প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪০
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
“ আপনার বোন একটু আগেই মা’রা গেছে। ডক্টর চ্যাক করে জানালেন পালস নেই। আপনারা প্লিজ তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসুন। ”
স্বচ্ছরা তখনও গাড়িতে। যখন কল করার পর ঐ ব্যাক্তি জানাল মহিলাটি স্বচ্ছর কি হয় তখনই স্বচ্ছ জানিয়েছিল সে তার বোন হয়। এবং লোকটাকে বারবার করে বলেছিল হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অপেক্ষা না করার জন্য। দয়া করে হসপিটালে নিতে।ওখানকার কিছু লোক মিলে তা করলও। নিয়েও গেল হসপিটালে। অথচ হসপিটালে নেওয়ার মিনিট পাঁচ পর কল করে উপরোক্ত কথাটা বলা মাত্রই স্বচ্ছর পাগল পাগল লাগল। অস্থির লাগল। কি উত্তর দিবে তা বুঝে না উঠেই সে একবার পেছনের সিটে বসে থাকা সুহা আর মায়ের দিকে তাকাল।পাশের সিটে বসে থাকা সাদও উদ্গ্রীব হয়ে চেয়ে আছে ফোনের দিকে।হসপিটাল অব্দি এইটুকু পথ যেন আজ শেষই হচ্ছে না। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে আর অপেক্ষা করতে না পেরে এবারে বলেই ফেলল সে,
“ কি হলো ভাইয়া? সিয়া ঠিক আছে তো?ঠিক আছে ও?”
স্বচ্ছ উত্তর করতে পারে না। বুকের ভেতর কেমন ভার হয়ে আসে তার। সে ছোট থেকে নিজের ছোটবোনকে এত এত আদর দিয়ে যেখানে বড় করেছে সে বোনটাকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে নিয়ে নিতে পারল? সৃষ্টিকর্তা এই কাজটা কি করে করতে পারল? যে মেয়েটা শুধু কষ্ট পেল এতগুলো বছর। পরিবারের আদুরে মেয়েটি ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পেল না। অবশেষে এতগুলো বছর পর যখন নিজের বোনের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের বোনের হাতে তুলে দিবে ঠিক তখনই সৃষ্টিকর্তা নিজের পাষান রূপটা দেখাল? স্বচ্ছ চোখজোড়া লালাভ হয়ে উঠে। গাড়ি চালাতে নিয়ে আচমকাই একটা এক্সিডেন্ট ঘটাতে নিল। আর একটুর জন্যই রক্ষা পেল যেন। সাদ এবারে অস্থির হয়েই শুধাল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ স্বচ্ছ ভাই? একবার বলুন না, কি বলল ঐ লোক? সিয়া ঠিক আছে না? বলুন না ভাই…”
এইটুকু বলতে বলতে সে নিজেই স্বচ্ছর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল। কল লিস্টে গিয়ে আবারও কল দিল। মুহুর্তেই ওপাশ থেকে লোকটা কল তুলল। জানাল,
“ আপনারা চলে এসেছেন? উনার ডেডবডি…. ”
বাক্যের বাকি অংশটুকু সাদ শুনতেই পেল না যেন। ডেডবডি? সাদের গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস আটকে আসে। বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে শুধায়,
