প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৩+৪৪

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৩+৪৪
Nabila Ishq

শাবিহার কান্নাকাটি থেমেছে রাত দুটো পঁয়তল্লিশে। এতক্ষণ ধরে সে টানা কেঁদেছে। থেমে থেমে ভাঙা গলায় কেঁদেছে। চোখ মুখ নাক সব লাল করে ফেলেছে। টিস্যু তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে আছে। এক গ্লাস পানি অবদি গলায় দেয়নি। এবার উঠে এক গ্লাস পানি খেল। খেয়ে পুনরায় ফ্লোরে বসে পড়ল। অনেক্ক্ষণ ত কেঁদেছে। কেঁদেকেটে হয়রান হয়ে পড়েছে গলা এবং চোখজোড়া। এখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছে যেমন। শত চেষ্টার পরও জল আসছে না চোখ দিয়ে। এরপর থেকে কি হবে? শাবিহার শ্বাস আটকে আসে ভাবতেই। সবাই ত সব জেনে গেল। শাবিহাকে নিশ্চয়ই খারাপ ভাববে? বাজে কথা বলবে। কেউই মেনে নিবেনা তাদের। কেউ না! অয়ন ও দূর হয়ে যাবে। শাবিহার চোখজোড়া ভরে উঠলো পুনরায়। চোখের পাতায় ভেসে এলো, অয়নের মায়াবী মুখমণ্ডল। তার হাসি, রাগ এমনকি মন খারাপের নানান দৃশ্য। নাক টেনে বিছানা হাতড়ে সেলফোন হাতে নিল। অয়নের কোনো কল আসেনি। এতবড় তান্ডব করে, মাফ পর্যন্ত চাইলো না! তার সম্পুর্ন পৃথিবী উজাড় করে দিয়ে, কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই ছেলেটার! কোনো চিন্তাভাবনা নেই!

বৃষ্টি থেমেছে। আঁধারের আকাশ এখন ঝকঝকে পরিষ্কার। চাঁদের দেখা মিলেছে। মেঘেদের এড়িয়ে জ্বলজ্বল করছে। চাঁদটা ঠিক অয়নের মাথার উপরে যেন। তার আঙুলের ফাঁকে জলন্ত একটা সিগারেট। সিগারেট খানা হুটহাট ঠোঁটে ছুঁয়ে চলেছে সে। তার মুখের সামনে ধোঁয়ার মেলা। পরনের টি-শার্ট এবং প্যান্ট এখনো ভেজা। চুলগুলো লেপ্টে কপালে পড়ে আছে। প্রচন্ড বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে ফুঁক বসাচ্ছে! উশখুশ করে কয়েকবার দেয়ালে লাথি বসিয়েছে। অস্পষ্ট স্বরে গালিগালাজ করছে। ঠিক কাকে করছে অজানা! চোয়াল শক্ত করে সেলফোন ছুঁড়ে মেরেছে ঘন্টাখানেক আগে৷ সেই ভাঙা ফোন গিয়ে উঠাল। ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। কাজ করছে না। টাচস্ক্রীন চুড়চুড় হয়ে আছে। রেগেমেগে আরেকটি আছাড় বসালো। শব্দ হলো বিকট। তপ্ত শ্বাস ফেললো। চুলগুলো কপাল থেকে উঠালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লাফিয়ে শাবিহাদের ছাঁদে এলো। ছাঁদের দরজা বন্ধ। নাহলে আজ অয়ন সোজা শাবিহার রুমে ঢুকে যেতো। অস্থির পায়ে ফিরে যেতে নিচ্ছিলো, তখনই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পরপর দরজা খোলার শব্দ। অয়ন ঘুরে তাকাল। শাবিহা এসেছে। এখনো শাড়ি পরে আছে। সাজগোছ কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে কপালের টিপ এখনো একই যায়গায়। চকচক করছে ফর্সা কপালে। চোখজোড়া ফোলা ফোলা এবং লালচে। কান্নাকাটি করে ভাসিয়েছে যেমন। অয়নকে দেখতেই রেগে তাকাল। হুড়মুড়িয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। অয়ন দ্রুততম গতিতে ছুটে গেল। চেপে ধরলো শাবিহার হাত। টেনে আনল ছাঁদে। দরজা খানা শব্দ করে লাগালো।

