বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৮

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৮
রানী আমিনা

ছোট্ট শিনজোকে বুকে নিয়ে মীর পায়চারী করলো ঘরময়। এতক্ষণের ফাঁকা ফাঁকা বুকটা হঠাৎ করেই ভরে উঠলো যেন। কিসের একটা কমতি, একটা অভাব বোধ করছিলো এতক্ষণ, এখন যেন বুকটা ওর পরিপূর্ণ হয়ে গেছে!
ডাকলো ও,
“শিনজো….!”
“হুউউউম….”
সুর করে সাড়া দিলো মেয়েটি। মীর ওর কপালে একটা নরম চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আমার শিনজো খেয়েছে?”
পরক্ষণেই তার ছোট্ট পেটে একবার হাত রেখে পরখ করে ভ্রু কুচকে বিচলিত গলায় বলল,
“পেটে তো কিছুই নেই!”
ছোট্ট মেয়েটি কোনো সাড়া শব্দ না দিয়ে বুকে মুখ গুজে পড়ে রইলো। ছোট্ট ছোট্ট হাত জোড়া দিয়ে আকড়ে ধরার চেষ্টা করলো মীরের চওড়া বক্ষ।
কিন্তু এই ছোট্ট সত্তাটি এখনো ক্ষিদে পেটে আছে জেনে ক্রোধে আপনিই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মীরের। কেন হঠাৎ তার এত রাগ হচ্ছে, কেন তার মেজাজ এমন ভয়ানক খারাপ হচ্ছে বুঝলোনা সে, পরমুহূর্তেই তার গলা থেকে বেরিয়ে এলো হুঙ্কার, কর্কশ গলায় গর্জে ডেকে উঠলো সে,
“বেলিন্ডা!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার হঠাৎ গর্জনে কেঁপে উঠলো যেন সম্পুর্ন প্রাসাদ, তটস্থ হয়ে গেলো সমস্ত দাস দাসীদের দল!
বেলিন্ডা বলে যাকে ডাকা হলো সে কিচেনের দিকে ছিলো। এই জান্তব হুঙ্কার শোনা মাত্রই তার স্মরণে এলো কি চরম ভুলটাই না সে করেছে৷ সমস্ত কাজ ফেলে উর্ধশ্বাসে ছুটে এলো সে!
খোলা দরজার সম্মুখে এসে অপরাধবোধে মাথা নুইয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ বানের ন্যায় ঝাপটে এসে তাকে আক্রমণ করলো দ্বিতীয় দফার কর্কশ কন্ঠের গর্জানো ভর্ৎসনা!
“তোমাকে এখানে কেন রাখা হয়েছে? কিসের জন্য? রাত কত হয়েছে জ্ঞান আছে তোমার? এখনো কেন আমার শিনজোর খাওয়া হয়নি? জবাব দাও, এখনি!”
জবাব এলোনা, মাথা আরও নুইয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো মেয়েটি। এই বুঝি ভয়ের ভারে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে!

“এই মুহুর্তে এই প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, আমি তোমার মুখ দেখতে চাইনা!”
কোনো নিকৃষ্ট কীটের দিকে কেউ যেভাবে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ঘৃণাভরে তাকিয়ে থাকে ঠিক সেভাবেই বেলিন্ডা নামক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তীব্র আক্রোশে বাক্য দুখানা বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো সে কামরার আরও ভেতরে। পরক্ষণেই তার কর্কশ কন্ঠে নেমে এলো অত্যন্ত নমনীয় মিষ্টতা। বুকের ভাজে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটির তুষার শুভ্র মুখখানা তর্জনী আর মধ্যমার সাহায্যে উঁচিয়ে শুধালো,
“খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমার প্রাণটার?”

