বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩
রানী আমিনা
আনাবিয়া তাকালো, ইলহান আসছে, ধীর পায়ে হেটে। পেছনে একটি অতীব সুন্দরী মেয়ে, হয়তো ওর খাস দাসীদের কেউ।
আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালো আবার সমুদ্রের দিকে, উঠে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করলোনা।
ইলহান মুখে দুর্বোধ্য হাসি ফুটিয়ে হাটতে হাটতে এসে দাড়ালো আনাবিয়ার পেছনে, আনাবিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজেও তাকালো দূর সমুদ্রের মধ্যিখানে। এরপর আনমনেই শুধালো,
“সুন্দর, না?”
আনাবিয়া উত্তর দিলোনা, আগের মতোই তাকিয়ে রইলো সমুদ্রের দিকে৷ ইলহান কিয়ৎক্ষণ আনাবিয়ার শুভ্র চোয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,
“রেড জোনের মালকিন হঠাৎ সমুদ্রে পাড়ে কি করছে?”
“সে কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিবোনা নিশ্চয়!”
শক্ত কন্ঠে উত্তর দিলো আনাবিয়া৷ হাসলো ইলহাম, পেছনে দাঁড়ানো খাস দাসীটিকে আদেশের সুরে বলল,
“ইয়াসমিন জঙ্গলের ধারেই অপেক্ষা করছে, ওর সাথে প্রাসাদে ফিরে যাও।”
“আপনি ফিরবেন না ইয়োর ম্যাজেস্টি?”
বিনীত সুরে শুধোলো দাসীটি। ইলহান তার গাল ছুয়ে দিয়ে উত্তর দিলো,
“দেরি হবে সামান্য, তুমি ফিরে যাও।”
কথাটি বলে ইলহান আবার ফিরলো আনাবিয়ার দিকে। দাসীটি লক্ষ্য করলো ইলহানের দৃষ্টি, স্পষ্ট মুগ্ধতা তাতে। বাদশাহর জীবন থেকে নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে কাতর হয়ে একটা ঢোক গিলে দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কি করবেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রশ্ন শুনে ঝট করে তাকালো ইলহান, নির্বিকার দৃষ্টিতে দাসীর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনী আর মধ্যমার সাহাজ্যে হঠাৎই চেপে ধরলো দাসীটির চোয়াল, ওর শক্ত আঙুলের চাপে ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো দাসীটি, যন্ত্রণায় ভর্তি হলো চোখ!
দাসীটির দিকে দুকদম এগিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রশ্ন করছো কাকে? তোমার কাছে এখন কৈফিয়ত দিবো আমি?”
ইলহানের নখ বসে গেলো দাসীটির চোয়ালে, কিঞ্চিৎ লালিমার আভাস পাওয়া গেলো সেখানে।
কিছুক্ষণ কঠোর চিত্তে দাসীটির চোখে চেয়ে থেকে অতঃপর হঠাৎ করেই ছেড়ে দিলো চোয়াল, মেয়েটি ককিয়ে উঠে সরে গেলো পেছন দিকে।
পুরোটা সময় আনাবিয়া এক দৃষ্টিতে সমুদ্রেই তাকিয়ে রইলো, পেছনে ফেরার সামান্য প্রয়োজন মনে করলোনা। ইলহান কড়া গলায় মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“প্রাসাদে ফিরে যাও, আর আজকের পর থেকে যেন তোমাকে রয়্যাল ফ্লোরের আশেপাশেও না দেখি। বোঝা গেছে?”
মেয়েটি কান্নাভেজা চোখে তড়িতে মাথা নাড়ালো, মুখথেকে টু শব্দটি বের করলোনা ভুলেও! ইলহান হাতের ইশারায় তাচ্ছিল্যভরে নিজের সামনে থেকে দূর হয়ে যেতে বলল দাসীটিকে। দাসীটি মাথা নুইয়ে আনুগত্য জানিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
ইলহান আনাবিয়ার পেছন থেকে ঘুরে এসে বসতে চাইলো আনাবিয়ার পাশে, পাথরের বাকি অংশে। কিন্তু মুহুর্তেই আনাবিয়ার টান টান বাক্যে থেমে গেলো ও,
“ভুলেও আমার পাশে বসার চেষ্টা করবেন না, শেহজাদা জাজিব ইলহান!”
“চেষ্টা করলে কি করবে?”