দরজার সঙ্গে শাবিহার পিঠ ঠেকিয়ে তাকে আটকে রাখল। শাবিহা হাসফাস করছে। নাক ফুসছে তার। প্রচন্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। আজ যা হয়েছে সব অয়নের জন্য। সব দোষ অয়নের। শাবিহা মুচড়ে উঠলো। দু’হাতের সাহায্যে অয়নকে ঠেলতে চাইল। অয়ন সরল না। ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। শক্তপোক্ত গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখনই শাবিহাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে যেমন। শাবিহাও সমানতালে রাগী চোখে তাকিয়ে। অয়ন আচমকাই শাবিহার চোখে ঢেকে ফেললো। মাথা নিয়ে গেল শাবিহার ঘাড়ে। সেখানে তপ্ত শ্বাস ফেলছে। গরম তার একেকটি নেওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস। খুব গভীর স্বরে বলল, ‘এভাবে তাকাবে না। বুকে লাগে। আমার রাগ উবে যায়৷’

শাবিহা অয়নের হাত সরাতে চাইল। পারলো না। বিরক্ত সুরে বলল, ‘দেখি সরো।’
‘পর পুরুষের সামনে এমন সাজগোছ করে যাবার মানে কী! কই আমার সামনে তো কখনো এভাবে আসলে না।’
‘আসিনি আর আসবোও না। আজই আমাদের শেষ দেখা। তুমি আমার সাথে আর কোনো কানেকশন রাখার চেষ্টা করবে না। ছাড়ো নাহলে আমি চেঁচাব।’
অয়ন আকাশ থেকে পড়লো। শাবিহার চোখের সামনে থেকে হাত সরালো। শাবিহার দৃঢ় নজরে নিজের ক্ষিপ্ত নজর রাখল, ‘কি বললে? আবার বলোতো।’

‘বারবার বলতে পারবো না। সরে দাঁড়াও।’
‘মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি! আমি আইসক্রিমের সস্তা বাটি নই, যে খেয়েদেয়ে ফেলে দিবে।’
‘ফেলে দিলাম।’
‘ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।’
‘দেখি সরো।’
‘আরেকবার টেস্ট করে দেখ, মতামত চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।’
‘কি! অয়ন!’
‘এতো জোরসে চেঁচায় না। আশেপাশের মানুষ উঠে চলে আসবে।’

শাবিহা দিশেহারা হয়ে অয়নের হাতে কামড় বসালো। শক্ত কামড়। অয়ন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলল। দাঁত খিঁচিয়ে রাখল। তবুও হাত ছোটানোর চেষ্টা করলো না। শাবিহাকে কামড়াতে দিল। অয়নের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শাবিহা আরও বিরক্ত হলো। একপর্যায়ে হাত থেকে মুখ সরালো। দাঁতের দাগ বসে গেছে স্পষ্ট। রক্ত বেরোবে এমন অবস্থা। অয়নের চোখের কোণ ভিজে। শাবিহার একটু খারাপ লাগলো। পরমুহূর্তেই দোষ অয়নকেই দিল। তাকে ছেড়ে দিলে ত আর কামড় দিত না। জেদ ধরে কামড়াতে দিয়েছে। হাত সরিয়ে নিতো। কে না করেছে হাত সরাতে। স্বেচ্ছায় দিয়ে রাখলে কী তার দোষ নাকি! শাবিহা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর কামড় খেতে না চাইলে সরে দাঁড়াও।’
অয়ন হাত এগিয়ে দিল,’দাও কামড়।’
‘সত্যি কামড় দিব কিন্তু!’
‘দাও।’

শাবিহা মুখ বাড়ালো। অয়ন চোখ বুজল। নিজেকে প্রস্তুত করে রাখল। তবে যেটার জন্য প্রস্তুত রইলো, সেটা এলো না। নরম তুলতুলে একটি স্পর্শ অনুভব করতে পেল। চমকে চোখ মেলে তাকাল। শাবিহার ঠোঁট জোড়া এখনো ক্ষত স্থান ছুঁয়ে আছে৷ আরেকবার ঠোঁট ছুঁয়ে মাথা তুলে তাকাল। চাঁদের আলোয় দেখতে পারছে অয়নের ফ্যাকাসে মুখশ্রী। বৃষ্টিতে ভিজেছে নিশ্চয়ই। হাত গরম। অয়নের কপালে হাত ছোঁয়াল। জ্বর আসবে আসবে ভাব৷ শাবিহা চিন্তায় পড়ে গেল, ‘বৃষ্টিতে ভিজেছ! কেন!’
অয়ন আরও ঘনিষ্ঠ হলো। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজল। গরম নিশ্বাস ফেলছে সে। তার কন্ঠের স্বর গভীর, ‘আমার তোমাকেই চাই কিন্তু। যেভাবেই হোক না কেন, তোমার আমার হতে হবে। খুব ভালোবাসি তোমায়।’

শাহজাহান বাড়ির নারীদের ঘুম ভাঙে ভোর সকালে। ভোরের আলো যখন ফুটে। তারপর সম্পুর্ন বাড়িঘরে হাঁটাচলা করবে। অভ্যাসবশত আজও তাই করেছে। বাড়িঘর ঘুরেফিরে রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জয়া বেগম। তার বরাবর হয়ে দাঁড়িয়েছেন সুমিতা বেগম। দুজন কোণা চোখে একে অপরের দিক চাওয়া-চাওয়ি করছেন। তবে মুখে কিছু বলছেন না। এমন সময় মুফতি বেগমের প্রবেশ। তার হাতে গ্লাস! এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিতে এসেছেন। এভাবে জয়া বেগম এবং সুমিতা বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধালেন, ‘হয়েছে কী?’