মেয়েটি তার বড় বড় ঝলমলে চোখ জোড়া তুলে শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো মীরের স্বর্ণাভ চোখে, এই দৃষ্টি প্রচন্ড বাজলো মীরের বুকে! মেয়েটির একরত্তি নাকে নাক ঠেকিয়ে সে বলল,
“আর অল্প একটু অপেক্ষা করো প্রাণ আমার, নোমান এখুনি খাবার নিয়ে আসবে, তখন আমরা দুজন একসাথে বসে পেট ভরে খাবো।”

অতঃপর মেয়েটির ছোট্ট ললাটে ঘষে দিলো নিজের চওড়া কপাল। মেয়েটি আবার মুখ লুকালো মীরের বুকে, আর মীর ছোট্ট ছোট্ট চুমুতে ভরিয়ে দিলো তার কপাল, চোয়াল, ঝলমলে সফেদ চুল!
এমন সময় মীরের কানে ভেসে এলো কোনো পুরুষের কন্ঠস্বর, দূর থেকে কেউ যেন ডেকে চলেছে তাকে, দূর আহ্বানের ক্ষীণ শব্দ এসে পৌছচ্ছে তার কর্ণকুহরে।
দৃঢ় ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুচকে, মেয়েটিকে বুকে চেপে ধরে অত্যন্ত সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে মীর খুঁজে চলল এই অজানা আহ্বানের উৎস, কে ডাকে তাকে?
ক্রমে ক্রমে কণ্ঠস্বরটি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে শুরু করলো আরও! মীর মেয়েটিকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো কামরার দেয়াল গুলোর দিকে, তাকে যেন পাথুরে দেয়াল গুলোর ভেতর হতে কেউ ডেকে চলেছে অনবরত!

ক্ষণিক পরেই শুনতে পেলো গুটিকয়েক স্পষ্ট বাক্য,
“ক্যান ইয়্যু হিয়ার ম্যি? মিস্টার দেমিয়ান, ক্যান ইয়্যু হিয়ার মি?”
মীর এবার দিশেহারা হয়ে উঠলো যেন! জঙ্গলে যে মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিলো সে বলেছিলো ওর নাম মীর, তবে ওকে দেমিয়ান বলে কেন ডাকা হচ্ছে?
হঠাৎ জঙ্গলের মেয়েটির কথা স্মরণে আসতেই আরও অস্থির হয়ে উঠলো ও! মেয়েটি যে এখনো এলোনা! ওকে যে বলে গেলো ফিরে আসবে!
পরক্ষণেই ওর মনে পড়লো জঙ্গলের সমস্ত স্মৃতি! সে কে? কি নাম তার? সে জঙ্গলে কি করছিলো? কার জন্য শেকল ভেঙে ছুটে গিয়েছিলো সেদিন?

তারপর… তারপর, কি হয়েছিলো তখন ওর? কারো সাথে লড়াই হয়েছিলো কি? আর ওই শুভ্র মেয়েটি? তাকে কি ওই অদ্ভুত যানে সওয়ার হয়ে আসা লোকটি নিয়ে গিয়েছে? ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে ওর থেকে? কোথায় নিয়ে গেলো তাকে? এখন কোথায় খুঁজবে সে ওকে?
ভাবতেই ভয়ানক অশান্ত হয়ে উঠলো মীর! মস্তিষ্কে হঠাৎ চাপ পড়লো প্রচন্ড, বিধ্বংসী যন্ত্রণায় খেই হারিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে মাথা চেপে ধরে তীব্র চিৎকার পাড়লো সে!
পরক্ষণেই খেয়াল এলো ওর কোলে ছোট্ট মেয়েটি ছিলো, সে কোথায় গেলো? মস্তিষ্কের অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রাণপণে চোখ মেলে তাকালো সে।
মেয়েটি নেই! কোথায় গেলো? এখানেই তো ছিলো, কেবলই! তারই কোলে! কোথায় হারিয়ে গেলো তার শিনজো?
“তোমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।”
মিষ্টি, কোমল নারীকন্ঠ শুনে চমকে পেছনে তাকালো সে!জঙ্গলের মেয়েটি দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে! এখানে কি করছে সে? তার কোলের ছোট্ট মেয়েটির সাথে এর এত এত মিল কেন?
সেই ঝলমলে চোখ, টেরাকোটা রঙা ঠোঁট, রেশমসম সফেদ চুল, সেই মায়াময় চাহনী, তুষার শুভ্র ত্বক, সেই মিষ্টি হাসি!