“সমুদ্রের পানিতে আপনাকে চুবিয়ে মেরে ফেলবো।”
নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলো আনাবিয়া, দৃষ্টি নিবদ্ধিত রইলো সমুদ্রে।
শব্দ করে হাসলো ইলহান। কিন্তু সত্যিই আনাবিয়ার পাশে এসে বসলোনা, হাসি থামিয়ে আনাবিয়ার পাশের পাথরে গিয়ে আরামসে বসলো, তারপর তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে।
ইলহান যে তারই দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পেরে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো আনাবিয়া। ইলহান পর্যবেক্ষণ করলো সেটা, বলল,
”শুনো আনাবিয়া, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন চাইলেও আর কোনো কিছু ফিরে আসবেনা, জানোই তো! আমি চাই তুমি প্রাসাদে ফিরে আসো, তোমার কামরা বুঝে নাও, তোমার অংশ বুঝে নাও। যে নেই তার জন্য শোক করে কোনো লাভ আছে বলে আমি মনে করিনা।
তোমার বয়স কম, ধরতে গেলে তুমি সবেমাত্র তারুণ্যে পা দিয়েছো। সামনে এক বিশাল জীবন পড়ে আছে। তোমার উচিত আসওয়াদের শোক ভুলে আবার বিয়ে করে নেওয়া। তুমি চাইলে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার জন্য পাত্র খুজবো। তবে…… তুমি যদি প্রাসাদেই থেকে যেতে চাও তবে আমি আছি তোমার জন্য! আসওয়াদ আর আমার ভেতরে তো কোনো পার্থক্য নেই, তাই না? শুধু রংটাই যা, নাথিং এলস্!”
“আপনার লজ্জা শরমের অনেক ঘাটতি আছে শেহজাদা ইলহান! আপনাকে আবার প্রথম থেকে লজ্জা শেখায় মনোযোগ দেওয়া উচিত।”
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকেই কঠিন স্বরে বলল আনাবিয়া।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমার লজ্জার প্রতি সম্মান রেখে আমি এই ব্যাপারে আর কখনো কোনো কথা তোমাকে বলবোনা। তুমি সালিম ভাইজানের মেয়ে তোমাকে আমিও মেয়ে হিসেবেই দেখবো, খুশি?”
ফিচেল কন্ঠে শুধিয়ে উত্তরের আশায় আনাবিয়ার দিকে চেয়ে রইলো ইলহান, কিন্তু উত্তর দিলোনা আনাবিয়া, আগের মতোই মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো।
“শুধুমাত্র আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান হওয়ার কারণে তুমি পঞ্চদ্বীপে এত্ত দারুণ ভাবে টিকে আছো আনাবিয়া! আমি জানি তুমি আমাকে বাদশাহ মানোনা, কিন্তু তুমি এটাও জানো যে পঞ্চদ্বীপে বাদশাহর আদেশই শেষ কথা। আর বাদশাহর আদেশ অমান্য করার অর্থ সম্পুর্ন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধাচারণ করা, এবং তার শাস্তি শুধুমাত্র মৃত্যুদন্ড।
তুমি হয়তো আরও ওয়েল ম্যানার্ড হতে যদিনা আসওয়াদ তোমাকে অতিরিক্ত আদরে বাদর না করে ফেলতো। ওর উচিত ছিলো তোমাকে এতটা প্রশ্রয় না দিয়ে, তোমার ভালোবাসাকে সম্মান জানানোর খাতিরে অন্য দাসীদের কাছে যাওয়া থেকে বিরত না থাকা।
কিন্তু আমার দু মিনিটের ছোট ভাইটাতো তুমি বলতে অজ্ঞান ছিলো! তাই কোনোদিন তোমার ভুলের জন্য কিচ্ছুটি বলেনি…”
শব্দ করে কিঞ্চিৎ হাসলো ইলহান, সমুদ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আনাবিয়ার গালের দিকে দৃকপাত করে আবার বলল,
“সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তুমি তার সন্তানকে হত্যা করেছো, একজন দেমিয়ান সদস্যকে হত্যা করেছো! আর সে শাস্তি হিসেবে তোমাকে সামান্য ওয়ার্কার্স দের ভেতর ছেড়ে দিয়েছে, হা হা! মানে মানুষ ভালোবাসায় কতটা অন্ধ হলে নিজের সন্তানের হত্যাকারীকে বাঁচিয়ে রাখে!