জয়া বেগম মুখটা কাচুমাচু করলেন। ঠিক কী বলবেন বা কিভাবে বলবেন বুঝতে পারলেন না! মাথাটা দু দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। সুমিতা বেগম ও আঁড়চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। বোকার মতো মুফতি বেগম ফ্রিজের দিক অগ্রসর হলেন। সাতসকালে কী এমন হলো! ওদিকে সুমিতা বেগম ছটফট করছেন। সবকিছু উলটপালট করে ফেলছেন। দুধে পানি ঢেলে ফেলেছেন। আটা গোলাতে পানি বেশি ব্যবহার করেছেন। পরোটায় আলু বেশি হয়ে গেল। এমন হাবিজাবি সব সমস্যা। অন্যদিকে জয়া বেগমও রুখেদুখে কাজ করছেন। বারংবার ফিরে তাকাচ্ছেন একটি কাংখিত রুমের দিক। আরেকবার দৌড়ে ছুটে চেক করছেন, মোস্তফা সাহেব উঠেছে নাকি! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন! তপ্ত শ্বাস ফেলছেন ক্ষনে ক্ষনে। দ্বিধা জড়িত পায়ে দুবার রুমের সামনে গিয়ে ফিরে এলেন। পুনরায় রান্নায় ব্যস্ত হবার বৃথা চেষ্টা করছেন। সুমিতা বেগম ইনিয়েবিনিয়ে বললেন, ‘ডাকবো?

‘কি জানি!’
‘ভাইজান উঠে যাবেন কিছুক্ষনের মধ্যেই।’
‘একটা টোকা মেরে আয়।’
‘আপনি যান ভাবী!’
‘তুই যা সুমিতা।’
‘আপনি বড়ো ভাবী। আপনি যান।’
‘আমাকে মানাবে না। তুই ছোট, তুই যাবি।’
মুফতি বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ‘কোথায় যেতে হবে আমাকে বলো! আমি যাবো।’
জ্বলজ্বল করে উঠলো জয়া বেগমের চোখজোড়া। তিনিই অরুর নতুন রুমের দিক আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘টোকা মেরে আয় দু একটা!’
‘এতটুকু কাজ? তোমরা যেমন করছিলে! অদ্ভুত।’
মুফতি বেগম এগিয়ে গেলেন। ছটফট হাতে করাঘাত করলেন। উচ্চস্বরে ডাকলেন ও,’এই অরু! উঠে পড়। সকাল ত হলো!’
পর্দার পেছনে জয়া বেগম আর সুমিতা বেগম। দুজন ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এখন ঠোঁটের মুচকি হাসি লোকাতে ব্যস্ত। মহা ব্যস্ত!

অরুর ঘুম ভেঙেছে সূর্যের কিরণে। ঝলমলানো কিরণ। সোজা তার পাশে শুয়ে থাকা তন্ময়ের মুখের উপর পড়ছে। উজ্জ্বলতায় ঘেরা তন্ময়ের মুখশ্রী। অরু মন দিয়ে দেখতে লাগলো। একসময় কাত হয়ে উঠে বসলো। সূর্য আড়াল করল। তন্ময়ের মুখে পড়তে দিল না। হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিল। ভাবুক নজরে শুধু তন্ময়কে দেখতে থাকা অরু হঠাৎ করাঘাতের শব্দে চমকে উঠল৷ মুফতি বেগম চওড়া কন্ঠে ভয় পেয়ে গেল। তন্ময়ের ও ঘুম কেটে গিয়েছে। সে পিটপিট করে চোখ মেলেছে। কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ তার। বসে থাকা অরুর পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, পরপর উঠে বসলো। অরু ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মারাত্মক লজ্জিত সে। এই মুখ বাইরে কিভাবে নিবে। সে ত তন্ময়ের দিকই ভালোভাবে তাকাতে পারছেনা।

তন্ময় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।দেয়াল ঘড়িতে নজর বোলালো। ঘড়ির কাঁটা আটটা আঠারো’তে। সে ব্যস্ত পায়ে ওয়াশরুমের দিক ছুটলো। যেতে নিয়ে বলে গেল, ‘চোরের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে, উপরে গিয়ে কাপড়চোপড় আর অফিস ব্যাগটা নিয়ে আয়।’
অরুর লজ্জা কেটে গেল। রেগেমেগে অস্থির হয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ, ‘আপনি চোর!’
‘দ্রুত আন।’

