প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪২
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আবির সেইসময়েই হুলস্থুল বাঁধিয়ে ছুটির কাছে গেল৷ অতঃপর ছুটিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেমন করে তাকায় যেন সে। বুকের ভেতর কি যেন বিশাল কিছু ছুটির মুখটা দেখামাত্রই সরে গেল। আবির দ্রুত নিজের প্রিয় নারীটির মুখ আগলে ধরে। চোখমুখ ভিজে আছে মেয়েটার। ঘাম কিংবা কান্নায় ভেজা দেখাচ্ছে মুখ,গলা, নাকের অগ্রভাগ।বড্ড ক্লান্তি যেন ভেসে উঠছে মুখটায়। তবুও কোথাও একটা প্রাপ্তির সুখ!আবির অপেক্ষা করে না। উপস্থিত ডক্টর আর নার্সের সামনেই মাথা নিচু করে দ্রুত চুমু আঁকল ছুটির গালে, কপালে,নাকে।বড্ড অস্থিরতা নিয়ে নিজের প্রিয় নারীর মুখ আগলে ধরে শুধাল,
“ তুই ঠিক আছিস না ছুটি? তোকে কতোটা কষ্ট পেতে হয়েছে। আমি আর কখনোই বেবি নিব না ছুটি। ”
উপস্থিত এতগুলো মানুষের সামনে আবির যে এমন একটা কান্ড করে বসবে ছুটি টেরই পায়নি। আড়ষ্ট হয়ে সে দুয়েকবার ডক্টর আর নার্সদের দিকে তাকাল। সবাই কেমন করে তাকিয়ে যেন হাসছে। ছুটি দৃষ্টি সরাল দ্রুতই৷ আবিরের দিকে চেয়ে বলল,
“ কোলে নিয়েছেন ওকে? সুস্থ তো ও পুরোপুরি? ”
আবির এবার থতমত খেয়ে গেল। মেয়েকে তো কোলেই তোলে নি সে। ভালো করে দেখেওনি মেয়েটাকে। কি বলবে? ছুটি নিশ্চয় কষ্ট পাবে কোলে নেয়নি শুনলে? আবির যখন এসব ভাবতে লাগল ঠিক তখনই উপস্থিত ডক্টরটি কিছুটা হাসলেন। এগিয়ে এসে আবিরকে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আপনার স্ত্রী ঠিক আছে মিঃ আবির। আপনি এবার দয়া করে বাইরে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিন৷ আমাদেরকে আমাদের কাজটা করতে দিন। উনাকে কিছুক্ষন পরই কেবিনে দেওয়া হবে। হু?”
আবির বুঝে উঠল। ছুটির দিকে তাকিয়ে আবারও তার কেমন প্রশান্তি কাজ করল। ডক্টরকে শুধাল,
“ স্যরি, স্যরি ম্যাম।যাচ্ছি আমি। আমার ওয়াইফ সুস্থ আছে না? হু?”