তেতো হলেও সত্য, আসওয়াদের এমন অধঃপতন এর কারণ তুমি আনাবিয়া, শুধুমাত্র তুমি। তুমি ওর জীবনে না থাকলে আজ ওর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস কারোরই হতোনা, আমার তো না-ই!”
“মুখ সামলে কথা বলুন শেহজাদা! আমার স্বামী এবং আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার নিয়ে একটিও শব্দ উচ্চারণ করার অধিকার আমি কাউকে দেইনি, আপনাকেও না৷
ভুলে যাবেন না আমি একজন শেহজাদী, এবং এই ‘শেহজাদী’ শব্দটা জাস্ট একটা শব্দ নয়, এটা আমার ক্ষমতার প্রতীক। আমি জানি আপনি আমার ওপর কেন এখনো চড়াও হচ্ছেন না, কেন আমাকে ডার্ক প্যালেসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন না।
আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি ঠিক কি কি করতে পারি, এবং আপনি আমাকে ভয় পান। সুতরাং, নিজের ভালো চাইলে চুপ থাকুন, এবং দ্বিতীয়বার কখনো আমার সম্মুখে অথবা অগোচরে আমার স্বামীকে জড়িয়ে কোনো ধরনের অসম্মানজনক শব্দ উচ্চারণ করার দুঃসাহস করবেন না। নইলে আপনার জন্য সেটা একদমই ভালো হবেনা, শেহজাদা জাজিব ইলহান!”
ইলহানের দিকে ফিরে তাকিয়ে নির্বিকার শক্ত গলায় বলল আনাবিয়া, এরপর ইলহানের দিকে নিজের শকুনি দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই উঠে পড়লো পাথরের ওপর থেকে, অতঃপর চোখের পলকে রেড জোনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
ইলহান ওর প্রস্থানের পথে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, ঠোঁটের কোণা বাকিয়ে হাসলো সামান্য। ওর দু মিনিটের ছোট ভাইটা বড়ই নির্বোধ, নইলে একে কেন পেলে পুষে বড় করবে?
আকাশে মেঘ করেছে ভীষণ, দানবের ন্যায় আকৃতির কালো মেঘেরা দল বেঁধে উড়ে এসে একটু একটু করে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যের চেহারা খানা, মেঘের গাঢ় ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে গোটা রেড জোন।
একটু আগেও দুপুরের ভীষণ তপ্ত রোদে গাছের পাতাগুলোও নুইয়ে পড়েছিলো, থমকে গেছিলো বাতাস। ঘন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীক্ষ্ণ রোদ গলে গলে পড়ে জ্বলন্ত আঁচড় কেটে দিচ্ছিল শুকনো মাটির ওপর।
কালো মেঘের ঘনঘটার উপলক্ষে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গিয়ে সমস্ত জঙ্গলকে করে ফেলেছে শীতল! মৃত পাতাগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেছে দূরে কোথাও।
আকাশে এক বিরাট গুমোট গর্জন শোনা গেলো এমন সময়ে, বনের সমস্ত প্রাণীকে বুঝিয়ে দিলো এক প্রবল বর্ষণ আসন্ন। গাছের শাখাগুলো দুলতে শুরু করলো তীব্র বাতাসে, পাতাগুলো কাঁপতে লাগলো থরথর, মাটির ধুলোবালি গুলো ঘুর্ণি পাকিয়ে বাতাসে উড়তে শুরু করলো এক অদ্ভুত নাচের ছন্দে।
মসভেইল প্যালেসের সম্মুখের খোলা স্থানে বেতের পাটির ওপর শুকনো ঝালের ছড়াছড়ি, ঝাঝালো রোদ দেখে আনাবিয়া ফাতমাকে দিয়ে সকালেই সেগুলো রোদে দিয়েছিলো। আকাশে মেঘ করতেই ফাতমা আর শার্লট মিলে সেগুলোকে তুলে ফেলার কাজে লেগে গেলো তৎক্ষনাৎ।
কিন্তু আকাশ জুড়ে জমে থাকা কালো মেঘ অপেক্ষা করলো না ওদের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে হঠাৎ করেই বিদ্যুতের এক উজ্জ্বল শিখা ছুঁড়ে দিলো দিগন্তের ওপারে, আর তারপরই এক বিস্ফোরিত গর্জন!
