বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৫
রানী আমিনা
বিছানার উপর আধাশোয়া হয়ে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে আনাবিয়া। সফেদ খোলা চুলগুলো অবাধে ছড়িয়ে আছে বিছানার ওপর৷
কোলের ওপর রাখা একটি কুশন বালিশ, সেটাকে আকড়ে ধরে আছে ও। পাশেই ফাতমা একটা অটোমানের ওপর বসে বাটি থেকে চামচে করে অল্প অল্প স্যুপ নিয়ে খাওয়াচ্ছে ওকে। আনাবিয়া বাচ্চাদের মতোন ছোট্ট ছোট্ট করে চুমুক দিচ্ছে তাতে।
কোকো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলো কয়েক ঘন্টার জন্য, একটু আগেই ফিরে এসেছে আবার। অ্যানিম্যাল টাউন থেকে একজন পাক্কা রাধুনিকে ধরে নিয়ে এসেছে আনাবিয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করাতে।
তার ধারণা শার্লট ফাতমার রান্না করা আউল ফাউল রেসিপি খেয়ে ওর আম্মার এমন শরীর খারাপ হচ্ছে। যে মেয়ে প্রাসাদের দক্ষ বাবুর্চিদের হাতের অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ফিক্সড ম্যিল ছাড়া অন্য কিছু খায়নি কখনো তাকে এইসব বাইরের খাবার খাওয়ালে শরীর তো খারাপ হবেই, তারওপর রাধুনি কাঁচা।
কোকোর এমন অভিযোগে তখন থেকেই ফুলে আছে শার্লট, ফাতমার অবশ্য এসব গায়ে লাগেনি, সে আনাবিয়ার সেবায় ব্যাস্ত।
এমন সময় মহলের সিঁড়ির সম্মুখে শোনা গেলো রেড জোনের বর্ডার গার্ডদের কারো একজনের যান্ত্রিক শব্দ, আনাবিয়া সেটা শুনতে পাওয়া মাত্রই ফাতমাকে বলল গার্ড কেন এসেছে সেটা জানার জন্য।
ফাতমা স্যুপের বাটি রেখে উঠতেই যাচ্ছিলো তখনি টোকা পড়লো কামরার দরজায়, বাহির থেকে কোকো জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভেতরে আসবো আম্মা?”
“আয়……”
ঠোঁট ভিজিয়ে বলল আনাবিয়া, গায়ে থাকা চাদরটা ঠিকঠাক করে নিলো। কোকো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলল,
“আম্মা, প্রাসাদ থেকে ইয়াসমিন আপা আর কয়েকজন দাসী এসেছে। ওরা ভেতরে ঢোকার জন্য অনুমতি চায়।”
“ইয়াসমিন, হঠাৎ? সাথে আবার দাসীরাও! কোনো সমস্যা হয়েছে? তুই জানিস কিছু?”
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো আনাবিয়া। কোকো প্রতিউত্তরে বললনা কিছুই, চোখ নামিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইলো মাটির দিকে। আনাবিয়া সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,
“এসবের ভেতর তোর কোনো হাত নেই তো কোকো?”
“ও্-ওদেরকে আমিই আসতে বলেছিলাম আম্মা, আপনাকে না জানিয়েই প্রাসাদে আপনার অসুস্থতার সংবাদ দিয়েছি আমি, ক্ষমা করে দিবেন আমাকে আম্মা!”
মাথা নুইয়ে অপরাধীর সুরে বলল কোকো। আনাবিয়ার দৃষ্টি কঠোর হলো, কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে না জানিয়ে কবে থেকে একা একা সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করেছিস কোকো? নাকি আমাকে আর তোদের প্রয়োজন নেই?”
কোকো বললনা কিছুই আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কিয়ৎক্ষণ কোকোর নতমুখের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে ঝাঝালো গলায় আনাবিয়া আবারও বলল,
“যে প্রাসাদ থেকে আমি দূরে যাওয়ার জন্য ছুটছি সেটাকেই বার বার আমার কাছে টেনে নিয়ে আসছিস তোরা, কেন? আমি ভালো থাকি সেটা কি তোরা চাস না?”