অরু গলার স্বর নামিয়ে আরও কয়েকবার ‘চোর, চোর ‘ বলল। খুব শব্দহীন ভঙ্গিতে দরজা খুলল। তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে একপ্রকার। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই জেনে গেছে। হলোও তাই। অরু রুম খুলতেই মুফতি বেগমকে দেখতে পেল। দূরে দাঁড়ানো সুমিতা বেগম এবং জয়া বেগমকেও দেখতে পেল। তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মুফতি বেগম ‘উঠেছিস’ বলে হেসে চলে গেলেন। জয়া বেগম ও নজর সরিয়ে সাইড কাটলেন। রয়ে গেল সুমিতা বেগম। তিনি ধীর পায়ে অরুর সামনে এলেন৷ মুখমণ্ডল গম্ভীর করে বললেন, ‘এভাবে বেড়িয়েছিস কেন!’

অরু নিজের দিক তাকাল। বলল,’কীভাবে!’
‘গোসল সেড়ে বেরোতে হয়।’
‘আমিতো দুপুরে গোসল করি মা।’
সুমিতা বেগম মহা বিরক্ত হলেন। কপালে হাত চেপে বিড়বিড় করলেন। মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘একসাথে থাকলে ফরজ গোসল করতে হয়। তুই…’
তন্ময় বেরিয়ে এসেছে। সে তাওয়াল পেঁচানো। খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘চাচী গতকাল খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলাম তাই আর উপরে যাইনি। এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এতকিছু ভাবার মতো কিছু হয়নি।’
সুমিতা চোখ পিটপিট করলেন।’ওহ আচ্ছা’ বলে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছেন। তিনি তো ভালো চিন্তাভাবনা নিয়ে এসেছিলেন। কে জানত যে সে ফাস্ট ফাস্ট সবকিছু ভেবে ফেলেছেন। ওদিকে অরু বোকার মতো দাঁড়িয়ে। আগামাথা না বুঝতে পেরে শুধালো, ‘কি ভাবার মতো কিছু হয়নি!’
তন্ময় ধমকের সুরে বলল, ‘তোকে কাপড়চোপড় আনতে বললাম!’

‘যাচ্ছিলামই ত। এরমধ্যে… ‘
‘পকপক পড়ে। যা দ্রুত।’
অরু তন্ময়ের আকর্ষণীয় দেহে ভালোভাবে নজর দিতে পারলো না। মুখ বেঁকিয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে ছুটলো উপরে। অবশ্য এক ঝলক দেখেছে। তাতেই লজ্জায় তার মরে যাই যাই অবস্থা।

অরু ওড়না দুলিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। সাজগোছ করে পরিপাটি সে। হাঁটার তালে নুপুরের শব্দে রাঙিয়ে উঠছে চারিপাশ। তন্ময় তখন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। অরুকে দেখেই বলে, ‘বিছানার উপর আমার শার্ট-প্যান্ট রেখে এসেছি। বিকেলেই লাগবে। ধুয়ে শুকাতে দে!’
অরুর মাথায় বাজ পড়লো যেমন। চমকে তাকিয়ে রইলো। নিজের কাপড়চোপড় সে ধুয়ে পড়ে না। আর তন্ময়ের কাপড়চোপড় ধুবে। অরু মন ক্ষীণ করে ফেললো। চোখ জোড়া বড়বড় করে আশেপাশে তাকাল। সকলেই উপস্থিত। অথচ কেউই কিছু বলছে না! অরু নাক ফুলিয়ে রাখল। নড়ল না এক’পা। তন্ময় পুনরায় বলল, ‘যাচ্ছিস না কেন?’
‘আপনি বুয়াকে দেন নাই কেন ধুতে!’
‘তুই কী যাবি?’

অরু হাসফাস করে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিল। তন্ময় আজকাল যথাসম্ভব হুকুম করে অরুকে। এটাসেটা সবকিছু নিয়েই তার হুকুম, আদেশ লেগেই থাকে। যেমন সেদিন অফিস থেকে এসে অরুর হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে দিল। হুকুম করল গুঁছিয়ে রাখতে। তোতাপাখির মতো অরু বলেছিল,’নিজের জিনিস নিজে কেন রাখছেন না!’
তন্ময় ভোঁতা চোখে তাকিয়ে অরুকে ভয় পাইয়ে দৌড় দেওয়াল। আজ সন্ধ্যায় সেই ফাইল তন্ময় আনতে বলেছে। অরু কই যেনো রেখেছে মনে নেই। সেই ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ঘন্টা লেগে গেল। সাতটা ত্রিশে তন্ময়ের রুমে গেল ফাইল হাতে। তন্ময় তখন মহা ব্যস্ত। এই ল্যাপটপ ঘাটছে নাহলে একের পর এক ফাইল। অরু শব্দহীন ভঙ্গিতে ফাইল রাখল পাশে। তন্ময় ল্যাপটপে নজর রেখেই বলল, ‘ধুয়েছিলি?’