মীর ভারী, দ্রুত পায়ে এগোলো তার দিকে, তাকে একটাবার ধরতে, আর পালিয়ে যেতে না দিতে!
কিন্তু আশপাশ ফিঁকে হয়ে আসলো হঠাৎ! একটু আগেও রাতের আঁধারে পরিপূর্ণ ছিলো সর্বত্র, এখন ক্রমেই সাদা আলোতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে চারদিক! তীব্র আলোর ঝলকানিতে সমস্তই অদৃশ্য হয়ে আসতে শুরু করেছে ওর দৃষ্টিতে, কিছুই আর দেখার উপায় নেই!
ঝিলমিলে মেয়েটা যেন হারিয়ে গেলো এই তীব্র আলোর বানের ভেতর! আর তাকে খুঁজে পেলোনা মীর, চোখের দেখাটুকু দেখতে পেলোনা৷ কোথায় গেলো সে, কোথায় হারিয়ে গেলো?
পরক্ষণেই ওর কর্ণকুহরে আবারও ভেসে এলো মিষ্টি, রিনরিনে কন্ঠস্বরটি,
“তোমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান। বলো, তোমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান!”
মীর দিশেহারার ন্যায় খুঁজে চলল তাকে, কিন্তু চোখ মেলে রাখা দায়! পরমুহূর্তেই মিষ্টি কন্ঠটিকে ছাপিয়ে প্রতিধ্বনিত হলো পূর্বের পুরুষ কণ্ঠস্বর,

“ক্যান ইয়্যু হিয়ার ম্যি? মিস্টার দেমিয়ান, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? রেসপন্স করছেন, তিনি রেসপন্স করছেন! হী ইজ ম্যুভিং!”
শেষোক্ত বাক্যদ্বয় কারো উদ্দ্যেশ্যে চেচিয়ে বললেন তিনি! পরক্ষণেই আবার মীরের দিকে ফিরে বললেন,
“ক্যান ইয়্যু ব্লিঙ্ক? আপনি আমাকে শুনতে পেলে একবার ব্লিঙ্ক করুন মিস্টার দেমিয়ান, জাস্ট ওয়ান্স!”
স্বর্ণাভ চোখ জোড়া পলক ফেললো ধীর গতিতে। পাশে সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত ডাক্তারের মুখে দেখা গেলো বিজয়ীর হাসি! কে একজন ছুটলো বাইরে তাঁর জ্ঞান ফেরার সংবাদ দিয়ে আসতে।

শেহজাদা ইলহান আর ইযানকে গাড়ি সুদ্ধ প্রাসাদে পৌছে দিয়ে কোকো মাত্রই ফিরলো মহলে। ইলহানকে এই মুহুর্তে প্রাসাদের মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল ইউনিটে রাখা হয়েছে।
কোকো অপেক্ষা করেনি, দ্রুতই ফিরে এসেছে। ওকে এখন ওর আম্মার কাছে পৌছতে হবে৷ মহলে ফিরে কারো সাথে দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে সে গেলো কিচেনে। সেখানে শার্লট আর রেক্সার রান্না সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
শার্লটের শরীর খারাপ লাগছে হঠাৎ করেই। বমি হয়েছে দুবার। ফাতমা এসে ট্রিটমেন্ট দিয়ে গেছে অল্প স্বল্প। এখন দুটো খেতে পারলেই কামরায় গিয়ে ঘুমোবে সে।
কোকো কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলো সার্বিক অবস্থা। তারপর শার্লটকে বলল,
“আম্মার কামরায় ঢুকে কিছু পোশাকের বন্দোবস্ত করে দিতে হতো, শার্লট। আম্মা কুরো আহমারে গেছেন, আমিও এখন সেখানেই যাচ্ছি। আজ তিন/চার দিন ধরে আম্মা একই পোশাক পরে আছেন, খাওয়া গোসলও হয়তো ঠিক মতো হয়নি।”