কিঞ্চিৎ কাঁপলো কোকো, ওর আম্মার জন্য যে ও প্রয়োজোনে নিজের জান কুরবান করে দিতে চায় সেটা কে বুঝাবে ওর আম্মাকে? ওর আম্মা যে অভিমানী, ভীষণ অভিমানী সেটা কি ও জানে না?
হিজ ম্যাজেস্টির পর কেউ যদি ওর আম্মাকে চিনে থাকে তবে সেটা ও নিজে! তার আম্মার বুক ফাটবে তবুও অভিমান এতটুকুও কমবে না!
কিন্তু ও কি ওর আম্মাকে এভাবে অসুস্থতায় পড়ে যেতে দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? ও কি কিছুই করবে না?
কোকোকে নিশ্চুপ দেখে আনাবিয়া শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ওদেরকে ফিরে যেতে বল, আমি প্রাসাদের কাউকে দেখতে চাইনা। আমি বাঁচলে এভাবেই বাঁচবো, মরলে এভাবেই মরবো!”
কোকো চমকে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, একটা ঢোক গিলে কয়েককদম এগিয়ে বিছানার নিকট এসে হঠাৎ করেই মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়লো ও, তারপর অনুনয়ের সুরে বলল,
“একটাবার ওদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিন আম্মা, একটাবার শুধু! আপনাকে একটাবার চেকআপ করতে দিন ওদের, ওরা আর আসবে না! প্লিজ আম্মা!”
আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্য দিকে, কোকো আবারও বলল,
“অনুরোধ করছি আম্মা, দয়া করে একটাবার আমার কথা শুনুন! ওদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিন আম্মা একটিবার!”
বিছানার পাশে বসে থাকা ফাতমা নরম সুরে বলল,
“শেহজাদী, কোকো ভাইজানের কথা শুনুন একবার! আপনার শরীর অনেক খারাপ, আমি যেটুকু পেরেছি সেটুকু করেছি, কিন্তু এতটুকু যথেষ্ট নয় শেহজাদী! আপনার আরও ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন, নইলে আপনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ওদেরকে আসতে অনুমতি দিন শেহজাদী!”
কোকো হাটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলো আরও একটু, কাতর স্বরে বলল,
“শুধু এই একটা অনুরোধ রাখুন আম্মা, আমি আর কখনো কিচ্ছুটি চাইবোনা আপনার কাছে! একবার অনুমতি দিন ওদের রেড জোনে প্রবেশের, প্লিজ আম্মা!”
আনাবিয়া চুপ রইলো কিয়ৎক্ষণ, তারপর মুখ না ফিরিয়েই বলে উঠলো,
“ঠিক আছে।”
খুশি হয়ে গেলো কোকো, ফাতমার দিকে একবার জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ও মেঝে থেকে উঠে ছুটে চলে যেতে নিলো বাইরে, কিন্তু আনাবিয়ার শক্ত কন্ঠে থেমে গেলো হঠাৎ,
“তবে এই শেষ বার, আর কখনো নয়।”
কোকো পেছনে ফিরে সম্মানের সাথে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবারও ছুট লাগালো, আর তার মিনিট পাঁচেক পরেই দরজার সামনে উপস্থিত হলো ইয়াসমিন সহ এক ঝাঁক দাস দাসী।
থমথমে মুখে বিছানায় বসে আছে আনাবিয়া, ইয়াসমিন বসে আছে ফাতমার স্থানে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দাসীদের ঝাঁক। সকলেরই মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি আনাবিয়ার টেরাকোটা ঠোঁটের মোলায়েম বাধনে ধরে রাখা শুভ্র মুখশ্রীর ওপর, মোহগ্রস্তের ন্যায় ওরা তাকিয়ে আছে এই অত্যন্ত সুশ্রী সুদর্শনাটির দিকে।