অরু ওড়নার কোণা মুঠো করে ধরে। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। মুলত তন্ময়ের প্রশ্নেই এই অবস্থা তার। কাপড়চোপড় সে ধুয়েছে। এর পূর্বে তন্ময়ের প্যান্টের পকেটে সে লাল রঙের ছোট বক্স পেয়েছে। সেটার ভেতর চকচকে আংটি দেখেছে। একদম তার আঙুলের মাপের। অরু আংটি খানা পরেছেও। তন্ময় কী তার জন্য কিনেছে? অরু বিষয়টি সকাল থেকে বলতে যেয়েও পারছে না। এখন যখন তন্ময় যেচে জিজ্ঞেস করছে, সে লজ্জার সম্মুখীন হয়ে পড়লো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,’হু।’

‘আংটি পেয়েছিস?’
‘হু।’
‘আঙুলে ফিট হয়েছে?’
‘হু।’
‘কই দেখি।’
‘আমি পড়িনি।’
‘সঙ্গে আছে?’
‘হু।’
‘এদিকে আয়।’

অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এগিয়ে গেল না কথামতো। তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। নিজেই এগিয়ে আসলো। অরু আংটির বক্স ওড়নায় বেঁধে রেখেছিল। সেখান থেকে ছোটাল। বক্স তন্ময় হাতে নিল। ছটফট হাতে আংটি বের করে অরুর আঙুলে পরিয়ে দিল। ঠিক এনগেজমেন্ট আঙুলে। অরু লক্ষ্য করলো তন্ময়ের হাত। তার আঙুলেও আংটি। অরু আগে কখনো তন্ময়কে আংটি পরতে দেখেনি। এই প্রথম। তাও হুবুহু একই ধরনের আংটি। অরুর ঠোঁট জুড়ে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠতে চাইছে। সে খুব প্রচেষ্টায় হাসি লোকাল। তন্ময় আবারো ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। কাজে ভীষণ ব্যস্ত সে। অরু লাজুক নয়নে তাকিয়ে রইলো। হাতটা সমানে দেখছে সে। কি সুন্দর মানিয়েছে আংটি খানা। অরু সঙ্গে সঙ্গে গেল না। চেয়ার পেতে বসলো। মন দিয়ে তন্ময়কে দেখতে লাগলো। খুটিয়ে খুটিয়ে! তার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে, ‘আপনার জন্য কফি আনি? মাথাটা টিপে দেই?’

তন্ময় হুট করে ফাইল বন্ধ করে ফেললো। কপালে আঙুল চেপে ধরলো। মাথা ব্যথা করছে খুব। কপাল সহ চোখজোড়া কুঁচকে রাখল। অরু ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘খুব মাথা ব্যথা করছে? কফি করে আনব?’
তন্ময় পুনরায় দানব আদেশের শুরু বলল,’মাথাটা টিপে দে।’
এই ইচ্ছে মনে তখন পোষণ করলেও, আপাতত করতে দ্বিধাবোধ এবং লজ্জাবোধ ঘিরে ধরছে অরুকে। তবে পরক্ষণেই তন্ময়ের অতিরিক্ত কুঁচকানো কপাল দেখে, দ্রুত পায়ে এগোল। খুঁজে আনলো মুভ ক্রিম। তন্ময় মাথা এলিয়ে চেয়ারে বসে। অরু পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঙুলে ক্রিম নিয়ে তন্ময়ের কপাল স্পর্শ করলো। নরম তুলতুলে হাত তার। একেকটি স্পর্শ যেমন স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছে তন্ময়কে। সে গম্ভীর স্বরে ছোট করে গোঙ্গাল। অরুর হাত থেমে গেল। তন্ময় চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল, ‘থামিস না।’

মোস্তফা সাহেবের কানে এসে পৌছেছে, লতা বেগম শাবিহাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট। বিয়েটা তিনি মেনে নিতে চাচ্ছেন না। শাবিহার বয়স বেশি, বিন্দুমাত্র মানানসই নেই দুজনের মধ্যে, এমন আক্ষেপ পুষে রেখেছেন মনে। সঙ্গে বলাবলি, আলোচনা করেছেন কিছু কটূ কথা। সেসব আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে মহল্লায়। মোস্তফা সাহেব মেয়ের জন্য হলেও রাজি হবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। তবে এখন আর তা সম্ভব নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না। কিছুতেই না। মেয়েকে এমন কোনো পরিবারের কাছে তুলে দিবেন না, যারা তার মেয়ের কদর করতে জানেনা। শাবিহাকে পরদিনই ড্রয়িংরুমে ডাকা হলো। বাড়ির সকলের সামনে মোস্তফা সাহেব বলেছেন, অয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে না। কোনোপ্রকার কথাবার্তা, দেখাসাক্ষাৎ করা যাবেনা। অয়নকে ভুলে যেতে হবে।
আশ্চর্যজনক ভাবে শাবিহা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে বাবার আদেশ।