“ঠিক আছে আমি দেখছি।”
বলে দুর্বল পায়ে এগোলো শার্লট আনাবিয়ার কামরার দিকে৷ আনাবিয়ার পোশাক পত্রের দেখাশোনা সেই করে। কোথায় কি রাখা আছে সে ব্যাতিত অন্য কারো জানা নেই৷ ফাতমা আর রেক্সা বসে ছিলো ভেতরে। চারদিকে অসুস্থতা আর নানা ঝামেলার কারণে মন ভালো নেই কারো। কোকো ফাতমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“আমার সাথে যেতে পারবে ফাতমা? আম্মার যদি কোনো প্রয়োজন হয়! আমি ছেলে মানুষ, আম্মার সব প্রয়োজনে হয়তো আসতে পারবোনা, আম্মা আমাকে বলবেনও না হয়তো। তুমি গেলে ভালো হতো।”
“কিভাবে যাই বলুন ভাইজান! লিন্ডা অসুস্থ, জ্বর কমছেনা ওর। কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে দেখে আসতে হচ্ছে। আবার শার্লটেরও শরীর খারাপ করলো হঠাৎ। ওদিকে জোভির ফিয়ান্সের হয়তো খুব দ্রুতই বার্থপেইন উঠবে, কখন কি হবে বলা যাচ্ছে না৷ এসব ছেড়ে আমি যে কিভাবে যাবো!”
অসহায় গলায় বলল ফাতমা। কোকো ফোস করে শ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর কি ভেবে রেক্সার দিকে তাকিয়ে বলল,

“মিস রেক্সুরেন্ট, আপনি যেতে পারবেন আমার সাথে?”
“আ-আমি?! এ-এখন!”
সামান্য ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল রেক্সা। ফাতমার দিকে ইতস্তত চোখে তাকালো একবার। ফাতমা মিষ্টি করে হেসে অনুরোধের সুরে বলল,
“তুমি যাও না হয় ভাইজানের সাথে! শেহজাদীর এখন কাউকে খুব প্রয়োজন বোধ হয়। সব ঠিক ঠাক থাকলে আমিই যেতাম, শেহজাদীকে একা আমরা কেউ কখনোই ছাড়িনা, উনি অযত্ন একদমই সহ্য করতে পারেন না, শরীর খারাপ হয় তাঁর। আর সেখানে তিনি তিনদিন ধরে একা একা কি করেছেন কোথায় গিয়েছেন, কি খেয়েছেন আমরা কিছুই জানিনা। তুমি যাও ভাইজানের সাথে।

শার্লট কিছু পোশাক দিচ্ছে ওগুলো নিয়ে যাও। ওনার গোসলের ব্যাবস্থা করে দিও। শুনে নিও উনি কিভাবে গোসল দিতে চান, ঠিক আছে? আর একটু চাপাচাপি করে খাইয়ে দিও, উনি সহজে খেতে চাইবেন না।
খাবার কোকো ভাইজানকে বললে এনে দেবে। শেহজাদী আবার সব খাবার খেতে পারেন না, খাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকবে, কেমন? উনি কোনো খাবার খেতে না চাইলে একদম জোর করবে না, যেটা উনি পছন্দ করবেন সেটাই খাওয়াবে। আর যদি তুমি খাওয়াতে না পারো তবে কোকো ভাইজানকে ডেকে দিবে, ভাইজানই খাইয়ে দিবে তাঁকে। ঠিক আছে?”

