টর। কেবিনেই আছে, তবে জ্ঞান ফেরেনি। ”
“ ওহ! ”
সাদাফ চলে যেতেই নিল। আবার কি বুঝে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি ওর কি হও? ”
সাদ কি উত্তর দিবে বুঝে উঠে না। কি উত্তর দেওয়া উচিত ওর? কি হয়? কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে ও ক্লান্তগলায় শুধাল
“ কিছু নয়, আগে টিউটর ছিলাম তাই৷ ”
” আচ্ছা। ”
সাদ পা বাড়াল। সিয়ার কেবিনের কাছে এসে পা থমকে দাঁড়ায় সে। বুক ভার হয়ে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে দরজার দ্বার থেকেই শুঁয়ে থাকা সিয়াকে পরখ করল সে। হাতে ব্যান্ডেজ করা, চোখ বুঝে রাখা! সাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৩৩
“ সিয়া? তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে সিয়া! সম্ভবত তোমার জন্য আজকাল আমার মনে কিছু একটা তৈরি হয়েছে। আমি বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক। তবে এটুকু বুঝতে পারি তোমাকে অন্য কারোর সাথে মানতে আমার যন্ত্রনা হচ্ছে। রাহার বেলাতে যেভাবে আমি মেনে নিয়েছিলাম তোমার বেলাতে আমি সেটা মানতে পারছি না। অদৃশ্য এক রাগ হচ্ছে । অধিকারবোধ থেকে চিড়চিড় এক জেদ জম্মাচ্ছেে।আমার এখনও রাগ লাগছে সিয়া! নিজের জীবনটাকে এতোটা ঠুনকো ভাবলে কেন? আমি কে? আমার চড়ে তুমি জীবন দিয়ে দিবে? তুমি তো এখন আমায় চাও না সিয়া, মুভ অন করছো। তবুও এই হঠকারিতা কেন সিয়া? ”