একটু আগেই প্রাসাদের রয়্যাল হেকিম এসে দেখে গেছে ওকে, এখন বাইরে কোকোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে তার।
ইয়াসমিন কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে গলা খাকারি দিলো আস্তে করে, তারপর আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, আপনাকে অনেক ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।”
আনাবিয়া নিরুত্তর রইলো। ইয়াসমিন কিছু সময় চুপ থেকে আস্তে আস্তে পাড়লো কথাটা,
“দাসী গুলোকে হিজ ম্যাজেস্টি পাঠিয়েছেন আপনার জন্য, শেহিজাদী। উনি ধারণা করছেন এখানে আপনার সেবা যত্নে অনেক গাফিলতি হচ্ছে, আপনার ঠিক ঠাক দেখাশোনা হচ্ছে না।”
“আমার কাউকে প্রয়োজন হবে না ইয়াসমিন, ওদেরকে নিয়ে তুমি প্রাসাদে ফিরে যাও। আর শেহজাদা জাজিব ইলহানকে বলে দিও আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজের সাম্রাজ্যের উন্নতি কিভাবে করবে সেটা ভাবতে।”
“শেহজাদী…. হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে চান। এখানে থাকলে আপনার শরীর এভাবে রোজই খারাপ করবে শেহজাদী, আপনি প্রাসাদে অনেক ভালো থাকবেন! আপনার যত্মের সামান্য ত্রুটি হবে না কোথাও, হিজ ম্যাজেস্টি হতে দেবেন না। দয়া করে ফ……”
বাকি কথা শেষ করতে পারলোনা ইয়াসমিন, তার আগেই আনাবিয়া কড়া গলায় বলে উঠলো,
“আর একটিবারও প্রাসাদে ফেরার কথা বললে তোমাকে আমি খুন করবো ইয়াসমিন, চুপ থাকো!”
ইয়াসমিন চুপসে গেলো, মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে।
সময় কাটলো আরও বেশ কিছুক্ষণ, ইয়াসমিন দের ফেরার পালা এলো। তার হাজার অনুরোধের পরেও আনাবিয়া একটি দাসীকেও রাখলোনা নিজের কাছে। ব্যর্থ হয়ে শেষ মেশ সব দাসীকে নিয়ে ইয়াসমিন আবার ফিরে চলল প্রাসাদে।
কোকো চিন্তিত মুখে বসে ছিলো মহলের বারান্দা চত্বরের বেতের তৈরি সোফার ওপর, চোখ দুটো ওর নিবদ্ধিত কাঠের মেঝেতে, একটুও পলক পড়ছেনা৷
বাচ্চারা সব মহলের বাইরে বিরাট অশ্বত্থ গাছটির ছায়াতলে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেতর চাপা আলোচনায় ব্যাস্ত ছিলো। লিও তাকিয়ে দেখলো একবার কোকোকে, তারপর ফ্যালকনকে সাথে নিয়ে চলে এলো মহলের বারান্দায়।
কোকোর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“হেকিম কি বলে গেলেন কোকো? শেহজাদীর শরীরের কন্ডিশন কেমন?”
“দুর্বলতার কারণে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি, কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করে গেছেন, প্রাসাদ থেকে কিছুক্ষণ পরেই সেগুলো চলে আসবে। এগুলো নিয়মিত দিলে আর পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ালে ঠিক হয়ে যাবে৷ শেহজাদী কিছুদিন থেকে খাবার দাবারে অনিয়ম করছেন ভীষণ, এসব তারই সাইড ইফেক্ট। কিন্তু এসবের চাইতেও একটা এলার্মিং ব্যাপার আছে লিও!
“কি ব্যাপার? কোনো অসুবিধা হয়েছে আম্মার?”
“হেকিম বলেছেন আম্মা একাকিত্ব আর বিষণ্নতায় ভুগছেন, এবং এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই তিনি ডিপ্রেশন ফেইজে চলে যাবেন!