রেক্সা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো, সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে গেলো যেন! শেহজাদীকে সে দুই তিনবার দেখেছে সর্বোচ্চ। কৈশোর পেরিয়ে সদ্য নারীত্বে পা দেওয়া একটি অতীব সুন্দরী মেয়ে, থমকে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য তাঁর। এই জঙ্গলের ভেতরেও তাঁর কত যত্ন, কত খেয়াল! তবে ওই শ্বেত পাথরের রাজপ্রাসাদে কতই না আগলে আগলে রাখা হতো তাঁকে!
“দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন, সময় নেই আমার। আম্মার কাছে পৌছতে হবে শিগগিরী।”
বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল কোকো। শার্লট আনাবিয়ার কিছু পোশাক ব্যাগ ভর্তি করে এনে দিলো কোকোর হাতে। ফাতমা আবারও অনুরোধ করলো রেক্সাকে কোকোর সাথে যেতে৷ অগত্যা রাজি হলো রেক্সা। কোকো ওকে সময় দিলো প্রস্তুত হতে, পাঁচ মিনিট।

রেক্সা ছুটলো কামরাতে, কোকো বেইজমেন্টের দিকে এগেলো বাইক বের করতে। বেইজমেন্টটা আনাবিয়া ঠিক বিরাট এক গ্যারাজের মতোন করে তৈরি করিয়েছে বলে বেশ সুবিধাই হয়েছে ওদের৷
কোকো বাইক নিয়ে মহলের সামনে এসে বাইকে চেপে বসে হর্ণ বাজালো দুবার৷ রেক্সা জুতার ফিতে বাধতে বাধতে ছুটলো বাইরে, ফাতমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবারও মনে করিয়ে দিলো কি করতে হবে, কি করতে হবে না।
রেক্সা দ্রুত পায়ে এসে দাড়ালো কোকোর পাশে, কোকো ওকে দেখে বাইকে স্টার্ট দিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে ইশারায় উঠতে বলল পেছনে। রেক্সা ইতস্তত করলো, কোকোকে ধরে উঠবে নাকি না ধরেই উঠবে সেই চিন্তা করতে লাগলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের সাথে বের হচ্ছে সেটাও রাতের বেলা! ভয়ে বুকের ভেতর দুরু দুরু করছে ওর।
ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোকো ধমকে বলল,

“কি সমস্যা? দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার! উঠুন দ্রুত।”
রেক্সা আর না ভেবে কোকোর কাধে হাত রেখে ভর দিয়ে উঠে বসলো পেছনে। কোকো বাইক ছেড়ে দিতে দিতে নির্বিকার গলায় বলল,
“আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, এমন সস্তা ভাতের হোটেলে আমি মুখ দেই না।”

“শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টির ভোকাল কর্ড বহুদিন যাবৎ একনাগাড়ে এবং উচ্চস্বরে চিৎকারের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলতে গেলে তার স্বরযন্ত্র এখন প্রায় অচল। এখন কথা বলার চেষ্টা করলেই তার গলায় যন্ত্রণা অনুভূত হবে এবং অদ্ভুত বিকৃত আওয়াজ বের হবে। এর সাথে তাঁর মেন্টাল হেলথ্ও জড়িয়ে আছে।
এটাকে সম্বোধন করতে আমরা মিউটেশন অব ভোকালাইজেশন টার্ম টা ব্যাবহার করতে পারি। অনেক সময় মস্তিষ্কের গভীর ট্রমা বা ভয়ঙ্কর মানসিক আঘাতের কারণে কেউ কেউ কথা বলতে ভুলে যায়, কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করতে গর্জন, ক্রন্দন বা অস্পষ্ট আওয়াজ করে।

এখন হিজ ম্যাজেস্টির ভোকাল কর্ড সম্পুর্ন হ্যিল না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিক ভাবে কোনো অর্থবহ শব্দ উচ্চারণ করতে পারবেন না। এভাবে জাস্ট মিনিংলেস আওয়াজই করে যাবেন।”
বলে থামলেন মেডিক্যাল টিমের চিফ ডক্টর। আনাবিয়া হাটুতে কনুই ভর দিয়ে দুহাতে মুখ গুজে শুনছিলো। ডাক্তার কথা শেষ করতেই ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে৷ চিফ ডক্টর আবার বললেন,
“তবে আশ্চর্যের বিষয় উনি খুব দ্রুত ইম্প্রুভ করছেন। তাঁকে কেবিনে নিয়ে প্রথমবার ল্যারিংগস্কপি করার পর আমরা যতটা জখম দেখেছিলাম, বুলেট বের করে দ্বিতীয় বার চেকআপ করে তার অনেকটাই কম পেয়েছি। এত দ্রুত কারো বডি হ্যিল হতে আমি কখনো দেখিনি! তাঁকে প্রোপার কেয়ারে রাখলে হয়তো উনি খুব দ্রুতই কথা বলতে পারবেন।”
“এম আর আই করে কেমন দেখলেন? তার ব্রেইনের কান্ডিশান কেমন?”