ডক্টর সাহেবা হেসেই শুধালেন,
“ একদম সুস্থ। এবার যান।”
আবির তবুও যাচ্ছে যাচ্ছে বলে যায় না। আরও একবার ঝুঁকে গিয়ে ছুটির কপালে ভালোবাসার পরশ দিল। ফিসফিস স্বরে বলল,
” বোকাপাখি? ভালোবাসি। ”
এটুকু বলেই পরমুহুর্তে সে পা বাড়াল যাওয়ার পথে। ছুটি নিজের এত কষ্টের মাঝেও এবার হাসল কিছুটা। ডক্টর তখন ছুটির হাসিটা খেয়াল করে দ্বিগুণ হেসে বললেন,
“আপনারা দুইজনই পাগল। একজন হাজব্যান্ড আসা ছাড়া ও.টি রুমে আসতে চাইলেন না, আরেকজন বউ এর চিন্তায় অস্থির হয়ে নিয়ম ভেঙ্গে ও.টি.রুমে চলে এসেছে।”
ছুটি শুনতে পেয়েছে আবিরকে যখন বাচ্চা কোলে নেওয়ার জন্য বলা হলো আবির নাকি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে কোলে তুলেনি। বরং বউ এর খবর জিজ্ঞেস করেছে। এইটুকু খবর পেয়ে অন্য বউরা কেমন খুশি হয় তা ছুটির জানা নেই, তবে ছুটি মা হিসেবে খুশি হতে পারল না। তার এইটুকু বাচ্চাটা! সবেমাত্র দুনিয়ায় এল। কি ভীষণ মিষ্টি! ওকে কোলে তুলল কেন ওর বাবা? এটুকু দুঃখে ছুটি তখন থেকে দুঃখ করছে। যদিও এর পরের সময়টা তার ছোট্ট বাচ্চাটা তার বাবার কোলেই আছে। এমনকি, এখনও। ছুটি ফোঁসফোঁস করছে। আবিরের মাকে দেখতে পেয়ে মুহুর্তেই শুধাল,
“ মেয়ে জম্মালে নাকি খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন উনি। অথচ মেয়েকে কোলে পর্যন্ত নেননি প্রথমে আপনি? নিষ্ঠুর! আমার মেয়ে, আমার কোলে দেওয়া হোক। ভুলেও উনার কোলে দিবে না আর মামনি। ”
আবিরের মা হাসল। ছুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ এমন করছিস কেন? আমার ছেলেটা তোর চিন্তায় অস্থির ছিল।”
ছুটি নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ তো? তাই বলে আমার মেয়েটা ফেলনা নাকি? জন্মের পর মায়ের কোলে না থাকুক, বাবার কোলে থাকার তো অধিকার ওর ছিল। অথচ উনি, উনি কতোটা খারাপ। আমি বলেছিলামও উনাকে যাতে আমার মেয়েকে কষ্ট না দেয়। ”
আবির ছোট ছোট চোখে চেয়ে ছিল। এতক্ষন মেয়েকে সযত্নে কোলে নিয়ে মেয়ের মুখের দিকে চেয়েছিল সে৷ হুবুহু ছটির মুখের আদর।চোখ মুখ, এমনকি ঠোঁটটাও কি মিষ্টি!আবির ছুটির কথা শুনে শুধু হাসল। মেয়েকে প্রথম দফায় কোলে না নেওয়ার অপরাধে তখনই ছুটির থেকে ফিরে মেয়েকে কোলে নিয়ে স্যরি বলেছে সে। তবুও মেয়ের মা যে কিভাবে খবর পেল। আবির শান্ত চাহনিতে চেয়ে শুধু তার মাকে বলল,
“ আম্মু? ওকে বলো। এটা আমারও মেয়ে। ও কেবল ওর মেয়ে ওর মেয়ে করছে।”
আবিরের মা হাসল কেবল। যেতে যেতে বলে গেল,
“ তোরা পারিসও বটে! মেয়ের বাপ মা হয়েছিস। এবার তো বুঝতে শিখ। ”
ছুটি অবশ্য বুঝল না। ঠোঁট উল্টে শুধাল,
“ আপনি কি করে পারলেন ওকে উপেক্ষা করতে? ”
আবির হতাশ শ্বাস টানে। ছুটির পাশে তার এইটুকু বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে শুধাল,
“ দোষ টা তোর। ফোনকলে শেষবার আমায় কি কি বললি? কিছু হয়ে গেলে মানে? ওটুকু কথাই কি যথেষ্ট নয় আমার তখনকার বাবার হওয়ার সুখ উপলব্ধি না করার জন্য? তুই ঠিক আছিস কিনা ঐটুকু না জেনে আমি ওকে কোলে নিয়ে সুখ সুখ উপলব্ধি করতে পারতাম না তো। আর ওর ও তো মন খারাপ হতো বাবার কোলে এসে বাবার মন ভালো হয়নি দেখলে তাই না?”