আম্মাকে এই জঙ্গল থেকে বের করতে হবে লিও, আম্মাকে এখানে রাখা যাবেনা। এই জঙ্গল আম্মার জন্য ক্ষতিকর। হয়তো আমরা সবাই এখানে আম্মার পাশে আছি বলে ক্ষতিটা স্লোল্যি হচ্ছে, গুরুতর হচ্ছেনা বলে আমরা বুহহতে পারছিনা। কিন্তু হচ্ছে! এই জঙ্গল আম্মাকে ভালো থাকতে দিচ্ছেনা, আম্মাকে হিজ ম্যাজেস্টির স্মৃতি ভুলতে দিচ্ছেনা, প্রতি মুহুর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে!”
“তাহলে এখন কি করার?”
শুধোলো ফ্যালকন, কোকো কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“কুরো আহমারে আম্মার একটা রাজমহল আছে না? আম্মাকে ওখানে নিয়ে গেলে কেমন হয়?
জায়গাটা অনেক সুন্দর, তাছাড়া সেখানে আম্মার জন্য সবধরণের সুব্যবস্থাই করে রেখে গেছেন হিজ ম্যাজেস্টি, আম্মার সেখানে কোনো সমস্যাই হবে না, তিনি সেখানে প্রাসাদের মতোই ভালোভাবে থাকবেন।”
“শেহজাদী কি শিরো মিদোরি ছাড়তে রাজি হবেন?”
লিওর প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো কোকো, ভ্রু জোড়া কুচকে আবারও চিন্তিত দৃষ্টি নিবদ্ধিত করলো মেঝের দিকে। ওর আম্মা এই শিরো মিদোরি ছাড়তে কখনোই রাজি হবেনা, যেখানে হিজ ম্যাজেস্টির ছোয়া লেগে আছে সে স্থান ছেড়ে তিনি কখনোই যাবেন না।
ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে কোকো বলে উঠলো,
“সেটাই তো চিন্তার বিষয় লিও! উনি রেড জোন ছেড়ে যেতে চাইবেন না, আর আমরা তাকে জোর করতেও পারবোনা!”
কোকোর দুঃশ্চিন্তা এবার গ্রাস করলো লিও ফ্যালকনকেও, কোকোর মতোই চোখে চিন্তার পাহাড় জমিয়ে ওরা দৃষ্টি নিবদ্ধিত করলো মেঝেতে।
কেটে গেছে প্রায় কয়েক মাস। রেড জোনের ভেতরে কোমর থেকে ভেঙে পড়া আধমরা বিশাল রেডউড গাছটির ভেতরে থাকা ট্রি হাউজের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে আছে আনাবিয়া। ওর সফেদ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বিছানায়। মুখটা শুকিয়ে আছে কিঞ্চিৎ।
এখন আর পূর্বের মতো যত্ন নেওয়া হয়না চুলগুলোর, রেশমসম কেশগুচ্ছ ধীরে ধীরে রুক্ষ হতে শুরু করেছে। মীর থাকতে রোজ রাতে চুলে বেণী করে তবেই ঘুমোতে হতো। আনাবিয়া কখনো ভুলে গেলে মীর নিজেই সযত্নে বেণী করে দিতো ঘুমন্ত আনাবিয়ার চুল৷ আচড়ে তেল লাগিয়ে দিতো পরম যত্নে।
কিন্তু এখন আর মীর নেই, তাই আনাবিয়ার চুলের যত্নও ফুরিয়ে গেছে। আর কেউ পরম স্নেহে ওর চুলগুলোতে তেল দিয়ে দেয়না, আচড়ে বেণী করে দেয় না!
শার্লট, ফাতমা, লিন্ডা খুব করে চায় আনাবিয়ার যত্ন নিতে কিন্তু পারেনা৷ আনাবিয়া সেই পূর্বের মতোই কাউকে স্পর্শ করতে দেয়না ওকে। কোকোকেও নয়! নিজের কাজ গুলো নিজেই করে, অন্য কাউকে ধরতেও দেয়না ওর জিনিস পত্র গুলো। কোকো ইয়াসমিনকে দিয়েও চেষ্টা করিয়েছে আনাবিয়াকে স্পর্শের কিন্তু সবার মতো ব্যার্থ ইয়াসমিনও, আনাবিয়া ভুলেও কাউকে স্পর্শ করতে দেয়না ওকে। কেউ ওকে স্পর্শ করতে হাত বাড়ালেও রেগে যায় প্রচন্ড! ঘুমিয়ে থাকা অবস্থাতে কেউ স্পর্শ করলেও কুচকে যায় ওর কপাল, বিরক্তিতে নড়াচড়া করতে থাকে অদ্ভুত ভাবে!