চিফ ডক্টর এবার চুপসে গেলেন সামান্য, সময় নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
“ক্ষমা করবেন শেহজাদী, বিষয়টা অনেক জটিল! আমি এমন কম্পলিকেটেড কেইস এর আগে কখনো ফেইস করিনি। তাঁর ব্রেইনের অবস্থা আমি ব্যাখা করতে পারবো, কিন্তু এক্সাক্টলি কি হয়েছে আমি হয়তো বলতে পারবোনা।”
“যেটুকু পারবেন সেটুকুই বলুন।”
“হিজ ম্যাজেস্টির মস্তিষ্কে আমরা অ্যামিলয়েড প্লাকস খুঁজে পেয়েছি। অ্যামিলয়েড একটি প্রোটিন, তাঁর ব্রেইনের নিউরনগুলোর মধ্যে এই প্রোটিনের স্তর জমে গেছে। প্রোটিনটা ভয়ঙ্কর! এটি ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের সমস্ত নিউরনকে গ্রাস করে ফেলে।
এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে একজন মানুষের স্মৃতি, ভাষা, চিন্তা, অনুভূতি সবকিছু, বলা যায় পার্মানেন্টলি ডিলিট করে দেয়। এমনটা হয় বিশেষ করে আলঝেইমার পেশেন্ট দের ক্ষেত্রে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হিজ ম্যাজেস্টির আলঝেইমার নয়! সেটা অন্য কিছু!”
আনাবিয়া নড়েচড়ে বসলো, ডাক্তার আবার বললেন,

“এই অ্যামিলয়েড প্লাককে বলা যায় নিঃশব্দ মস্তিষ্ক খাদক। এই প্রোটিন সবার মস্তিষ্কেই তৈরি হয় তবে সাধারণভাবে এটি শরীর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু অ্যালঝেইমার পেশেন্টদের ক্ষেত্রে এটি অপসৃত হয় না। এটি জমাট বাধতে বাধতে একসময় একটা সুক্ষ্ম লেয়ার ফেলে সমগ্র ব্রেইনের ওপর। তারপর ধীরে ধীরে একজন মানুষের বোধ, বুদ্ধি, স্মৃতি সব নষ্ট করে দেয়।”
“তবে আপনি বলতে চাইছেন হিজ ম্যাজেস্টি আর কখনোই তার স্মৃতি ফিরে পাবে না?”
“এটা যদি প্রাইমারি স্টেজ হতো তবে হয়তো স্মৃতি আংশিক ফেরানো যেতে পারতো। আমরা এখনো জানিনা তাঁর নিউরন সম্পূর্ণ মারা গেছে কিনা৷ যদি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়
তবে থেরাপি, মেডিসিন, ভালোবাসা, ইমোশনাল সাপোর্ট, প্রোপার কেয়ার এসব দিয়ে ইনফ্লুয়েন্স করলে স্মৃতি ফিরে আসতে পারে, তবে শিউরিটি দিতে পারিনা৷

ব্রেইনের নিজস্ব প্লাস্টিসিটি আছে, ব্রেইন নিজে নিজেই নতুন করে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা রাখে৷ কিন্তু সেটা খুব সীমিত সময় কালের জন্য। দীর্ঘদিনের অ্যামিলয়েড প্লাক মানেই স্মৃতির মৃত্যু।”
আনাবিয়া চুপ হয়ে গেলো, তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। এই কামরাতে ও আর চিফ ডক্টর একাই। বাইরের কামরায় ফারিশ কথা বলছে জায়ানের তিন ছেলের সাথে। তাদেরই একজনের শরীর থেকে মীরের জন্য ব্লাড কালেক্ট করা হয়েছে। উচ্চস্বরে আড্ডা দিচ্ছে ওরা, এই কামরা থেকে স্পষ্ট কর্ণগোচর হচ্ছে।
আনাবিয়ার বিরক্ত লাগছে সবকিছু। ভ্রু কুচকে নিয়ে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে ও বলল,
“আরও কিছু জানানোর থাকলে জানান৷”