তাও খুবই স্বাভাবিক ভাবে। কোনো হেলদোল দেখায়নি। বরং সেদিনই রুমে ঢুকে সেলফোন থেকে সিম বের করে, ভেঙে ফেলেছে। কাজ থেকেও লিভ নিয়ে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। একপ্রকার সে ঘরবন্দী করে নিল নিজেকে। বাবার সব কথা মুখ বুজে মেনে নেবার কারণ রয়েছে শাবিহার কাছে। সেও জানতে পেরেছে লতা বেগমের নারাজি। তার বলা একেকটি কথা কানে এসেছে শাবিহার। চারপাশে আলোচনায় এখন শুধু শাবিহা! সবার ধারণা এখানকার অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তি শাবিহা। অয়ন ছোটো, কতটুকু বা বুঝে সে! শাবিহা তো বড়ো। ঠিক সময় বিয়েসাদী হয়ে গেলে তার একটা বাচ্চা থাকতো। এমন হাজারো আলোচনার কথা শুনেছে শাবিহা।

তৎক্ষণাৎ হৃদয় তার কেমন মরে গেল। বাবার যুক্তির সাথে মিল পেল৷ যোগাযোগ করার সকল রাস্তা বন্ধ করে দিল, নিজ হাতে। কিন্তু হৃদয়? এই ব্যাকুল হৃদয় যে মানতে নারাজ। বিচলিত হয়ে ছটফট করে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। এক দন্ড শান্তি দিচ্ছে না। তোলপাড় করে তুলছে বুকের ভেতরে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যন্ত্রণায় গলা দিয়ে পানি পর্যন্ত গিলতে পারছেনা। চারপাশের কিছুতেই আনন্দ মিলছে না। রঙিন পৃথিবী আঁধারে তলিয়ে গেল। অন্ধকারে রুপান্তরিত হলো প্রত্যেকটি কোণা। শাবিহার পরিবর্তন গুলো পরিবারের চোখে নিউজপেপারে হেডলাইনের মতো, ছেঁয়ে গেল।
বুধবার বিকেলে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো শাবিহা। অজ্ঞান শাবিহাকে প্রথমে দেখতে পেয়েছে অরু। সেই চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জড়ো করেছে। ডাক্তার ডাকা হলো। দুর্বল হয়ে পড়েছে শাবিহার শরীর। মানসিক ক্লান্তিতে ভুগছে সে। ডিপ্রেশনের দিক চলে যাচ্ছে ক্রমাগত। তার অবস্থা ভালো নয়।

ডাক্তারের একেকটি কথা ধারালো তীরের ন্যায় মোস্তফা সাহেবের বুকে চুবেছে। তিনি মাস খানেক ধরে মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। স্ত্রীও তাকে বারংবার বলেছে। মোস্তফা সাহেব অগ্রাহ্য করেছিলেন। সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়ে যাবে তার মেয়ে, অনিমেষ ভঙ্গিতে বলেছিলেনন। তবে আজ যা হলো সেটা মেনে নিতে পারছেন না। চোখের সামনে মেয়ের এমন করুণ অবস্থা সহ্য হচ্ছেনা। কি করবেন, কোথায় যাবেন, বুঝতে পারছেন না!
জবেদা বেগম রুম ট্রান্সফার করলেন। আজ থেকে তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকবেন৷ যতটুকু সম্ভব মুখের উপর রাখবেন মেয়েকে। কথা বলতেই থাকবেন মেয়ের সঙ্গে। তারপর দেখবেন কীভাবে মেয়েটা ডিপ্রেশনে থাকে! এসব ডিপ্রেশন টিপ্রেশন সব দূর করে দিবেন।