ছুটি শুধাল,
“ উচিত করেননি। ”
আবির হাসল। বলল,
“ ঠিক আছে!অনুচিত কার্য করার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনার এবং আমার ছোট্ট মায়ের কাছে। দুইজনের কাছেই! ”
ছুটি অন্যদিকে ফিরে জানাল,
“ দিলাম না ক্ষমা। ”
আবির হাসে কেবল। ফের বলল,
“ আমার মেয়ে দিলেই হবে। তোরটা আমি আদায় করে নিব নাহয়। ”
ছুটি কেমন করর যেন চাইল এবারে।
“ ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”
ছুটির হুট করেই যেন কান্না পেল। কেন সে নিজেও জানে না। মন খারাপ হয়। নিজের মেয়ের দিকে আরেকবার তাকিয়ে সে উত্তর করল,
“ জানি না। ”
আবির ছোটশ্বাস ফেলে। জানাল,
“ মন খারাপ? ”
ছুটির উত্তর আসে না। আবির ফের বলল,
“ আমি কিন্তু সত্যিই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো খুশি হয়েছি। কিন্তু অজ্ঞান হচ্ছি না। বুকে হাত রাখ, দেখ কেমন টিপটিপ করছে এখনো। ”
কথাটা বলেই ছুটির একটা হাত টেনে রাখল বুকের বা পাশে। ছুটি তাকাল কেমন করে যেন। আবির হাসে। মেয়েকে একটা চুমু দিয়ে পরমুহুর্তে মেয়ের মাকেও চুমু দিল। বলল,
“ আমার না এখন সত্যিই খুশিতে অজ্ঞান হওয়ার মতোই ফিল হচ্ছে। আমার লক্ষী মেয়েটা একদম তোর মতো হোক বোকাপাখি। আমার আরেকটা ছোট্ট ছুটি! ”
সিয়ার সেদিনটা ব্যস্ততাতেই কাঁটল। ঐ টিচারটার হাজব্যান্ডকে জানানো, এরপর ওখানে থাকা৷ অনেকটা সময়ই!টিচারটার সাত বছরের মেয়েটাকে ভুলিয়ে রাখা সহ বহু ব্যস্ততা! অতঃপর যখন প্রায় সন্ধ্যার পরপর সময়টাতে সে বাড়ি ফেরার জন্য রিক্সার জন্য অপেক্ষা করল ঠিক তখনই আবারও দেখা মিলল সাদের সাথে। সাদ বোধহয় এখানেই ছিল, অপেক্ষা করছিল। সিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বারবার দেখা হচ্ছে কেন এই লোকের সাথে? সাদ এগিয়ে এসেই শুধাল,
“ সিয়া? ”
সিয়া তাকায়। উত্তর করে,
“ হু? ”
“ কোন একদিন তোমায় কথা দিয়েছিলাম রাতের শহর দেখাব। দুর্ভাগ্যবশত সে কথাটা রাখার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলাম একপ্রকার। আজ কি এই সন্ধ্যের আকাশটাই ভাগ করবে আমার পাশে হেঁটে?”