“ ডেডবডি? কিসব বলছেন? সিয়া ঠিক আছে না? ”
মুহুর্তেই লোকটা সাদকে আবারও নিরাশ করে দিয়ে জানাল,
“ ভাই আপনাকে তো জানালামই, আপনার বোনের পালস পায়নি ডক্টর। উনারা জানিয়েছেন আপনার বোন মা’রা গেছে। ”
সাদ এই পর্যায়ে আর উত্তর দিল না। পেছন থেকে সিয়ার মা ততক্ষনে কান্না জুড়েছে আওয়াজ তুলে। সুহার চোখেও কান্না তবে শ্বাশুড়িকে সামলাতে ব্যস্ত সে। অথচ এত কোলাহলের মধ্যেও সাদ নিশ্চুপে জমে থাকা কোন পাথরের ন্যায় বসে থাকল। প্রথম দফায় এই সত্যটাকে বিশ্বাস করতে মন না চাইলেও পরের দফায় তার সত্যিই নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষটি মনে হলো। চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠল। গলা যেন অবরুদ্ধ। সাদ চোখ বুঝল। ভেসে উঠল সিয়ার সেদিনকার মুখটা। শাড়ি পরিহিতা সিয়া! সে স্নিগ্ধ মুখ চাহনি। সাদের কান্না আসল হঠাৎ। পুরুষ মানুষ হয়েও তার ইচ্ছে করল আহাজারি করে কান্না করতে।
সিয়াকে পাওয়ার জন্য লোভ করা কি তার অন্যায় হয়েছে? আজীবন তো সে দূরে সরেই ছিল। সিয়াকে প্রশ্রয় পর্যন্ত দিল না। সিয়ার মতো মূল্যবান রত্নকে নিজের সাধারণ জীবনে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে সে কাপুরুষের মতো পালিয়েও গেল। অবশেষে যখন বুঝতে পারল সিয়াকে আগলে রাখার সামর্থ্য তার হয়েছে, সিয়ার মতে মূল্যবান রত্নটিকে তার জীবনে সে রাখতে পারবে তখনই তো সে এই রত্নটির দিকে হাত বাড়াল। বড্ড পাপ হয়ে গেল তা? সৃষ্টিকর্তা কেন চাইল না এই রত্নটা তার হোক? কেন কেড়ে নিল? সাদ কি আজীবন এই তীব্র যন্ত্রনা বইতে পারবে? একটিবার নিজের মনের ব্যাকুলতা জানাতে না পারার দুঃখ কি সে সারাজীবন বয়ে যেতে পারবে? সিয়া কেন চলে গেল এভাবে? একটিবার কি তাকে সুযোগ দিতে পারত না?
একটিবার? একটিবার তে সাদ সিয়াকে জানাতে পারত নিজের হৃদয়ের কথা। জানাতে পারত, সাদ কখনো তাকে অবহেলা করেনি। গোপনে হৃদয়ে খুব যত্নেই আগলে রেখেছিল এই মেয়েটিকে। সাদের চোখ জুড়ে সত্যিই পানি নামল। লাল রক্তাভ চোখজোড়া যখন মেলল তখনই তা গড়িয়ে পড়ল গালে। ইশশ! সাদ যদি একটিবার জানত সেদিনকার দেখাটাই সিয়ার সাথে শেষ দেখা তবে সে সত্যিই সিয়াকে মনের কথাটা বলত। বেহায়ার মতোই বলত। একটিবার সুযোগ চাইক এই স্নিগ্ধ রমণীকে আলিঙ্গনের। এই সমস্ত জীবনে সে এই তীব্র না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে কি করে বাঁচবে? তাও তো ভালো, সে দূরত্ব বেঁছে নিয়ে এই যন্ত্রনা থেকে পালিয়ে বাঁচছিল৷ কিন্তু এখন? যাকে পাওয়ার আশা পেয়েও পেল না, এই দুঃখ কি সে ভুলতে পারবো? এই আপসোস কি তার জীবনে শেষ মুহুর্ত অব্দি থাকবে না?