“আমি এখনো নিশ্চিত নই হিজ ম্যাজেস্টির ঠিক কি হয়েছে। যেহেতু তার অ্যালঝেইমার নেই, সেহেতু হতে পারে তার মেমোরি লক হয়েছে। অনেক সময় প্রচন্ড শোক, যন্ত্রণা বা ভয়ের কারণে মানুষের মেমোরি লক হয়ে যায়৷ আর পেশেন্ট যদি কোনো স্পেইশাল মুহূর্ত, বিশেষ কারো স্পর্শ, কণ্ঠস্বর, কিংবা মৃত্যু, ভীতির সংস্পর্শে আসে তবে লক খুলে যেতে পারে৷ লক খুলে গেলে ঠিক বিদ্যুৎ প্রবাহের মতোন তার সকল স্মৃতি ফিরে আসবে। কিন্তু আমি এখনো নিশ্চিত নই, জাস্ট পসিবিলিটির কথা বললাম আপনাকে, শেহজাদী।”
“উনি অ্যালঝেইমারে আক্রান্ত নন এটা আপনি এত শিউরলি কিভাবে বলছেন?”
“আপনি বলেছিলেন তিনি অ্যাকটিভ ছিলেন, ছোটাছুটি করছিলেন, হাসছিলেন, বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন। এমনকি আপনার শেয়াল ছানার প্রতি, আপনার প্রতি প্রোটেক্টিভ আচরণ করছিলেন। একজন অ্যালঝেইমার পেশেন্ট এমনটা কখনোই করবে না৷

এ ছাড়া আপনি বলছিলেন অ্যাট ফার্স্ট উনি আপনার ভাষা বুঝতে পারছিলেন না, কিন্তু পরবর্তীতে সাড়া দিচ্ছিলেন আপনার কথায়। আদতে উনি শিখছেন, নতুন করে সব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন নিজে নিজেই, নিজের অবচেতন মনে। হী ইজ ফুল্যি অ্যাকটিভ ফ্রম হীজ কোর।
বুলেট অপসারণের পর আমরা যখন তাকে ব্লিঙ্ক করতে বললাম তিনি করলেন। আমাদের টিম মেম্বার ইংরেজিতে বলেছিলেন তবুও তিনি বুঝতে পেরেছেন। কারো পক্ষেই তার শেখা ভাষা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে মাতৃভাষা। সব স্মৃতি ভুলে গেলেও ভাষা কখনো কেউ ভুলে যায় না। তবে সেভার অ্যালঝেইমার পেশেন্ট ধীরে ধীরে ভাষাও ভুলে যায় এবং ঠিক একটা জড়বস্তুর মতো পড়ে থাকে। সুতরাং উনি অ্যালঝেইমারে আক্রান্ত নন।”
আনাবিয়া চুপ করে বসে রইলো ভাবতে লাগলো ডাক্তারের বলা সমস্ত কথা৷ কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো,
“এম আর আই করেছিলেন দ্বিতীয় বার?”