সিয়া প্রথমে কি বলবে বুঝে উঠল না। অতোগুলো বছর পর এই কথাটা মনে রেখেছে? আশ্চর্য! কেন? সিয়া ভেবে উত্তর করল,
” করাই যায়, যদি না আপনার স্ত্রী রাগ করে। তবে রাগ করার সম্ভাবনাই বেশি। যেঁচে কারোর সংসার ভাঙ্গতে চাই না। ”
সাদ হাসল। বলল,
“ সংসারই নেই যেখানে, ভাঙ্গবে কি করে? ”
“ মানে? ”
“ কিছুই নয়। আমি জানি তুমি ক্লান্ত, তবুও আজ হেঁটেই বাসায় ফিরবে প্লিজ? ”
সিয়া এবারে সম্মত হলো। বলল,
“ দশ মিনিটেরই তো ব্যাপার। পারব। চলুন। ”
সাদ হাসে। পথ চলতে চলতে ভাবল কিভাবে কি বলা উচিত। অথচ সাদ কিছুতেই কিছু গুঁছিয়ে উঠতে পারছে না। তারপর হঠাৎই শুধাল,
“ সিয়া? আমার প্রতি আজও অনুভূতি কিছু রেখেছো কি? আজও কি আমায় ভালোবা…”
সিয়া শব্দটা পুরোপুরি বলতে দিল না। মুহুর্তেই বলল,
“ পাগল নাকি! অন্যের বরকে ভালোবাসব এখনো? ছিঃ! দেখুন আর যায় করি না কেন, অন্যের বর,অন্যের বয়ফ্রেন্ড এসব নিয়ে টানাহেঁছড়া করার মতো মন মানসিকতা আমার নেই সাদ ভাই। আমার ব্যাক্তিত্বটা এতেটা লেইম না। ভালোবাসায় শত বেহায়াপনা একসময় করলেও এতোটা বেহায়া আমি নই যে অন্যের বরের প্রতিও দুর্বলতা রাখব।”
সাদ চোখ মিনমিন করে তাকায়। বলে,
“ আমি বোধহয় তোমার প্রতি দুর্বলতা রেখেছি। এরজন্য কি করণীয়? ”
সিয়া মুহুর্তেই নাক মুখ কুঁচকাল।বলল,
“ ছিঃ! বিবাহিত আপনি সাদ ভাই। নিজ স্ত্রী ব্যাতীত অন্য একটা মেয়েকে এমন কথা বলা শোভনীয় নয়। ”
সাদ সে ছিঃ এর ধার ধারল না। হঠাৎ বলল,
“ আমার সে স্ত্রীটা তুমি হবে সিয়া? ”
সিয়া আকস্মিক কথাটায় কেমন করে তাকায়। বলে,
“ হু? ”
সাদ হেসে মাথা চুলকে বলল,
“ বারবার বিবাহিত বলছো। অথচ আমি আজ পর্যন্ত সচক্ষে নিজের বউ এর দেখা পাইনি। তুমি যদি সে বউ হয়ে আমার লাইফে আসো তাহলে নাহয় স্বীকার করে নিলাম এবারে যে আমি বিবাহিত! ”
সিয়া বুঝে উঠে না যেন। বলে,
“ মানে? আপনি বিবাহিত নন? ”
সাদ জানাল,
“ এখনও তো নই। ”
“ কেন? ”
এই পর্যায়ে সাদ সিয়ার চোখের দিকে তাকিয়েই হাসল। বলল,
“ যে কারণে তুমিও অবিবাহিত। ”
সিয়া ভাবে কেমন। সেদিন রিক্সায় তাহলে? বলল,
“ আপনার সাথে একজনকে দেখেছিলাম আমি। ”
সাদ এই প্রশ্নটারই অপেক্ষায় ছিল যেন। মুহুর্তেই উত্তর করল,
“ বোন হয়। ”
“ ওহ। ”
এরপর কথা হলে না। নিরবেই হাঁটল দুইজনে। অতঃপর যখন সিয়া বাসা অব্দি পৌঁছাল সাদ বলল,
“ মতামত জানিও। ”
“ কিসের? ”
সাদ বড্ড মিষ্টি হেসে বলল,
“ অবিবাহিত থেকে বিবাহিত হওয়ার পথে সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাবের। ”
সিয়ার কপাল কুঁচকানো। লোকটা কি আজ এতবছর পর পাগল হয়েছে? নাকি আন্দাজে বকছে? বলল,
“ আমি জানি না আপনি মজা করছেন কিনা।”
সাদকে হঠাৎ গম্ভীর দেখাল।জানাল,
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ৪১
“ তোমার সাথে কখনো তেমন মজা আমার হয়নি সিয়া। ”
“ হু। ”
সাদ নিজের গম্ভীরতা বজায় রেখেই আবার বলল,
“ তবে ভবিষ্যৎ এ হলে হতে পারে। ”
সিয়া কেমন করে যেন তাকায়। বুঝার চেষ্টক করে। পরমুহুর্তেই বলে,
“ আমাকে যেতে হবে সাদ ভাই। ”
সাদও দ্রুত বলল,
“ ওকে, অপেক্ষায় থাকলাম মিস সিয়া। ”