তৎক্ষনাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। রেড জোনের উঁচু উঁচু রেড উড ট্রির পাতার ওপর ভারী বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়তে না পড়তেই পুরো জঙ্গল দুলতে শুরু করলো এক মোহময় সংগীতের তালে।
ঝরঝর শব্দে বৃষ্টির পানি ঝরতে লাগলো আকাশ থেকে, বিশাল বৃক্ষরাজি তাদের দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা মেটাতে মেলে ধরলো ডালপালা, শুকনো মাটিতে প্রথম ফোঁটা পড়তেই ধোঁয়ার মতো এক উষ্ণ গন্ধ ভেসে উঠলো বাতাসে, মুহুর্তেই আবার সেগুলো চাপা পড়ে গেলো ঝুম বৃষ্টির ভীষণ দাপটের নিচে৷
শার্লট ফাতমা দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে এক ছুটে উঠে এলো মহলের বারান্দায়, পাটি শুদ্ধ শুকনো ঝাল গুলো বারান্দায় রেখে দুজনে ঝেড়ে নিতে থাকলো নিজেদের পোশাকে লেগে থাকা পানির স্পর্শ। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো, পানির ঝাপটা থেকে বেচে ফেরার হাসি।
আনাবিয়া ছিলো নিজের কামরায়, বৃষ্টি হচ্ছে দেখে বাইরে বেরিয়ে এলো ও। ছেলেগুলো ততক্ষণে নেমে গেছে নিচে, ঝুম বৃষ্টিতে নেমে পায়ের নিচের নরম ঘাস মাড়িয়ে ভীষণ উচ্ছাসে লাফালাফি ঝাপাঝাপি চিৎকার চেচামেচির ওপর আছে সবগুলো। অথচ কিছুক্ষণ আগেই গোসল করলো সবগুলো।
লিন্ডা ঘুমিয়ে ছিলো, বাইরে ছেলেদের এমন উদ্ভট চিৎকার চেচামেচি শুনে কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ও, বাচ্চাদের কান্ড দেখে হাসতে থাকা আনাবিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বাহুতে চোয়াল ঠেকিয়ে দেখতে লেগে গেলো ওদের হুটোপুটি।
লিন্ডাকে বারান্দা চত্বরে দেখতে পেয়ে লিও হুটোপুটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ভেজা পায়ে থপ থপ শব্দে মহলের কয়েকটা সিড়ি বেয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিলো লিন্ডার দিকে। একটু আগেই গোসল দিয়ে বের হওয়া লিন্ডা তড়িতে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে মানা করে দিলো সাথে সাথে, কিন্তু লিও শুনলোনা। আর এক সিড়ি উঠে লিন্ডার হাত ধরে টেনে হাওয়ার বেগে নিয়ে গেলো ওদের হুটোপুটির ভেতর।
লিন্ডাকে দেখা মাত্রই উচ্ছাসের পরিমাণ বেড়ে গেলো ওদের, চিৎকার দিয়ে উঠে দুই লাভবার্ডকে ধরে জোর জবরদস্তি করে মাঠের ভেতরে ফেলে কাঁদা মাখিয়ে ছেড়ে দিলো ওরা। বারান্দায় থাকা শার্লট ফাতমা হেসে গড়াগড়ি খেলো।
কোকো হুটোপুটি থেকে বেরিয়ে এসে দুহাত বাড়িয়ে ঝুম বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নিলো কাঁদামাখা হাত, এরপর ছুটে কাঠের সিড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে হাত ধরলো আনাবিয়ার, বলল,
“আসুন আম্মা, বৃষ্টিতে ভিজবেন আমাদের সাথে।”
আনাবিয়া না না করলো কিন্তু কাজ হলোনা তাতে, কোকো টেনে নিয়ে গেলো ওকে। ব্রায়ান গিয়ে শার্লট ফাতমাকেও নিয়ে এলো, ভিজছে যখন তখন গুষ্টিসুদ্ধ সবকটা ভিজুক।
একটা ব্যাগি ট্রাউজার আর ফুলস্লিভ টি শার্ট পরিহিতা আনাবিয়া বৃষ্টির ভেতর এসে দু হাত মেলে মুখটা বাড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে, বৃষ্টির বড় বড় ফোটা এসে পড়লো ওর মুখের ওপর, ছুয়ে দিয়ে গেলো ওর শ্বেত শুভ্র ত্বক!