ইয়াসমিনের ধারণা শেহজাদীর ওসিডি ব্যাপারটা আবারও গুরুতর হতে শুরু করেছে, ঠিক ছোট বেলায় যেমন ছিলো। কারো স্পর্শ সহ্য করতে পারতেন না তিনি, এখন আবার হঠাৎ সেই ডিজিজ টাই প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
কিয়ৎক্ষণ বাদেই ভোরের প্রথম সূর্য রশ্মি ট্রি হাউজের ছোট্ট জানালাটা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধীরে ধীরে এসে পড়লো আনাবিয়ার মুখের উপর, সূর্যের নরম আলো এসে তার মুখে পড়লে৷
চোখ কুচকে নিলো আনাবিয়া, একমুহূর্তের জন্য পাশ ফিরে মাথা গোজার জন্য ও খুঁজলো কারো প্রশস্ত লোমশ বক্ষ, পরক্ষণেই হুশ এলো ওর।
সে তো নেই……!
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো আনাবিয়া, মনে করার চেষ্টা করলো গতরাতের ঘটনা। ঘুম না আসায় এখানে চলে এসেছিলো ও, কিছুমাস আগেও ওর মনে ছিলোনা ট্রি হাউজটির কথা, সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলো!
সেদিন হাটতে হাটতে হঠাৎ করেই ওর চোখে পড়ে ট্রি হাউজটি, তারপর থেকেই দিনের বেশিরভাগ সময় ওর এখানেই কাটে৷
ময়লা ধরে যাওয়া বিছানা বদলে সমস্ত ট্রি হাউজটি ঝকঝকে তকতকে করে নেয় ও আবার, নিয়মিত শুরু করে যাতায়াত। এখানে এলেই শান্তিতে ছেয়ে যায় ওর বুক, নিজের নিজের মনে হয় যেন! মসভেইল ওকে যে শান্তি দিতে পারেনি সেটা ও এখানে এসে পুষিয়ে নেয়।
কিছুক্ষণ বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে উঠে বসলো আনাবিয়া, বালিশের পাশে থাকা স্বচ্ছ যান্ত্রিক বস্তুটা হাতে তুলে নিলো। গত রাতে মহল থেকে বের হওয়ার সময় ফোন বন্ধ করে রেখেছিলো, তারপর আর খোলেনি। নয়তো বাচ্চাগুলো বিরক্ত করে ফেলবে ওকে৷
আনাবিয়া অন করলো ফোন, সময় দেখে নিলো, ছটা বেজে পয়ত্রিশ। ক্ষিদে পেয়েছে প্রচন্ড, মহলে ফিরতে হবে ওকে। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে কামরায় এলো আনাবিয়া। ছেড়ে রাখা চুলগুলোকে ক্লাচার দিয়ে বেধে নিলো, তারপর ট্রি হাউজের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো কামরা থেকে।
সিঁড়িতে পা রাখতেই ওর চোখে পড়লো কোকো আর ফ্যালকনকে। দুজনে ট্রি হাউজের সম্মুখে একটা বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে বেঘোরে, কোকো ওর বিশাল সাইজের পা জোড়ার একটি তুলে দিয়েছে ফ্যালকনের গায়ের ওপর, বেচারা ফ্যালকন স্টিলের মতো সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