আঁধার রাত। ঘড়ির কাঁটা নয়টায় ঘুরছে। এমন সময়, শাহজাহান বাড়ির সদরদরজায় হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। চেঁচামেচির তুমুল শব্দ। বিকট শব্দের কারণে, সকলেই বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। এমনকি শাবিহাও। সে নিচে নামেনি। দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সদরদরজায় অয়ন দাঁড়িয়ে। খুব অগোছালো অবস্থা তার। ক্ষিপ্ত মুখশ্রী। শরীরের সর্বচ্চ শক্তি ব্যবহার করে, কেচি গেটে আঘাত করে চলেছে। মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ডাকছে, ‘শাবিহা!’
প্রতিবেশীদের উপস্থিতি ঘটেছে। চারপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। মোস্তফা সাহেব ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। বেসামাল গতিতে ছুটে এসেছেন। অয়ন চেঁচাল, ‘আমার শাবিহা কোথায়? কী করেছেন ওর সাথে?’
মোস্তফা সাহেব চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। ওহী সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় শাসালেন, ‘চেনাজানা বিদায় চুপ আছি। নাহলে এতক্ষণে হাজতে থাকতে।’

‘অয়ন ভয় পায়না। পুলিশ ডাকুন। আপনার বাড়ির মেয়ের জন্য মা’র খেতেও রাজি। আগে শাবিহাকে ডাকুন।’
ওহী সাহেব রেগে এগোলেনন। ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তেজে ছটফট করছেন। সেই মুহুর্তে তন্ময় বেরিয়ে আসলো। তার সঙ্গে আকাশ ও রয়েছে।তন্ময় বাসার কাপড়চোপড় পরে। কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে এসেছে। খুব শান্ত ভঙ্গিতে মোস্তফা সাহেবের পাশে দাঁড়ালো। আকাশ সদরদরজা খুলে দিলো। উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ট্রেলার বিনামূল্যে দেখতে দিলাম। বাকিটা মুভি চলবে, সেই মুভি দেখতে হলে টিকিট কাটতে হবে। না কাটলে সকলেই নিজ নিজ গর্তে চলে যান।’

হুড়মুড়িয়ে সকলকে হাতের ইশারায় সরিয়ে দিল। লাজলজ্জা ভুলে অনেকেই তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। যেমন মুভি তারা দেখবেই দেখবে। অয়ন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর ঢুকতে চাইল। উচ্চস্বরে আবারো ‘শাবিহা!’ ডেকে উঠলো। তন্ময় তার চাচ্চুকে সরিয়ে অয়নের সামনে দাঁড়ালো। দুজন লম্বায় উঁচু নিচু। হাইটে অয়ন সামান্য শর্ট। প্রাপ্তবয়স্ক হলে হয়তো অতটুকুও ঘুচিয়ে নিবে। অয়নের কাঁধে হাত রাখল তন্ময়। সেখানে প্রবল শক্তিতে দুটো থাপ্পড় বসালো। যেমন কাঁধের ময়লা ঝাড়ছে। কন্ঠে কঠিন্যতা নিয়ে বলল, ‘স্বপরিবার মানিয়ে, সকলের প্রশ্নের সহি জবাব দিয়ে, প্রাপ্ত মর্যাদা সহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই, এই বাড়ির দরজায় পা রাখবে। কেমন? বাসায় যাও এখন।’

অয়নের ছটফট পা জোড়া থমকে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাসের বেসামাল অবস্থা। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে এবং নিচ্ছে। দ্রুততম গতিতে উঠানামা করছে বুক। হাসফাস করছে সে। দৃঢ় দৃষ্টিতে চাইল তন্ময়ের চোখে। লালিত চোখজোড়ার অবস্থা। মনির চারিপাশে লালচে দাগ ফুটে আছে। কন্ঠের স্বর নিচুস্তর এবং অনিমেষ, ‘শাবিহা কেমন আছে?’
তন্ময় নির্দ্ধিধায় বলে দিল, ‘কি মনে হয় তোমার? কেমন থাকতে পারে!’
‘একদম ভালো না!’
‘ভালো থাকার ব্যবস্থা করো তাহলে।’

অয়ন মাথা দোলাল। নিষ্প্রাণ চোখে ভেতরে তাকাল। পরপর উপরে নজর রাখল। ততক্ষণে শাবিহা মুখ চেপে সরে গিয়েছে। ফুঁপিয়ে চাপাস্বরে কেঁদে উঠেছে। বুক ভাঙা যন্ত্রনায় শব্দ করে কাঁদতে লাগলো একসময়। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে যাকে দেখতে হতো তাকে না দেখে, অসহায় মুখশ্রী নিয়ে অয়ন ঘুরে হাঁটা ধরলো। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। মোস্তফা সাহেব এবার ছেলের দিক দৃষ্টিপাত করলেন। চোখ রাঙালেন। অবিশ্বাস্য সুরে বললেন, ‘তুমি এতকিছুর পরও চাচ্ছ শাবিহাকে এই পরিবারে দিতে?’
‘অয়ন খুব ভালো বাবা। শাবিহাকে সুখে রাখবে।’