আবির একটা দরকারেই এসেছিল সোনার দোকানে।এক পরিচিতে বিয়েতে গিফ্ট কেনার জন্য। অতঃপর গিফ্ট কিনতে কিনতে চোখে পড়ল একদম ছোট্ট একজোড়া চুড়ি। আবির হাতে নিল। একটা ছোট্ট চুড়ি। একদম নবজাতক বাচ্চার হাতের সাইজমতোই। আবির তা দেখল। কল্পনা করল তা আদুরে ছোট্ট মেয়েটার হাতে আদুরে এই চুড়ি। মিষ্টি ছোট্টো ছোট্ট আঙ্গুল গুলো নাড়াচ্ছে সে। আবিরের মুখে স্পষ্টই ফুটে উঠল এক অজানা খুশি। মুহুর্তেই হেসে জানাল,
“ ভাই এটাও কিনব। দিয়ে দিন। ”
অতঃপর তা নিয়েই বাসায় আসল সে। ছুটিকে দেখা গেল বিছানায় শুঁয়ে ঘুমোচ্ছে। রাতভর এ পাশ ওপাশ হতেই যে মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যায়, পায়চারি করে তার আজকাল সন্ধ্যের পরপরই ঘুমানোর অভ্যেস হয়েছে। আবিরের অন্যদিন ঘুম ভাঙ্গানোর ইচ্ছে না হলেও আজ সে এগিয়ে গেল। তখনও ফ্রেশ হয়নি। কেমন এক খুশি খুশি অনুভূতি নিয়ে সে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল। ছুটির ঘুমন্ত মুখটা মুগ্ধ করা দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে পরপরই মেয়েটার আলুথালু গালগুলোতে চুমু দিল। একটা, দুটো,পরপর কয়েকটা চুমু এঁকেই সে বিড়বিড় করল,
“ আমি সম্ভবত এত খুশিতে পাগল হয়ে যাব ছুটি। আমার কাছে তুই নামক আস্ত একটা সুখ আছে, আমার পিচ্চিটাকে দিয়ে আরেকটা সুখের রাজ্যে ভাসিয়ে দিয়েছিস বোকাপাখি। এত খুশি আমি কোথায় রাখব বল? আজকাল যখনই আমি তোদরর কথা ভাবছি তখনই আমি আনন্দে হারিয়ে যাচ্ছি। আমার এত সুখ সুখ লাগে তোদের মা মেয়ের কথা ভাবতে! আচ্ছা? ও কবে আসবে? আর অল্প কয়টা দিন? আমি বোধহয় ওর জম্মালে খুশিতে পাগল হয়ে যাব রে ছুটি! ”
এটুকু বলেই আবির এবারে ছুটির পেটের দিকটায় গিয়ে বসল। ঘুমন্ত ছুটির মুখের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ গুঁজল ওর ফুলো পেটে।পেটের উপর থেকে কামিজের অংশটা তুলে বার কয়েক চুমু আঁকল। মুহুর্তেই তার আম্মুটা ভেতর থেকে সাড়া দিল। নড়চড় দিয়ে বুঝাল বোধহয় সে আব্বুর উপস্থিতি টের পেয়েছে। আবির বরাবরের মতোই ড্যাবড্যাব করে মেয়ের নড়চড় দেখে। উপলব্ধি করে। পেটের যে অংশে যে অংশে মেয়ের নড়চড়ে ফুলে উঠল সেসব অংশে আদুরে স্পর্শ দিয়ে চুমু আঁকল। অতঃপর আদর দিয়ে বলল,
“ আব্বু তোমার জন্য চুড়ি এনেছে আম্মু। তাড়াতাড়ি চলে আসে আব্বুর কোলে,আর কত অপেক্ষা করাবে বলো? আব্বু তোমায় আদর করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আম্মু। ”
ছুটি যে এই পুরুষটার পাগলামো টের পায়নি এমন নয়। প্র্যেগনেন্সির পর থেকে সামান্য পর্দা নড়লে পর্যন্ত ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। ছুটি এতক্ষন নিরবেই অনুভব করছিল এই পুরুষটার পাগলামো। অতঃপর আবিরের চুড়ি আনার কথা শুনে শুধাল,
“ আপনাকে না অনেকবার বলেছি যে ও জম্মানোর আগে কিছু কিনবেন না?তবুও কিনেছেন? কেন কিনেছেন? নিষেত করেছিলাম না? ”
আবির তাকাল। ফের আরেকবার পেটে চুমু দিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
“ আমার মেয়ে, আমি কিনব। তোর কি?হিংসে হচ্ছে তোর জন্য কিনিনি বলে? ”
ছুটির দৃষ্টি দেখার মতো। তার হিংসে হবে? মেয়ের প্রতি? মোটেই না!
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৩৯
সিয়া বাসায় ফিরল একটু আগেই। আসার পরই দেখল বাসায় তালা ঝুলছে। সিয়া কপাল কুঁচকাল। বাসার লোককে কল দেওয়ার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন নিবে ঐ মুহুর্তেই টের পেল তার ব্যাগে ফোন নেই। আশ্চর্য! সিয়া ব্যাগটা ভালোভাবেই খঁজে দেখল। সবটাই! অথচ ফোন নেই। সিয়ার কপাল কুঁচকে এল ফের। ফোন কোথায় গেল?