হয়তো কোকোর হাতির সাইজের পাটিকে সরানোর জন্য বেশ কসরত করেছিলো সে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে ও এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে৷
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া। এই কোকোটা ওকে কখনোই একা ছাড়তে চায় না, সারাটাক্ষন আনাবিয়াকে ওর চোখের সামনে থাকা লাগবে। আর এখন তো এখানেও চলে এসেছে! সারারাত মশাতে যে ওদের খুব আদর দিয়েছে সেটা চেহারা দেখলেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
আনাবিয়া এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে দেখলো ওদেরকে কিছুক্ষণ, একবার ভাবলো ডাকবে কিনা, কিন্তু দুজনকে এত আয়েশ করে ঘুমোতে দেখে ডাকতে মন সায় দিলোনা ওর।
ওদেরকে ঘুমোতে দিয়ে আনাবিয়া এগোলো মসভেইলের দিকে।
দুপুর হয়ে এসছে প্রায়, কোকো ফ্যালকন মহলে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। ঘুম ভেঙেছে ওদের দশটার দিকে, উঠে আনাবিয়াকে ট্রি হাউজে না দেখে দুজনেই এত ঘুমানোর কারণে নিজেদেরকে খানিক গালমন্দ করে ছুটেছে মহলের দিকে৷ পৌঁছে দেখে আনাবিয়া ততক্ষণে গোসল টোসল শেষ করে পরিপাটি হয়ে পুতুলের মতোন বসে আছে বারান্দা চত্বরে। হাতে তার হিজ ম্যাজেস্টির ডায়েরি খানা।
গত ক পাসে আনাবিয়াকে প্রায় হাতে পায়ে ধরেছে ওরা সকলে মিলে কিন্তু তাকে এই রেড জোন ছাড়তে রাজি করাতে পারেনি। এতবার করে অনুরোধ করেছে কটা দিন কুরো আহমারে থেকে আসার জন্য কিন্তু সেটাতেও আনাবিয়ার অমত। সে কিছুতেই এই স্থান ছেড়ে যাবে না৷ বাকি জীবন সে এখানেই থাকবে তাতে তার যা হওয়ার হবে৷
কোকো রাও তাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, আর তার ফলাফল আনাবিয়ার অবস্থার অবনতি। শেহজাদা ইলহান কয়েকবার দেখা করতে চেয়েছেন তার সাথে কিন্তু শেহজাদী কোনো মতেই দেখা করবেন না কারো সাথে, ইলহানের সাথে তো নয়-ই।
এখন তার রোজকার সঙ্গী হলো হিজ ম্যাজেস্টির ডায়েরি খানা। তার দ্বিতীয় সঙ্গী মহলের বেইজমেন্টে থাকা হিজ ম্যাজেস্টির সমস্ত জিনিসপত্র।
সময় পেলেই ডায়েরি টা হাতড়ে দেখে আনাবিয়া, ওর মনে হয় যেন এই-ই একটা মাত্র বস্ত যাতে মীরের স্পর্শ প্রকট হয়ে আছে এখনো, আর কোনো কিছুতেই মীরের স্পর্শ লেগে নেই৷ প্রাসাদ থেকে নিয়ে আসা মীরের পোশাক গুলো থেকে মীরের শরীরের পুরুষালি ঘ্রাণটা ম্লান হতে হতে বর্তমানে নেই হয়ে গেছে, তা থেকে আর পরিচিত ঘ্রাণটা আসেনা বহুদিন!