কোকো এগিয়ে আসলো, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে রইলো ওর আম্মার বৃষ্টি বিলাস। এই ছোট্ট মেয়েটি কিনা ওর মা, ওর আশ্রয়, ওর সবচেয়ে প্রিয় মানবী!
আনাবিয়ার কাছাকাছি এসে আনাবিয়ার গাল দুটো দুহাতে ধরলো ও। চমকে ওর দিকে তাকালো আনাবিয়া, কোকো মিষ্টি গলায় ডাকলো,
“আম্মা…..”
“হুউউম”
আদুরে ভঙ্গিতে টেনে উত্তর দিলো আনাবিয়া, পরক্ষণেই কোকোর কানের দিকের চুলে নজর গেলো আনাবিয়ার, এক প্রকার লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত স্বরে ও বলে উঠলো,
“কোকো, তোর চুলে পাক ধরছে, কি সর্বনাশ!”
কোকো আশ্চর্য ভঙ্গিতে আনাবিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে চুলে হাত দিয়ে বলল,
“সত্যি নাকি?!”
আনাবিয়া কোকোর ওই অল্প কয়েকটি পাকা চুল দেখে খিলখিল করে হাসলো বিস্তর, কিন্তু পরক্ষণেই এক অজানা আশঙ্কায় মিলিয়ে গেলো ওর হাসি, মুখে হঠাৎ এসে ভর করলো আধার৷
ওর কোকো কি একটু বেশিই বড় হয়ে গেলো? যাবেই তো, বয়স হয়েছে এখন ষাটের ওপারে, সর্বোচ্চ গেলে হয়তো দুশো, তারপর? তারপর……
মুহুর্তেই নিজের চোখের সামনে একে একে বেলিন্ডা, হামদান, নোমানের হাস্যোজ্জ্বল চেহারাগুলো ভেসে উঠলো আনাবিয়ার, লাঠিতে ভর দিয়ে চলা ইয়াসমিনের চামড়া কুচকানো মুখখানাও। সবার শেষে স্মৃতিপটে এসে যোগ হলো আরেকটি চেহারা, শ্যামবরণ পুরুষটির ভিষণ দাপুটে চেহারা!
কোকো…. ওর কোকোও কি তবে একদিন……!
বুক কাঁপলো আনাবিয়ার, ঠোঁট দুটো হঠাৎই কেঁপে উঠলো যেন। অসহায়ত্ব ঘিরে ধরলো ওর চেহারাটাকে। কেন সবাই ওকে ফেলেই চলে যায়? কেন বার বার একা হওয়ার সময় ওরই আসে?
আনাবিয়ার ওই আঁধার নেমে যাওয়া চেহারাটা দেখে কোকো যেন সাথে সাথেই বুঝে গেলো ওর আম্মার মনের কথা, আরও কাছাকাছি এগিয়ে এসে জোরালো হাতে আনাবিয়ার মুখখানা ধরে ও বলে উঠলো,
“আম্মা, আমার আম্মা….
আমি কোথাও যাবোনা আপনাকে ছেড়ে, আমার এখনো বিয়ে করা বাকি, একগাদা বাচ্চার বাবা হওয়া বাকি, এই সবগুলোর বাবু দেখা বাকি, আপনার কোলে আমার বাচ্চাদের হুটোপুটি করতে দেখা বাকি! অনেক কিছু বাকি আম্মা, আমি কোথাও যাবোনা। আপনার কোকো আপনার কাছেই থাকবে আম্মা!”
আনাবিয়ার তবুও ঠোঁট ফুললো, পুতুল কেড়ে নেওয়া সদ্য কৈশরে পা দেওয়া ছোট্ট মেয়েটির ন্যায় অভিমানভরে তাকিয়ে রইলো ও। কোকো ওর ঠোঁট ফুলানো দেখে শব্দ করে হাসলো, বলল,
“আচ্ছা আম্মা, সম্পর্কটাকে এবার উলটে দেওয়া যায় না?”
“কেমন?”
উলটানো ঠোঁটেই শুধোলো আনাবিয়া।
“এতদিন আমি আপনাকে আম্মা ডেকেছি, আপনি আমাকে সন্তানস্নেহে বড় করেছেন। এখন আমার চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু আপনি সেই ছোট্ট খুকিটিই রয়ে গেছেন। সঠিক বয়সে বিয়ে করলে আপনার মতো দেখতে আমার একটা মেয়ে হয়ে যেতো এতদিনে। তাই আজ থেকে আমি আপনার বাবা, আপনি আমার একমাত্র প্রিন্সেস!”