“জ্বি শেহজাদী, বুলেট অপসারণের পর আবারও এম আর আই করেছিলাম। সত্যি বলতে এমন আশ্চর্যজনক কিছু আমি কখনোই দেখিনি! অ্যামিলয়েড প্লাকের যে প্রলেপ টার কথা বলেছিলাম সেটা ওই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় টু-থ্রি পার্সেন্ট রিমুভ হয়ে গেছিলো। যেটা বলা যায় অসম্ভব!
এত অল্প সময়ের ভেতর এত দ্রুত হ্যিল হওয়া ইম্পসিবল!আমার ধারণা উনি নিজে নিজেই হ্যিল হচ্ছেন৷ বা হতে পারে আপনার সংস্পর্শে এসে তার হ্যিল হওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েক গুন।”
ডাক্তার এবার একটু ইতস্তত করে শুধোলো,
“শেহজাদী, যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি?”
আনাবিয়া ওপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ডাক্তার সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল,

“আমি জন্মের পর থেকে কখনো দেমিয়ান পরিবারের সদস্যদের বাইরে চিকিৎসা নিতে দেখিনি, শুনেছি তারা কখনোই বাইরে চিকিৎসা নেন না। তারা তাদের প্রাসাদেই তাদের জন্য চিকিৎসক তৈরি করেন, সেখানেই বাচ্চাদেরকে পড়ানো হয়, সেখানেই তারা বেড়ে ওঠে, সেখানেই তাদের কর্মসংস্থান হয়।
আমি ডাক্তারি পড়ার সময়ে খুব করে চাইতাম প্রাসাদের ডাক্তার হতে। একজন প্রাসাদের ডাক্তারের নিকট আমাদের সাধারণ ডাক্তারির অনেক অনেক তফাৎ জানতাম। তাদেরকে যে শ্রদ্ধা সম্মান দেওয়া হতো তার জন্য আমার খুব লোভ লাগতো। কিন্তু বাইরে থেকে কখনোই কাউকে চিকিৎসক হিসেবে নিতেন না প্রাসাদের কর্মীরা৷
মনে খুব ক্ষোভ হতো আমার, প্রশ্ন থাকতো, কেন কেউ সর্বোচ্চ ভালো করলেও প্রাসাদের চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করতে পারে না। কিন্তু আজ আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, ক্ষোভও নেই।
হয়তো এসব আশ্চর্যজনক ব্যাপার স্যাপার দেখে আমরা প্রতি পদে পদে অবাক হতাম, হয়তো বুঝতামই না কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে!”

আনাবিয়া নিজেও জানতোনা প্রাসাদের হেকিম আর বাইরের ডাক্তারদের ভেতরের এমন অতিমাত্রার ভিন্নতা সম্পর্কে। শুনে কিছুটা অবাকই হলো ও।
প্রাসাদে ডাক্তারদেরকে হেকিম ডাকা হতো, এটা ওদের দেমিয়ান ট্রাডিশন৷ সব কিছুতেই একটা ভিন্টেজ ব্যাপার স্যাপার পছন্দ করতো হয়তো ওর পূর্বপুরুষ, ও নিজেও করে৷ প্রাসাদের সাথে বাইরের দুনিয়ার খুব কমই মিল আছে। প্রাসাদের সিংহদুয়ার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই যেন কোন সাদা পাথরে গড়া প্রাচীন স্থাপত্যের ভেতর ঢুকে যায় ও সর্বদা। নিজেকে তখন সত্যি সত্যিই শেহজাদী মনে হয়।

অথচ ওই প্রাসাদ ছেড়ে একবার বেরিয়ে এলে ওর শেহজাদীর খোলস ভেঙে পড়ে! মনে হয় ও এই জনসাধারণের বিশাল সমুদ্রেরই একজন নাবিক, ভীষণ উত্তাল সমুদ্রে পাল তোলা নৌকার পাটাতনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে স্রোতের সাথে ভেসে চলেছে গন্তব্যের দিকে, ওর পেছনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের উদ্দামতার দিকে নজর রাখছে মীর। মীর….. মীর…!

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭

দুবার নিজের মনে মীরের নামটা আওড়ালো আনাবিয়া। মেঝের দিকে নিষ্পলক, কঠিন চোখে তাকিয়ে নিজের মনের ভেতর মীরকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো,
“মীর…. তোমার বড় ভাইয়ের বদ্ধমূল ধারণা আমার জন্য তুমি তোমার সাধের সাম্রাজ্য হারিয়েছো। তোমার সাম্রাজ্য আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিবো, যেভাবেই হোক!”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here