লিন্ডা এলো তখনি, হাতে তার খাবারের ট্রে। আনাবিয়ার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, সকাল থেকে আপনি কিছুই খাননি, খেয়েনিন কিছু, আপনার মেডিসিন আছে।”
“পরে খাবো, রেখে দাও।”
ডায়েরি থেকে মুখ না উঠিয়েই বলল আনাবিয়া। লিন্ডা আর দ্বিতীয় কথা বললনা। কোনো কথা বললেই ভয়ানক রেগে যাবে আনাবিয়া, তখন তার ক্রোধকে শান্ত করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
অসহায় দৃষ্টিতে ও তাকালো হলরুমের ভেতরে থাকা লিওর দিকে, ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি করবে, লিও মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো আনাবিয়াকে এই মুহুর্তে না ঘাটাতে, পরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ানো যাবে।
লিও লিন্ডার এই নিঃশব্দ কথপোকথনের মাঝেই মসভেইলের কাঠের চওড়া সিঁড়ির ওপর শোনা গেলো একটা ক্ষীণ যান্ত্রিক শব্দ, স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় একটি রোবটিক গার্ড এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে, নিয়ে এসেছে কারো আগমনী বার্তা।
আনাবিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে, রোবটিক গার্ড নিজের শরীরটা সামান্য ঘুরিয়ে আনাবিয়ার দিকে ফিরে আর্টিফিশিয়াল ভয়েসে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, নওয়াস জাবিনের পুত্র ফারিশ জাবিন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চায়।”
কিঞ্চিৎ চমকালো আনাবিয়া। ফারিশ জাবিন! সে এতদিন পর এখানে কেন এসেছে? মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আনাবিয়া, মনে পড়ে গেলো আজ হতে প্রায় পয়ত্রিশ বছর পূর্বের কথা, যেদিন ফারিশ জাবিনের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলো ও আর মীর।
সেদিন নওয়াস জাবিন কথা দিয়েছিলেন ফারিশ জাবিন আর কখনো এ মুখো হবেনা, মীর বা আনাবিয়ার সামনে পড়বে না সে কখনো, তবে আজ সে কেন এসেছে?
আনাবিয়া কোকোকে খুজলো, কোকো তখন হলরুমের ডাইনিংয়ে বসে গোগ্রাসে গিলছিলো। আনাবিয়া ডাকছে শুনে খাবার রেখে হাত ধুয়ে দৌড়ে এলো ও, রোবটিক গার্ডটা তখনো স্থীর দাঁড়িয়ে আদেশের অপেক্ষায়।
কোকো এসে আনাবিয়ার সম্মুখে দাড়ালে আনাবিয়া ওর দিকে তাকালো সরাসরি। আনাবিয়ার এমন ভেতর পড়ে ফেলা দৃষ্টি দেখে কোকো ভড়কালো সামান্য।
আনাবিয়া সামান্য ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো,
“ফারিশ জাবিন কেন এসেছে?”
থমকালো কোকো, অপ্রস্তুত চেহারায় দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই বলে উঠলো,
“আম-আমি কিভাবে বলবো আম্মা? উনি জানেন কেন এসেছেন! হয়তো আপনার ফিরে আসার সংবাদ শুনে আপনার সাথে দেখা করতে এসছেন!”
আনাবিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবার শুধালো,
“এর ভেতরে তোর কোনো হাত নেই তো!”
“আম্মা, আপনি শুধুই আমাকে সন্দেহ করেন। আমি আপনার বাধ্য ছেলে, তবুও আপনি এমন করেন! কিছু হলেই আমার দোষ!”
কপট অভিমানী গলায় বলল কোকো। আনাবিয়া আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসতে বসতে বলল,
“বুঝিস কিন্তু! আমি কিন্তু চাইলেই তোর মস্তিষ্কের ডেটা কালেক্ট করতে পারবো। যদিও তাতে আমার হিউজ এনার্জি খরচ হবে, কিন্তু পারবো।”
কিঞ্চিৎ ভড়কালো কোকো, তারপর আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিলো,
“এনি টাইম আম্মা!”