কোকোর এমন অদ্ভুত আবদারে অভিমান ভুলে শব্দ করে হাসলো আনাবিয়া। কোকোর নাক টিপে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, বাবা আমার!”
বাকিরা এতক্ষণ কানপেতে এদের দুজনের সম্পর্ক বদলাবদলির কাহিনী শুনছিলো, লিন্ডা হঠাৎ করে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, কোকো ভাইজান আপনার বাবা হয়ে গেলে আমি আপনার তো ফুপ্পি হয়ে যাবো।”
লিও ওর চুল টেনে ধরে চাপা ধমকে বলে উঠলো,
“এই ম্যাও টা বেশি ম্যাও ম্যাও করে সবসময়।”
“আমি ফুপ্পি হলে তুমি কি হবা? চাচাজান! হে হে। না না, তুমি হবা ফুফা। কারণ আমি ফুপ্পি, নইলে সম্পর্কে গণ্ডগোল লাগবে।”
লিও ওর হাত ধরে পেছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ওর গাল টিপে ধরে একটা চুমু খেয়ে বন্ধ করে দিলো ওর মুখ। লিন্ডা চুমুর তোপে কনুই দিয়ে গুতা দিলো ওর পেটে।
হাসাহাসি, লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করতে করতে আরও কিছুক্ষণ ভিজলো ওরা বৃষ্টিতে। লিন্ডা কিছুক্ষণ কসরত করে লিওর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রইলো আনাবিয়াকে, অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, এই লিওর বাচ্চাটা সারাক্ষণ আমাকে শুধু ধমকায় আর মারে।”
আনাবিয়া এক হাতে আগলে নিলো ওকে, তাকালো লিওর পানে। চোখের দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিলো তার এই মেয়েকে কখনো এতটুকু কষ্ট দিলেও সে দেখে নেবে লিওকে।
লিও মিষ্টি হেসে চোখ নামিয়ে নিলো নিচে তবে আড়চোখে লিন্ডাকে পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে ভুললোনা। তখনি কোকো এসে লিন্ডার চুল টেনে ধরে আনাবিয়ার দিকে ফিরে কপট অভিমানের সুরে বলল,
“আম্মা, আপনি কিন্তু এই পাঁজি মেয়েটাকে আজকাল বেশি বেশি আদর দিচ্ছেন৷ এসব কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগছেনা!”
লিও ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“আয় ভাই, তোকে আমি আদর দিচ্ছি।”
“দূর হ, শালার বোনের স্বামী!”
বলে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো কোকো। ওর যাওয়ার ধরণ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া৷
আরও কিছুক্ষণ বৃষ্টির ভেতরে থেকে অতঃপর ভেজা শরীরে আনাবিয়া উঠে এলো বারান্দায়, বাচ্চারা তখনো সেখানেই হুটোপুটি করতে ব্যাস্ত রইলো।
শীতল বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে কামরায় এসে দ্রুত পোশাক বদলে নিলো আনাবিয়া, বৃষ্টি থামলেই ওকে একবার জঙ্গলের গভীরে যেতে হবে, বিশেষ কাজে।
“আমি আপনার সাথে যাই আম্মা?”
আবদারের সুরে বলল কোকো। ওর আম্মাকে ও একা ছাড়তে চায়না একটুও, ভয় হয় ওর। পাছে না আবার ওর আম্মা হারিয়ে যায়, কিছু হয়ে যায় ওর আম্মার!
“না কোকো, জায়গাটা অনেক দূরে, তোকে নিয়ে গেলে আমার ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে। আমি এই যাবো আর এই আসবো।”
পরনের কালো রঙা হুডির হুডটা ঠিকঠাক করতে করতে বলল আনাবিয়া।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো, এখন ওকে যেতে হবে রেড জোনের পেছন দিকের শেষের প্রান্তে। তার জন্য মোটামুটি একটা প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে ও।
কোকো কিছুক্ষণ হাত কচলে আবার ইতস্তত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আগামীকাল গেলে হয়না আম্মা?”