ছেলের নরম স্বর শুনে, মোস্তফা সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। ছেলের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভেতরে চলে গেলেন। সবসময় তিনি আর তার ছেলে আগুন এবং পানির ন্যায়। খুব কম সময় তাদের মতের মিল ঘটে। তাও অফিসের সমস্যা গুলোতে। এভাবে দৈনন্দিন জীবনে দুজন টম অ্যান্ড জেরির মতো লেগে থাকে। কিছু না কিছু কারণে তাদের দন্ড ঘটেই। তার প্রথম সন্তান বলে কথা। খুব অল্প বয়সেই বাবা হয়েছিলেন। তাই ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হতেই, এক অদেখা বন্ধুতে পরিনত হয়েছে বলা যায়! মোস্তফা সাহেব প্রায়শই বিক্ষিপ্ত অনুভূতি শেয়ার করেন। সমস্যা, চিন্তাভাবনা খোলাখুলি বলেন। পরামর্শ করেন বৃদ্ধদের মতো। ছেলে নিজেও তাকে সবকিছুই বলে কয়ে করে। কোনোকিছুই গোপন নয়। ছোট থেকেই এমন ছেলেটা। মোস্তফা সাহেব অফিস থেকে ফিরতেই ছোট্ট তন্ময় দৌড়ে আসত। বসে বসে সকল ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলত। এতসব ছেলেটা নিজের মা’কেও বলত না। মোস্তফা সাহেবের মনে আছে, একটি বিশেষ ঘটনা। তন্ময় তখন ক্লাস টেন৷ তার সমবয়সী মেয়ে তাকে প্রপোজ করে। ফুল দেয়, লেটায় লেখে, ডায়রি গিফট করে। মোস্তফা সাহেবকে সেগুলো ছেলেটা দিয়ে বলেছিল, ‘এই বেয়াদব মেয়েটার বাবাকে গিয়ে নালিশ দিবে।’

পড়ন্ত বিকেল। স্নিগ্ধ পরিবেশ। অরু সেজেগুজে গাড়িতে উঠে বসেছে। তন্ময়ের সাথে সে ধানমন্ডি যাবে। সুপরিচিত ‘হাজিবলা মিষ্টান্ন’ হোটেলের উদ্দেশ্যে। খুব ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় সেখানে। এমনকি সুস্বাদু রসমালাইও। মুলত তারা রসমালাই আনতে যাচ্ছে। পছন্দ হলে, মিষ্টিও আনা হবে। গাড়ি স্টার্ট করেছে তন্ময়। অরু গুনগুন করে কাঁচ নামিয়ে দিল৷ তন্ময়ের দেখাদেখি সানগ্লাস পড়লো। পরপর খুলে রেখে পরিবেশ উপভোগ করায় মনোযোগী হলো। এমন সময় তন্ময়ের ফোন বেজে উঠলো। সেলফোন অরুর সামনেই। স্টেয়ারিংয়ের পাশে। তন্ময় বলল, ‘দেখ কে!’
অরু ফোন হাতে নিল। স্ক্রিনে মাহিন লেখা। অরু দেখে বলল, ‘মাহিন ভাইয়া।’
‘ধর। লাউড স্পিকার দে।’

অরু সময় নিয়ে ধরলো। তার এখনো মাহিনের কথাগুলো মনে আছে। কীসব বলেছিল, সে স্পষ্ট শুনেছে। অবশ্য তাতে অরু রেগে নেই। বরং লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো প্রায়।
মাহিনের গলার স্বর স্বতঃস্ফূর্ত, ‘মাম্মা!’
তন্ময় নিঃশব্দে হাসলো। জবাবে বলল,’হু।’
‘লালে লাল হয়ে আছ না! বন্ধুবান্ধব চেনো না।’
এইবারেই যদি না আসিস, তোর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকব না। কইয়া দিলাম!’
‘কই যাচ্ছিস এবার?’
‘যাচ্ছি নারায়ণগঞ্জ মাম্মা। সবকিছু স্যাট! রিহানের বাবা লঞ্চ দিবে। সবাই মিলে। ধুমসে যামু। প্লিজ চল এবার। মজা হবে। ইয়াহু।’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪১+৪২

‘ব্যাচের সবাই যাচ্ছে?’
‘হু। সব্বাই! এই চল না! অরুকে সঙ্গে নিবে কিন্তু।’
অরুর চোখজোড়া বোয়াল মাছের মতো বড়ো হয়ে আছে। তন্ময় তখনো পাকাপোক্ত স্বীকারোক্তি দেয়নি। ইনিয়েবিনিয়ে কল কেটেছে। কিন্তু অরুর মনে রয়েই গেল বিষয়টি। খোঁচ খোঁচ করছে ভেতরে। নারায়ণগঞ্জ সাথে লঞ্চ! অরু হাওয়ায় দুলতে লাগলো! যেতে পারলে মন্দ হতো না…

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব ৪৫+৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here