আনাবিয়া গার্ডটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আসতে দাও।”
আনাবিয়ার আদেশ পাওয়া মাত্রই বুলেট গতিতে রোবটিক গার্ডটি আবার ফিরে গেলো নিজের স্থানে, আর তার কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলের ভেতর থেকে প্রান্তরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো ফারিশকে।
আনাবিয়া ডায়েরি টা বন্ধ করে চলে গেলো নিজের কামরায়, যাওয়ার আগে লিন্ডাকে বলে গেলো ফারিশের জন্য নাস্তার ব্যাবস্থা করতে৷
ডিনার শেষ করে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় পায়চারি করছে ফারিশ, গায়ে একটা ঢোলাঢালা ধুসর রঙা ফতুয়া। পয়ত্রিশ বছর পূর্বের ফারিশের সাথে এই ফারিশের বিশেষ কোনো অমিল এখনো হয়নি। শুধু তখনের সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া সুদর্শন ফারিশের চেহারায় এখন পরিপূর্ণ যুবকের বৈশিষ্ট্য ছাপানো। লম্বাও হয়েছে হয়তো কিছুটা।
চুলগুলো বেশ কায়দা করে ছাটানো, চোখে ফ্রেমওয়ালা চশমা, মুখে কিঞ্চিৎ দাঁড়ির আভাস। চওড়া কপালে সামান্য চিন্তার ভাজ। হয়তো এখনো আনাবিয়াকে দেখতে না পাওয়ার মর্মযাতনায় ব্যাকুল হয়ে তারা ভাজ ফেলেছে ফারিশের অজান্তেই।
এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পড়লো, পায়চারি থামিয়ে ফারিশ গিয়ে খুলে দিলো দরজা। সম্মুখে ফ্যালকনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে রইলো। ফ্যালকন যন্ত্রের মতো করে বলে উঠলো,
“ফারিশ জাবিন, শেহজাদী আপনাকে ডেকেছেন৷”
শেহজাদী শব্দটা শোনা মাত্রই চকচক করে উঠলো ফারিশের চোখজোড়া, এক দুর্দমনীয় খুশি দেখা দিলো সেখানে৷ ফ্যালকনের নজর এড়ালোনা সেটা। নির্বিকার চোখে সে দেখে গেলো ফারিশের মুখে ফুটে ওঠা আনন্দের ঝলক, যেটা লুকিয়ে রাখার জন্য ফারিশের সব চেষ্টাই বৃথা হয়ে যাচ্ছে।
“শেহজাদী কোথায় আছেন এখন?”
কামরা থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলো ফারিশ, ফ্যালকন ঘুরে দাঁড়িয়ে ফারিশের আগে আগে হাটতে হাটতে বলে উঠলো,
“আসুন আমার সাথে।”
ফারিশকে পথ দেখিয়ে ফ্যালকন ওকে নিয়ে গেলো আনাবিয়ার কামরায়। আনাবিয়া কামরায় নেই তখন। ফারিশ ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে খুঁজে চলল আনবিয়াকে, ফ্যালকন বলে উঠলো,
“উনি বাহিরে আছেন, চলে আসবেন এখনি। আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন৷”
ফ্যালকনের গলার স্বর কিছুটা রুষ্ট শোনালো, কিন্তু তাতে বিশেষ মনোযোগ দিলোনা ফারিশ। বেতের সোফায় বসে ও বলে উঠলো,
“আমি যখন শেহজাদীর সাথে কথা বলবো তখন তুমি এখানে থাকবেনা ফ্যালকন, আমাদেরকে একা ছেড়ে দিবে৷”
“কেন?”
ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে কিছুটা উচ্চস্বরেই শুধোলো ফ্যালকন। ফারিশ বলে উঠলো,
“আমি বলছি তাই। আমি শেহজাদীর সাথে একা কথা বলতে চাই, অন্য কেউ উপস্থিত থাকলে আমি আনকম্ফর্টেবল ফ্যিল করবো।”
“আমি এখানেই থাকবো।”
ঘাড় ঘুরিয়ে ফ্যালকনকে দেখলো ফারিশ, ফ্যালকন ফারিশের দৃষ্টিকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৪
“আমি শেহজাদীর সাথে একা কথা বলবো, এবং সেখানে তুমি থাকবেনা। শুধু তুমি কেন কেউই থাকবেনা। আমাকে নিয়ে খুব অবিশ্বাস থাকলে সর্বোচ্চ বাইরে দাড়াতে পারো, কামরার ভেতরে নয়। এমন স্থানে যেখান থেকে তুমি আমাদের কথা শুনতে পাবেনা।”
ফ্যালকন কিছু বলতে নিবে তার আগেই বাইরে শোনা গেলো আনাবিয়ার পদশব্দ। চুপ হয়ে গেলো ফ্যালকন, ফারিশ আরো একবার ওর চোখে চোখ মিলিয়ে মনে করিয়ে দিলো শর্তের কথা।