“না কোকো, আজ বৃষ্টি হয়েছে আজকেই যেতে হবে, নইলে পরে গেলে আর পাবোনা।”
বলে ব্যাকপ্যাক টা কাধে তুলে নিলো, কোকো কামরার বেতের সোফার ওপর বসে হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
“মিডনাইটের আগেই ফিরে আসবো, চিন্তা করিস না। ওদেরকে দেখে রাখিস, চোখ কান খোলা রাখিস।”
“আপনার যেমন আদেশ আম্মা। ”
সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল কোকো৷ আনাবিয়া ওর ভার হয়ে থাকা মুখের চোয়াল টেনে দিয়ে চিন্তা না করতে বলে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
কোকো এগিয়ে এলো বারান্দা পর্যন্ত, আনাবিয়া সিড়ি বেয়ে নেমে পেছনে ফিরে একবার কোকোর দিকে তাকালো, আর এরপর ঝড়ের গতিতে এগোলো কোথাও, ওর বিদ্যুৎ গতির কারণে কোকো দেখতেও পেলোনা ওর আম্মা ঠিক কোনদিকে গেলো!
১৯.
সোনালি সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে, সূর্যের শেষ আলো পাতার ফাঁক গলে জঙ্গলের মাটিতে পড়ে ঝিলমিলিয়ে উঠছে, গাছের ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
চারপাশে নেমে এসেছে এক মায়াবী স্তব্ধতা, পাখিরা সারাদিনের কোলাহল শেষে নিজেদের খড়কুটোর বাসায় ফিরে গিয়ে ডেকে উঠছে শেষবারের মতো।
গাছের গাঢ় ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে থাকা সরু মেঠো পথগুলো ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে সন্ধ্যার ছোঁয়ায়। পাতার ফাঁক গলে যে সূর্যালোক আসছিল, তা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে নরম কমলা থেকে বেগুনি আভায়।
আনাবিয়া চারদিকে দৃষ্টি দিতে দিতে হেটে চলেছে একটা হঠাৎ পাওয়া সরু রাস্তা ধরে৷ মনে ওর হাজার খানেক প্রশ্ন!
ঘন গাছের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা হালকা ঠাণ্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর৷ শীতল বাতাস অনুভব করতে করতে হেটে চলেছে ও উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে।
ফোনের জিপিএস টা কাজ করছেনা, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই একদমই! একটু আগে যা কাজ করছিলো এখন পুরোপুরি নেটওয়ার্ক জিরো।
মীরের সাথে প্রায় বছর বিশেক পূর্বে একবার এদিকটায় এসেছিলো ও মশলা জোগাড় করতে, আজও সেই একই উদ্দ্যেশ্যেই এসেছে। কিন্তু রাস্তা ভুলে গেছে, মনে করতে পারছেনা ঠিক কোন রাস্তা!
গতবার যে স্থান দিয়ে সেই মশলার রাজ্যে প্রবেশ করেছিলো সেই স্থানটা আজ আর খুজে পাচ্ছেনা।
এই সিজনে শিরো মিদোরি দ্বীপের শেষের অংশে এক বিশেষ ধরণের মশলা জন্মে, কিন্তু এই মশলা গুলোকে সহসাই খুজে পাওয়া যায়না৷ এগুলো জন্মে ঠিকই কিন্তু এদের এক অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলো অদৃশ্য থাকে।
ঝুম বৃষ্টির পর বৃষ্টির পানিতে মশলার গাছ গুলো স্বচ্ছ কাছের মতো চকচক করে, পানি শুকিয়ে গেলে আবারও সেগুলো আগের মতোই অদৃশ্য হয়ে যায়৷ কৃত্রিম ভাবে পানি দিলেও তাদের খুজে পাওয়া যায়না, শুধুমাত্র বৃষ্টির পানিতেই সেগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আনাবিয়া আজ সেগুলোই সংগ্রহ করতে এসেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে ও। জঙ্গলের এই স্থানটাতে কেউই আসেনা বলতে গেলে, জংলী প্রাণি ব্যাতিত এদিকে আর কিছুই নেই।
হাজার বছর পূর্বে কোনো এক বিজ্ঞানি কোনো এক রিসার্চের মাধ্যমে যে অদ্ভুত প্রাণি জগতের সূচনা করেছিলো তার কিছু অংশ থেকে গেছিলো এদিকে। বাকিরা একত্রিত হয়ে বর্তমান অ্যানিম্যাল টাউনে বসবাস করলেও এখানের প্রাণী গুলো হয়ে গেছিলো দলছুট!
এখানে এখনো তাই তাদেরই আনাগোনা। কিন্তু ওরা এতটাও সভ্য হয়ে ওঠেনি যে রাস্তা ব্যাবহার করবে। আদিম যুগের মানুষের মতোই তাদের চলাচল এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান৷
কিন্তু এই ঘন জঙ্গলের ভেতর এই সরু রাস্তার উৎপত্তি কিভাবে হলো সেটা ভাবালো আনাবিয়াকে।
বৃষ্টিস্নাত মাটির উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হেটে চলেছে ও। নাক টেনে একবার চেষ্টা করলো ফুলের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য, বৃষ্টির পর ফুলটির সুগন্ধ প্রখর হয়ে ওঠে ভীষণ, সেটাই বার বার পরখ করে চলল আনাবিয়া।
বৃষ্টির কারণে পানি জমেছে যেখানে সেখানে, কিছু অদ্ভুত পশম ওয়ালা ছোট্ট ছোট্ট গোলগাল ফ্লাপি প্রাণি ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, গাছপালার ভিড়ের ভেতর এদিক থেকে ওদিকে ছুটে লুকোচুরি খেলছে ওদের সঙ্গী সাথিদের সাথে।
আনাবিয়া সাবধানে পা ফেললো যেন ওদের গায়ের ওপর পাড়া না দিয়ে ফেলে৷ আনাবিয়াকে দেখে ওরা খেলাধুলা বাদ দিয়ে লাফাতে লাফাতে এগোলো আনাবিয়ার পেছন পেছন, আনাবিয়া দুবার ওদেরকে পিছু ছাড়াতে চাইলেও পারলোনা, ওরা ছোট্ট ছোট্ট করে লাফিয়ে এগিয়ে চলল আনাবিয়ার পেছনে। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে আনাবিয়া ওদেরকে সাথে নিয়েই এগোলো৷
কিয়ৎক্ষণ এগোনোর পরই আনাবিয়ার নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকলো এক অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ, ঘ্রাণটা যে মশলার ফুলেরই সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ওর, দ্রুত পা চালালো ও। রাত নেমে আসছে ওকে ফিরতে হবে মহলে।
দুমিনিট পা চালিয়ে হাটার পরই ওর চোখের সামনে পড়লো একটা ফাঁকা জায়গা, আর সেখানেই বৃষ্টির জল জমে থাকা ঘাসের ফাঁক গলিয়ে ফুটে আছে ঝাকে ঝাকে স্বচ্ছ ফুল!
রাতের সূচনার মৃদু আলো তার শুভ্র পাপড়ির ওপরে পড়ে তৈরি করেছে এক অন্য জগতের আভা।
পাপড়িগুলোর ওপর বৃষ্টির জমে থাকা ফোঁটাগুলো হীরার মতো ঝলমল করছে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে ফুলের অপার্থিব সৌরভ! স্বচ্ছ পাপড়ির ফুলগুলোর ভেতরে উকি দিয়ে আছে এক ঝাঁক সোনালি রঙা কেশর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো আনাবিয়া, আঙুল বাড়িয়ে ছুয়ে দিলো ফুলের কোমল পাপড়ি— ঠান্ডা, নরম, সদ্য বৃষ্টিতে ধোয়া। আর এরপরেই কাজে লেগে পড়লো।
ব্যাকপ্যাক থেকে একটা ছোট খাটো বেতের ঢাকনা ওয়ালা ঝুড়ি বের করে ফুলের ভেতর থেকে তুলে নিতে থাকলো সোনালী কেশরের গুচ্ছ।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১২
অন্ধকার গাঢ় হতে রইলো, জঙ্গলের আরও গভীর থেকে কিছুক্ষণ পর পর ভেসে আসতে থাকলো অদ্ভুত সব অচেনা প্রাণিদের রহস্যময় ধ্বনি, ওদের হাড়হিম করা মুখনিঃসৃত ধ্বনিতে নিজের অজান্তেই বুক কেঁপে উঠলো আনাবিয়ার৷
রাত নামছে তড়িৎ গতিতে, ওকে মহলে ফিরতে হবে দ্রুতই। দ্রুত হাত চালালো আনাবিয়া, আর সেই মুহুর্তেই দক্ষিণ থেকে বেসে আসা ঝড়ো হাওয়াতে বয়ে ফুলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে ওর নাকে এসে ঠেকলো অন্য একটি ঘ্রাণ….
